এক বনের মধ্যে থাকে বাচ্চা খরগোশ ও তার মা। খরগোশের বন্ধু আছে, বান্ধব আছে। তাদের সঙ্গে সে ঘুরে বেড়ায়। তাদের পাঠশালায় যায়। পাঠশালে গুরু মশায়ের বেত আর বাড়িতে মার বকুনি তার ভাল লাগে না। সে চায় নাচতে, গাইতে আর ছড়া কাটতে। কিন্তু তা কি করার জো আছে? চারদিকেই শাসন আর শাসন। বাড়ী থাকতে আর ভাল লাগে না। বাইরে বেড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। এ বনে যা আছে পুরনো হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীতে কত বন, কত গাছপালা, কত ফুল, কত ফল, কত রকমের জীবজন্তু। আর চলবার পথই বা কত! কিছুই তার দেখা হল না। আরে বই পড়েই কি সব জানা যায়? না কেবল শুনে শুনে সব শেখা যায়? একদিন বাচ্চা খরগোশটা মাকে বলল, মা মণি, তোমার কেবল পড়া আর পড়া। এতো পড়তে কি ভালো লাগে? গুুরু মশাই কি বলে জানো। তিনি বলেন, দেশে দেশে ঘুরে বেড়ালে ঢের বেশি শেখা যায়। খরগোশের মা ছেলে কথা শুনে হাসল, বলল, বেশ তো, পাঠশালা তো এখন ছুটি। বেড়িয়েই এন না আজ। তবে নতুন কিছু শিখে আসতে হবে। যদি শিখতে না পার, তবে কানটি আচ্ছা করে মলে দেব, আর রাতের খাওয়া বন্ধ থাকবে। তবে পুরস্কার পাবে, নতুন কিছু শিখতে পারলে। মায়ের মুখে এমন কথা! খরগোশটা তখুনি আনন্দে খানিকটা নেচে নিল। তারপর ঝোপজঙ্গল গাছপালার ভেতর দিয়ে তর তর করে এগিয়ে চলল।
কোথায় যাবে তার ঠিক নেই। কোথায় গিয়ে উঠবে, তার ঠিকানা নেই। নেই তো নেই। তাতে আর হয়েছে কি! সে চলতে লাগল। চলতে চলতে দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যে হল। তবুও ফেরবার নাম নেই। রাত হল। সে দিন পূর্ণিমা। রূপোর বড় একটা থালার মতো আকাশে চাঁদ উঠেছে। জোছনায় চার দিক ধব ধব করছে। আরো খানিক দূরে এগিয়ে এসে সে দেখে একটা বড় কপি ক্ষেত। ক্ষেত ভর্তি কপি আর ফুলকপি। কেউ কোথাও নেই। কচি কচি কপিপাতার কি সুন্দর গন্ধ। সারাদিন কিচ্ছু খাওয়া হয়নি। খিদেও পেয়েছে খুব। মহাখুশীমনে তখুনি সে কচি কচি কপি পাতা কুর কুর কুর করে খেতে শুরু করে দিল। পেটটা ভরে এসেছে। চাঁদের আলোয় এবার মনটা বেশ উথলে উঠল। বাচ্চা খরগোশটা গাইতে জানত আর পারত ছড়া তৈরী করতে। কিন্তু বাড়ীতে মা আর পাঠশালে গুরুমশায়ের ভয়ে চুপচাপ থাকত। পড়া ছেড়ে ছড়া বলা? আবার গান? আজ ত আর মা কাছে নেই। গুরুমশাই ও নেই। ভাবনা? খরগোশ মুখে মুখে একটা ছড়া তৈরী করে গলা ছেড়ে গান জুড়ে দিল– তাইরে নাইরে নাইরে না, কাছাকাছি নেইক মা।
পাঠশালাটা অনেক দূর, নাচের তালে লাগাও সুর। এগিয়ে চল, এগিয়ে চল। জগৎ কবে দেখবি বল? তাইরে নাইরে নাইরে না আমি চলছি, চলছে পা। হা হা হা হা—। কে হেসে উঠল না? খরগোশ হঠাৎ চমকে গেল। গান থেমে গেল। ভয়ে ভয়ে সে একটু দূরেই সরে এল। না, অজানা দেশে একটু সাবধান হওয়াই ভালো। সে দূরে চুপ করে ঘাপটি মেরে বসে পিট পিট করে তাকাতে লাগল। আরে এ যে একটা ইঁদুর। সত্যি ইঁদুরটাই হাসছিল। হাসছিল, খরগোশের গান শুনে। ইঁদুর খরগোশের কাছাকাছি এসে বলল, বেশ ত গাইতে পার, ভায়া। ছড়াও বানাতে পার দেখছি। আমি তোমার মতই একজন খুঁজছিলাম। আমাদের একটা গানের দল আছে। এই মাঠটার ওই কোনে দলটা বসে। গান গাইতে জানে। কিন্তু গানে কোন কথা নেই। শুধু সুর ভাঁজলে কি গান হয়? কথা না থাকলে কি গান জমে? তুমি আমাদের গানের দলে এস। তুমিই গান তৈরী কর। গানের দল? ইঁদুরের কথা শুনে খরগোশের কান দুটো খাড়া হয়ে উঠল। এ একটা নতুন কথা বটে। এমনটা ত কখনো শোনা যায় নি। ইঁদুর বলল, আমাদের দেল অনেক গাইয়ে আছে, ব্যাঙ, পেঁচা, ঝিঁঝি পোকা, আর কাক। বাজনা বাজায় কাঠঠোকরা। খরগোশ বলল, বাহঃ বেশতো। ইঁদুর বলল, বেশ বললে কি হবে।
গানে যে কোন কথা নেই। খরগোশ বলল, ও-বুঝেছি। ব্যাঙের শুধু যেঙর ঘেঙ নেইক কথা নেইক মানে, পেঁচায় জানে একটি কথা, সেই কথারই সুর টানে। কাকের কথা বলব কিবা– ঝিঁ ঝিঁ পোকাই দল রেখেছে, মিষ্টি সুরে রাখছে মান। ইঁদুর তো খুশিতে ডগমগ। খরগোশকে একেবারে জড়িয়ে ধরল। এখুনি টেনে নিয়ে যাবে। তারপরেই ইঁদুর কি মনে বলল, আচ্ছা, তুমি এগোও। গানের আসরে তো খাবার চাই। আমি কিছু চাল-ডাল নিয়ে আসি। তুমি কচিপাতা নিয়ে চল। এই বলে ইঁদুর চলে গেল। খরগোশ ইচ্চামত কচিপাতা কুড়িয়ে নিল। তারপর সেই বোঝা ঘাড়ে করে গান গাইতে গাইতে চলতে লাগল,– গানের কথা গাঁথব আমি, সবাই ধরবে তান। কথায় কথায়, সুরে সুরে, জাগবে খুশির বান। আমিই হব দলের সেরা, সবাই মোরে মানবে, পাঠশালার এ ছোট ছেলে, কে বা তা আর জানবে। কে হে, কে গায়। খরগোশের কানের কাছেই করা ভরাট গলার ডাক। আরে এ যে ব্যাঙ ভায়া। ব্যাঙ বলল, চমৎকার গাইতে পারত। চলনা আমার সঙ্গে। আমি যাচ্ছি ইঁদুরের গানের আসরে। সঙ্গে আছে অনেক পোকামাকড়। খেতে হবে তো। খরগোশ বলল, চল। আমি ত যাচ্ছি সেখানে। তুমি আমার সঙ্গে চলতে পারবে তো। ব্যাঙ এগোয় থপ থপ করে। তাড়াতাড়ি চলতে পারে না। তবুও পালপণে সে এগিযে চলর। থামল না কোথাও, আনন্দে শরীরের কষ্ট ভুলে গেল।
কেবল জোরে জোরে চলার শব্দ হচ্ছে– থপ থপ থপ। দুজনেই এসে দেখে, ইঁদুর এসে গেছে। তার সঙ্গে আরও অনেক ইঁদুর। আর এসেছে পেঁচা ও ব্যাঙের দল, কাকের দল। আসর একেবারে জমজমাট। গান তখনও শুরু হয়নি, লম্বা লম্বা ঠোঁট নিয়ে একাধারে বসে আছে কাঠঠোকরার দল। গান শুরু হলেই বাজনা বাজবে। গান শুরু হবে কি করে! গানের কথা চাই ত? ইঁদুর এগিয়ে এল। খরগোশকে আদর করে সভার মাঝখানে বসিয়ে বলল, আর ভাবনা নেই। খরগোশ গানের কথা দেবে আর আমরা সে কথা দিয়ে গান গাইব। সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠল। কি মজা কি মজা। গান আজ জমবে ভাল। এদিকে খরগোশের বুকটা ফুলে উঠেছে অহঙ্কারে। এত সম্মান! মা যদি আজ কাছে থাকত, তা হলে ছেলেকে কোলে করেই নাচতে শুরু করে দিত। গানের আসর বসে গেল। সবাই বসল ঘন হয়ে। মধ্যেখানে খরগোশ। প্রথমে গাইছে সে, তারপর আর সকলে! সঙ্গে সঙ্গে কাঠঠোকরা তাল তুলছে।
ক্রমে গান জমে উঠল। খুরগোশের গানে সুর মিলিয়ে সবাই গানের দোহারি করতে লাগল। পেঁচার সুর সবার উপরে। হুই ও …হুইও… হো, কেরে তুই মারবি ছো? চোখ যে সব দেখতে পায়, আড়ালে কেেআছে কে যে যায়? আজ ধরার নেই জো, হুইও হুইও হো। তারপর শোনা যাচ্ছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গান। ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ— সবাই মোদের দেখছ কি? আড়ালে ভয়ে লুকিয়ে যাই। আঁধার হলে গান যে গাই আজকে কারো ভয় নাই ভাইকে ভাইয়ে মারবে কি? ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ। এবার শুরু হল ব্যাঙের গান– পুকুরের জলে নই কাদার ভেতর নই। এত আরো, এত সআলো। সাঁতার দেব না আর, শুধু গান এনতার এই ভালো এই ভালো। এবারে কাকের গদল গান গেয়ে উঠল– কা–কা–কা– আমরা সবাই বন্ধু রে ভাই কা–কা–কা। নাচব মোরা গাইব গান জোর গলাতে তুলব তান সব আপন সব সমান কা–কা–কা। গানের আসরে খরগোশের জয়-জয-কার। সবাই তাকে ঘিরে নাচতে শুরু করে দিল।
তারপর আসর ভেঙ্গে গেল। খরগোশ তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে ছুটে গেল। মাকে সব বলতে হবে। কেমন গান সে তৈরী করেছে। কেমন সে গেয়েছে। নিজের চেষ্টায় আজ সে কত বড়। কত তার মান। সবাই করেছে তার প্রশংসা। ভাগ্যিস সে একা বেরিয়েছিল। তাইত নিজের শক্তির পরিচয় পেল। বাচ্চার জন্য মা দোরে দাঁড়িয়েছিল। তারপর মা শুনল সব কথা। শুনে মা আনন্দে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। সত্যিই একটা ভালো কাজ করে এসেছে। মা ভাবছে, বাচ্চাকে কি পুরস্কার দেবে। খরগোশ এখনো কোন পুরস্কার পায়নি। সকাল বেলা উঠলেই সে বনে জঙ্গলে ঘুরে দেখবে, ছেলের জন্য কি পুরস্কার দেওয়া যায়।