এ যদি পাহাড় হয়

চীনদেশের গল্পের নাম ছিল “সূর্যের কাছে যাওয়া” । দেশে দেশে কত না প্রমিথিউস আছে। সব্বারই তো আগুন লাগে ! সব্বাই তো শীতের সময় হাত সেঁকতে চায়, পাহাড়ি গাঁয়ের চুল্লীর চারধারে বসে। সে তোমার যদি অন্য উপায় থাকে তুমি আমাদের বোলো না। তুমি যদি কাউকে কম্বল পেলে , তো ওই অন্ধকার কুঁড়েয় যাও গে যাও । আমরা এখন লাল পাহাড়ের দৈত্যের গল্প শুনবো । রুটির ফুলকি ওড়ে , আটার সোঁদা সোঁদা গন্ধ ভেসে আসে । আর প্রেমিকের সামনে উঠে দাঁড়ায় হাড়ের পাহাড় । সে যে কত্ত বড়ো , কত্ত উঁচু । তার ওপার থেকে মেহুং শুনতে পাচ্ছে না তার মানুষের ডাক ।
কাগজের ঘোড়া খড়বড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় । সেই সব কটা কাগজ যারা প্রেম পত্তর লিখে রেখেছিল বুকের উপরে । তারা বলে ওঠে আমরা চড়ব ওই পাহাড় । হুয়াং উঠে বসে ঘোড়ার পিঠে । তার পায়ের তলায় চুরমার হয়ে যায় হাড়ের পাহাড় । সফেদ হয়ে যায় রক্তের নদী । পাহাড়ের নীচে বসে কাঁদছিল মেহুং । উঠে দেখে পাহাড় আর নেই । শুধু আলিঙ্গন আছে । ঘোড়াটি ফিরসে কাগজ হয়ে লুটিয়ে পড়েছে সোহাগে । পাহাড় তুমি কই ? পাহাড় পেরিয়ে তো দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “দুরন্ত ঈগল” এর জুরা চলেছে প্রাণের জয়নাবের খোঁজে । দুর্দান্ত ডাকাত তাগাই এর খোঁজে ! বাসমাচি ডাকাত পালায় উপত্যকা দিয়ে ।দুরন্ত সোনালী ঈগল জুরা যায় পাহাড়ের শিখরে শিখরে । ওই যেখানে বরফের উপর রোদ ঝলকিয়ে অন্ধ করে দেবে মানুষের চোখ। উত্তুঙ্গ পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ । সে এক চিরন্তন চ্যালেঞ্জ । চড়বে কী ? আসবে ওইইইইই উপরে ? ওখানে পাকদণ্ডী বেয়ে বেয়ে ঝরনার জল আনতে হয় । ওখানে চাষ করতে হয় জমি কেটে কেটে ধাপে ধাপে। পাহাড়ি মানুষ , ঝঝকে ধারালো তলোয়ার । তাকে পাহাড় সমস্তক্ষণ পাথরে সানাচ্ছে যে ! ক্লেদ নেই, অবসাদ নেই । জীবনের প্রতি ধাপে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ আর রাত্রিবেলায় জীবনের ভিতর থেকে উঠে আসা ধুন ! আমি আর তুমি তবু সমতলে ছিলাম। ওই বড় বড় মাঠ , আর তার মধ্যে হঠাৎ জঙ্গল । ওই আকাশ উপুড় হয় বুকের উপরে । আর দৌড়োনোর কি খিদে , কি তৃষ্ণা ! মাঠ হল এক পুকুর দৌড়োবার জল । আমরা চুমুকে চুমুকে খাই । তারপর জঙ্গলের ছায়ায় খিলখিলিয়ে হাসি । তোমার নীচে রোদ্দুরের ছায়া , তাতে ঘাসের বিছানা ।
তুমি আমি স্বপ্ন দেখি খুউউউব । ওই মাঠ পেরিয়ে যাবার স্বপ্ন । ওই দিগন্ত ছাড়িয়ে যাবার স্বপ্ন । আমাদের সন্তান আদুল গায়ে হলুদ রোদের মাঠে খেলে খেলে ফেরে । আমার স্তনের উদাসীন দুধ খায়। তোমার অন্যমনা হাতে মাথা রাখে। আস্তে আস্তে শুধু স্বপ্নই দেখি, আর তোমাকে দেখি না। তুমি আমাকে দেখো না আর । কেমন খনির স্বপ্ন দেখো ! যেখানে কয়লা , যন্ত্রণায় হীরে হল । হীরে হল গিয়ে একটা স্বচ্ছ ভাব । ওই অত নিপীড়ন , তার পরে কাঠ বলল আমি নই । কয়লা বলল আমি নই। ওই অত আগুন , অত চাপ, আচ্ছা দেখ আমরা আর ছায়া রাখবো না । কোন গোপন অন্ধকার , কোন গভীর কথা । তারা হীরে হয়ে গেল । তাতে আলো খালি আসে যায়। কেউ তাকে ধরে না । কি আলো কি আলো । তুমি হীরের স্বপ্ন দেখো । আমি মুক্তোর স্বপ্ন দেখি । ওই ঝিনুকের পেটে খচখচ । চোখে মুখে বালি । আহা ঝিনুকের আঠালো কষ্ট গোল করে বাঁধা । তাতে আলো ঢুকবে না। সাদা সাদা । তুমি আমার হাতে টান দাও । চলো খনির গভীরে । আমি টান দিই । চলো সমুদ্রের বুকে । টানতে টানতে কবে হাত ছিঁড়ে গেল , খুব যন্ত্রণা হলো । খেলার মাঠে গাছের ছায়ায় দুধের শিশুকে ভুলে যায় দুষ্মন্ত , শকুন্তলাও ! আমরা বললাম তবে চলি ! তবে চলি ! স্বপ্নের শেষে ফের ফিরে আসব এখানে প্রান্তরে । প্রতিধ্বনি উঠলো , তবে চলি ! তবে চলি ! ওমা একী ! মাঠ তো প্রতিধ্বনি জানতো না। জঙ্গল মর্মর শব্দ জানে , কিচিরমিচির জানে , প্রতিধ্বনি না । আমাদের মাঝখানে কোথা থেকে বিশাল পাহাড় , মাথা তুলে আছে । পিয়ের গিণ্ট তার মাথার উপরে কুঁড়ে ঘরে, কবে তার নতুন বউকে রেখে চলে গিয়েছিল ! বলেছিল- “তবে চলি” ! সে মেয়েটি নীল চোখ নিয়ে শুধু কাঁদে । আর পাহাড়ের বুকে বসে থাকে । ট্রলেদের রাণী , যার মাথাখানা গোরুদের মত আর হৃদয় সবুজ, হিংসের রঙে সেও পিটার কে ভালোবেসেছিল , সেও দেখে যায় বউটাকে । মেয়েটার চোখ যেই অন্ধ হয়ে গেল, চুল বরফের মত খুব সাদা , পিয়ের ফেরত এলো রাজা হয়ে কোন দেশ থেকে ! বউয়ের কোলে মাথা রেখে ভাবল সুখ সুখ পাখি – এইখানে ছিল । প্রতিধ্বনি শুধু পাহাড়ের ! দেবরাজ জিউস তো মাঝে মাঝে প্রণয়ের শখে , নেমে আসতেন কিথাইরন পাহাড়ের বুকে । হেরা তাঁর স্বামীর পিছু পিছু এসে ধরে ফেলেন আর কী ! ইকো নামে পরী , যাকে আমরা ডাকি প্রতিধ্বনি বলে , কথার জাল বুনে হেরাকে আটকে রেখেছিল । জিউস তো ফিরে গেলেন, প্রতিধ্বনি হেরার যন্ত্রণায় অভিশপ্ত হলো ! সে খালি পুনরাবৃত্তি করে , পাহাড়ে পাহাড়ে ।
নিজের মনের ভার কথার আধারে , রাখতে পারবে না আর, এই অভিশাপ । আমাদের “তবে চলি ” সেই অভিশাপে , অভিশপ্ত ছিল । আমরা নার্সিসাসের মতন , নিজেদের স্বপ্নের ছায়ায় ঘুরে যাই ঘুরে যাই । কিথাইরন পাহাড় বসে থাকে, দুজনের মাঝখানে । আমরা যদি শুধু বলতাম “ভালবাসি ভালবাসি”। তাহলে প্রতিধ্বনি অন্ততঃ তাই তো ফেরাতো ! এখন তো দুজনেই দুইদিকে । তোমার হীরেয় খুব আলো । আমার মুক্তো আলো রোখে । আর আমরা সেই কুঁড়ে ঘরটাকে খুঁজতে এসেছি। হীরে আর মুক্তোর বোঝা , টাকা আর কড়িদের বোঝা অবান্তর । কিন্তু পায়ে জোর নেই ! খনি খুঁড়ে , সাঁতারে ডুবুরি দিন গেলো । হঠাৎ পাহাড় চুড়ো ছোঁয়া গুহার ছায়ার মধ্যে দেখি উজ্জ্বল যুবক এক উজ্জ্বল যুবতীর চুলে , পাহাড়িয়া ফুল গুঁজে দিল । সে যুবকটি চেনা চেনা , আমাদের প্রেমের সন্তান । চোখ কচলে দেখি , ন্যাড়া কিথাইরন পাহাড়ের গায়ে কত গাছ । কত ফুল ! পিয়ের গিণ্টের কুঁড়ে নতুন পাতার ছাওয়া ঢাকা । তার কাছে বেড়ার উপরে সুখ-সুখ পাখি এক পাহাড়িয়া ধুনে শিস দিলো । আমরা আর নাই বা চড়লাম। সন্তান জীবনের সেতু ।
তার কুঁড়ে শিশুর কল্লোলে খিলখিল হেসে ওঠে । আমরা আর নাই বা চড়লাম ! তুমি ওই দিকটাতে পিঠ রেখে বোসো । আমি এইখানে একটু ঠেস দিয়ে বসি । মাঝে মাঝে যেই বলি “ভালবাসতাম ভালবাসি !” প্রতিধ্বনি সেইটুকু নিয়ে হাসে, খুব খেলা করে। পাহাড় ভাবগ্রাহী , দেবতার মতো , জীবনের মতো – যার যার অভীষ্ট রূপে আসে । প্রাণের ঊষ্ণতায় – বরফ গললেই জল , দুরন্ত ঝর্ণা !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *