গুপি গাইন ও বাঘা বাইন-উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী-২য় অংশ

এই ব’লে দুজনায় সেই ভিজা কাপড়েই প্রাণ খুলে গান বাজানা শুরু করল। বাঘার ঢোলটি সেদিন কিনা ভিজা ছিল, তাইতে তার আওয়াজটি হয়েছিল যার পর নাই গম্ভীর। আর গুপিও ভাবছিল, এই তার শেষ গান, কাজেই তার গলার আওয়াজটিও খুবই গম্ভীর হয়েছিল। সে গান যে কি জমাট হয়েছিল, সে আর কি বলব? এক ঘণ্টা দু ঘণ্টা ক’রে দুপুর রাত হয়ে গেল, তবু তাদের সে গান থামছেই না। এমন সময় তাদের দুজনারই মনে হল, যেন চারিদিকে একটা কি কাণ্ড হচ্ছে। ঝাপসা ঝাপসা কালো কালো, এই বড় বড় কি যেন সব গাছের উপর থেকে উঁকি মারতে লেগেছে। তাদের চোখগুলো জ্বলছে যেন আগুনের ভাঁটা, দাঁতগুলো বেরুচ্ছে যেন মুলোর সার। তা দেখে তখনই আপনা হতে বাঘার বাজানা থেমে গেল, তার সঙ্গে সঙ্গে দুজনার হাত-পা গুটিয়ে, পিট বেঁকে, ঘাড় বসে, চোখ বেরিযে মুখ হাঁ করে এল।
তাদের গায়ে এমনি কাঁপুনি আর দাঁতে এমনি ঠকঠকি ধ’রে গেল যে, আর তাদের ছুটে পালাবারও জো রইল না। ভূতগুলি কিন্তু তাদের কিছু করল না। তারা তাদের গান বাজনা শুনে ভারি খুশি হয়ে এসেছে, তাদের রাজার ছেলের বিয়েতে গুপির আর বাঘার বায়না করতে। গান থামতে দেখে তারা নাকিসুরে বলল, ‘থামলি কেন বাপ? বাজা, বাজা, বাজা!’ এ কথায় গুপির আর বাঘার একটু সাহস হল। তারা ভাবল, ‘এ ত মন্দ মজা নয়, তবে একটু গেয়েই দেখি না।’ এই ব’লে যেই তারা আবার গান ধরেছে, অমনি ভূতেরা একজন দুজন ক’রে গাছ থেকে নেমে এসে তাদের ঘিরে নাচতে লাগল। সে যে কি কাণ্ডকারখানা হয়েছিল, সে কি না দেখলে বোঝবার জো আছে! গুপি আর বাঘা তাদের জীবনে আর কখনো এমন সমজদারে দেখা পায় নি। সে রাত এমনি ভাবেই কেটে গেল ভোর হলে ত আর ভূতেদের বাইরে থাকবার জো নেই, কাজেই তার একটু আগেই তারা বলল, ‘চল্‌ বাবা মোদের গোদার বেটার বে’তে! তোদের খুশি ক’রে দিব।’ গুপি বলল, ‘আমরা যে রাজাবাড়ি যাব! ভূতেরা বলল, ‘সে যাবি এখন, আগে মোদের বাড়ি একটু গানবাজনা শুনিয়ে যা! তোদের খুশি করে দিব!’ কাজেই তখন তারা দুজনে ঢোল নিয়ে ভূতেদের বাড়ি চলল। সেখান গান-বাজনা যা হল, সে আর বলে কাজ নেই।‌ তারপর তাদের বিদায় করবার সময় ভূতেরা বলল, ‘তোরা কি চাস্‌? গুপি বলল, ‘আমরা এই চাই যে, আমরা যেন গেয়ে বাজিয়ে সকলকে খুশি করতে পারি।’ ভূতেরা বলল, ‘তাই হবে, তোদের গানবাজনা শুনলে আর সে গান শেষ হওয়ার আগে কেউ সেখান থেকে উঠে যেতে পারবে না। আর কি চাস্‌? গুপি বলল, ‘আমরা এই চাই যে আমাদের যেন খাওয়া-পরার কষ্ট না হয়।’ এ কথায় ভূতেরা তাদের একটি থলে দিয়ে বলল, ‘তোরা যখন যা খেতে বা পরতে চাস, এই থলের ভিতরে হাত দিলেই তা পাবি। আর কি চাস্‌?’ গুপি বলল, ‘আর কি চাইব, তা ত বুঝতে পারছি না!’ তখন ভূতেরা হাসতে হাসতে তাদের দুজনকে দুজোড়া জুতো এনে দিয়ে বলল, ‘এই জুতো পায়ে দিয়ে তোরা যেখানে যেতে চাইবি, অমনি সেখানে গিয়ে হাজির হবি।’ তখন ত আর কোনো ভাবনাই রইলো না। গুপি আর বাঘা ভূতদের কাছে বিদায় হয়ে সেই জুতো পায়ে দিয়েই বলল, ‘তবে আমরা এখন রাজবাড়ি যাব।’ অমনে সেই ভীষণ বন কোথায় যেন মিলিয়ে গেল গুপি আর বাঘা দেখল, তারা দুজনে একটা প্রকাণ্ড বাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এত বড় আর সুন্দর বাড়ি তারা তাদের জীবনে কখনো দেখে নি।
তারা তখনই বুঝতে পারল যে, এ রাজবাড়ি। কিন্তু এর মধ্যে ভারি একটা মুশকিল হল্‌ রাজাবাড়ির ফটকে যমদূতের মত কতকগুলো দারোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল, তারা গুপি আর বাঘাকে সেই ঢোল নিয়ে আসতে দেখেই দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘এইয়ো! কাঁহা যাতা হ্যায়?’ গুপি থতমত খেযে বলল, ‘বাবা, আমরা রাজামশাইকে গান শোনাতে এসেছি।’ তাতে দারোয়ানগুলো আরো বিষম চটে গিয়ে লাঠি দেখিয়ে বলল, ‘ভাগো হিঁয়াসে।’ গুপিও তখন নাক সিঁটকিয়ে বলল, ‘ঈস্‌! আমরা ত রাজার কাছে যাবই।’ বলতেই অমনি সেই জুতোর গুণে, তারা তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাজামশায়ের সামনে উপস্থিত হল। রাজবাড়ির অন্দর মহলে রাজামহাশয় ঘুমিয়ে আছেন, রানী তাঁর মাথার কাছে বসে তাঁকে হাওয়া করছেন, এমন সময় কথা নেই বার্তা নেই, গুপি আর বাঘা সেই সর্বনেশে ঢোল নিয়ে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হল। জুতোর এমনি গুণ, দরজা জানালা সব ব রয়েছে, তাতে তাদের একটুও আটকায় নি। কিন্তু আসবার বেলা আটকাক, আর নাই আটকাক, আসবার পরে খুবই আটকাল। রানী তাদের দেখে বিষম ভয় পেয়ে, এক চিৎকার দিয়ে তখনই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। রাজামশাই লাফিয়ে উঠে পাগলের মত ছুটাছুটি করতে লাগলেন। রাজবাড়িময় হুলস্থুল পড়ে গেল। সিপাই সান্ত্রী সব খাঁড়া ঢাল নিয়ে ছুটে এল। বেগতিক দেকে গুপি আর বাঘার মাথায় গোল লেগে গেল। তারা যদি তখন শুধু বলে, ‘আমরা এখান থেকে অমুক জায়গায় চলে যাব, ‘তবেই তাদের জুতোর গুণে সকল ল্যাঠা চুকে যায়্‌ কিন্তু সে কথা তাদের মনেই হল না।‌ তারা গেল ছুটে পালাতে, আর দু-পা যেতে না যেতে না যেতেই বেচারারা যে মারটা খেল! জুতো, লাঠি, চাবুক, কিল, চড়, কানমলা- কিছুই তাদের বাকি রইল না। শেষে রাজামশাই হুকুম দিলেন, ‘বেটাদের নিয়ে তিন দিন হাজতে ফেলে রাখো। তারপর বিচার করে, হয় এদের মাথা কাটব, না হয় কুত্তা দিয়ে খাওয়াব।’ হায় গুপি! হায় বাঘা! বেচারারা এসেছিল রাজাকে গান শুনিয়ে কতই বকশিশ পাবে ভেবে, তার মধ্যে একি বিপদ? পেয়াদারা বেঁধে মারতে মারতে একটা অন্ধকার ঘরে নিয়ে ফেলে রাখল। সেখানে পড়ে বেচারারা একদিন আর গায়ের ব্যাথায় নড়তে চড়তে পারল না। তাতে তেমন দুঃখ ছিল না, কিন্তু বাঘার ঢোলটি যে গেল, সেই হল সর্বনাশের কথা! বাঘা বুক মাথা চাপড়িয়ে ভেউ ভেউ ক’রে কাঁদছে, কাঁদছে আর বলছে, ‘ও গুপিদা।-ওঃ-ওঃ-হ-হ-হ-অ-অ! আরে ও গুপিদা! মার খেলাম, প্রাণ যাবে, তাতে দুঃখ নেই কিন্তু দাদা, আমার ঢোলকটি যে গেল!’ গুপির কিন্তু ততক্ষণে মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সে বাঘার গায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ভয় কা দাদা? ঢোল গিয়েছে, জুতো আর থলে তো আছে। আমরা নিতান্ত বেকুব, তাই এতগুলো মার খেলাম।’ যা হোক, যা হবার হয়ে গিয়েছে, এখন এর ভিতর থেকে একটা মজা ক’রে নিতে হবে।’
বাঘা এ কথায় একটু শান্ত হয়ে বলল, কি মজা হবে দাদা?’ গুপি বলল, আগে ত খাবার মজাটা ক’রে নিই, তারপর অন্য মজার কথা ভেবে দেখব এখন। এই ব’লে সেই ভূতের দেওয়া থলির ভিতরে হাত দিয়ে বলল, ‘দাও ত দেখি, এক হাঁড়ি পোলাও।’ অমনে একটা সুগন্ধ যে বেরুল! তেমন পোলাও রাজরাও সচরাচর খেতে পান না। আর সে কি বিশাল হাঁড়ি! গুপি কি সেটা থলির ভিতর তেকে তুলে আনতে পারে? যা হোক, কোনমতে সেটাকে বার ক’রে এনে তারপর থলিকে বলর, ‘ভাজা ব্যঞ্জন, চাটনি, মিঠাই, দই, রাবড়ি, শরবত। শিগগির দাও।’ দেখতে দেখতে খাবার জিনিসে আর সোনা-রূপোর বাসনে ভ’রে গেল। দুজন লোকে আর কত খাবে? সে অপূর্ব খাবার খেয়ে তাদের গায়ের ব্যথা কোথায় চলে গেল তার আর ঠিক নেই। তখন বাঘা বলল, ‘দাদা চলো এই বেলা এখান থেকে পালাই, নইলে শেষে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবে? দেখাই যাক-না, কি হয়।’ এ কথায় বাঘা খুব খুশি হল। সে বুঝতে পারল যে, গুপিদা একটা-কিছু মজা করবে। দুদিন চ’লে গেল, আর একদিন পরেই রাজা তাদের বিচার করবেন। বিচারের দিন রাত থাকতে উঠে গুপি থলের ভিতর হাত দিয়ে বলল, ‘আমাদের দুজনের রাজপোশাক চাই।’ বলতেই তার ভিতর থেকে এমন সুন্দর পোশাক বেরুল যে, তেমন পোশাক কেউ তয়েরই করতে পারে না। সেই পোশাক তারা দুজনে পরে তাদের পুরনো কাপড় আর বাসন কখানি পুঁটলি বেঁধে নিয়ে জুতো পায় দিযে তার বলল, ‘এখন আমরা মাঠে হাওয়া খেতে যাব।’ অমনি দেখে, রাজবাড়ির বাইরের প্রকাণ্ড মাঠে চ’লে এসেছে। সে মাঠের এক জায়গায় তাদের পুঁটুলিটি লুকিয়ে রেখে, তারা বেড়াতে এরে রাজবাড়ির সামনে উপস্থিত হল। দূর থেকে তাদের আসতে দেখেই রাজার লোক ছুটে গিয়ে তাঁকে খবর দিয়েছিল যে, ‘মহারাজ, দুজন রাজা আসছেন।’ রাজাও তা শুনে তাঁর ফটকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বাঘা আর গুপি আসতেই তিনি তাদের যার পর নাই আদর দেখিয়ে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলেন। চমৎকার একটি ঘরে তাদের বাসা দেওয়া হল। কত চাকর, বামুন, পেয়াদা, পাইক তাদের সেবাতে লেগে গেল, তার অন্ত নেই। তারপর গুপি আর বাঘা হাত-পা ধুয়ে জলযোগ করে একটু ঠাণ্ডা হলেই রাজামশাই তাদের খবর নিতে এলেন। তাদের পোশাক দেখে অবধিই তিনি ভেবে নিয়েছেন যে, ‘না জানি এঁরা কত বড় রাজাই হবেন।’ তারপর শেষে যখন তিনি গুপিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কোন দেশের রাজা?’ তখন গুপি হাত জোড় ক’রে তাঁকে বলল, ‘মহারাজা! আমরা কি রাজা হতে পারি? আমরা আপনার চাকর!’ গুপি সত্য কথাই বলেছিল, কিন্তু রাজার তাতে বিশ্বাস হল না। তিনি ভাবলেন,‘কি ভাল মানুষ, কেমন নরম হয়ে কথা বলে। যেমন বড় রাজা, তেমনি ভদ্রলোকও দেখছি!’ তিনি তখন আর বিশেষ কিছু না বলে তাদের দুজনকে তাঁর সভায় নিয়ে এলেন। সেখানে সেদিন সে দুটো লোকের বিচার হবে-তিনদিন আগে যারা গিয়ে তাঁর শোবার ঘরে ঢুকেছিল।
বিচারের সময় উপস্থিত, আসামী দুটোকে আনতে পেয়াদা গিয়েছে। কিন্তু তাদের আর কোথায় পাবে? এ তিন দিন তাদের ঘরে তালা বন্ধ ছিল, সেই তালা খুলে দেখা হল, সেখানে কেই নেই, খালি ঘর প’ড়ে আছে। তখন ত ভারি একটা ছুটোছুটি হাঁকাহাঁকি পড়ে গেল। দারোগামশাই বিষম ক্ষেপে গিয়ে পেয়াদা গুলোকে বকতে লাগলেন। পেয়াদারা তাহ জোড় করে বলল, ‘হুজুর! আমাদের কোনো কসুর নেই। আমরা তালা দিয়ে রেখেছিলা, তার উপর আবার আগাগোড়া দরজার সামনে দাড়িয়েছিলা,। ও দুটো ত মানুষ ছিল না, ও দুটো ছিল ভুত; নইলে এর ভিতর থেকে কি ক’রে পালাল?’ এ কথায় সকলেরই বিশ্বাস হল। রাজামশাইও প্রথমে দারোগার উপর রেগে তাকে কেটেই ফেলতে গিয়েছিলেন, শেষে ঐ কথা শুনে বললেন, ‘ঠিক, ও দুটো নিশ্চয় ভূত। আমার ঘরও ত বন্ধ ছিল, তার ভিতর এত বড় ঢোল নিয়ে কি করে ঢুকেছিল?’ তা শুনে সকলেই বলল, ‘হাঁ হাঁ, ঠিক ঠিক, ও দুটো ভূত!’ বলতে বলতেই তাদের শরীর শিউরে উঠল, গা বেয়ে ঘাম পড়তে লাগল। তখন তারা বাঘার সেই ঢোলকটির কথা মনে করে বলল, ‘মহারাজ! ভূতের ঢোল বড় সর্বনেশে জিনিস! ওটাকে কখনো আপনার ঘরে রাখবেন না। ওটাকে এখুনি পুড়িয়ে ফেলুন।’ রাজামশাইও বললেন, ‘বাপ্‌ রে! ভূতের ঢোল ঘরে রাখব? এক্ষুনি ওটাকে এনে পোড়াও! যেই এ কথা বলা, অমনি বাঘা দুহাতে চোখ ঢেকে ‘হাউ- হাউ-হাউ-হাউ-হাউ’ ক’রে কেঁদে গড়াগড়ি দিতে লাগল! সেদিন বাঘাকে নিয়ে গুপির কি মুশকিলই হয়েছিল। ঢোল পোড়াবার নাম শুনেই বাঘা কাঁদতে আরম্ভ করেছে, ঢোল এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলে না-জানি সে কি করবে। তখন, সেটা যে তারই ঢোল, সে কথা কি আর বাঘা সামলে রাখতে পারবে? সর্বনাশ! এখন বুঝি ধরা প’ড়ে প্রাণটাই হারাতে হয়। গুপির বড়ই ইচ্ছা হচ্ছিল যে বাঘাকে নিয়ে ছুটে পালায়। কিন্তু তার ত আর জো নেই। সভায় বসবার সময় যে সেই জুতোগুলো পা থেকে খুলে রাখা হয়েছে। এদিকে কিন্তু বাঘার কাণ্ড দেখে সভাময় এক বিষম হুলুস্থুল প’ড়ে গেছে। সবাই ভাবছে, বাঘার নিশ্চয় একটা ভারি অসুখ হয়েছে, আর সে বাঁচবে না। রাজবাড়ির বদ্যিঠাকুর এসে বাগার নাড়ী দেখে যার পর নাই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। বাঘাকে খুব ক’রে জোলাপের ওষুধ খাইয়ে তার পেটে বেলেস্তারা লাগিয়ে দেওয়া হল। তারপর বদ্যিঠাকুর বললেন, ‘এতে যদি বেদনা না সারে, তবে পিঠে আর-একটা, তাতেও না সারলে দুপাশে আর দুটো বেলেস্তারা লাগাতে হবে।’ এ কথা শুনেই বাঘার কান্না তৎক্ষণাৎ থেমে গেল। তখন সকলে বালল যে, বদ্যিঠাকুর কি চমৎকার ওষুধই দিয়েছেন, দিতে বেদনা সেরে গেছে।
যা হোক, বাঘা যখন দেখল যে তার কান্নাতে ঢোল পোড়াবার কথাটা চাপা প’ড়ে গেছে, তখন সেই বেলেস্তারার বেদনার ভিতরেই তার মনটা কতক ঠাণ্ডা হল। রাজামশাই তখন তাকে খুব যত্নের সহিত তার ঘরে শুইয়ে রেখে এলেন। গুপি তার কাছে ব’সে তার বেলেনস্তারায় হাওয়া করতে লাগল। তারপর সকলে ঘর থেকে চলে গেলে গুপি বাঘাকে বলল, ‘ছি ভাই, যেখানে-সেখানে কি এমন করে কাঁদতে আছে। দেখ দেখি, এখন কি মুশকিলটা হল।’ বাগা বলল, ‘আমি যদি না কাঁদতুম, তা হলে ত এতক্ষণে আমার ঢোলকটি পুড়িয়ে শেষ করে দিত। এখন না হয় একটু জ্বলুনি সইতে হচ্ছে, কিন্তু আমার ঢোলকটা ত বেঁচে গেছে!’ বাঘা আর গুপি এমনি কথাবার্তা বলছে। এদিকে রাজামশাই সভায় ফিরে এলে দারোগামশাই তাঁর কানে কানে বললেন, ‘মহারাজ, একটা কথা আছে, অনুমতি হয় ত বলি।’ ‘রাজা বললেন, ‘কি কথা?’ দারোগা বললেন, ‘মহারাজ, ঐ যে লোকটা গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদল, সে আর তার সঙ্গের ঐ লোকটা সেই দুই ভূত। আমি চিনতে পেরেছি।’ রাজা বললেন, ‘তাই ত হে, আমারও একটু যেন সেইরকম ঠেকছিল। তা হলে ত বড় মুশকিল দেখছি। বলো ত এখন কি করা যায়?’ তখন এ কথা নিয়ে সভার ভারি একটা কানাকানি শুরু হল। কেউ বলল, ‘রোজা ডাকো, ও দুটোকে তাড়িয়ে দিক।’ আর-একজন বলল, ‘রোজা গদি তাড়াতে না পারে, তখন ত সে দুটো কে পুড়িয়ে মারুন না।’ এ কথাটা সকলেরই খুব পছন্দ হল, কিন্তু এর মধ্যে একটু মুশকিল এই দেখা গেল যে, ভূতদের পোড়াতে গেলে রাজবাড়িতেও তখন আগুন ধরে গেদে পারে। শেষে অনেক যুক্তির পর এই স্থির হল যে, একটা বাগানবাড়িতে তাদের বাসা দেওয়া হবে। বাগানবাড়ি পুড়ে গেলেও বিশেষ ক্ষতি হবে না। রাজামশাই বললেন, ‘সেই ঢোলকটাকেও তা হলে সেই বাগানবাড়িতে নিয়ে রাখা যাক। বাগানবাড়ি পোড়াবার সময় একসঙ্গে সকল আপদ চুকে যাবে।’ বাগানবাড়ি যাবার কথা শুনে গুপি আর বাঘা খুব খুশি হল। তারা ত জানে না যে এর ভিতর কি ভয়ানক ফন্দি রয়েছে। তারা খালি ভাবল যে বেশ আরামে নিরিবিলি থাকা যাবে, সংগীত চর্চার সুবিধা হতে পারে। জায়গাটি খুবই নিরিবিলি আর সুন্দর। বাড়িটি কাঠের, কিন্তু, দেখতে চমৎকার। সেখানে গিয়ে দেখতে দেখতে বাঘা ভাল হয়ে গেল। তখন গুপি তাকে বলল, ‘ভাই, আর এখানে থেকে কাজ কি? চলো আমরা এখান থেকে চ’লে যাই।’ বাঘা বলল, ‘দাদা, এমন সুন্দর জায়গায় ত আর থাকতে পাব না, দুদিন এখানে রইলামই বা। আহা, আমার ঢোলকটি যদি থাকত!’ সেদিন বাঘা বাড়ির এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে, গুপি বাগানের এক জায়গায় ব’সে গুনগুন করছে, এমন সময় হঠাৎ বাঘা ভয়ানক চেঁচামেচি ক’রে উঠল। তার সকল কথা বোঝা গেল না, খালি ‘ও গুপিদা। ও গুপিদা!’ হাকটা খুবই শোনা যেতে লাগল। গুপি তখন ছুটে এসে দেখল যে, বাঘা তার সেই ঢোলকটা মাথায় ক’রে পাগলের মত নাচছে, আর যা-তা আবোল-তাবোল বলতে বলতে ‘গুপিদা গুপিদা চেঁচাচ্ছে! ঢোলক পেয়ে তার এত আনন্দ হয়েছে যে, সে আর কিছুতেই স্থির হতে পারছে না, গুছিয়ে কথাও বলতে পারছে না। এমনি ক’রে প্রায় আধঘণ্টা চলে গেলে পর বাঘা একটু শান্ত হয়ে বলল, ‘গুপিদা, দেখছ কি, এই ঘরে আমার ঢোলকটি-আর কি মজা-হাঃ-হাঃ’ বলে আবার সে মিনিট দশেক খুব নেচে নিল। তারপর সে বলল, ‘দাদা, এত দুঃখের পর ঢোলকটি পেয়েছে। খাওয়া দাওয়ার পর রাত্রে বারান্দায় ব’সে দুজনায় খুব ক’রে গানবাজনা করা যাবে।’
রাজামশাই কিন্তু ঠিক করেছেন, সেই রাত্রেই তাদের পুড়িয়ে মারবেন। দারোগার উপর হুকুম হয়েছে যে, সেদিন সন্ধ্যার সময় সেই বাগানবাড়িতে মস্ত ভোজের আয়োজন করতে হবে।‌ দারোগামশায় পঞ্চাশ-ষাট জন লোক নিয়ে সেই ভোজে উপস্থিত থাকবেন। খাওয়াদাওয়ার পর গুপি আর বাঘা ঘুমিয়ে পড়লে, তাঁরা সকলে মিলে একসঙ্গে সেই কাঠের বাড়ির চারদিকে আগুন দিয়ে তাদের পালাবার পথ বন্ধ করবেন। সেদিনকার খাওয়া বেশ ভালমতই হল। গুপি আর বাঘা ভাবল যে, লোকজন চ’লে গেলেই তারা গান বাজনা আরম্ভ করবে। দারোগামশাই ভাবলেন যে গুপি আর বাঘা ঘুমোলেই ঘরে আগুন দেবেন। তিনি তাদের ঘুম পড়াবার জন্য বড়ই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর ভাব দেখে যখন স্পষ্টই বোঝা গেল যে, তারা না ঘুমোলে তিনি সেখান থেকে যাবেন না, তখন গুপি বাঘাকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় প’ড়ে নাক ডাকাতে লাগল।
একটু পরেই গুপি আর বাঘা দেখল যে লোকজন সব চ’লে গেছে, আর কারু সাড়াশব্দ নেই। তারপর আর একটু দেখে যখন মনে হল যে, বাগান একেবারে খালি হয়ে গেছে, তখন তারা দুজনে বারান্দায় এসে ঢোল বাজিয়ে গান জুড়ে দিল। এদিকে দারোগামশাই তাঁর লোকদের বলে দিয়েছেন, ‘তোরা প্রত্যেক দরজায় বেশ ভাল ক’রে আগুন ধরাবি। খবরদার, আগুন ভাল ক’রে ধরলে চ’লে যাস নি যেন!’ তিনি নিজে গিয়েছেন সিঁড়িতে আগুন ধরাতে। আগুন বেশ ভাল মতই ধরেছে, দারোগামশাই ভাবছেন, ‘এই বেলা ছুটে পালাই’। এমন সময় বাঘার ঢোল বেজে উঠল, গুপিও গান ধ’রে দিল। তখন আর দারোগামশাই বা তাঁর লোকদের কারু সেখান থেকে গড়বার জো রইল না, সকলেই পুড়ে মরতে হল। ততক্ষণে গুপি আর বাঘাও আগন দেখতে পেয়ে তাদের জুতোর জোরে, তাদের ঢোল আর থলেটি নিয়ে সেখান থেকে চম্পট দিল। গল্পের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

আরো পড়তে পারেন...

প্রতারণার কোয়ান্টাম মেথড

কয়েক মাস আগে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি মিলনায়তনের একটি অনুষ্ঠানের খবর আমরা জানতে পারি পরদিন প্রকাশিত দেশের…

সৌভাগ্যের ভেজাল চিঠি

কয়েকদিন আগে একটা চিঠি পেয়েছি, ডাকযোগে। টাইপ করা চিঠিটাতে কোন নাম ঠিকানা ছিল না, খামের…

বুনো রাজা ও রাজকুমারী– শ্রী ক্ষিতীশচন্দ্র কুশারী

এক বুনো রাজা। বনেই তাঁর রাজত্ব। যত অসভ্য জংলী তাঁর প্রজা। প্রজাদের ঘর নেই, দোর…