গোরস্থানের বধূ

তখন আমি স্কুলে পড়ি।। পড়ালেখার জন্য নানুবাড়িতে থাকতাম।। একবার আমরা বাসা বদল করে একটা নতুন বাসাতে উঠলাম।। নতুন পরিবেশ।। আসে পাশে কাউকেই চিনি নাহ।। বাসাটা তিনতলা ছিল।। তবে, তিনতলার নির্মাণ কাজ তখনো চলছিলো, তাই সেটা ছিল ফাঁকা।। আমরা দ্বিতীয় তলায় থাকতাম।। নিচ তলায় অন্য এক ভাড়াটিয়া থাকতো।।

যাই হোক, আমাদের নতুন বাসার ঠিক সামনেই ছিল এক গোরস্থান।। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে গোরস্থানের কবর আর গাছপালা স্পষ্ট দেখা যেত।। সেই বাড়িতে উঠার পর প্রথম রাত।। রাত ১১ টার দিকে হটাৎ পুরো বাড়িতে কড়া আগরবাতির গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো।। আসে পাশে কোন উৎস খুঁজে পেলাম না।। ছোট ছিলাম।। ঘাবড়ে গেলাম।। ভয়ে ভয়ে নিজের রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।।

গভীর রাতে হটাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো।। মনে হলো ছাদ থেকে একটা আওয়াজ আসছে।। কে যেনও স্যান্ডেল টেনে টেনে হাঁটছে ছাদে।। প্রচণ্ড ভয় পেলাম।। পাশে শোয়া আম্মুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলাম।। এমনিতে কখন যেনও ঘুমিয়ে গেছি।।

সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ছোট মামা বললেন, উনি নাকি রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলেন।। তখন তার চোখ যায় গোরস্থানের দিকে।। সেখানে নাকি তিনি দেখেন, এক নব বধূর মত কেউ লাল শাড়ি পড়ে বসে আছে।। বাতাসের আসা যাওয়ার তা কিছুটা দুলছিল।। এছাড়া আকৃতিটা সাধারন মানুষের মতন ছিল নাহ।। তার চেয়ে অনেক বড় সাইজের ছিল।।

এভাবে অনেকদিন কেটে গেলো।। মামা প্রায় রাতেই সেই অদ্ভুত নতুন বউয়ের সাজের আকৃতিটা দেখতে পেতেন।। একদিন আমরা সবাই মিলে অনুরোধ করলাম, মামা যেহেতু প্রায় রাতেই সেই আকৃতিটা দেখতে পান, তাই পরে কোনবার দেখলে যেনও অবশ্যই আমাদের ডাক দেন।।

একদিন রাতে মামা আমাদের রাত ২ টার দিকে ডাক দেন।। ঘুম থেকে উঠে দেখি চাঁদের আলোয় সব ঝলমল করছে।। খুব সম্ভবত সেদিন পূর্ণিমা ছিল।। দূরের জিনিসগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম চাঁদের আলোয়।। আমরা মামার রুমে গেলাম।। চারদিকে শুনশান নিরবতা আর চারপাশে কড়া আগরবাতির গন্ধ।। মাঝে মাঝে কোথায় যেনও একটা কুকুর ডেকে উঠছিল।।

সবাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।। যা দেখলাম তাতে সবার চোখ প্রায় কপালে উঠে গেলো।। গোরস্থানের ভেতরের দিকে একটা ঘরের মত ছিল।। ঠিক ঘর নাহ, বাস টিকেট বিক্রি করার জন্য যেমন ছোট ঘর থাকে তেমন।। তবে তা চারদিক দিয়েই খোলা ছিল।। সেখানে যেনও নতুন বউয়ের মতন সেজে কে একজন বসে আছে।। মাথাটা কিঞ্চিৎ দুলাচ্ছে।। অনেকটা আমরা গুনগুন করে পড়ার সময় যেমন মাথা দুলিয়ে পড়ি, সেরকম।।

ভয়ে আমার এক কাজিন চিৎকার দিয়ে উঠলো।। সাথে সাথে সেই মূর্তিটা আমাদের দিকে ঘুরে গেলো।। আশ্চর্য, এত দূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম তার চোখগুলো যেনও জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।। আমরা ভয়ে চিৎকার দিয়ে সরে যাই।। মামা তাড়াতাড়ি জানালাটা বন্ধ করে দেন।। পড়ের খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একবার এই গ্রামে নদীতে একটা লাশ ভাসতে ভাসতে আসে।। লাশটার গায়ে নতুন বউয়ের শাড়ি ছিল।। পরে অনেক খোঁজাখোঁজি করেও সেই লাশের পরিচয় পাওয়া সম্ভব হয় নি।।

সেই গোরস্থানে দাফন করা হয় লাশটা।। এরপর নাকি প্রায়ই অনেকে উল্টাপাল্টা অনেক কিছু দেখে।। মাঝে মাঝে নাকি কড়া গন্ধ পাওয়া যায় আগরবাতির।। আর সেই গোরস্থানটি আসলে প্রচলিত অর্থে শুধু মুসলমানদের কবরখানা নয়, সেখানে বাকি সব ধর্মের মানুষেরও শেষ কীর্তি সম্পাদন করা হয়।।

যাই হোক, এরপর থেকে আমরা আর জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতাম না।। যতদিন সেই বাড়িতে ছিলাম ততদিনই সন্ধ্যার পর সব জানালা বন্ধ করে দেয়া হতো।। আর, ছাদের সেই শব্দটার কোন ব্যাখ্যা পাইনি।।

সেই রাতে

একেই বলে কপাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *