
গত ২০ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তানের বাগরাম বিমান ঘাঁটিতে মার্কিন সেনারা তিনশ’র বেশী কোরআন পুড়িয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে আফগানিস্তানের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভের সময় ৩২ জন মানুষ নিহত হয়েছে। মার্কিন সেনাদের কোরআন অবমাননার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগে তারা ইরাকের রেজওয়ানিয়া এলাকায় প্রশিক্ষণ গ্রহণের সময় পবিত্র কোরআনকে লক্ষ্য বানিয়ে তাতে গুলি করেছিল। কিউবা’র গুয়ান্টানামো বে’র বন্দীশিবিরেও মার্কিন সেনারা পবিত্র কোরআন অবমাননা করেছিল। কেবল মার্কিন সেনারাই নয়, ২০১০ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি এলাকায় কিছু হিংস্র ও নিষ্ঠুর লোক কট্টরপন্থী এক খ্রিস্টান পাদ্রীর নির্দেশে পবিত্র কোরআনে অগ্নিসংযোগ করেছিল। জেরুজালেমেও উগ্র ইহুদিরা কোরআন শরীফে আগুন লাগায়।
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, দু’বছর আগে বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও কোরআনের শুদ্ধতা দাবিতে রিট করা হয়েছিল। কোরবানি নিয়ে কোরআনের শুদ্ধতা দাবি করে রিটটি করেন বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্ট দেব নারায়ণ মহেশ্বর। এসব লোককে উদ্দেশ্য করেই মহান আল্লাহ সূরা তাওবার ৩২ নম্বর আয়াতে বলেছেনঃ ‘তারা চায় মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে কিন্তু আল্লাহ নিজের নূরকে পরিপূর্ণ করা ছাড়া আর কিছুই চান না, তাতে কাফেররা যতোই অসন্তুষ্ট হোক না কেন।’
কেবল কোরআন অবমাননাই নয়, বিশ্বমানবতার মহান শিক্ষক হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অবমাননাও গত কয়েক বছরে অনেক বেড়ে গেছে। এ মাসেই ঢাকার কালিগঞ্জে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ(সা.)-কে অবমাননা করে নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। গত বছরের ১৪ জুলাই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার জিটি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক শঙ্কর বিশ্বাস দশম শ্রেণীর ক্লাসে দাড়ি রাখা নিয়ে সমালোচনাকালে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর অবমাননা করেন। একই বছর ২৬ জুলাই ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক মদন মোহন দাস মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এবং পবিত্র হজ নিয়ে কটূক্তি করেন। একইভাবে মানিকগঞ্জে বিশ্বজিত মজুমদার কর্তৃক রাসূল (সা.) এর জন্ম এবং পবিত্র কোরআন নিয়ে কটূক্তি করেন।
শুধু তাই নয়, বাগেরহাটের এক হিন্দু কাবা শরিফের হাজরে আসওয়াদকে শিব লিঙ্গের সঙ্গে তুলনা করে। খুলনার পাইকগাছায় আরেক হিন্দু মহান আল্লাহ সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেয়। এছাড়া, নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ হাইস্কুল গেটের কোরআনের আয়াত সংবলিত সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলা, বাগেরহাটের কচুয়ায় এক হিন্দু কর্তৃক মহান আল্লাহর ছবি ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্কন করা, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে রাসূল (সা.) সম্পর্কে হিন্দু কর্তৃক চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শন এবং ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে এক হিন্দুর (সা.) প্রতি কটূক্তিসহ বিভিন্ন মহল থেকে এ ধরনের ইসলামবিরোধী বক্তব্য স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এসব ঘটনার প্রতিবাদ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে ইসলাম অবমাননাকারীদের কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়নি। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো-ইসলাম অবমাননা, রাসূলের প্রতি কটূক্তির ঘটনা যুগ যুগ ধরেই চলে এসেছে। রাসূলের জীবদ্দশায়ও এসব ঘটনা ঘটেছে। কাফেররা রাসূলকে অবমাননা করার পাশাপাশি তাকে হত্যার চেষ্টাও করেছে। এমনি রাসূলের ওফাতের পর তার লাশ নিয়েও ষড়যন্ত্র করেছে ইসলাম বিরোধীরা।
রংধনু আসরে এ সম্পর্কেই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা প্রচার করেছি। অনেকদিন আগের কথা। সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী তখন মিশর ও সিরিয়ার শাসনকর্তা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ ও সাহসী একজন শাসক। একদিন শেষ রাতে সুতান এক অভিনব স্বপ্ন দেখলেন।
তিনি দেখলেন, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নীল বর্ণের চোখবিশিষ্ট দুই লোককে দেখিয়ে বললেন, ‘নুরুদ্দীন! এই দুষ্ট লোকদের ষড়যন্ত্র থেকে আমাকে রক্ষা কর।’ এই স্বপ্ন দেখে সুলতানের ঘুম ভেঙে ড়েল। তিনি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অজু করে তাহাজ্জুদ নামায পড়ে আবার শুয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। বিছানা ছেড়ে অজু করে নামায পড়লেন তিনি। এরপর দরুদ শরীফ পড়ে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর একই স্বপ্ন দেখলেন সুলতান। এবার সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গেলেন তিনি। বিছাড়া থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। উজীর জামালুদ্দীনকে ডেকে পাঠালেন। শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে ছুটে এলেন জামালুদ্দীন। ব্যাপার কি বুঝতে না পেরে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন সুলতানের দিকে। সুলতান এবার তার স্বপ্নের কথা খুলে বললেন।
সব শুনে উজির বললেন, ‘জাঁহাপনা! মোটেও দেরি করবেন না। আপনার এক্ষুনি মদীনা শরীফ যাওয়া উতি। নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তাই নবীজী আপনাকে ডাকছেন। তাড়াতাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিন। আর এই স্বপ্নের কথা কাউকে বলবেন না।’ সেই রাতেই সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী মদীনার পথে রওয়ানা হলেন। সঙ্গে নিলেন উজীর জামালুদ্দীন আর কুড়িজন সৈন্যের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী। একটানা ষোলদিন পথ চলার পর তারা মদীনায় পৌছলেন। উজীর জামালুদ্দীন ঘোষণা করে দিলেন যে, সুলতান নুরুদ্দীন রাসূলের রওজা শরীফ জিয়ারত করতে এসেছেন। তিনি মদীনার জনগণের সঙ্গে দেখা করবেন এবং সবাইকে উপহার দেবেন। দাওয়াত পেয়ে সবাই এল সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে। সুলতান সবার সঙ্গে হাত মেলালেন এবং উপহার দিলেন। উপহার দেয়ার সময় সুলতান সেই নীল চোখওয়ালা লোক দু’টিকে খুঁজছিলেন। কিন্তু যারা সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তাদের মধ্যে সেই নীল চোখের লোক দু’টি নেই!
সুলতান জানতে চাইলেন, ‘এমন কেউ কি বাকি আছে যারা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি?’ লোকেরা বলল, ‘মদীনার সকলেই আপনার কাছে এসেছে, কেউ বাদ পড়েনি। তবে দু’জন বিদেশী দরবেশ আছেন। তারা মসজিদ ছেড়ে কোথায় যান না। কারও কাছ থেকে কোনো দান-খয়রাতও নেন না। বরং তারাই অভাবি মানুষদেরকে মুক্ত হস্তে দান করেন। ওই দুই বুজুর্গ ব্যক্তিই আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি।’ এ কথা শুনে সুলতান মনে মনে চমকে উঠলেন। তার চেহারা কঠিন হয়ে উঠল। তিনি নির্দেশ দিলেন সেই দুই বিদেশীকেও হাজির করতে। সুলতানের নির্দেশে সেই দুই দরবেশকেও হাজির করা হলো। তাদের দেখেই সুলতান চমকে উঠলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন-এরাই তো স্বপ্নে দেখা নীল চোখের মানুষ। এরাই রাসূলকে কষ্ট দিচ্ছে। লোক দুটোকে দেখে সুলতান মনে মনে খুব রেগে গেলেন। কিন্তু তা কাউকে বুঝতে দিলেন না। ধীরকণ্ঠে তাদের পরিচয় জানতে চাইলেন।
তাদের একজন নম্রভাবে জানালো- আমরা পশ্চিম দেশীয় মুসলমান। হজ্ব করতে এসেছিলাম। হজ্বের পর মদীনায় এসেছি হুজুরের রওজা জিয়ারত করতে। সুলতান বললেন, শুনলাম তোমরা অনেকদিন থেকেই মদীনা অবস্থান করছো? ভণ্ড দরবেশদের অপরজন বলল- আপনি ঠিকই শুনেছেন। আসলে জিয়ারতে এসে রওজাপাকের মহব্বতে আটকা পড়ে গেছি। তাই প্রিয় নবীর পাশে থেকে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই। এ সময় সুলতান ওদের বাসস্থান সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। জানা গেল-রওজা শরীফের কাছেই একটি মুসাফিরখানা। ওখানেই নিরিবিলি একটি কক্ষে বাসা করে ওরা। সব জানার পর সুলতান হঠাৎ ওদের বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন।
সুলতানের কথা শুনে কেমন যেন ভড়কে গেল লোক দুটি। তাদের নীল চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে উঠল।
তারা হেসে বলল, জাঁহাপনা কি আমাদের ওপর রাগ করেছেন দাওয়াতে আসিনি বলে? যদি তাই হয় তাহলে আমরা ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এ রকম ভুল আর জীবনে হবে না। সুলতান ওদের কথায় কান দিলেন না। তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সোজা মুসাফিরখানার সেই কক্ষে এসে হাজির হলেন তিনি। ঘরে ঢুকে সন্দেহ করার মত কিছুই চোখে পড়ল না সুলতানের। দু’একটা সাধারণ আসবাবপত্র ছাড়া আর বই-পুস্তক ছাড়া আর কিছুই নেই ঘরে। বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন সুলতান। কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তার মন বলছে এই ঘরেই কিছু একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। মহানবীর দেখানো স্বপ্ন তো আর মিথ্যা হতে পারে না ! এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সুলতানের নজর গেল ঘরের এক কোণে যেখানে একটি মাদুরের ওপর সুন্দর করে বিছানো আছে একটি জায়নামাজ।
সুলতান সেখানে গিয়ে টান দিয়ে মাদুরটা উঠিয়ে ফেললেন। অবাক হয়ে দেখলেন মাদুরের নিচেই একটি মসৃণ পাথর। পাথরটি সরিয়ে ফেলতেই একটি গভীর সুড়ঙ্গ পথ দেখা গেল। মাটি খুঁড়ে খুব নিপুণভাবে এই সুড়ঙ্গ পথটি তৈরি করা হয়েছে। পরীক্ষা করে দেখা গেল-সুড়ঙ্গটি পবিত্র রওজা শরীফের প্রায় কাছাকাছি চলে গেছে। সবার কাছে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে গেল ভণ্ড দরবেশদের ষড়যন্ত্রের কথা। সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী ভয়ংকর স্বরে গর্জন দিয়ে বললেন, বল্- কেন তোরা এই জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছিস? তোদের পরিচয় কি?
দুই শয়তান কাঁপতে কাঁপতে বলল- আমরা ইউরোপের বাসিন্দা। জাতে খ্রিস্টান। আমাদের রাজা এবং পাদ্রীদের নির্দেশে আমরা এখানে এসেছি। একটু দম নিয়ে তারা আবার বললে লাগল- “আমাদের এক মহা পরিকল্পনা রয়েছে। চারদিকে মুসলমানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর ইসলামী জাগরণ দেখে আমাদের হিংসা হয়। মুসলমানদের কীভাবে অপমান করা যায় সেটাই আমাদের একমাত্র চিন্তা। আমাদের বিশ্বাস মদীনাতে নবীর কবর থাকাতে মুসলমানরা চারদিকেড বিজয় অর্জন করছে। তাই আমরা এসেছি মদীনা থেকে নবীর মরদেহ সরিয়ে ফেলতে অথবা ধ্বংস করে দিতে। এই কাজ করার জন্য আমাদেরকে অনেকদিন ধরে ট্রেনিং দেয়া হয়। এখানে এসে আমরা দরবেশের ছম্মদেব ধারণ করি। প্রচুর দানখয়রাত করে মানুষের মনও জয় করি। তারপর শুরু করি আসল কাজ।”
ওই পাপিষ্ঠদের জবানবন্দিতে আরও জানা গেল, প্রতিদিন গভীর রাতে ওরা খনন কাজ শুরু করত। খনন করা মাটি পানির মশকে ভরে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসত। এভাবে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে ওরা মহানবীর করবের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। ওই দুই শয়তানের জবানবন্দী শুনে মদীনার লোকজন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এভাবে দরবেশের রূপ ধরে তাদেরকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে জানতে পেরে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে গেল। জনগণ দাবি জানাল দুই শয়তানকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হোক। কিন্তু সুলতান তাদেরকে জনগণের হাতে তুলে দিলেন না।
তিনি আরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। দু’জনের মস্তক বিচ্ছিন্ন করার পর তাদের দেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হল। এরপর রওজা শরীফ সুরক্ষার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন সুলতান। কবরের চারপাশে গভীর গর্ত করে সেই গর্তে সীসা, তামা ও লোহা গলিয়ে মজবুত দেয়াল তৈরি করা হল। এভাবে সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র থেকে রাসূলের পবিত্র দেহকে রক্ষা করলেন।