আল্লাহ ওয়ালাদের ইন্তেকাল
এক বুজুর্গ বর্ণনা করেন, আমরা কয়েক ব্যক্তি এক নৌযানে ভ্রমণ করছিলাম। আমাদের এক সহযাত্রী দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ ছিল। একদিন হঠাৎ সে ইন্তেকাল করল। আমরা তার গোসল, কাফন ও নামাযে জানাজা শেষে তার লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেয়ার আয়োজন করছিলাম। এমন সময় সাগরের পানি দুদিকে সরে যেতে লাগল। এবং আমাদের নৌযানটি ক্রমে নীচে নেমে এসে সাগরের মাটি স্পর্শ করল। আমরা যথারীতি কবর খনন করে তাকে দাফনের পর ক্রমে আবার পানি বৃদ্ধি পেয়ে আমাদের নৌযান উপরে ভেসে উঠল।
বর্ণিত আছে যে, এক ফকীর এক অন্ধকার ঘরে মৃত্যুর পর তাকে গোসল দানের জন্য আলোর প্রয়োজন হল কিন্তু বহু চেষ্টা করেও আলোর ব্যবস্থা করা গেল না। এমন সময় আল্লাহর হুকুমে উজ্জ্বল আলতে ঘর ভেসে গেল।
এক বুজুর্গ বর্ণনা করেন, আমি এক বিরান জঙ্গলে গিয়ে দেখলাম, আবু তোয়াব বখশী সেখানে একাকী দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু কাছে এসে দেখলাম তার মৃত্যু হয়েছে এবং কোন কিছুর সাহায্য ছাড়াই তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার লাশ নিয়ে আসার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই পারলাম না। এমন সময় গায়েব থেকে আওয়াজ এল, আল্লাহর ওলীকে আল্লাহর কুদরতী হাতেই ছেড়ে দাও। অন্য এক বর্ণনায় প্রকাশ, ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্তে হযরত আলী বওদুবারী চোখ খুলে বলতে লাগলেন, আরশের কেউ উচ্চস্বরে বলছে, হে আলী! যদিও তুমি এর উচ্চ মর্যাদার আশা করনি, তথাপি আমরা তোমাকে যথাযথ মর্যাদায় ভূষিত করছি। অতঃপর হযরত আবু আলী রব্বুল আলামীনকে লক্ষ্য করে একটি বয়াত পাঠ করলেন যার অর্থ হল-
তোমার ইজ্জতের শপথ, আমি কখনো তোমাকে ছাড়া অন্য কারো প্রতি মোহাব্বতের দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকাইনি। দুনিয়ার ভোগ বিলাস আমাকে স্পর্শ করেনি। আর আমি শুধু তোমাকেই কামনা করেছি। হে পরওয়ারদিগার! তোমার খাস রহমত দ্বারা আমাকে ভাগ্যবান কর।
শায়েখ আবু মোহাম্মদ হারিরি বলল, আমি হযরত জোনায়েদের ইন্তেকালের সময় তার নিকট উপস্থিত ছিলাম। দিনটি ছিল শুক্রবার। তিনি কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করতে করতে পূর্ণ খতম শেষ করলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এই নাজুক সময়ও তিলাওয়াত করছেন? তিনি বললেন, কালামে পাক তিলাওয়াতের জন্য এটার চেয়ে উত্তম সময় আর কখন হবে? একটু পরেই আমার আমলনামা গুটিয়ে ফেলা হবে।
প্রখ্যাত বুজুর্গ মোহাম্মাদ ইবনে হামেদ বলেন, ইমাম আহমদ হাজারাবিয়ার মৃত্যুর সময় আমি তার নিকট উপস্থিত ছিলাম। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। ইন্তেকালের সময় তাঁর এক মুরিদ একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, বেটা! ৯৫ বছর একটি দরজা খোলার চেষ্টা করেছি। এখন তা খোলার সময় হয়েছে। অতঃপর বললেন, পরিণতি ভাল হবে কি মন্দ হবে, কিছুই জানা নেই।
এমন সময় তাঁর কিছু পাওনাদার এসে উপস্থিত হল। তিনি সাতশ দিনার ঋণী ছিলেন। অথচ তাঁর নিকট কোন টাকা পয়সা ছিল না। তিনি আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আমি যতদিন জীবিত ছিলাম ততদিন পাওনাদাররা তাদের টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল। এখন আমি দুনিয়া থেকে বিদায় হচ্ছি, তুমি আমার কর্জ আদায় করে দাও। এ সময় ঘরের দরজায় এসে কেউ আওয়াজ দিল আহমদের পাওনাদাররা কোথায়? তোমরা তোমাদের প্রাপ্য নিয়ে যাও। পাওনাদাররা কোথায়? তোমরা তোমাদের প্রাপ্য নিয়ে যাও। পাওনাদাররা তাদের প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার পর তিনি ইন্তেকাল করলেন।
শায়েখ আবুল হাসান মাজুনী বলেন, আবু ইয়াকুব মহরজুরীর মৃত্যুর সময় আমি তাকে কালেমার তালকিন দিচ্ছিলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেঁসে বললেন, ঐ চিরঞ্জীব সত্তার শপথ! তাঁর এবং আমার মাঝে শুধু তাঁর বড়ত্ব ও ইজ্জতের একটি পর্দা অবশিষ্ট আছে। একথা বলার পরই তিনি মৃত্যুবরণ করলেন।
পরবর্তীতে হযরত মাজুনী নিজের দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলতেন, হায়! কি লজ্জার কথা, আমার মতো একজন নাপিত আল্লাহর এক ওলীকে মৃত্যুর সময় কালেমার তালকিন দিয়েছিল। এ কথা বলেই তিনি অজস্র ধারায় কান্না করতেন।
হযরত আবুল কাশেম জুনায়েদ (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, হযরত আবু সাইদ (রহঃ) কে মৃত্যুর সময় বেশ প্রফুল্ল মনে হচ্ছিল, তাঁর কারণ কি? তিনি বললেন, ঐ সময় তাঁর আত্মা ও যদি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উড়ে যেত তাতেও বিস্মিত হওয়ার কিছুই ছিল না।
হযরত খালফ ইবনে সালেম বলেন, আমি আবু আলী ইবনে মুগীরা (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাসস্থান কোনটি? সে বলল, যেখানে ছোট বড়র কোন ভেদাভেদ নেই। আমি বললাম, তা কোথায়? সে উত্তর দিল, কবরস্থান। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, রাতের অন্ধকারকে তুমি কি ভয় পাও? সে বলল, কবরের অন্ধকার ও বিভীষিকার কথা স্মরণ করলে রাতের অন্ধকার তুচ্ছ মনে হতে থাকে। অবশেষে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কবরস্থানে কখনো কিছু দেখেছ কি? সে উত্তর দিল, কবরস্থানে যা দেখেছি তা আখেরাতের ভয়াবহতার মোকাবেলায় কিছুই নয়।
ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) বলেন, ইমাম আবু বকর ইবনে ফাওরাক বলতেন, ছাত্রজীবন আমার এক সাথী ছিল। সে অত্যন্ত পরহেজগার ও মেহনতি ছাত্র ছিল। একবার সে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চাইলাম। কিন্তু সে কিছুতেই দাওয়া খানায় যেতে সম্মত হল না। এমন সময় সে একবার আকশের দিকে তাকিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে বলল, হে ইবনে ফাওরাক- لمثل هذا فليعمل العاملون
অর্থাৎঃ এরূপ সফলতার জন্য। কর্মপরায়নদের কাজ করা উচিৎ।
এ আয়াত তিলাওয়াতের সাথে সাথেই সে ইন্তেকাল করল।