
রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই “অহংকার পতনের মূল”-এ প্রবাদটি শুনেছো এবং অহংকারীদের পতনও দেখছো। সত্যি বলতে কী, কোন মানুষের অহংকার করা সাজে না। গর্ব ও অহংকার একমাত্র আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য। হযরত লোকমান তাঁর ছেলেকে অহংকার থেকে দূরে থাকার আদেশ দিয়ে বলেছেন, “ঘৃণা ও অবজ্ঞাভরে মানুষের কাছ থেকে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না, গর্ব ও অহংকারের সঙ্গে দুনিয়াতে চলো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারী লোকদেরকে পছন্দ করেন না।”
অন্যদিকে হযরত আলী (আ.) বলেছেন, “আল্লাহ যদি কাউকে অহংকার করার অনুমতি দিতেন তাহলে তিনি সে অনুমতি দিতেন নবী-রাসূল ও আউলিয়াদের। কিন্তু আল্লাহপাক অহমিকাকে তাদের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং বিনয়কে তাদের জন্য গ্রহণযোগ্য করেছেন।” ইমাম আলীর দৃষ্টিতে ‘অহমিকা অনেকগুলো রোগের সমষ্টি।’ সম্ভবত এ কারণেই অহংকারী ব্যক্তিরা সব সময় নিজেদের কথা ও কাজকে উন্নত ও গ্রহণযোগ্য মনে করে। তারা বুঝতে পারে না যে, তাদের মধ্যেও দোষত্রুটি আছে এবং অন্যরা তাদের চাইতেও অনেক বেশী যোগ্যতা ও পূর্ণতার অধিকারী হতে পারেন।
ইমাম আলী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তার দোষত্রুটি কখনও তার চোখে ধরা পড়বে না।” রংধনু আসরে আমরা অহংকারের পরিণতি সম্পর্কে ইরানে প্রচলিত একটি গল্প প্রচার করেছি।
বসন্তের চমৎকার একটি দিনে এক বনের মধ্যে ফুটলো লাল টুকটুকে এক গোলাপ। ফোটার পর থেকেই গোলাপটি তার আপন সৌরভে নজর কেড়ে নিল আশপাশের সবার। ছোট-বড় সব গাছ গোলাপের সৌন্দর্য আর সুগন্ধে মুগ্ধ হয়ে গেল। গোলাপের কাঁটা দেখে যে পাইন গাছ একদিন টিটকারি দিয়েছিল সেও বলে উঠল, “আহ্! কী চমৎকারই না ফুলটি! আমি যদি এমন সুন্দর হতে পারতাম তবে আমার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ত আরো অনেক দূর।”
পাইনের দুঃখ দেখে অন্য একটি গাছ তাকে সান্ত্বনা দিল। এদিকে সকলের প্রশংসা আর অভিভূত দৃষ্টি দেখে গোলাপ ধীরে ধীরে অহংকারী হয়ে উঠল। সে গর্বভরে বলল, ‘এই বনের মধ্যে আমিই সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় গাছ।’ গোলাপের এই কথায় পাইন গাছ বলল, ‘কেন তুমি এমন কথা বলছ? এই বনে তোমার মতো আরো অনেক সুন্দর সুন্দর তরুলতা আছে। তুমি কেবল তাদের একজন, এর চেয়ে বেশী কিছু নয়।’
এ কথার পরও গোলাপের গর্ব কমল না। সে উত্তর দিল, ‘তুমি যা-ই বল না কেন, আমার তুলনা কেবল আমি। দেখ না আমার দিকে সবাই কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে!’ একটু পর গোলাপটি তার পাশের একটি ক্যাকটাস গাছের দিকে ইশারা করে বলল, ‘দেখতো এটা কত কুৎসিত একটি গাছ। ওর সমস্ত শরীরজুড়ে শুধু কাঁটা আর কাঁটা।’
গোলাপের কথা শেষ না হতেই পাইন গাছটি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এসব কী ধরনের কথা! তোমার কাছে যা সুন্দর অন্যের কাছে তাই অসুন্দর মনে হতে পারে। আর তাছাড়া, তোমার গায়েও তো কাঁটা আছে।’ পাইনের কথায় অপমান বোধ করল গোলাপ। ভীষণ রেগে গেল সে। বলল, ‘হে পাইন, আমি এতদিন ভাবতাম তোমার রুচি বোধহয় অন্যদের চেয়ে ভালো। এখন দেখছি সৌন্দর্য সম্পর্কে তোমার তেমন কোন ধারণাই নেই! আমার কাঁটা আর ক্যাকটাসের কাঁটাকে তুমি এক করে ফেললে!’
এই বলে কপাল কুঁচকে গোলাপ তার মূলটিকে ক্যাকটাসের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু একচুলও নড়ালে পারল তার মূলকে। ক্যাকটাসের কাছ থেকে দূরে সরতে না পেরে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল গোলাপ। তবে ক্যাকটাস কিন্তু গোলাপের বাঁকা চাহনিতে একটুও মন খারাপ করল না। বরং গোলাপকে বুঝানোর চেষ্টা করল যে, আল্লাহ কোনো কিছুকেই উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি।
এ ঘটনার পর বেশ কিছুদিন চলে গেল। বসন্ত শেষে শুরু হলো গ্রীষ্ম। আবহাওয়া গরম হতে থাকায় মাটি শুকিয়ে ফেটে যেতে লাগল। পানির অভাবে অনেক ছোট ছোট গাছের সঙ্গে অহংকারী গোলাপ ফুলটিও শুকিয়ে যেতে লাগল। এতে গোলাপের সৌন্দর্য দিন দিন কমে যেতে থাকলো।
একদিন গোলাপটি দেখতে পেলো- কয়েকটি চড়ুই পাখি তাদের ঠোঁট ক্যাকটাসের শাখা-প্রশাখায় প্রবেশ করিয়ে কী যে চুষে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে তৃপ্তির সঙ্গে। এই দৃশ্য দেখে গোলাপ অবাক হয়ে গেল। পাখিদের আসা-যাওয়ার কারণ সম্পর্কে সে পাইন গাছের কাছে জানতে চাইলো- ‘প্রতিদিনই দেখছি তোমার কাছে অনেক পাখি যাওয়া-আসা করছে। তোমার মত একটা কুৎসিত গাছের কাছে তারা কেন আসছে আমি ভেবে পাই না। বলতো কেন আসে তারা?’
পাইন গাছ জানালো, পাখিরা ক্যাকটাসের শরীরে ঠোঁট ঢুকিয়ে পানি সংগ্রহ করে। বিস্মিত গোলাপ জানতে চাইল-‘পাখিরা যখন ক্যাকটাসের শরীরের ঠোঁট ঢুকিয়ে দেয় তখন সে ব্যথা পায় না?’ পাইন বলল : ব্যথা পায় বটে, কিন্তু সে কোনো পাখির কষ্ট দেখতে চায় না।
পাইনের কাছ থেকে গোলাপ যেন এক নতুন তথ্য আবিষ্কার করল। সে বলল: ‘হায়! এই গাছটির মধ্যে পানি আছে! অথচ আমি পানির জন্য কষ্ট পাচ্ছি।’ এ কথা শুনে পাইন গাছ বলল: ‘ক্যাকটাসের শরীর থেকে তুমিও পানি পান করতে পার। তুমি যদি ওর কাছে পানি চাও তাহলে চড়ুইরা ওর শরীর থেকে তোমাকে পানি এনে দিতে পারবে।’
ক’দিন আগে ক্যাকটাসকে যেভাবে অপমান করেছিল তা ভুলে যায়নি গোলাপ। তাই ওর বেশ লজ্জা হচ্ছিল ক্যাকটাসের কাছে পানি চাইতে। ওদিকে জীবনও তার যায় যায় অবস্থা। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে ক্যাকটাসের কাছে পানি চাইল গোলাপ।
ক্যাকটাস হাসিমুখে গোলাপকে পানি দিতে রাজি হলো। এরপর চড়ুইরা তাদের ঠোঁট ভর্তি করে পানি এনে গোলাপ গাছের গোড়ায় ঢালতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোলাপের মনে স্বস্তি ফিরে এলো।
এ ঘটনা থেকে গোলাপ গাছ উপযুক্ত শিক্ষা পেল। সে আর কখনো অহংকার ও তাচ্ছিল্য করে কারো সম্পর্কে কোনো বাজে মন্তব্য করেনি। ক্যাকটাসের উদারতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে অন্যভাবে গড়ো তুলল গোলাপ।