আমার মা-দ্বিতীয় পর্ব

দীর্ঘদিন বাবা মায়ের কাকুতি মিনতিতে একে বারেই পাত্তা দেননি। বাবা বিদ্রুপ করে বলতেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় কেন তারচেয়ে চল না একেবারে তিব্বতে চলে যাই। দুটো দেশের মধ্যে তফাৎটাই বা কি? দুটোই তো দুনিয়ার সেই আরেক মাথায়।’ নিজের দেশ ছাড়বার আইডিয়াটাই এত অবান্তর মনে হোতো তাঁর কাছে যে তিনি যখনই মা এবিষয়ে কথা বলতেন তিনি উপহাস করে তা উড়িয়ে দিতেন। তিনি ভেবেছিলেন এতে করে মায়ের স্বপ্ন সাধ রঙ্গিন বেলুনের মতো একসময় চুপসে যাবে। অলস, অকর্মণ্য আমার বাবার আসলেই অন্য কোনো দেশে যাবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে ছিল না।
নিজের শহরের হাতে গোনা তিন/ চারটি রাস্তাই ছিল তাঁর চৌহদ্দি, এর বাইরে আর বেশী তাঁর জানা ছিল না। আর কেনই বা তাঁর স্ত্রীর তাঁর আয়ের উৎস নিয়ে এতো আদিখ্যেতা, কেন নূতন আয়ের পথ খুঁজতে হবে তাও তিনি ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। জীবনের কোনো কাজই তিনি ভেবে করেনি আর গভীরভাবে কোনো কিছু তলিয়ে দেখাও তাঁর ধাতে নেই। তারচাইতে ঝকমকে পোশাক, আশাক আর হইহুল্লোড় ভরা জীবন অনেক স্বাচ্ছন্দ্যের, কেন অহেতুক নূতন যন্ত্রণা মাথায় নেয়া?
শেষ পর্যন্ত মায়ের দৃঢ়চেতা মনোভাবের কাছে বাবাকে রণ ভঙ্গ দিতে হোলো। রাশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘ সারাটা পথ তাঁর মন বড় তিতিবিরক্ত হয়ে রইলো মায়ের উপর, কেন মা এমন একটা আজব সিধান্ত নিলেন? কিন্তু, অস্ট্রেলিয়ায় পা দেবার যেন একেবারে সাথে, সাথেই এটাই তাঁর প্রিয় বাসভূমি উঠলো,নিজের দেশকে ভুলে যেতে শুধু মুহূর্ত বিলম্ব মাত্র। তিনি ভেবেছিলেন অস্ট্রেলিয়া একেবারেই অন্য রকম একটা দেশ কিন্তু দেখলেন আসলে মোটেও তা নয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সাঙ্গোপাঙ্গ জুটিয়ে ফেল্লেন, আর শুরু হোলো ক্যাফেতে বসে নব্য সাথীদের সাথে নূতন ব্যবসার পাঁয়তারা কষা। মুহূর্তেই বাবার হিশাব নিকাশ হয়ে গেল, এদেশে টাকা রোজগার করার অজস্র উপায়, টাকা এখানে হাওয়ায় উড়ছে, শুধু ধরে বস্তা বন্দি করবার অপেক্ষা! তবে, নূতন দেশের নূতন ভাষা একটা বিরাট বাঁধা বইকি। কিন্তু ব্যবসা করতে গেলে কি অতসব ভাবলে চলে? সে সমস্যাও বাবা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন, ‘যদি জানো কি করে বিকিকিনি করতে হয় তাহলেই যথেষ্ট, এ হচ্ছে সোনার দেশ।’ কিন্তু, মায়ের জন্য ছিল সম্পূর্ণ অন্য আর এক চিত্র। জাহাজে করে এদেশে এসে পৌঁছাবার পর দিনই তিনি ফিরে যাবার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠলেন। অজানা, অচেনা নূতন দেশে এসে প্রথম যে অনুভূতি মায়ের মনে জেগেছিল তা তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল। নিজের দেশের তুলনায় প্রতিটি জিনিশ, নিজ এলাকার মানুষজন, কাস্টমসের অফিসাররা, ট্যাক্সি ড্রাইভার এমনকি বাড়ির দালাল সব কিছুই এত উন্নত আর অন্য রকমের ছিল যে, মায়ের মনে চরম ক্রোধের জন্ম হয়েছিল। মায়ের মনে হয়েছিল, প্রতিবেশীদের নজর তাঁদের প্রতি যতটা প্রসন্ন ও বন্ধুত্বসুলভ যেন ঠিক ততটাই ব্যঙ্গ আর সহানুভূতিমাখা।
তিনি কল্পনা করতেন পাড়ার প্রতিটা মানুষই তাঁদের একই নজরে দেখে। তাই কক্ষনো তিনি তাঁদের সহ্য করতে পারতেন না। তাই বলে তাঁর যেসব ইহুদী আত্মীয় ছিল এদেশে অথবা জাহাজে যে সব ইহুদীদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিল তাঁদের সাথেও তাঁর কোনো রকম সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তা ভাবাও খুবই ভুল হবে। কাউকেই মা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। মায়ের আত্মীয় যারা অনেক আগে থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন স্বভাবতই তাঁরা এদেশ সম্পর্কে অনেক বেশী জানতেন। তাঁরা চাইতেন নূতন দেশ আর এর বিভিন্ন নিয়ম কানুনের বিষয়ে জ্ঞান দিয়ে মাকে চমৎকৃত করতে। এ ব্যপারে রীতিমত তাঁদের মধ্যে প্রতিযোগীতা লেগে থাকতো কে কতো বেশী আমার মাকে বিস্মিত করতে পারে নয়া, নয়া তথ্য সরবরাহ করে। তাঁদের কথা বলবার ভঙ্গী ছিল কেমন যেন আক্রমণাত্মক, কথায় কথায় বলতো, ‘এটা একটা স্বাধীন সংস্কারপূর্ণ দেশ, সবারই বাক স্বাধীনতা রয়েছে, খাবার সময় সবাই ভদ্র লোকের মতো ছুরিকাঁটা ব্যবহার করে কেউই হাত দিয়ে খায় না। সবাই লেখা পড়া জানা, চিৎকার করে কথা বলে না। এখানে কেউই কারো সাথে অন্যায় আচরণ করে না, যেমনটি হোতো পুরানো দেশে।’ মার ছিল অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, খুব সহজে আর কম সময়ে তিনি তাঁর পারিপার্শ্বিক জগত সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। অন্য দিকে বাবা ছিলেন ধূর্ত, অন্যেরা কথা বলবার সময় এমন হাসি হাসি মুখ করে থাকতেন যেন তিনি কতই না তাঁদের কথা প্রাণ ভরে উপভোগ করছেন। কিন্তু মা অন্যদের কথা বলার মাঝখানেই থামিয়ে দিতেন, মৃদু কিন্তু কঠিন হিমশীতল স্বরে বলতেন, ‘ধরে নিলাম তোমাদের কথাই সত্যি তাহলে তোমরা এমন পোষা কুকুরের মতো নেচেকুঁদে বেড়াও কেন? কাকে খুশী করবার চেষ্টা কর শুনি?’ নূতন দেশের প্রতি মায়ের এই কঠিন আর শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের কোনোদিনও পরিবর্তন হয়নি। এ দেশে যেন কিছুই ছিল না তাঁর কাছে এমনকি, সেজন্য এদেশের ভাষা শেখবার আগ্রহও দেখাননি তিনি। আমি আর বোন যখন স্কুলে যাবার মতো যথেষ্ট বড় হলাম তখন যেন মা খানিকটা হলেও তাঁর মনে আশেপাশের জগত সম্পর্কে কৌতূহল জেগে উঠলো। মায়ের মনে বই পড়া আর শিখবার যে অদম্য ইচ্ছে সুপ্ত ছিল তা যেন নূতন করে বিকশিত হলো। আমাদের বই পুস্তক গুলো মা এমন ভাবে নাড়াচাড়া করতেন যেন ওগুলো কোনো পবিত্র ধর্ম্যগ্রন্থ! আমাদের ভবিষ্যতের লক্ষ্যমাত্রা আগে ভাগেই মা ঠিক করে রাখলেন। মা আমাদের জগত এমন ভাবে নির্ধারণ করে দিলেন যে, আমাদের দু’ ভাইবোনকে চিকিৎসা বিদ্যা, সংগীত আর সাহিত্য প্রতিটা বিষয়ে হতে হবে তুখোড়। মায়ের ধারণা ছিল কেবল এভাবেই আমরা মানবতার সেবায় নিজের উৎসর্গ করতে পারবো। গোকীর্ আর টলস্টয় থেকে পড়ে শোনাতেন মা।
আর তাঁর মেডিক্যাল টিমের সাথে কাজ করবার দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতেন সবসময়। মায়ের ধারণা ছিল শুধুমাত্র স্কুলের শিক্ষাই আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। একমাত্র তাঁর মেডিক্যাল মিশন তাঁকে যেমন ভাবে পথ দেখিয়েছিল মানবতার সেবায় সেটাই ছিল সব চেয়ে আদর্শ উদাহরণ। এই বন্ধ্যা দেশে একমাত্র ওই আদর্শই আমাদের বাঁচাতে পারে অন্তঃসারশূন্যতার হাত থেকে। খেলা থেকে অসময়ে ডেকে এনে বই পড়ে শোনাতেন বলে আমি মাঝে মাঝে তীব্র প্রতিবাদ জানাতাম মায়ের বিরুদ্ধে। বাবাও ভেবে আশ্চর্য হতেন মা কেন অযথা এত সময় নষ্ট করেন আমাদের বই পড়ে শোনাতে গিয়ে। আর কেনই বা তাঁর মেডিক্যাল মিশনের একঘেয়ে গল্প বার, বার বলেন। মাঝে সাঝে বাবা তাই আমার পক্ষ নিতেন, ‘ওরা এখনও অনেক ছোট, এসব বুঝবার মতো অত বড় হয়নি, কেন জোর করে ওদের এসব গিলাতে চাও শুনি। কচি মাথাগুলো কি না বিগড়ালেই নয়? ঈশ্বরই জানেন শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে!’ তারপর, আমাদের দিকে ইশারা করে বলতেন ‘আমার ছেলে যদি ভাল একজন ছুতোর মিস্ত্রী হয় আর মেয়ে পোশাক কারখানায় কাজ পায় তাহলেই আমি যথেষ্ট খুশী হবো।’ ‘যাক, তোমার মতো ব্যবসায়ী হবার পরামর্শ যে দাওনি সেটাই ভাগ্যের। অন্তত জীবন থেকে খানিকটা হলেও কিছু শিখেছ শেষ পর্যন্ত।’ বাবা রেগে চিড়বিড়িয়ে উঠতেন, ব্যাঙ্গ করে বলতেন, ‘কি আর করা যাবে আমার বাপ যখন আমাকে প্রফেসার হবার মতো শিক্ষা দেননি। তাই ব্যবসায়ী না হয়ে বা আমার উপায় বা কি?’ তবে, মায়ের শীতল দৃষ্টি আর কুঞ্চিত মুখোভঙ্গীর সামনে খুব বেশীক্ষণ তাঁর এই যুদ্ধাংদেহী মূর্তি টিকতো না, বাবার চেহারা দেখাতো চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো। এত সহজেই বাবা রণেভঙ্গ দিতেন দেখে আমারা দু’ ভাই বোন রেগে আগুন হয়ে যেতাম, ‘বাবাটা যেন কি, তাঁর উপর নির্ভর করাটাই মুর্খামি, কক্ষনো আমাদের পক্ষ নিয়ে দুটো কথা মাকে বলার সাহস নেই।’ আসলে মুখে,মুখে মায়ের সাথে তর্ক করলেও মনে, মনে বাবা মাকেই সমর্থন করতেন। ঘরের বাইরে মাকে নিয়ে বাবার যে কি গর্ব ছিল, এক অদ্ভুত ধরণের অহংকার প্রকাশ পেতো বাবার কথায় মায়ের শিক্ষা সহবত নিয়ে। যেমন ভাবে আমরা দু’ভাই বোন মায়ের শেখানো বুলি তোতা পাখীর মতো করে আওড়ে যেতাম, বাবাও ঠিক তাই করতেন। মায়ের ভারী দুঃশ্চিন্তা ছিল কি করে আমাদের দু’ভাইবোনকে, উপযুক্ত গানের তালিম দেয়া যায়।
কিন্তু, তাঁর পক্ষে স্বপ্নেও কল্পনা করা কঠিন ছিল যে আমাদের জন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র কিনবেন বা শিক্ষক রাখবেন। একেই বাবার ব্যবসার সব সময়ই টলোমলো অবস্থা, কোথা থেকে টাকা যোগাড় হবে কে জানে, ঠিক মতো বাড়ি ভাড়াই দেয়া হয় না। তাই মা আমাদের পরিচিত মানুষদের বাড়িতে নিয়ে যেতেন গ্রামোফোনের গান শোনাবার জন্য। এডিসন কোম্পানির তৈরি সরু চোংগা ওয়ালা আদ্যিকালের গ্রামোফোন থেকে এমন কিনকিনে সুর উঠতো মনে হতো যেন সেই অসীম সুদূর থেকে ভেসে, ভেসে আসছে। আমার দু’ভাইবোন তাতেই মন্ত্রমুগ্ধ ছিলাম, বুঁদ হয়ে শুনতে চাইতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মায়ের আবার তাতেও মহা আপত্তি, তাঁর ধারণা বেশিক্ষণ এমন তীক্ষ্ণ বাজনা শুনলে আমাদের কানের ক্ষতি হতে পারে। এরপর থেকে আমরা গানের দোকানে দোকানে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম। স্কুল ছুটির পর কিবা ছুটির দিন গুলোতে আমরা এ দোকান সে দোকান করে কাটিয়ে দিতাম। আর বাড়িতে বাবা কখনো দুপুরের খাবার আবার কখনো বা সন্ধ্যার খাবারের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে রইতেন। কিন্তু তা নিয়ে তিনি কক্ষনো কোনো রকম হই চই করেননি, বরং উল্টে মানুষের কাছে গর্ব করে মায়ের প্রশংসা করতেন। মা যে আমাদের গান শেখাবার জন্য কতো কঠোর তপস্যা করছেন তা নিয়ে বাবার অহংকারের সীমা ছিল না। মা তো নিজে পড়তে পারতেন না তাই, প্রথম প্রথম আমরা দোকানে গিয়ে দু’ভাই বোন মিলে তাকে সাজানো গানের বইগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করতাম।
গানের কথা কে লিখেছেন, সুর কে করেছেন, কোন রেকর্ড কোম্পানি এটা বাজারে ছেড়েছে আর দেয়ালে ঝোলানো বড় বড় ছবি গুলো গায়কের জীবনবৃত্যান্ত মুখস্ত করে ফেলেছিলাম। ও এলাকার এমন একটা দোকানও বাদ ছিল না যেখানে, আমাদের নিত্য আসা যাওয়া ছিল না। এরপর, আমরা আবার প্রথম দোকান থেকে শুরু করতাম, এবারে গান শোনার পালা। মা তো ইংরেজি জানতেন না তাই, মায়ের হয়ে আমি দোকানদারদের তাঁর পছন্দের গান বাজিয়ে শোনাবার অনুরোধ করতাম। এরপর আরেকটা পিস বাজাবার অনুরোধ করতাম, কখনো তাচিকভাস্কির বেহালা, বা বিটোভেন, কারসু বা চ্যাপলিনের সময় কালে গাওয়া কোনো গান। যতক্ষণ পর্যন্ত না দোকানীর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেত, আমরা সেই দোকানে গেড়ে বসে থাকতাম। ধীরে ধীরে মায়ের সাহস বেড়ে গেল, দোকানে গিয়ে দোকানীকে পুরা একটা কন্সার্ট অথবা সম্পূর্ণ সিম্ফনি বাজিয়ে শোনাবার অনুরোধ করতেন। গান শোনাবার ছোট্ট ঘরটিতে আমরা ঘণ্টা খানেকেরও বেশী সময় এমন করেই কাটিয়ে দিতাম। দোকানীর অস্থির পদচারনা, বার বার হাই তোলা বিরক্তিমাখা মুখ কোনো কিছুতেই মায়ের ভ্রুক্ষেপ ছিল না। উল্টে মা চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে ঘূর্ণায়মান রেকর্ডের দিকে এক দৃষ্টিতে এমন ভাবে চেয়ে থাকতেন যেন সেখানে দোকানী বলতে কোনো জনপ্রাণীর অস্তিত্ব ছিল না। প্রতিটা দোকানের সব গুলো মানুষ আমাদের খুব ভাল ভাবেই চিনে গিয়েছিল। যে দোকানেই আমরা ঢুকতাম সবাই আমাদের দিকে এমন নজরে চাইতো যেন আমরা চিড়িয়াখানার কোনো আজব জীব। লজ্জায় আমার কান মাথা গরম হয়ে যেতো, মানুষগুলোর উপহাস ভরা বক্রদৃষ্টি আমরা যেদিকে যেতাম সেদিকই অনুসরণ করতো। কখনো, কখনো আমি মায়ের হাত দুটি ধরে অনুনয় করে বলতাম, ‘চল না মা, আজ নাহয় চলে যাই।’ কিন্তু এসব তুচ্ছ বিষয়ে নজর দেবেন এমন পাত্রী তিনি ছিলেন না। খুব তাড়াতাড়ি আমরা মানুষের উপহাসের বস্তু হয়ে দাঁড়ালাম। দোকানদাররা আমাদের আর মোটেই পাত্তা দিতেন না। এক দোকানী তো দরজার সামনে আমাদের দাড় করিয়ে রেখে কি যেন খানিকটা বিড়বিড় করে বকলেন। তারপর সেখানেই দাড় করিয়ে রেখে ভেতরে চলে গেলেন। তাই বলে এতো সহজে দমবার বান্দাও মা নন। মা ঠিক করলেন দোকানের ম্যানেজারের কাছে গিয়ে নালিশ দেবেন। দুঃখে অপমানে আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছি। ফিরে যাবার জন্য যেই পা বাড়িয়েছি অমনি মা খপ করে আমার আহত চেপে ধরলেন। ‘কিসের এতো ভয় শুনি, আমার উপর বিশ্বাস রাখ। দেখো, আমি তোমাকে কোনো রকম অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলবো না’ অভয় আশ্বাস দিলেন মা।
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ঠিক করে ভেবে বলো, কে ঠিক আমরা নাকি ওই দোকানী? কেন আমাদের বাজিয়ে শোনাবে না, এতে তো আর ওর নিজের গাঁটের কড়ি খরচ হচ্ছে না। আমার গরীব আমাদের কিনবার ক্ষমতা নেই তাই বলে, ভাল কিছু শোনার সুযোগ থেকেও আমরা বঞ্চিত হবো?’ মায়ের অকাট্য যুক্তি, যতক্ষণ পর্যন্ত না মায়ের সাথে ভেতরে যেতে রাজী হলাম মা একই কথা বলে, বলে আমার জান ঝলাপালা করে দিলন। আমরা তিনজন গিয়ে ম্যানেজারের ঘরে ঢুকলাম, মায়ের দোভাষী হয়ে তাঁর বক্তব্য ম্যানেজারকে জানালাম। আমি বুঝতে পারছিলাম ম্যানেজার সুলভ গাম্ভীর্য বজায় রাখতে তাঁর খুব কসরত করতে হচ্ছিল। বহু কষ্টে হাসি চেপে তিনি জানতে চাইলেন, ‘কিন্তু আদৌ কি রেকর্ড কিনবার কোনো ইচ্ছা আছে তোমাদের?’ মায়ের হয়ে আমি জবাব দিলাম, ‘আমি যদি বড়লোক হতাম তাহলেও কি আপনি এই একই প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করতেন?’ আমি চুপ করে থাকলেই মা আমাকে খোঁচাতেন, ‘হুবহু বলো ওনাকে যেভাবে আমি তোমাকে বলছি ঠিক তেমন করে।’ আমার শিরা উপশিরায় গরম রক্তের ছোটাছুটির কারনে আমার কান মাথা সব ঝাঁঝাঁ করতে থাকতো। ত্যাঁদড় ম্যানেজার আবার তাঁর প্রথম প্রশ্নটাই করলেন মাকে। এবার মায়ের ধৈর্যের বাধ্ টুটে গেল। ম্যানেজার তাঁর কথা আদৌ কিছু বুঝলেন কিনা তার তোয়াক্কা না করেই, নিজের ভাষায় শিল্প সংস্কৃতি, সংগীতে সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে তিনি লম্বা চওড়া জ্বালাময়ী এক ভাষণ দিয়ে বসলেন। এরপর প্রতিটা দোকান থেকেই আমাদের এমন করে ধুলোপায়ে বিদায় করে দেয়া হতে লাগলো।
দোকানীদের এক কথা যদি রেকর্ড কিনতে পার তাহলে এসো নইলে নয়। তবে মাও সহজে ছেড়ে কথা কইবার লোক নয়, আচ্ছা মতো তাঁদের দুচার কথা শুনিয়ে দিতেন। আমার মায়ের কল্যাণে এমন প্রত্যাখ্যান আমাদের কপালে প্রায়ই জুটতো। একবার তো মা আমাদের নিয়ে সোজা ইউনির সাইন্সল্যাবে হাজির। সারি সারি টেবিলের সামনে সাদা এপ্রন পরা ছেলে মেয়েরা উঁচু টুলে বসে আছে। তাদের সামনে সাজানো থরে থরে অসংখ্য টেস্ট টিউব, বিকন, জার ভর্তি রাসায়নিক তরল । একজন অধ্যাপক কি একটা বিষয় নিয়ে যেন লেকচার দিচ্ছিলেন, মা আর মায়ের পিছনে দুটি পুঁচকে ছেলে মেয়েকে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল পুরো ঘরটা ভাল করে ঘুরে ঘুরে দেখবার। কিন্তু, একটু পরে একজন কালো পোশাক পরা ভদ্রলোক এসে মাকে জিজ্ঞেস করলেন আমরা কি ভুল করে এখানে ঢুকে পরেছি কিবা কাউকে খুঁজছি কিনা? লোকটির চাল চলন দেখেই বোঝা যায় তিনি কোনো বিশেষ ব্যক্তি, চমৎকার ঝকঝকে চেহারা আর মথায় সিংহের কেশরের মতো সাদায় কালো মেশানো লম্বা ঝামুর ঝুমুর চুল। মায়ের বক্তব্য আমি পুনারাবৃতি করলাম, ‘না, আমরা কাউকে খুঁজছি না, আমরা শুধু আপনাদের কাজ আর জ্ঞানকে উপভোগ করতে চাই।’ তিনি তাঁর কুঞ্চিত মুখে খানিকটা প্রসন্নতা টেনে এনে মৃদু হেসে বললেন, ‘এখানে তো বাইরের কারো ঢুকবার অনুমতি নেই, এটা শুধুমাত্র ছাত্র/ ছাত্রীদের জন্য।’ মাকে লোকটির কথা অনুবাদ করে বলার সাথে সাথে মায়ের চেহারা বদলে গেল, রাগে টকটকে লাল হয়ে গেল তাঁর মুখ। ঝাড়া দশটি সেকেন্ড তিনি লোকটির চোখের দিকে অপলক চেয়ে রইলেন।
তারপর আমাকে বললেন, ‘ওনাকে জিজ্ঞেস করো কেন, তিনি এমন হাসি হাসি মুখ করে আমাদের সাথে কথা বলছেন?’ আমি বললাম, ‘ মা জানতে চাইছেন কেন আপনি আমাদের সাথে এমন সৌজন্যের সাথে কথা বলছেন?’ আমার কথা শুনে ভদ্রলোক এমন থতমত খেলেন যে কিছুক্ষণের জন্য রীতিমত তাঁর বাক্য হরে গেল। একটু পরেই তাঁর মুখ কঠিন হয়ে গেল, তিনি প্রথমে গলা খ্যাঁকরালেন, অস্থির ভাবে এক পা পিছিয়ে গেলেন। তারপর, ঘড়ির দিকে একনজর চেয়ে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে দৃপ্ত পায়ে হেটে অন্যদিকে চলে গেলেন। আমরা রাস্তায় বেরিয়ে এসে দেখি আজ বসন্তের দিনটা যে কি অপরূপ সাজে সেজেছে। মা কিছুক্ষণ থম ধরে রইলেন তারপর বললেন, ‘এ ধরণের ভদ্রলোকরা নিজেদের খুব উদারচিত্তের মনে করে আসলে, ভেতরে ভেতরে এরা আমাদের মতো মানুষদের শুধু করুণাই করে আর কিছু নয়। তোমাদেরও আমার মতো কপালে অনেক ভোগান্তি রয়েছে এদেশে। শুধু কি আর মিষ্টি কথায় চিঁড়ে ভেজে? আমার দেশে তো যাওবা কিছু হলেও হৃদয়বান মানুষের দেখা মিলতো, কিন্তু এখানে সে আশা করাটাও বাহুল্য দেখছি!’ এই একই কথা মা হরহামেশাই বলতেন।
এমনকি আমি এখন আর সেই ছোট্ট বালকটি আর নই আমি এখন তের বসরের কিশোর। এদেশে সম্পর্কে অনেক কিছু আমার জানা হয়ে গেছে, আর এটাই আমার একমাত্র দেশ একথাও আমি জানি। কিন্তু, মায়ের সাথে তর্কে এঁটে ওঠা অত সহজ নয়। সারা জীবন মা একই রকম রয়ে গেলেন, মায়ের এই ধ্যান ধারণা আর একগুঁয়ে স্বভাবের পরিবর্তন করা অসম্ভব ছিল। পুরানো দিনের সুখ স্বপ্নে মা এতোই বিভোর ছিলেন যে এদেশের বর্তমান আর ভবিষ্যতের কোনো কিছুই তাঁর কাছে আশাব্যঞ্জক মনে হতো না। মা হতাশ হয়ে বলতেন, ‘হয়তো তোমার মতো যারা তাদের জন্য বিষয়টা ভিন্ন, কিন্তু এ জীবনে আর কিছুতেই আমি পথ খুঁজে পাব না এদেশের মাটিতে!’ অনুবাদ : সুদর্শনা রহমান গল্পটির প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করূন

আরো পড়তে পারেন...

হাম্মামখানা –শামসুদ্দোহা চৌধুরী

প্যাচপেচে গরমে ঘামাচির মহোৎসব শরীরে। জ্যৈষ্ঠের রোদের ঝাঁজালো আগুনের পরশমণিতে হুল ফুটানো উৎসবে মেতে উঠছে…

একটি অনুগল্প…

সত্যব্রত মাঝি। মাঝির পুরো নাম। সবার কাছে ও মাঝি বা মাঝিদা এসব নামেই পরিচিত। আজ…

সত্যদাসের নব-জন্ম

সত্যদাস অমন হঠাৎ মারা যাওয়াতে প্রথমটা সকলের চমকে উঠেছিল বৈকি! সারা দেশ জুড়ে সে যেন…