আরোও কিছু গুনাহের শাস্তি
বুখারী শরীফের এক দীর্ঘ হাদিসে নবী কারীম (সাঃ) এর একটি স্বপ্নের বর্ণনা রয়েছে। সেখানে কবরের কিছু বিশেষ বিশেষ শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নবী কারীম (সাঃ) বলেন, আজ রাতে আমি স্বপ্নে দেখতে পেলাম, দুইজন লোক এসে আমার হাত ধরে আমাকে এক পবিত্র স্থানের দিকে নিয়ে চলল। (কিছু দূর যাওয়ার পথে) দেখালাম, একজন লোক বসে আছে এবং আরেকজন লোক তাঁর নিকটে দাঁড়িয়ে আছে। দণ্ডায়মান লোকটির হাতে একটি সাড়াশি রয়েছে। সে ঐ সাড়াশি ঢুকিয়ে বসে থাকা লোকটির চোয়ালে মাথার পেছন পর্যন্ত কেটে ফেলেছে। আবার অন্যদিক দিয়েও অনুরূপ করে। একদিক কাটার পর যখন অন্যদিক কাটতে যায়, তখন প্রথম দিক জোড়া লেগে ভল হয়ে যায়। আবার ঐরূপ কাটে, আবার ঐরূপ জোড়া লেগে যায়। আমি এ অবস্থা দেখে অত্যন্ত ভীত হয়ে সঙ্গীদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, (বন্ধুগণ!) ব্যাপার কি? তারা বললেন, সামনে চলুন। ফলে আমরা সামনের দিকে চললাম। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম, একজন লোক একখানা ভারী পাথর হাতে নিয়ে তাঁর নিকট দাঁড়িয়ে আছে। দণ্ডায়মান লোকটি ঐ পাথর দিয়ে শায়িত ব্যক্তির মাথায় আঘাত করে চূর্ণবিচূর্ণ করছে। যখন সে তার মাথায় পাথর নিক্ষেপ করে তখন (জোরে আঘাত হানার দরুন) পাথর দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে লোকটি নিক্ষিপ্ত পাথর কুড়িয়ে আনার আগেই মাথার ছিন্নভিন্ন টুকরোগুলো জোড়া লেগে আগের মত হয়ে যায়। সে ঐ পাথর কুড়িয়ে এনে আবার মাথায় আঘাত করে এবং মাথা চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে।
এভাবে সে বারবার আঘাত করতে থাকে। এই ভয়ানক দৃশ্য দেখে আমি অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সঙ্গীদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, একি কাণ্ড? তারা আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললেন, সামনে চলুন। আমরা সামনে চলতে আরম্ভ করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর একটি বিরাট গর্ত দেখতে পেলাম। গর্তটির মুখ সরু, কিন্তু ভিতরটা অত্যন্ত গভীর ও প্রশস্ত, যেন একটি তন্দুর। তার ভেতর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে আর বহু উলঙ্গ নারী-পুরুষ সেখানে অবস্থান করছে। আগুনের তেজ এত বেশী যে, আগুন যেন ঢেউ খেলছে। ঢেউয়ের সাথে যখন আগুন উপরে উঠে আসে, তখন লোকগুলো গর্তের মুখে এসে গর্ত থেকে বের হওয়ার উপক্রম হয়। আবার যখন আগুন নিচে নেমে যায় তখন লোকগুলো আগুনের সাথে সাথে নিচে নেমে যায়। আমি খুব ভয় পেয়ে সঙ্গীদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, বন্ধুগণ ব্যাপার কি? আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়েই তারা বললেন, সামনে চলুন। আমরা সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলাম। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একটি রক্তের নদীর নিকট পৌঁছলাম। নদীর মাঝখানে এল লোক দাঁড়িয়ে আছে। আর নদীর তীরে আরেকটি লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটির সামনে কতগুলো পাথর পড়ে আছে। নদীর মাঝের লোকটি যখন কুলের দিকে আসার চেষ্টা করে, তখনই তীরে দাঁড়ান লোকটি তাঁর মুখে জোরে পাথর মেরে নদীর মাঝের দিকে হটিয়ে দেয়। এভাবে যখনই সে তীরের দিকে আসার চেষ্টা করে, তখনই তীরের লোকটি পাথর মেরে তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। এই নিষ্ঠুর ব্যবহার দেখে খুব ভীত হয়ে সঙ্গীদের জিজ্ঞাসা করলাম, বন্ধুগণ বলুন, একি ব্যাপার? তারা কোন জওয়াব না দিয়ে বললেন, আগে চলুন। আমরা অগ্রসর হতে লাগলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি একটি সুন্দর সবুজ শ্যামল বাগান। বাগানের মাঝখানে অনেক উঁচু একটি বৃক্ষ। তাঁর নিচে একজন বৃদ্ধ লোক বসে আছে। বৃদ্ধের চারপাশে অনেক বালক-বালিকা। বৃক্ষটির কাছে আরও একজন লোক বসা আছে। তার সামনে আগুন জ্বলছে। লোকটি আগুনের তাপ আরও বৃদ্ধি করছে।
সঙ্গীরা আমাকে সেই বৃক্ষের উপরে নিয়ে গেলেন। বৃক্ষটির উপর একটি মনোরম বালাখানা দেখতে পেলাম। তারা আমাকে একাই ঘরে প্রবেশ করালেন। এমন সুন্দর ও নয়ন জুড়ানো বালাখানা ইতিপূর্বে আর কখনও দেখিনি। বালাখানার ভেতরে নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ ও বালক-বালিকা সব শ্রেনীর লোক রয়েছে। বালাখানা থেকে বের হয়ে আসার পর সঙ্গীরা আমাকে আরও উপরে নিয়ে গেলেন। সেখানে প্রথমটার চেয়ে উন্নত একটি বালাখানা দেখতে পেলাম। সেখানে শুধু বৃদ্ধ ও নওজোয়ান। আমি সঙ্গীদের বললাম, আপনারা আমাকে সারা রাত বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করিয়ে আনলেন, এবার দয়া করে বলুন, ঐ সব ঘটনার কি রহস্য ছিল? সঙ্গীরা বললেন,
(প্রথম) যে লোকটির মস্তক ছেদন করা হচ্ছে দেখেছেন তার মিথ্যা বলার অভ্যাস ছিল। তারা মিথ্যা কথা দুনিয়াতে মশহুর হয়ে গিয়েছিল। তাই কিয়ামত পর্যন্ত তার সাথে উক্ত আচরণ করা হবে।
দ্বিতীয় যে লোকটির মস্তক পাথরের আঘাতে আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করতে দেখেছেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে কুরআনের ইলম দান করেছিলেন। কিন্তু সে ইলম থেকে গাফেল হয়ে রাত্রে ঘুমিয়ে থাকত এবং দিনে সে অনুযায়ী আমল করত না কিয়ামতের দিন হিসাব-নিকাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার এরূপ আযাব চলতে থাকবে।
(তৃতীয়) আপনি যাদেরকে আগুনের তন্দুরের ভিতর দেখেছেন, তারা দুনিয়াতে ব্যভিচারে লিপ্ত ছিল। (কিয়ামত পর্যন্ত তাদের উপর এই শাস্তি চলতে থাকবে।)
(চতুর্থ) যে ব্যক্তিকে রক্তের নদীতে হাবুডুবু খেতে দেখেছেন, সে সুদ খেত।
বৃক্ষের নিচে যে বৃদ্ধকে দেখেছেন, তিনি হযরত ইব্রাহীম (আঃ)। বাচ্চাগুলো হল মানুষের নাবালক ছেলে-মেয়ে। আর তিনি আগুন জ্বালাচ্ছিলেন, তিনি হলেন জাহান্নামের দারোগা মালেক ফেরেস্তা। আপনি প্রথম যে বালাখানায় প্রবেশ করেছেন, তা সাধারণ ইমানদারদের আর দ্বিতীয়টি শহীদদের। আমি হলাম জিব্রাইল (আঃ) ফেরেস্তা এবং ইনি মীকাইল (আঃ) ফেরেস্তা। এরপর জিব্রাইল (আঃ) আমাকে বললেন, এখন আপনি উপরের দিকে তাকান। আমি উপরের দিকে দৃষ্টিপাত করে একখণ্ড সাদা মেঘ দেখলাম। জিব্রাইল (আঃ) বললেন, ঐটাই হল আপনার বালাখানা। আমি বললাম, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আমার বালাখানায় চলে যেতে চাই। জিব্রাইল (আঃ) বললেন, আপনার সময় এখনও পূর্ণ হয়নি, আপনার দুনিয়ার হায়াত বাকী আছে। যদি বয়স পূর্ণ হত, তাহলে এখনই যেতে পারতেন।
(মিশকাত শরীফ)