একটা আষাঢ়ে গল্প-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-তৃতীয় অংশ

মাথার উপরে পাখি ডাকিতে থাকে , বাতাস অঞ্চল ও অলক উড়াইয়া হূহু করিয়া বহিয়া যায় , তরুপল্লব ঝর্‌ঝর্‌ মর্‌মর্‌ করে এবং সমুদ্রের অবিশ্রাম উচ্ছ্বসিত ধ্বনি হৃদয়ের অব্যক্ত বাসনাকে দ্বিগুণ দোদুল্যমান করিয়া তোলে । একটা বসন্তে তিনটে বিদেশী যুবক আসিয়া মরা গাঙে এমনি একটা ভরা তুফান তুলিয়া দিল ।

রাজপুত্র দেখিলেন , জোয়ার-ভাঁটার মাঝখানে সমস্ত দেশটা থম্‌থম করিতেছে — কথা নাই , কেবল মুখ চাওয়াচাওয়ি ; কেবল এক পা এগোনো , দুই পা পিছনো ; কেবল আপনার মনের বাসনা স্তূপাকার করিয়া বালির ঘর গড়া এবং বালির ঘর ভাঙা । সকলেই যেন ঘরের কোণে বসিয়া আপনার অগ্নিতে আপনাকে আহুতি দিতেছে , এবং প্রতিদিন কৃশ ও বাক্যহীন হইয়া যাইতেছে। কেবল চোখ-দুটা জ্বলিতেছে , এবং অন্তর্নিহিত বাণীর আন্দোলনে ওষ্ঠাধর বায়ুকম্পিত পল্লবের মতো স্পন্দিত হইতেছে । রাজপুত্র সকলকে ডাকিয়া বলিলেন , “ বাঁশি আনো , তূরীভেরী বাজাও , সকলে আনন্দধ্বনি করো , হরতনের বিবি স্বয়ম্বরা হইবেন । ” তৎক্ষণাৎ দহলা নহলা বাঁশিতে ফুঁ দিতে লাগিল , দুরি তিরি তূরীভেরী লইয়া পড়িল । হঠাৎ এই তুমুল আনন্দতরঙ্গে সেই কানাকানি, চাওয়াচাওয়ি ভাঙিয়া গেল । উৎসবে নরনারী একত্র মিলিত হইয়া কত কথা , কত হাসি , কত পরিহাস । কত রহস্যচ্ছলে মনের কথা বলা , কত ছল করিয়া অবিশ্বাস দেখানো , কত উচ্চহাস্যে তুচ্ছ আলাপ । ঘন অরণ্যে বাতাস উঠিলে যেমন শাখায় শাখায়, পাতায় পাতায়, লতায় বৃক্ষে, নানা ভঙ্গিতে হেলাদোলা মেলামেলি হইতে থাকে , ইহাদের মধ্যে তেমনি হইতে লাগিল । এমনি কলরব আনন্দোৎসবের মধ্যে বাঁশিতে সকাল হইতে বড়ো মধুর স্বরে সাহানা বাজিতে লাগিল । আনন্দের মধ্যে গভীরতা , মিলনের মধ্যে ব্যাকুলতা , বিশ্বদৃশ্যের মধ্যে সৌন্দর্য , হৃদয়ে হৃদয়ে প্রীতির বেদনা সঞ্চার করিল । যাহারা ভালো করিয়া ভালোবাসে নাই তাহারা ভালোবাসিল , যাহারা ভালোবাসিয়াছিল তাহারা আনন্দে উদাস হইয়া গেল । হরতনের বিবি রাঙা বসন পরিয়া সমস্তদিন একটা গোপন ছায়াকুঞ্জে বসিয়া ছিল । তাহার কানেও দূর হইতে সাহানার তান প্রবেশ করিতেছিল এবং তাহার দুটি চক্ষু মুদ্রিত হইয়া আসিয়াছিল ; হঠাৎ এক সময়ে চক্ষু মেলিয়া দেখিল , সম্মুখে রাজপুত্র বসিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে ; সে অমনি কম্পিতদেহে দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া ভূমিতে লুণ্ঠিত হইয়া পড়িল । রাজপুত্র সমস্তদিন একাকী সমুদ্রতীরে পদচারণা করিতে করিতে সেই সন্ত্রস্ত নেত্রক্ষেপ এবং সলজ্জ লুণ্ঠন মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলেন ।

রাত্রে শতসহস্র দীপের আলোকে , মালার সুগন্ধে , বাঁশির সংগীতে , অলংকৃত সুসজ্জিত সহাস্য শ্রেণীবদ্ধ যুবকদের সভায় একটি বালিকা ধীরে ধীরে কম্পিত চরণে মালা হাতে করিয়া রাজপুত্রের সম্মুখে আসিয়া নতশিরে দাঁড়াইল । অভিলষিত কণ্ঠে মালাও উঠিল না , অভিলষিত মুখে চোখও তুলিতে পারিল না । রাজপুত্র তখন আপনি শির নত করিলেন এবং মাল্য স্খলিত হইয়া তাঁহার কণ্ঠে পড়িয়া গেল । চিত্রবৎ নিস্তব্ধ সভা সহসা আনন্দোচ্ছ্বাসে আলোড়িত হইয়া উঠিল । সকলে বরকন্যাকে সমাদর করিয়া সিংহাসনে লইয়া বসাইল । রাজপুত্রকে সকলে মিলিয়া রাজ্যে অভিষেক করিল ।
সমুদ্রপারের দুঃখিনী দুয়ারানী সোনার তরীতে চড়িয়া পুত্রের নবরাজ্যে আগমন করিলেন । ছবির দল হঠাৎ মানুষ হইয়া উঠিয়াছে । এখন আর পূর্বের মতো সেই অবিচ্ছিন্ন শান্তি এবং অপরিবর্তনীয় গাম্ভীর্য নাই । সংসারপ্রবাহ আপনার সুখদুঃখ রাগদ্বেষ বিপদসম্পদ লইয়া এই নবীন রাজার নবরাজ্যকে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল । এখন, কেহ ভালো , কেহ মন্দ , কাহারো আনন্দ , কাহারো বিষাদ — এখন সকলে মানুষ । এখন সকলে অলঙ্ঘ্য বিধানমতে নিরীহ না হইয়া নিজের ইচ্ছামতে সাধু এবং অসাধু ।

আরো পড়তে পারেন...

রান্না করলেন রাজপুত্র — যশোধরা রায়চৌধুরী

রাজা, রানি, রাজপুত্র, রাজকন্যা কে নিয়ে এক সুখের সংসার। কোন গোলমাল নেই,আবার গোলমাল আছেও বলা…

অধ্যাপক-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-তৃতীয় পরিচ্ছেদ

একদিন অপরাহ্নে স্টেশনে না গিয়া অলসভাবে বাগানবাড়ির ঘরগুলি পরিদর্শন করিতেছিলাম। আবশ্যক না হওয়াতে ইতিপূর্বে অধিকাংশ…

অধ্যাপক-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-চতুর্থ পরিচ্ছেদ

ভবনাথবাবুর বাড়ি আমি এখন নিত্য অতিথি। পূর্বে চা জিনিসটাকে অত্যন্ত ডরাইতাম, এক্ষণে সকালে বিকালে চা…