
আজকের গল্পটি নিছক গল্প নয়—এটি সত্য ঘটনা।
ইন্টারমিডিয়েট পাস করে সদ্য নটরডেম কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছি। উঠতি মাস্তান, বোহেমিয়ান। ধরাকে সরা জ্ঞান করাই যেন স্বভাবদোষে পরিণত হয়েছিল। সবার চাইতে একটু বেশি বোঝা, অন্যকে হেয় করা—এসব ছিল আমার একধরনের আনন্দের উৎস।
এই ধরণের উপসর্গ একসময় প্রায় সবার মধ্যেই বাসা বাঁধে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে ধীরে ধীরে সেগুলো কমে আসে। তবে অতি সাধারণদের মধ্যে এসব দোষ বেশি প্রকটভাবে দেখা যায়। তাই আমারও দোষের অন্ত ছিল না।
এইসবের মধ্যেই নিজেকে এক অবিশ্বাসীর কাতারে ফেলেছি। ধর্ম নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করেছি। এলাকায় খ্যাতিমান ধর্মবিশ্বাসীদের বিতর্কে আটকে ফেলেছি—তারা বাধ্য হয়ে আমার শিষ্যত্ব স্বীকার করেছে।
তবে আমার মধ্যে সবসময় একধরনের ছন্নছাড়া ভাব কাজ করত। কোনো বিষয়েই নিজেকে বেশি দিন আটকে রাখতে পারতাম না। যতদিন ভালো লাগত, ততদিন পরীক্ষানিরীক্ষা চলত। কিন্তু জ্ঞানীরা বলেন—‘চর্চা, চর্চা, চর্চা ছাড়া কিছুই আয়ত্ত করা যায় না।’ আমি কারো কথা শুনিনি। নিজের খেয়ালখুশিতে চলতে গিয়ে আজ মানবেতর জীবনযাপন করছি।
যারা জীবনযুদ্ধে সফল, তাদের কাছে গেলে এক ধরনের দুঃখ আমাকে স্পর্শ করে। তবে তা ছাড়া দিব্যি আছি। এখন বিশ্বাসের ধারা কিছুটা বদলেছে—আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারি না। যুক্তি ও তর্কের ভিতর দিয়েই তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করি। তবে প্রচলিত ধর্মব্যবস্থায় আমার বিশ্বাস নেই। মানুষে মানুষে ভেদরেখা দেখি না। সবার মধ্যেই মানবিক দোষগুণ দেখি। তাই ধর্ম দিয়ে মানুষকে ভাগ করাটা আমার কাছে অর্থহীন।
এই প্রসঙ্গে যে ঘটনাটি বলতে যাচ্ছি, তা উপরিউক্ত বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িত।
আমার এক বন্ধু, নাম ধরি রফিক। ক্লাস ফাইভ থেকেই বন্ধুত্ব। বছর দুয়েক হলো ওর বাবা মারা গেছেন। বড় ভাই হওয়ার সুবাদে সংসারের ভার ওর কাঁধে এসে পড়ে। মা, দুই বোন আর তিন ভাইয়ের সংসার।
বাবার মৃত্যুর পর রফিকের পরিবারে নেমে আসে দুর্বিষহ দুঃখ-কষ্ট। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পাটকলের সুপারভাইজার পদে চাকরি নেয় রফিক। তখন থেকেই আজ পর্যন্ত সেই চাকরিতেই রয়ে গেছে—না উন্নতি, না অবনতি।
দুই বোনের বিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দু’জনেই স্বামী-সন্তান নিয়ে আবার ওর ওপর বোঝা হয়ে ফিরে আসে।
আমি অলৌকিকতায় বরাবরই বিশ্বাস করি না।
এক শুক্রবার রফিক আমার বাসায় এসে বলল, “দোস্ত, একটু বিপদে পড়েছি।” আমি বললাম, “নির্বিধায় বল, যতটা পারি সাহায্য করব।” কিন্তু ও যা বলল, তাতে মনে হলো ওর মানসিক অবস্থাই বোধহয় ঠিক নেই।
ওর বক্তব্য: রাত হলেই কে বা কারা যেন ওদের টিনের দেয়ালে আচর কাটে, যেন ঘুমানোই অসম্ভব হয়ে পড়ে। গত এক মাস ধরে প্রতিদিন একই ঘটনা। কোনও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা নেই।
আমি ওকে বললাম, “আজ রাতে তোর বাসায় গিয়ে থাকব। হকি স্টিক আর টর্চলাইট রেডি রাখ।”
রাত দশটায় ওদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছালাম। ওদের ঘরটি শহরতলির প্রায় শেষ প্রান্তে, রাস্তার পাশে একটি দোতলা বাড়ি—তার পেছনে ১৫-২০ গজ দূরে টিনের ঘর, গাছগাছালিতে ঢাকা। আশেপাশে আর কোনও বাড়ি নেই। লোকজনের ভাষায় ওই এলাকা ‘নামা’—নিচু জমি, খাল-বিলঘেরা।
রাতের খাবার খেয়ে রাত বারোটায় আমরা শুয়ে পড়লাম। রফিক বলল, “লাইট নিভালেই শুরু হবে।” ও আরও বলল, “ভয়ের কিছু নেই, এখন পর্যন্ত কোনও ক্ষতি করেনি—শুধু শব্দ।”
লাইট নিভানো মাত্রই শুরু হলো সেই শব্দ। আমি আর রফিক হকি স্টিক হাতে, টর্চ জ্বালিয়ে বের হলাম। বাড়ির চারপাশ ঘুরে দেখে আমি হতবাক। পাঁচ গজের মধ্যে কোনও গাছের ডাল পর্যন্ত নেই, বাতাসে শব্দ হওয়ার উপায় নেই।
মনে মনে ভয় ধরে গেল।
রফিককে বললাম, “তুই ঘরে গিয়ে লাইট নিভা, আমি একটু পর আসছি।” রফিক ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে লাইট নিভাল। সাথে সাথেই শুরু হলো ভয়ংকর শব্দ। সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। চারপাশে কেউ নেই, অথচ এমন শব্দ আসছে! জীবনে এমন ভয় পাইনি।
দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা আটকে ফেললাম। সকালে কাউকে কিছু না বলেই ফিরে এলাম। কিন্তু মনে একটাই প্রশ্ন—এটা ঘটছে কেন?
বিশ্বের নানা মনোবিজ্ঞানীর কেস স্টাডি পড়ে যাচ্ছি—কিন্তু উত্তর মিলছিল না।
দু’বছর পর উত্তর পেলাম পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি প্রভীর ঘোষের একটি বই থেকে (নাম মনে নেই)। সাথে সাথে রফিককে একান্তে ডেকে বললাম, “তোমাদের ঘরের ভেতর থেকেই কেউ এই আওয়াজ করছে। পরিবারের কোনও সদস্যই হয়তো এমন করছে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। যদি আমার কথা বিশ্বাস করো, তাহলে যেভাবেই হোক, তোমার দুই বোনকে আবার তাদের স্বামীর ঘরে পাঠিয়ে দাও।”
রফিক অনেক দেন-দরবার করে বোনদের পাঠিয়ে দিল।
এরপর আর সেই ‘ভূত’ তাদের বিরক্ত করেনি।