
পশু-পাখি পোষার রীতি আদিম যুগ থেকেই চলে আসছে। আধুনিক যুগেও অধিকাংশ বাড়িতে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, কুকুর, বিড়ালসহ বিভিন্ন ধরনের গৃহপালিত পশু পোষ মানানো হয়। এছাড়া অনেকেই ঘুঘু, মুনিয়া, ময়না, টিয়া, কোয়েল, তোতা, কবুতরসহ আরো অনেক পাখিকে পোষ মানায়। অবশ্য প্রায় সব এসব পোষা প্রাণীই মানুষের কোন না কোন কাজে আসে। তাই মানুষ তাদেরকে ভালবাসে, আদর-যত্ম করে।
রংধনু আসরে আমরা পোষা প্রাণীর প্রতি ভালবাসা সম্পর্কে একটি রূপকথা প্রচার করেছি।
অনেক দিন আগের কথা। ইরানের এক ছোট্ট গ্রামে বাস করত এক বুড়ি। তার ঘরের সামনের উঠানটি ছিল আকারে ছোট। বুড়ি ছিল খুব দয়ালু। ছোট্ট ছেলেমেয়েরা তাকে ভীষণ ভালবাসত। একদিন সন্ধ্যা বেলায় সূর্য ডুবার পর বুড়ি বাতি জ্বালিয়ে জানালার ধারে রাখল। এ সময় জোরেসোরে বাতাসের সাথে সাথে বৃষ্টিও শুরু হল। ঠাণ্ডার কারণে বুড়ি যেই মেঝেতে বিছানা পেতে শুতে যাচ্ছে, এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার ঠকঠক শব্দ হতে লাগল।
বুড়ি বলে ওঠল, ‘কী কাণ্ড! এই অসময়ে আবার কে এল?’ এ সময় দরজার ওপার থেকে জবাব এল, ‘আমি বুড়ি মা, আমি ছোট্ট চড়ুই। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে চুপসে গেছি। দয়া করে দরজাটা খুলুন।’ বুড়ি দরজা খুলে গিয়ে চড়ুইকে ভেতরে আসতে বলল। চড়ুই’র ঠোঁট থেকে বৃষ্টির ফোঁটা তখনও টপ-টপ করে পড়ছিল। বুড়ি চড়ুইটিকে ঘরের ভেতরে নিয়ে নিয়ে শুকনো কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে দিল পাখাদুটো।
এ সময় আবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। বুড়ি দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আবার কে-কড়া নাড়ছ?’ দরজার অপরপাশ থেকে জবাব এল, ‘আমি এক মুরগি। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে চুপসে গেছি। দয়া করে দরজাটা একটু খুলবেন?’ বুড়ি দরজা খুলে মুরগিকেও ঘরে আসার অনুমতি দিল। এরপর বুড়ি তার পিঠের ওপর কাপড় জড়িয়ে দিল। মুরগি একপাশে গিয়ে গা ঝাড়া শুরু করল যাতে বৃষ্টির পানি শুকিয়ে যায়।
বুড়ি মুরগির গায়ে গরম কাপড় জড়ানো শেষ করা মাত্রই কে যেন আবার দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করল। বুড়ি কোন ভাবনা-চিন্তা না করে তক্ষুণি দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কে, দরজায় কড়া নাড়ছে কে?’ দরজার ওপাশ থেকে জবাব এল, ‘আমি কাক মশাই, বুড়ি মা। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছি। দরজাটা খুলবেন দয়া করে?’
বুড়ি দরজা খুলেই বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, ভিতরে এসো।’ একটু পর আবার দরজার কড়া নড়ে উঠল। এবার ঢুকল একটা বিড়াল। বিড়ালকে ঢুকতে দেখেই চড়ুই, কাক আর মুরগি ভয়ে জড়সড় হয়ে কাঁপতে শুরু করল।
বিড়াল হেসে বলল, ‘ভয়ের কী আছে! আমরা তো সবাই এখানে মেহমান। সময়টা যাতে ভালো কাটে তেমনই কিছু একটা করব।’ বিড়ালের কথা শুনে সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এ সময় বুড়ি বিড়ালের গায়েও কাপড় জড়িয়ে দিল।
বিড়াল ঘরের এক কোণে গিয়ে পা ছড়িয়ে আরাম করে মুখ-চোখ বুজে থাবা চেটে সাফ করা শুরু করল। বুড়ি কেবলি বসতে যাচ্ছে এমন সময় আবার কড়া নাড়ার আওয়াজ হল। বুড়ি দরজা খুলে দেখতে পেল একটি কুকুর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরের সাথে কথা বলতে বলতেই সেখানে হাজির হল একটি কালো ষাঁড়। বুড়ি তাদেরকেও ঘরে আসার অনুমতি দিল। ষাঁড় শিং নিচু করে ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকেই জোরে গা-ঝাড়া দিতে শুরু করল। ষাঁড়কে দেখে সবাই তাকে জায়গা করে দিতে এদিক-ওদিক সরে যেতে লাগল। ছোট্ট চড়ুই এসব দেখে খুকখুক করে চাপা হাসি হাসল।
সব পশু-পাখি যার যার জায়গায় বসার পর বুড়ি বলল, “তোমরা সবাই এখন আরাম করে ঘুমাও। কাল সকালে যার যার বাড়ি ফিরে যেও।” এ কথা বলে বুড়ি চলে যাওয়ার পর চড়ুই, মুরগী আর কাক উড়ে গিয়ে জানালার নিচের কাঠটায় ঘুমাতে গেল। বিড়াল, কুকুর আর ষাঁড় ঘুমালে মেঝের ওপর।
পরদিন সকাল বেলা। বুড়ি আগের চেয়ে বরং একটু দেরিতেই ঘুম থেকে জাগল। ঘর থেকে বের হয়ে বুড়ি দেখতে পেল- কাক চা তৈরি করছে, কুকুর উঠোন ঝাঁড় দিচ্ছে আর ষাঁড় ঘরের স্যাঁৎসেতে মেঝেটা ঠিক করতে ব্যস্ত। এ কাজে মুরগি তাকে সাহায্য করছে। সবার ব্যস্ততা দেখে বুড়ি তো মহা খুশী! সবার খাওয়ার কথা চিন্তা করে সে বোরকা পরে রুটি কিনতে দ্রুত বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বুড়ি রুটি নিয়ে বাড়ি ফিরল। এ সময় সবাই চায়ের কেটলির চারদিকে গোল হয়ে বসে নাস্তা খাওয়া শুরু করল।
নাস্তা খাওয়া শেষে ষাঁড় বলল, “গত রাতে আসলে আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে এখানে এসে পড়েছি। এখন সবার উচিত আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেওয়া।” ষাঁড়ের কথা শুনে সবার মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ বুড়ি তাদেরকে যেভাবে সেবা-শশ্রূষা করেছে তা কোনদিন ভোলার নয়।
সবার মনের অবস্থা দেখে বুড়ি বলল, “তোমাদের বিদায় দিতে আমারও কষ্ট হচ্ছে। আমারও ইচ্ছা হচ্ছে- তোমরা সবাই আমার এখানে থাকো। কিন্তু বাড়িটা এত ছোট যে, তোমাদের সবার জায়গা হবে না। তবু ছোট চড়ুইটা না হয় আমার কাছেই থাক।” ছোট চড়ুই বুড়ির কাছে থাকার সুযোগ পাচ্ছে দেখে ষাঁড় একটু চিন্তা করে বলল, “আমি কিন্তু আপনার জন্য মিহি করে গম ভাঙিয়ে দিতে পারি-তবু কি আমাকে বিদায় করে দিতে চান?”
বুড়ি বুঝতে পারল যে, ষাঁড় যেতে চাইছে না। তাই সে বলল, “ঘরটা যদিও বেশ ছোট, তবু ঠিক আছে-না হয় থেকেই যাও।” চড়ুই পাখি আর ষাঁড় থাকার অনুমতি পাচ্ছে দেখে বিড়াল লেজ নেড়ে বলল, “আমি মিউ-মিউ ডাক শোনাব এবং ইঁদুরকে দেখামাত্র পাকড়াও করব। তবু কি আমার চলে যেতে হবে?”
বুড়ি বলল, “ওরে আমার পুষি সোনা, তোমাকে কি আমি বিদায় করতে পারি। তুমিও থেকে যাও।” এ সময় কাক বলল, “আমি কা কা করে সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতে পারব। তারপরও কি আমাকে চলে যেতে হবে?” কাকের কথা শেষ না হতেই মুরগি বলল, “আমি আপনার জন্য ডিম পেড়ে দেব। তবু কি আপনি আমাকে বিদায় করে দেবেন?”
বুড়ি বলল, “ঠিকাছে তোমরাও থাকো। তবে, এখানে থাকতে হলে সবাই সবাইকে সাহায্য করে নিজেদের ঘর সুন্দর করতে হবে; যাতে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পার।”
বুড়ির আশ্বাস পাওয়ামাত্র সবাই থালাবাটি পরিষ্কার করে যে-যার কাজ শুরু করতে শুরু করল। এরপর থেকেই তারা বছরের পর বছর সুখে-শান্তিতে বসবাস করে আসছে।