
গাধা বা গর্ধভের নাম শুনেনি এমন কাউকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের সমাজে যারা একটু বোকা কিংবা যারা পড়াশুনায় ভাল নয়, তাদেরকে সাধারণত ‘গাধা’ বলে তিরস্কার করা হয়। গাধা হচ্ছে ঘোড়া পরিবারের একটি চতুষ্পদ প্রাণী যেটি কালক্রমে গৃহপালিত পশুতে পরিণত হয়েছে। গাধা কেবল বোঝা বহনের কাজে ব্যবহৃত হলেও কোন কোন সময় এই গাধাই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। রংধনু আসরে আমরা এ সম্পর্কেই একটি গল্প প্রচার করেছি। গল্পটি নেয়া হয়েছে তের শতকের বিশিষ্ট ইরানী লেখক ও ইসলামী চিন্তাবিদ মোল্লা আহমদ নুরাকী কাশানীর ‘ত্বাক্বাদিস’ নামক গ্রন্থ থেকে।
একবার এক চাষী তার গাধার পিঠে বোঝা চাপিয়ে রওনা হলো শহরের দিকে। গাধাটি ছিল বুড়ো ও দুর্বল। গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার রাস্তাটি ভাল ছিল না। এবড়ো-থেবড়ো পাথুরে এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ গাধার একটি পা গর্তে ঢুকে পড়ায় সে তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল। চাষী বহু চেষ্টা করে গাধাটিকে দাঁড় করাতেই দেখতে পেল, গাধার একটি পা মচকে গেছে। চাষী বিরক্ত হয়ে গাধাকে সেখানে ফেলে রেখেই চলে গেল।
হতভাগা গাধা খোঁড়া পায়ে কোথায় যাবে তার কোন দিশা না পেয়ে মনে মনে ভাবলো :
গাধা : এই মানুষগুলোর জন্য সারাটা জীবন শুধু বোঝাই টানলাম। আজ যখন বুড়ো, দুর্বল ও খুড়া হয়ে পড়লাম তখন কিনা আমাকে এই পাহাড়ী মরুভূমিতে একাকী ফেলে চলে গেল। একটুও ভাবলো না, আমার কি উপায় হবে? আফসোস করতে করতে গাধা এদিক সেদিক তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ দেখতে পেল যে, একটা নেকড়ে দাঁত বের করে তারই দিকে এগিয়ে আসছে। গাধাকে একা পেয়ে নেকড়ে লাফিয়ে উঠলো। গাধা ভাবলো-
গাধা : আমার গায়ে যদি শক্তি থাকতো এবং পা মচকে না যেতো তাহলে দৌড়ে পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তাই বলে নেকড়ের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়া চলবে না। পা ভেঙ্গেছে তো কী হয়েছে? যতক্ষণ মগজ আছে তা কাজে লাগিয়ে বিপদমুক্ত হওয়ার উপায় বের করতে হবে। ভাল করে চিন্তা-ভাবনা করলে আল্লাহ নিশ্চয়ই একটা পথ বের করে দেবেন। এসব ভাবার পর গাধা একটা পরিকল্পনা আঁটলো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একটা সুবিধাজনক জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো।
এরপর যেই নেকড়ে তার কাছাকাছি এলো তখন নির্ভয়ে নেকড়েকে স্বাগত জানালো। গাধার আচরণ দেখে নেকড়ে খুশী হয়ে বললো :
নেকড়ে : কিরে! এখানে কি করছিস? দূর থেকে দেখলাম মাটিতে পড়ে গেলি এবং তোর মালিক তোকে টেনে তুললো। এরপর তোকে রেখেই সে চলে গেল। কী খবর চলতে চলতে ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি?
গাধা : জ্বী না জনাব! ঘুমিয়ে পড়িনি। হোঁচট খেয়ে গর্তে পড়ে গিয়েছিলাম। খুব ব্যথা পেয়েছি। একটা পা একদম নাড়াতে পারছি না। এ অবস্থায় নিজেকে আপনার কাছে সঁপে দিয়ে মরে যেতে পারলেই বাঁচি। তবে মরার আগে আপনার কাছে আমার একটা আর্জি আছে।
নেকড়ে : আর্জি? কিসের আজি?
গাধা : হে সম্মানিত নেকড়ে! আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, আমি ভীষণ অসুস্থ এবং কয়েক মুহূর্ত পরই হয়তো আমার প্রাণটা বের হয়ে যাবে। আপনার প্রতি আমার অনুরোধ তাড়াহুড়া করে আমাকে হত্যা না করে একটু অপেক্ষা করুন। আমি মারা গেলে তখন আপনি ইচ্ছামত আমার গোশত খেতে পাবেন। আর হ্যাঁ, আপনি যদি এ ক’টা মুহূর্ত সবর করে তাহলে আমি আপনাকে এমন কিছু দেবো যা কখনো দেখেননি এবং যা দিয়ে আপনি অনায়াসে আরো একশ’ গাধা কিনে নিতে পারবেন।
নেকড়ে : ঠিক আছে, তোর আর্জি মেনে নিলাম। কিন্তু তুই যে উপহারের কথা বললি- সেটা কোথায়?
গাধা : সে কথাই এখন বলছি। আমার মালিক এক মস্ত বড় জমিদার। তার সোনা-দানার কোন অভাব নেই। তিনি আমাকে নিজের ছেলেমেয়ের মতোই ভালবাসেন।
আদর করে আমার পায়ের খুর সেনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছেন। আজ মনিবের শরীরটা ভাল ছিল না বলে বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।
আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে আমাকে নিয়ে আসায় আমি ঠিকমতো পথ চলতে পারছিলাম না। হঠাৎ আমার একটা পা গর্তে ঢুকে পড়ায় আমি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাই।
যাগগে সেসব কথা। মরার আগে আমি আপনাকে আমার পায়ের খুরে লাগানো সোনাগুলো আপনাকে দিতে চাই।
এগুলো দিয়ে আপনি অনেক গাধা কিনে জীবনভর আরাম-আয়েশে খেয়ে যেতে পারবেন।
ধনসম্পদের লোভে অনেকেই হিতাহিত-জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়ে। নেকড়েও গাধার কথার জালে আটকা পড়ল।
তাই দেরি না করে গাধার পেছনে একটু ঢালু জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো।
নেকড়ে যখন গাধার পায়ের কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে খুর দেখতে গেল অমনি গাধা তার সামনের দু’পায়ের উপর দাঁড়িয়ে পেছনের দু’পা তুলে সারা গায়ের জোরে প্রচণ্ডবেগে একটা লাথি মারলো।
লাথির চোটে নেকড়ে মুহূর্তে উল্টে গিয়ে পড়লো ঢালু মাটিতে। গাধার এক পায়ের লাথি লাগলো নেকড়ের দাঁতে এবং অন্য পায়ের লাথি লাগলো পাজরে।
মাটিতে পড়ার সময় কয়েকটা পাজর মড়মড় শব্দে ভেঙ্গে গেল।
কতক্ষণ মাটিতে গড়াগড়ির পর হুশ আসতেই নেকড়ে বলে উঠলো : নেকড়ে : এই বেটা গাধা! তুই আমাকে মারলি? ঠিকাছে,আমি একদিন না একদিন অবশ্যই এর প্রতিশোধ নেবো।
গাধা : তুই আমার ওপর প্রতিশোধ নিবি ? ঠিকাছে দাঁড়া, প্রতিশোধ কিভাবে নিতে হয় তা তোকে দেখাচ্ছি। এই বলে গাধা নেকড়ের দিকে এগুতে থাকলো।
গাধাকে তেড়ে আসতে দেখে নেকড়ে জানের ভয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দিল দৌড়। কিছুদূর যাওয়ার পর নেকড়ের সামনে পড়লো এক শিয়াল।
নেকড়ের অবস্থা দেখে সে বললো : শিয়াল : নেকড়ে মশাই! আপনার এ কী অবস্থা! হাত-পা, নাক-মুখ এমন রক্তাক্ত কেন? কোন শিকারীর তীর-বর্শা লেগেছে নাকি? নেকড়ে কাতরাতে কাতরাতে বললো: নেকড়ে : আরে শিকারীর তীর-বর্ষা নয়, আমি নিজের বালা মুছিবত নিজেই ডেকে এনেছি।
শিয়াল : নিজেই ডেকে এনেছেন? সে কী? কী করতে গিয়েছিলেন? নেকড়ে : আর বলিসনে। পেশা বদলাতে গিয়েছিলাম।
কসাই ছিলাম,গোশত ছিড়ে খেতাম;কামার-স্বর্ণকারের কাজ জানতাম না।
কিন্তু আজ কী যে হলো, কামার আর স্বর্ণকারের কাজই করতে গিয়েছিলাম।
আহ! উহ!! হাড়-মাংস গুড়ো হয়ে গেছেরে!! এ গল্প থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনের তাগিদে গাধাও বুদ্ধিমান হতে পারে।