আগুন্তক

অয়নের ঘুম ভাঙ্গে চোখের উপর কড়া আলো পড়ায়। চোখ খুলতে কষ্ট হয় ওর। একটু পাশে সরে যায় ও। কিছুক্ষণ পর চোখে আলো সয়ে আসে। আর তখনই ও হতভম্ব হয়ে যায়। এটা কোন জায়গা? ভাবে অয়ন। ভীষণ ভয় পায় সে। চারপাশ এত অন্ধকার কেন? ওর চোখের উপর পড়া আলোর উৎস খুজতে গিয়ে উপরে তাকায় সে। আর তখনই ওটাকে দেখতে পায় সে। হ্যা, কোন ভুল হচ্ছে না তার। ওটা একটা ফ্লাইং সসারই। বেশ উপরে ভেসে আছে ওটা আর চারপাশে নীল আলো ছড়াচ্ছে। ওখান থেকেই তার চোখে আলো এসে পড়ছিল যদিও সেই আলোটা এখন নেই। ভয়ে দিশেহারা অয়ন লুকানোর জন্য চারপাশ দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই চোখে পড়ে না। ও উল্টা ঘুরে দৌড়ানের চেষ্টা করে কিন্তু পা দুটো নড়তে চায় না। ওর থেকে বেশ দূরে সসারটি নেমে আসে। ভয়ে জমে গিয়ে চুপচাপ সব কিছু দেখা ছাড়া অয়নের আর কিছুই করার থাকল না।

নিঃশব্দে সসারটি নেমে আসে আর এর গায়ের বেশ বড় একটি অংশ খুলে যায়। সেই খোলা অংশ দিয়ে শুধু আলোই বের আসছে। অয়নের মনে হতে থাকে আলোর ভিতর কিছু নড়ছে। অয়নের দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সেই আলোর ভিতর থেকে অবয়ব দেখা যাচ্ছে, মানুষেরই অবয়ব। অবয়বটা নিচে নামতে থাকে আর অয়নের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। আর তখনই অয়ন ওটাকে দেখতে পায়। আরে, ওটাতো একটা মানুষ। অয়নের ভয় বেশ কমে যায়। মানুষটাকে দেখে অয়নের তার সমবয়সীই মনে হচ্ছে। ছেলেটা অয়নের সামনে এসে দাঁড়ায় আর অয়ন পরিষ্কারভাবে ছেলেটার চেহারা দেখতে পায়। চেহারাটা দেখেই অয়নের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মাথা ঘুরতে থাকে আর সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ হওয়ার আগে অয়ন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা তার নিজের চেহারাটা দেখতে পায়।

অয়নের যখন হুঁশ ফিরে আসে তখন সে নিজেকে একটা চারকোণা টেবিলের উপর আবিষ্কার করে। মাথা তুলতে গিয়ে খুব ব্যথা অনুভব করে। হাত দিয়ে মাথার ডান পাশ স্পর্শ করলে ভেজা মনে হয় ওর কাছে। হাতটা চোখের সামনে আনতেই ও দেখে ওর হাতে রক্ত লেগে আছে। শুয়ে থেকেই সে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করে। একটা সাদা রুমে শুয়ে আছে সে। চারপাশের সবকিছুই সাদা। এছাড়া আর তেমন কিছুই নাই দেখার মত।

ইচ্ছে হলে উঠে বসতে পারো। অয়নের মাথার পিছন থেকে কে যেন বলে উঠলো। রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আর কথা গুলো শুনেই অয়নের ভয়টা ফিরে এল। আর দয়া করে অজ্ঞান হয়ো না। কন্ঠটা আবার বলে উঠলো। এবার অয়নের ভয়ের চেয়ে কেন জানি লজ্জা লাগলো। সে উঠে বসে পিছনে তাকাল। ওর বয়সী একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এর চেহারাটা অন্য রকম, ওর মত না। নিজের মত অন্য কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে ভয় তো পাবোই। ভীতু অয়নের মুখ দিয়ে কথাটা কিভাবে যেন বের হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে অয়ন চারপাশে তাকিয়ে ওর জমজটাকে খুজতে লাগলো। কাউকে না দেখতে পেয়ে মনে মনে শান্তি পেল। যাক বাবা, তখন নিশ্চয় আমি ভুল দেখেছি। ভাবে অয়ন।

কিছু খুজছো? ছেলেটা জিজ্ঞেস করে। নাহ। অয়ন দায়সারা ভাবে উত্তর দেয়। পৃথিবীতে কোথাও ফ্লাইং সসার তৈরি হয়েছে বলে তো শুনি নি। ভাবে অয়ন। তবে ছেলেটা আসলো কোথা থেকে? শুনেছিলাম আমেরিকায় এরিয়া-৫১ নামে একটা জায়গা আছে যেখানে মাঝে মাঝে সসার দেখা যায়। কিন্তু অন্য দেশের বিজ্ঞানীরা সেগুলোকে আমেরিকার তৈরি গোপন যুদ্ধযান বলেই মনে করে। এটা কি সেরকম কিছু? কিন্তু তাহলে এই ছোট ছেলেটা কি করছে?

তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না আমি কে? ছেলেটা প্রশ্ন করে। তা তো ইচ্ছে করছেই। অয়ন বলে। সেই সাথে তুমি কোথা এসেছ তাও জানতে ইচ্ছে করছে। ঠিক আছে, বলছি। ছেলেটা উত্তর দেয়। আমি সেপ্রা। কি?অয়ন মুখ কুচকে বলে। এটা আবার কোন দেশি নাম? এটা আসলে কোন নাম না। সেপ্রা বলে। এটা আমার জাতির নাম। তোমার জাতির নাম যেমন মানুষ, আমার জাতির নাম তেমন সেপ্রা। আমার কোন নাম নেই, আছে কোড। তবে তুমি আমাকে সেপ্রা বলেই ডাকতে পার।

সেপ্রা জাতি? অয়ন এবার অবাক হয়ে বলে। এরকম কোন জাতি তো পৃথিবীতে থাকে বলে তো শুনি নি। আসলে আমি তো পৃথিবীতে থাকি না। বলতে গেলে আমি তোমাদের গ্যালাক্সিতেই থাকি না। আমি তোমাদের পাশের ছায়াপথ সেরানা, যেটাকে তোমরা এন্ড্রোমিডা বলো, সেটাতে থাকি। ছেলেটা নিশ্চয় আমাকে বোকা বানাতে চাইছে। একটু পরই হেসে বলবে, কেমন বুদ্ধু বানালাম? অয়ন বলে। আর বোকা বানাতে পারবে না।

এবার সত্যি করে বলতো তুমি কে আর কোথা থেকেই বা আসলে? তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? ছেলেটা বলে। ঠিক আছে। তোমাকে প্রমাণ দেখাচ্ছি। ভয় পেয়ো না আবার। ছেলেটার কথা শেষ হওয়ার আগেই অয়ন দেখতে পেল ওর সামনে আরেকটা অয়ন দাঁড়িয়ে আছে।

অয়ন চিৎকার করতে চাইছিল কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। অয়ন ভয় পাচ্ছে দেখে সেপ্রা ওর আগের রুপে ফিরে এল। এজন্যই আগে বলে রেখেছিলাম ভয় পেয়ো না। সেপ্রা বলল। তুমি নিশ্চয় জাদুকর। অয়ন ভয়ে ভয়ে বলল। জাদু? সেপ্রা একটু অবজ্ঞার স্বরে বলল। জাদু বলে কিছু নেই। তোমরা মানুষেরা যা তোমাদের চিরায়ত নিয়মের বাইরে দেখ তাই জাদু বা অবাস্তব বা চোখের ভুল বলে ধরে নাও। তোমাদের আয়ত্বের বাইরেও যে অনেক কিছু থাকতে পারে তা মানতে চাও না।

অয়ন কিছুক্ষণ চুপ থাকল। ওটাকে বিশ্বাস করবে নাকি করবে না এই দ্বিধায় ভুগছে সে। সেপ্রাটা যে স্বাভাবিক কিছু না সেটা তো ও নিজের চোখেই দেখেছে। কিন্তু ওটাতো তার কোন ক্ষতিও করে নি। আচ্ছা, বিশ্বাস করলাম তোমার কথা। অয়ন বলল। কিন্তু তুমি পৃথিবীতে কেন এসেছ? আমি আমার বন্ধুদের সাথে ওয়ার্মহোল দিয়ে ভ্রমণ প্রাকটিস করছিলাম। সেপ্রা বলতে থাকে। ওয়ার্মহোল গুলো স্বল্প মাত্রার হওয়ার কথা ছিল যার ভিতর দিয়ে আমরা গ্রহের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারব। কিন্তু আমার ওয়ার্মহোলটা কিভাবে এত শক্তিশালী হয়ে গেল বুঝলাম না। একেবারে অন্য ছায়াপথে চলে এলাম।

ও, ওয়ার্মহোল কি তা জানো তো? হ্যাঁ, তা জানি। অয়ন মাথা ঝাকিয়ে বলে। স্বল্প সময়ে দীর্ঘ দূরত্ব ভ্রমণ করার কাল্পনিক পথ। যা বলেছিলাম। সেপ্রা মাথা নাড়িয়ে বলে। মানুষ এখনও আবিষ্কার করতে পারলো না এমন কিছু। তবে আমরা এটার ব্যবহার করছি নিয়মিত। তুমি জানো না, তবে আমাদের কাছে এটা অতি সাধারণ ব্যাপার। তবে আসল সমস্যা হলো আমরা এখন এখানে আটকে আছি। বুঝলে?

অয়নের মনে হয় যেন কিছু বুঝতে পারছে। কিন্তু তার মাথায় আরো অনেক প্রশ্ন চলে আসে। তোমরা কোথায় থাকো সেপ্রা? তোমাদের বাসস্থান কি এই সসারের ভিতর? তুমি তো বললে গ্যালাক্সির পাশের ছায়াপথে থাকো। সেপ্রা একটানা কথাগুলো বলতে থাকে। এটা একটা স্পেসশিপ, এটা আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে চলে যেতে সাহায্য করবে। এর মধ্যে অনেক কিছু সংরক্ষিত আছে। তবে এটা শুধু আমাদের গ্যালাক্সির মধ্যে কাজ করবে। আমাদের গ্রহ আমাদের গ্যালাক্সির মধ্যেই।

অয়ন কিছুটা আস্থাশীল হয়ে প্রশ্ন করে, তোমরা কি আমাকে যেতে বলছো?

কিন্তু, তুমি তো মানুষ, তুমি কিছু জানো না। সেপ্রা একটু বিরক্ত হয়ে বলে, তবে হয়তো তুমি তোমার গ্রহে ফিরে যেতে চাও।

প্রথম প্রহর

চাচা কাহিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *