আজব রোগী, আজব চিকিৎসা

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতির পথে সবচেয়ে বেশী অবদান রেখেছেন। ইবনে সিনার আসল নাম আবু আলী আল হোসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা। তবে তিনি ইবনে সিনা, বু-আলী সিনা এবং আবু আলী সিনা নামেই বেশী পরিচিত। তিনি এতই খ্যাতিমান চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন যে, পশ্চিমা বিশ্বে আজো তিনি “দ্য প্রিন্স অব ফিজিশিয়ানস” নামে পরিচিত।

তার বিখ্যাত গ্রন্থ “আল কানুন ফিল থিব” চিকিৎসা শাস্ত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পাঠ্য পুস্তক হিসেবে প্রায় পাঁচশ বছর ধরে গণ্য করা হয়েছে। তিনিই প্রথম মানব চক্ষুর সঠিক এনাটমি করেন। যক্ষ্মা রোগ নিয়ে তিনি অভিমত দেন যে, যক্ষ্মা একটি ছোঁয়াচে রোগ। ইবনে সিনার মৃত্যুর পর পশ্চিমা চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ অভিমত প্রত্যাখ্যান করলেও পরে তা সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়।

তো, প্রখ্যাত এই চিকিৎসা বিজ্ঞানীর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আমরা একটি ঐতিহাসিক কাহিনী প্রচার করেছি রংধনু আসরে। অনেক দিন আগের কথা। তৎকালীন পারস্যের এক শাহজাদার আজব এক অসুখ দেখা দিল। শাহজাদা কিছুই খায় না। না খেয়ে খেয়ে তার শরীর একদম শুকিয়ে যেতে লাগল। সে শুধু চিৎকার করে আর বলে, ‘আমাকে জবাই কর, জবাই করে আমার গোশত দিয়ে কাবাব বানাও।’

শাহজাদা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তার অসুখে তাই বাদশাহ ও বেগমের মন একদম ভেঙ্গে পড়ল। তাদের দুঃখে আমীর-উমরাহদের মুখও ভার হয়ে ওঠে। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে শাহজাদার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য। একে একে রাজ্যের সব হেকিম, কবিরাজ ডাকা হল শাহজাদার চিকিৎসার জন্য। কিন্তু কোন লাভ হলো না। হবেই বা কেমন করে? শাহজাদাকে কোনকিছুই খাওয়ানো যায় না। এমনকি কোন ওষুধও সে খেতে চায় না।

ছেলের অবস্থা দেখে বেগম সাহেবাও খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিলেন। বাদশাহর মন আরো ভেঙ্গে গেল। দেশ-বিদেশের বড় বড় হেকিম-কবিরাজ মনে দুঃখ নিয়ে মাথা হেঁট করে চলে যেতে লাগলেন। কারণ যে রোগীকে ওষুধ খাওয়ানো যায় না, পথ্য খাওয়ানো যায় না- তার চিকিৎসা হবে কি করে?

কোন উপায় না দেখে বাদশাহ আর বেগম আল্লাহর দরবারে হাত তোলেন আর ছেলের জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করেন। একদিন কয়েকজন উমরাহ বাদশাহকে বললেন, ‘জাঁহাপনা! আপনার উযীরে আযম শুধু একজন বড় আলেম ও শাসকই নন, তিনি একজন বড় হেকিমও বটে। একবার যদি তাকে শাহজাদার চিকিৎসার জন্য ডাকা হয় তাহলে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হবে।’

এ কথা শুনে বাদশাহ উযীরকে ডাকলেন। উযীর সব ঘটনা শুনে বললেন, শাহদাজাকে গিয়ে খবর দাও যে, একজন ভাল কসাই এসে। তাকে জবাই করে গোশত দিয়ে কাবাব বানানো হবে।

লোকজন গিয়ে যখন শাহজাদাকে এই খবর দিল, তখন সে খুশিতে আটখানা! তাড়াতাড়ি সে লোকদের সাথে এসে হাজির হলো উযীরের কাছে। উযীর একটা বড় চকচকে ছুরি নিয়ে শাহজাদার আগমনের অপেক্ষা করছিলেন। শাহজাদা এসেই লাফিয়ে বলে উঠল, ‘এই যে কসাই! এসো এসো, আমাকে জবাই করে গোশত দিয়ে কাবাব বানাও।’ উযীর তাঁর লোকদের হুকুম দিলেন, এই গরুটা খুব ভাল করে বেঁধে মাটিতে শুইয়ে দাও, জবাইটা শেষ করে ফেলি।

এ কথা শুনে শাহজাদা নিজেই শুইয়ে পড়লো। লোকেরা তার হাত ও মাথা চেপে ধরল। ছুরি হাতে নিয়ে উযীর তার দিকে এগিয়ে গেল। উপস্থিত সবাই এই কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেল! কেউ কেউ ভয়ে কাঁপতে লাগল। সত্যিই কি শাহজাদাকে জবাই করে ফেলবেন উযীর?

উযীর ‘বিসমিল্লাহে আল্লাহু আকবার’ বলে ছুরি চালাতে গিয়ে সাথে সাথে থেমে গেলেন। চোখে-মুখে একটা ঘৃণার ভাব এনে বললেন, ‘নাহ! গরুটা একদম শুকিয়ে গেছে। এর গোশত দিয়ে মোটেও কাবাব হবে না। একে জবাই করে কোন লাভ নেই। আগে বেশি করে খাইয়ে-দাইয়ে একে মোটা-তাজা কর। তারপর নিয়ে এসো, জবাই করে দেবো।’

উযীরের কথা শুনে দুঃখিত মনে শাহজাদা ওঠে দাঁড়ালো। মনে মনে ভাবলো, ‘সত্যিই কি আমি এত শুকিয়ে গেছি যে, কসাইও আমাকে ঘৃণা করল? মোটা-তাজা হওয়ার জন্য এখন থেকে আমাকে তাহলে ভাল ভাল খাবার খেতে হবে।’

উযীর গোপনে পরামর্শ দিলেন, ‘শাহজাদাকে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। আর তাতে মিশিয়ে দিতে হবে আমার দেওয়া কিছু ওষুধ।’

মোটা-তাজা হওয়ার লোভে শাহজাদা এবার খেতে শুরু করল। তাতে মিশিয়ে দেওয়া হলো উযীরের ব্যবস্থামত নানা পুষ্টিকর ওষুধ। অল্পদিনেই শাহজাদার চেহারা ফিরে এলো।

শাহজাদা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। সে আর বলে না, ‘আমাকে জবাই কর, আমার গোশত দিয়ে কাবাব বানাও।’ ছেলেকে সুস্থ হতে দেখে বাদশাহ-বেগমের মুখে আবার হাসি দেখা দেয়। আমির-ওমরাহ আর প্রজাদের খুশি আর ধরে না।

শাহজাদার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে সবাই আল্লাহর কাছে মুনাজাত করেন।

খোলা জানালা দিয়ে বয়ে আসছে মৃদু হাওয়া।

হিরোশিমা ও নাগাসাকি দিবস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *