রফিক সাহেব সেই ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে উঠেন। প্রতিদিন। এলার্ম ঘড়ির সাহায্য লাগে না। নিজের ভিতরের সেট করা অ্যালার্ম ই তাকে জাগিয়ে দেয়। একটুও এদিক সেদিক হয় না। ফজরের নামাজ মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করেন। এরপর তাবলিগ জামাতের সদস্যদের সাথে কিতাবে তালিমে বসেন। মিনিট দশেক সেখানে ব্যয় হয়। এরপর ফ্যাক্টরীতে গিয়ে লক ডিউটি। ৬ তলা বিল্ডিং এর প্রতি ফ্লোরের সামনে পিছনে দুটি করে তালার সীলগালা চেক করা। কাজের বুয়া সময়মত এসে রান্না করে দিয়ে যায়। ব্যক্তিগত সব কাজ সেরে ৮টার ভিতরেই অফিসে পৌঁছে যান।
আব্দুল হালিম সাহেব সিনিয়র স্টোরকিপার। এই ফ্যাক্টরীতে গত ২১ বছর যাবত রয়েছেন। সেই ইন্টার পাস করার পরে আর সুযোগের অভাবে পড়ালেখা চালাতে পারেননি। আবার নিজের বাবার সাথে মাঠে গিয়ে হালও ধরতে সংকোচ হয়েছে। ওনার বাবাও সেটা করতে দেননি। বলেছিলেন, ‘যেটুকু বিদ্যে অর্জন করেছিস, দ্যাখ চাকরি-বাকরি কিছু পাস কিনা।’ বাবার কথামত সেই যে চাকরিতে ঢুকলেন, আজো করছেন। তখন অবশ্য পোষাক শিল্পের একেবারে প্রথম দিক। অফিসে রফিক সাহেব তার সিনিয়র। দুজনে বসেন পাশাপাশি। রফিক সাহেবেরও তা প্রায় ১৪ বছর পার হল গত মাসে।
শিমুল বাবুর বাড়ি কারখানার মালিকের গ্রামেই। সে আর হেলাল একই গ্রামের। শিমুল বাবু স্টোরকিপার। হেলাল স্টোর সহকারি। হেলাল পরিবার নিয়েই অফিসের পাশে থাকে। এক ছেলেকে নিয়ে হেলালের ছোট্ট সংসার। কারখানা লাগোয়া একরুমের বাসায় মোটামুটিভাবে দিন কেটে যাচ্ছে ওর। শিমুল বাবু এবং সে লেবেল সেকশনটা দেখে থাকে। সুইং সেকশনের সাথে ওদের লিঙ্ক। সারাদিন লেবেল রিসিভ আর ইস্যু দিয়ে দিন শেষে ক্লোজিং বের করে দিয়েই তবে ওদের ছুটি। এরপরও বসের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। হেলালের ছেলেটা ৫টা বাজলেই বাবার অপেক্ষায় থাকে। মাকে কিছুক্ষণ পরপর বিরক্ত করে। শিমুলের অবশ্য সেই ঝামেলা নেই। অন্য তিনজনের সাথে মেসে থাকে সে। বাকীবিল্লাহ এবং ফরহাদ দুজনেই স্টোরকীপার। অ্যাক্সেসরিস ইন্সপেকশন করে ওরা দুজন। বাকীবিল্লাহ মেসে থাকলেও ফরহাদ পরিবার নিয়ে থাকে। ওর বাসা অবশ্য কারখানা থেকে বেশ দূরে। এজন্য প্রতিদিনই ফরহাদের অফিসে পৌঁছাতে লেট হয়। বসের চোখ রাঙ্গানি আর মাঝে মাঝে বকাও শুনতে হয়।
আকরাম হল বসের সব থেকে প্রিয়পাত্র। এই পুরো স্টোরের কোথায় কি আছে একমাত্র আকরামেরই নখদর্পণে। অন্যরা যার যার ইউনিটের খবর রাখলেও আকরাম সবকিছুই জানে। অবশ্য ওর পদবি লোডারের। আকরাম বিবাহিত এবং ওর বউ আর দুই শ্যালিকাকে নিয়ে থাকে। এক ছেলে গ্রামের বাড়ি আকরামের মায়ের কাছে থাকে। মাঝে মাঝে এখানে নিয়ে আসে। এভাবেই কেটে যাচ্ছে ওর জীবন। এই সাতজনকে নিয়ে স্টোরের বসের এই আলাদা ভুবন। তিনি নিজের বাসা থেকে প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করেন। অফিস থেকে ঘন্টাখানিক দূরত্বের পথ হলেও একেবারে ৮টা বাজার ৫ মিনিট আগে নিজের সীটে এসে বসেন। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছুই তার এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাতে পারে না।
বসের দুই মেয়ে। এই কারখানায় এই জুনে তার তিন বছর পুর্ণ হবে। কারখানাটির নাম নাইবা জানালাম। মানুষগুলোর পরিচয় দিয়েই গল্পটি শুরু করি। এই মানুষগুলো অনেকটা যন্ত্রের মতো হয়ে গেছে। ছুটি-ছাটা খুব কমই পায় এরা। আর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের বেতন নিয়ে তারা দৈনন্দিন ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়াগুলোকেই পুরণ করতে হিমশিম খেয়ে যায়। এরা মন-মানসিকতায় এক একজন অন্যজনের থেকে ভিন্ন। কিন্তু একটি দিক থেকে এদের ভিতর ১০০% মিল। এরা সবাই এক একজন বাবা। আর সন্তানের প্রতি তাদের রয়েছে অকৃত্তিম ভালবাসা। এই একটি দিকের মিল এই সাতজনকে ক্ষীণ এক সুতোর বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছে, যা প্রায় প্রতিদিনই ছিড়ে যায় যায়- আবার কিভাবে যেন আরো মজবুত হয়।
কোথায় যেন ধূপের গন্ধ… দমকা বাতাস নিমিষে দ্রুতধাবমান বাসের গতিতে চামড়াবৃত রক্ত পরিশুদ্ধকারী একটি জটিল মাংসপিন্ডকে রিফ্রেস করে দিলো। অখন্ড অবসর… ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলা টো টো সাজ্জাদের জটিল এক আইডিয়ার বিশ্লেষণরত ব্রেইনকেও সতেজ করে এই ঘ্রাণ। ডাইনে-বামে অহেতুক তাকিয়ে ঘ্রাণের উৎস খুঁজে দেখার অপচেষ্টা চালায় সে। তবে পরবর্তী ক’সেকেন্ডেই অন্যান্য আরো অনেক অতীত মৃত চিন্তার মতই এটাও ডিলিট হয়ে সোজা রিসাইকেল বিনে যায়গা করে নেয়। একটু আগের করা কাজটি ব্রেইনে এক সুখানুভূতির আবেশ এনে দিয়েছে। সেটাই হাঁটতে হাঁটতে উপভোগ করছে। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর জন্যই ওর নাম টো টো সাজ্জাদ হয়ে গেছে। বন্ধুমহল থেকে শুরু করে ওর বাসার সবাই- এমনকি শায়লা পর্যন্ত জানে।
শায়লা! নামটিই কেমন এক অদ্ভুদ প্রশান্তি এনে দেয়। সবসময়। চকিতে অন্য মানুষে পরিণত হয় সাজ্জাদ। ব্রেইনের একটু আগের সুখপ্রদ-বিকৃত আনন্দটুকু কীভাবে যেন ঢেকে যায় শায়লাকে মনে করার সাথে সাথে। মটর বাইকে করে এলাকায় অস্থির অলসতায় ঘুরে বেড়ানোর সাথে সাথে কিছু প্রয়োজনীয় কাজও সে করে। বাসায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখাশুনা করাটাই প্রধান কাজ। আর মাসের শেষে বাড়ির ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা, পানি-গ্যাস-বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করা- এ সবই সে করে। ওর বড় ভাই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। প্রতিমাসে একবার বাবা-মাকে দেখতে আসে। তাই বাবা-মার প্রতি ভালবাসার বড় ভাই এর অংশটুকুও সে প্রতিদিন নিজের মত করে ছড়িয়ে দেয়।
এর মাঝে নিজের বিকৃত মস্তিষ্কের চাহিদাটুকুও পূরণ করতে হয়। বিকৃত কথাটা বলা একটুও ভুল হচ্ছে না। সাজ্জাদের খুব প্রিয় একটি কাজ হচ্ছে, এলাকায় নতুন কেউ এলে ইচ্ছেকৃত সে ভুল ঠিকানা দেখিয়ে দেয়। আর নতুন মানুষটি যখন এক গলি থাকে অন্য গলিতে ঘুরপাক খায়, সে বাইকে করে দূর থেকে দেখে এই আনন্দটুকু লাভ করে। আলমগির মুন্সীর চায়ের দোকানের পাশে ওর বাইকটা স্ট্যান্ড করা। বাইকের ঘাড়ের লক খুলে স্টার্ট বাটন পুশ করে আশপাশ সচকিত করে একটা ইউ টার্ণ নিয়ে বেরিয়ে পড়া সুদর্শণ সাজ্জাদ মুহুর্তে টো টো সাজ্জাদে পরিণত হয়। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুদ হাসি।
এইমাত্র নতুন একটি আইডিয়ার জন্ম হয়েছে ওর উর্বর মস্তিষ্কে। শায়লা অনেকক্ষণ ধরে রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে। যাও বা পাচ্ছে সবই ওর উল্টো পথের। এই ভরদুপুরে সবাই যার যার বাসায় কিংবা নিরাপদ কোনো ছায়াঘেরা যায়গায় যেতে চাচ্ছে। বান্ধবী রিতার বাসায় এসে ফেঁসে গেলো শায়লা। একটা অটো নিয়ে চলে যাবে কিনা ভাবল একবার। দূর থেকে শায়লাকে দেখছে সাজ্জাদ। ও যেখানে আছে সেখান থেকে শুধু শায়লাকেই দেখা যাবে। শায়লা ওকে সেইভাবে দেখতে পাবেনা। বাইকের লুকিং গ্লাস দিয়ে বিপরীত দিক থেকে শায়লাকে দেখছে সে।
শায়লা যদিও এদিকে তাকায় তবে শুধু পিছনের অংশই দেখতে পাবে। পিছন থেকে দেখেও কি সে চিনবে সাজ্জাদকে? এই মেয়েটিকে দেখলেই কেমন যেন হয়ে যায় সাজ্জাদ। ওদেরই ভাড়াটিয়া। বৃদ্ধা মা এবং ছোট এক বোনকে নিয়ে থাকে ওরা। তৃতীয় তলার ডান পাশের ফ্ল্যাটে। একেবারে সাজ্জাদদের সরাসরি নীচের ফ্ল্যাট। শায়লার বড় এক ভাই আছেন। সে ঢাকায় এক পোশাক কারখানায় ভালো পোষ্টে চাকরি করে। সেখানেই দুই মেয়ে আর বউকে নিয়ে থাকে। তবে মাকে ও বোনদেরকে দেখার জন্য প্রতি মাসে একবার আসবেই। যতই কাজ থাকুক না কেন। নিজের ফুল ফ্যামিলি নিয়ে আসে।
সেই ক’টা দিন শায়লার খুব আনন্দে কাটে। দিন না বলে ক’টা রাত বললেই বেশী মানানসই হবে। ভাইয়া তো বৃহষ্পতিবার এসে আবার শুক্রবার রাতে চলে যায়। তবে ভাবী ও বাচ্চারা কখনো দু-তিনদিন থেকে যায়। এই ভাড়া বাসাটি তখন শায়লার কাছে নিজের বাড়ির মত শান্তি এনে দেয়। সেই যে বাবা বেঁচে থাকতে ওদের গ্রামের বাড়িতে সবাই মিলে একসাথে থাকার সময় যা অনুভব করত। আসলে পরিবারের সবাই এক সাথে থাকার আনন্দের সাথে অন্য কোনো কিছুর তুলনাই হয় না।
গরমে ঘেমে অস্থির হয়ে আছে। বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু স্টপেজে কোনো বাসও আসছে না সেই অনেকক্ষণ হয়ে গেলো। শায়লা বিরক্তির একেবারে চরমে পৌঁছে গেলো। ঠিক তখনই উল্টো দিকে সাজ্জাদের পিছনটা সে দেখতে পায়। এবং চিনে ফেলে। মেয়েদের ভিতরে অনেক অদ্ভুদ জিনিস আছে। একইসাথে এদের অতিরিক্ত একটি ইন্দ্রিয় রয়েছে। অদৃশ্য কিছু অতি সহজেই এরা অনুভব করতে পারে।
এতেই রিলাক্সে মাথার ভিতর ২/৩টি ব্যথাহীন চিন্তা কাজ করল। মনে মনে হিসেব করল, ‘কোথাও যাচ্ছিল। ঠিক আছেই!’ এরপর খুব সামান্য একটা সোজা পথ ধরে তাকিয়ে থাকা ভাবলো, ‘এতো কি বড় ব্যাপার? মনে হয়… আরে তাই তো!’