এপিটাফ

অতঃপর- দিনমান আপনাকে মেলিয়া ধরিয়া রাখিতে রাখিতে ক্লান্ত হইয়া অবশেষে আঁধারের সহিত মিতালি করিতে সূর্য চুপি চুপি কি যেন বলিতে লাগিলো। বড় দালানটির দক্ষিন পার্শ্বের আমবাগানে দলবদ্ধ হইয়া রাজ্যের পক্ষিকুল কলরব করিতে করিতে রাতের অভিসারের জন্য প্রস্তুতি লইতে ব্যাকুল। কাঁজল দীঘিটির নামকরণের ইতিহাস লইয়া কিছুটা বিতর্ক থাকিতে হয়তো পারে কিন্তু উহা দেখিতে বড় মনোরম! প্রায় দশ বিঘে জমি লইয়া এই দীঘির অবস্থান। মৎস উৎপাদিত হয় বিপুল পরিমাণে।

মূল দালান হইতে দীর্ঘ একটি সিঁড়ি দিঘী’র এক প্রান্তে নামিয়া গিয়াছে। একমাত্র চৌধুরী বাড়ির রমনীগণ’ই উক্ত সিঁড়িটি ব্যাবহার করিয়া থাকেন। এক্ষনে মস্ত দিঘী’র বিপুল জলরাশি একেবারে শান্ত, শুধু সেই সিঁড়িতে বসিয়া চাকরশ্রেনীর কেহ কিছু ধুইতেছে হেতু তাহারই যা একটু কম্পন ওই সিঁড়িটিকে ঘিরিয়া ঘুরিতেছে। পুরো চৌধুরী বাড়ি জুড়িয়া চাপা একটি স্তব্ধতা ভয়াবহ ভাবে চাঁপিয়া বসিয়াছে। বিড়াল-কুকুরগুলি কুন্ডুলি পাকাইয়া উহার মধ্যে মুখ গুঁজিয়া কেমন একরকম করিয়া যেন মাটিতে শুইয়া রহিয়াছে।

টানা বারান্দাগুলোয় ইতোমধ্যে কেউ হ্যাজাক বাতি জ্বালাইয়া দিয়া গেছে। আত্মাহুতিতে বিশ্বাসী এমন রাজ্যের পোঁকা-মাকড় হ্যাজাকের শিখাটিকে ঘিরিয়া বন্দনায় রত। বিশ বিঘে জমি’কে ঘিরিয়া চৌধুরী’দের বাটি’খানির অবস্থান মধ্যিখানে। প্রাসাদসম বাড়িখানিতে ওই কয়েকটি হ্যাজাকের আলো অন্ধকারকে যেন আরও বাড়াইয়া দিয়াছে। বাড়ির ভিতর মহল হইতে মৃদু অথচ করুণ একটি আওয়াজ কর্ণগত হইলো।

সেই মৃদু অথচ করুণ আওয়াজের মাঝে এমন একটি ব্যাপার ছিল, যাহা কিছুক্ষনের জন্যে হইলেও ‘কি যেন হইয়াছে, কি যেন হইয়াছে’ এরুপ একটি ভাবনায় ভাবাইতে যে কাউকে বাধ্য করিবে। চার পুরুষ ধরিয়া জমিদার চৌধুরী’দের সহায় সমত্তি এখনও নেহায়েত কম নয়। তাই আশ-পাশের মানুষ সবসময় তটস্থ হইয়া থাকে। এমতাবস্থায় তাহাদের খুদ্র মস্তিস্কে জমিদার বাড়ির অন্দর মহলের এরুপ আওয়াজ শুনিয়া স্থির কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছনো নিতান্তই অসম্ভব ব্যাপারই বটে।

তবুও কিছু মানুষ একত্র হইয়া নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করিয়া কি যেন বলা-বলি করিতেছে। তাহারও এক প্রহর পর মধ্য আসমানে একখানি পূর্ণচন্দ্র হাহাকার ভরা একরকমের মোহনীয় আলোয় সমস্ত গ্রামখানিকে ভাসাইয়া লইয়া যাওয়ার উপক্রম করিতে লাগিলো! ভ্রম হয় এই ভাবিয়া, দুধের চাঁদর বিছায়েছে কেহ পুরো প্রকৃতি জুড়িয়া। এক্ষনে কাজল দিঘীটি’কে দেখিয়া হঠাৎ করিয়াই যে কেউ ভাবিয়া বসিতে পারে যে, তরল জল কেমন করিয়া জানি তরল দুগ্ধে রুপান্তরিত হইয়েছে!

এমতবস্থায় দুগ্ধবত জোছনার আলোয় দূর হইতেও দেখিলে বোঝা যায়, চৌকোণ বিশিষ্ঠ একখানি জিনিষ চকচক করিতেছে। নিকটে গেলে দেখা যায় উহা ধবধবে সাদা মার্বল পাথড়ের গড়া একটি ‘এপিটাফ’! বড় চৌধুরী’র কবরের উক্ত এপিটাফে দু’খানি চরণ লেখা আছে এরুপ- ‘সারাটি জীবন শুধু খুঁজিয়াই গিয়াছি কিন্তু পাইলাম না কিছুই। চলিলাম অনন্তকালের মহাযাত্রায়। দেখি, এই যাত্রায় পাইতেও পারি।’

►অদ্ভুতুরে◄

►অন্ধকারের যাত্রাসঙ্গি◄

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *