
রাত ১২ টা বেজে ৫ মিনিট। কুমিল্লা জেল। জেলের মধ্যে আজ অনেক মানুষের কোলাহল একটু পরে একটা ফাঁসি হবে। আসামির নাম রসু খাঁ। সেই বিখ্যাত সিরিয়াল কিলার।
যে কিনা ১১ টি নিরাপরাধ তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে। রসু খাঁর খুনের স্টাইল খুবই বীভৎস।
রাতের আঁধারে নির্জন মাঠে ধর্ষণের পর ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মারত।
আদালতের রায়ে তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। রাত ৩ টা ১ মিনিটে সেই ফাঁসি দেওয়া হবে।
কুমিল্লা জেলের সেকেন্ড অফিসার মিলন সাহেব একটু পর পর ঘেমে উঠছেন। তার চাকরি জীবনে অনেক ফাঁসি দেখেছেন তবু কেন আজ এত ভয় লাগছে তিনি জানেন না।
জেলার সাহেব একটু পর আসামির প্রিজনে যাবেন। সাথে তাকেও যেতে হবে। এই ভয়ে তিনি অস্থির কিনা কে জানে।
মিলন সাহেব এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেলেন। ঠোঁট হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে মনে পড়লো রসু খাঁর কোন আত্তিয় কিনবা তার বউ তাকে শেষ দেখা দেখতে আসেনি।
ফাঁসির তারিখ ঠিক হবার পর রসু খাঁর বাড়িতে চিঠি পাঠানো হয়েছে কিন্তু কোন জবাব না পেয়ে থানার একজন জুনিয়র অফিসারকে রসু খাঁর বাড়ি পাঠানো হয়েছে।
সে ফিরে এসে জানিয়েছে রসু খাঁর বাড়ি পুর খালি। বাড়িতে কেউ থাকেনা।
আশেপাশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো রসু খাঁর বউ বাচ্চা ঢাকায় থাকে কিন্তু কই থাকে তা কেউ বলতে পারলো না।
এ কথা রসু খাকে জানানো হয়েছে, কিন্তু রসু খাঁ খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে ব্যাপারটা।
রসু খাঁ কথা কম বলে। কুমিল্লা জেলে রসু খাঁ মিলন সাহেবের তত্ত্বাবধানে ছিল। মিলন সাহেব অনেক চেষ্টা করেছেন তার সাথে কথা বলার।
কিন্তু রসু খাঁ ফাঁসির কথা শুনার পরি কেমন চুপচাপ থাকা শুরু করে। তবে যখন তার বিড়ি শেষ হয়ে যায় তখন- খুব করুন সুরে মিলনকে বলতো- সার, এক প্যাকেট বিড়ি এনে দেন না।
কদিন পরে তো মরেই যাব জাহান্নামে বিড়ি আছে কিন তা তো জানি না। বলে মিলনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নিশব্দে হাসত।
রসু খাঁর দাড়ি গোঁফের মধ্যে হলুদ দাঁতের সেই নিশব্দ হাসি দেখে মিলন সাহেবের অন্তর কেঁপে উঠত। এরকম বীভৎস হাসি মিলন সাহেব কখনো দেখেননি।
জেলার সাহেবের ডাকে মিলন সাহবের ছিন্তার সূত্রে বাধা পড়লো। জেলার সাহেব এখন আসামির সাথে দেখা করবেন। তারপর ইমাম সাহেব আসামিকে তওবা পড়াবেন।
জেল খানার এক নির্জন সেলে রসু খাঁকে রাখা হয়েছে। কেমন স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা। সেলের ভিতর। ৬০ ওয়াটের একটা বাতি মিটমিট করে জ্বলছে।
মিলন সাহব জেলার সাহেবের পিছপিছ সেলের ভিতর ঢুকলেন। রসু খাঁ সেলের এক কোনে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। কোন সাড়া শব্দ নেই।
জেলার সাহেব জিজ্ঞাস করলেন- “রসু খাঁ, কেমন আছ? রসু খাঁ কোন জবাব দিল না। সুধু মুখ তুলে একবার জেলারের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেলল।
মিলন সাহেব অবাক করে তাকিয়ে দেখলেন রসু খাঁর চোখে কোন ভয় নাই। তার অভিজ্ঞতায় তিনি জানেন এই সময়ে ফাঁসির আসামির অনেক হেলুসিনেশন হয়।
তারা ফাঁসির কাষ্ঠে যাওয়ার এক মিনিট আগেও ভাবে কোন এক দৈব শক্তি তাকে রক্ষা করবে।
কিন্তু যখন আসামিকে ফাঁসির কাষ্ঠে উঠানো হয় তখন আসামি একদম শান্ত হয়ে যায়। যেন সে তার মৃত্যুকে সে ইতিমধ্যে গ্রহন করে ফেলেছে।
রসু খাঁ কোন জবাব দিল না। সে আবার তার চোখ নামিয়ে ফেলল।
জেলার সাহেব আবার জিজ্ঞাস করলেন- তোমার বউ কিনবা সন্তান তো এল না, তাদের কিছু বলতে হবে? রসু খাঁ এইবার বলল- আমি জানি তারা আমার মরার পরও আমার লাশ নিতে আসবে না।
তাদের কিছু বলার দরকার নেই। জেলার সাহেব বললেন- ঠিক আছে, সে দেখা যাবে।
একটু পর একজন তোমাকে গোসল করাতে নিতে আসবে, গোসল শেষে ইমাম সাহেব এসে তোমাকে তওবা পড়াবেন।
তুমি তওবা পড়ে নিও। রসু খাঁ বলল- তওবা পরতে হবে না। আপনি আমার জন্য একটু বিড়ির বেবস্থা করেন।
জেলার সাহেব রসু খাঁর জন্য বিড়ি পাঠিয়ে দিলেন। মিলন সাহেব ভেবেছিলেন রসু খাঁ মুখে বললেও সে তওবা পড়বে।
কিন্তু মিলন সাহেবের ধারনা মিথ্যা করে রসু খাঁ তওবা পড়লো না। রাত ৩ টা ১ মিনিতে রসু খাঁর ফাঁসি হয়ে গেল।
কিন্তু মিলন সাহেবকে অবাক করে দিয়ে ফাঁসির ঠিক আগ মুহূর্তে রসু খাঁ – মা, মাগো বলে চিৎকার করে কেঁদে দিল।
ফাঁসির পাটাতন সরে যাওয়ার আগ মুহুতেও রসু খাঁ কাদছিল। এক বছর পর- মিনু একটা লক্ষ্মী মেয়ে। সদা হাস্য মিষ্টি চেহারার মেয়েটা ছাত্রি হিসাবেও অনেক ভাল।
এইবার সে কুমিল্লা সরকারি মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছে। হোস্টেলে এখনো সিট পায়নি সে, তাই তারা ৩ জন বান্ধবি মিলে কুমিল্লার ঠাকুর পাড়ায় একটা বাসা নিয়েছে।
বুয়া এসে রান্না করে দেয়। বাসা থেকে কলেজ মাত্র ১০ টাকার রিক্সা ভাড়া। যেতে আসতে কোন সমস্যা হয় না। ক্লাস শুরু হয়েছে প্রায় ১ মাস হয়ে গেল।
নতুন জীবনে মিনু অভ্যস্ত হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। মেডিক্যাল কলেজ ৩ দিনের বন্ধ পড়েছে। মিনুর অন্য ২ বান্ধবি দুপুরেই বাড়ি চলে গেছে।
মিনু যেতে পারেনি অন্য কারনে। কারন হল মিনু তার ক্লাসের জন্য এখনও কঙ্কাল কিনতে পারেনি।
নতুন কিনতে চাইলে কিনতে পারত, দাম পড়ত ১০ হাজার টাকা কিন্তু মিনুর এক বান্ধবি বলল- নতুন কিনে ফায়দা কম, তার চেয়ে সিনিয়র ব্যাচের কোন আপুর থেকে কিনে নে, কম দামে পাবি।
টাকা বাঁচবে। মিনুও তাই ভাবল। সুধু সুধু এত টাকা দিয়ে নতুন না কিনে পুরান কিনবে যে টাকা বাঁচবে সে টাকা দিয়ে ছোট ভাইটার জন্য গল্পের বই কিনবে।
অনেক খোঁজ করেও যখন পুরানো কঙ্কাল পাওয়ার আশা ছেড়ে দিল তখন আজ সকালেই কলেজের একজন পিওন বলল তার কাছে একটা পুরানো কঙ্কাল আছে তবে বেশি ব্যাবহার করা হয়নি।
আজ সন্ধায় ছুটির পরই পিওন কঙ্কাল দিতে পারবে। সেই জন্য মিনু বাড়ি যেতে পারেনি।
সে আজ কঙ্কালটা আজ পেলে কাল বাড়ি যাবে। ঠিক সন্ধ্যা ৭ টায় পিওন মিনুর বাসায় কঙ্কাল দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেল। কিন্তু পিওন মিনুকে একটা তথ্য বলল না যে- এই কঙ্কালের আগের মালিক যে মেয়েটি ছিল সে খুন হয়েছে এক মাঠের মাঝে ধর্ষিত অবস্থায়। রাত ১১ টা। মিনু ভাত খেয়ে কঙ্কালটা নিয়ে বসল। হুম। খারাপ না। নতুনের মতই আছে।
এত নতুন কঙ্কাল মাত্র ৩ হাজার টাকায় পেয়ে মিনু খুব খুসি। অনেক টাকা বেচে গেল। এই টাকা দিয়ে অনেক মজা করা যাবে।
মিনু এরই মধ্যে কয়েকটা এনাটমি ক্লাস করেছে, বান্ধবিদের কঙ্কাল গুল দেখেছে। তাই তার কঙ্কাল নিয়ে বিশেষ কোন ভয় নেই।
একটা কঙ্কাল জাস্ট একটা সাবজেক্ট, এর বেশি কিছু নয়। তবে মিনু একটু খেয়াল করে দেখল- কঙ্কালটির হনুর হাড়টি যেন একটু উঁচু।
এটা মনে হল কোন পুরুষ মানুষের কঙ্কাল। রাত ১১.৩০ এ মিনু ঘুমাতে গেল লাইট বন্ধ করে। এই ঠাকুর পাড়া এলাকাটি একটু নির্জন টাইপের পাড়া।
পুরা এলাকা যেন থ মেরে আছে। তার উপরে কারেন্ট চলে গেছে। মিনু খোলা জানালা দিয়ে দেখল পূর্ণিমার চাঁদ ঢেকে গেছে কাল মেঘে।
এই দৃশ্য দেখতে দেখতে মিনু এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো। হতাথ মিনুর ঘুম ভেঙ্গে গেল।
সে নিজেকে আবিস্কার করল স্যাঁতস্যাঁতে এক মাঠে! মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে লাগছে । যাহ্! আমি স্বপ্ন দেখছি। আমিতো আমার বাসায় শুয়ে আছি।
এ ভেবে যখন মিনু পাস ফিরতে যাবে তখন সে চাঁদের আবছা আলোয় দেখতে পেল একটা বিশাল দেহি পুরুষ একটু দূরে একটা বড় দায়ে শান দিচ্ছে।
চাঁদের আলো পড়ে দায়ের বুক চকচক করছে। চাঁদের আলোয় মানুষটিকে আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে। মুখ ভর্তি দাড়ি মোচ, গালের দুপাশে হনুর হাড় একটু উঁচু।
মিনু আবার নিজেকে সান্ত্বনা দিল- আমি স্বপ্ন দেখছি। এ সত্যি হতে পারেনা।
এক পশলা হিমেল হাওয়া মিনুর শরির যখন ছুয়ে গেল তখন মিনু বুঝতে পারলো তার পুরো শরির ঘাম দিয়ে গেছে।
চাঁদের উপর থেকে কাল মেঘের ভেলা যখন সরে গেল তখন পূর্ণিমার আলোয় দেখতে পেল কোন এক নির্জন মাঠের মাঝখানে শুয়ে আছে মিনু।
মিনু উঠে বসতে গেল কিন্তু তার পুরো শরিরে কোন শক্তি পেল না।
অসহায় হয়ে সেই লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল। চাঁদের আলোয় দেখতে পেল লোকটি দায়ের সাদা বুকে আঙ্গুল দিয়ে ধার পরিক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়ে মিনুর দিকে ফিরল।
মিনুর কাছে এসে দাঁড়ালো বিশাল ছায়া মূর্তিটি। মিনুর মনে হল এই লোকটিকে সে চিনে এবং অনেক ভাল করেই চিনে। মিনু ভয়ে অস্থির হয়ে গেল।
সে ভয়ে এপাস ওপাশ করতে লাগলো।
ছায়ামূর্তিটি শান্ত ভঙ্গিতে মিনুর শরীরের উপর নিজের শরীর চাপিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল- আমি রসু খাঁ, আমি সেই খুনি রসু খাঁ! পরদিন- পরদিন মিনুর লাশ পাওয়া গেল ঠাকুর পাড়া থেকে ৭ মাইল দুরের এক নির্জন ক্ষেতে।
ধর্ষিত এবং ক্ষতবিক্ষত অবস্থায়। কে যেন নির্মম আক্রশে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে নিস্পাপ মেয়েটিকে। মিনুর পাশে পাওয়া গেল গতকাল কেনা হনুর হাড় উঁচু কঙ্কালটি।
মিনু হত্যার রহস্য আর উন্মোচিত হল না। পিয়ন মতিন পুলিশকে বলল- মিনু তার কাছ থেকে কঙ্কালটি কিনেছে কিন্তু মিনু বলেছিল টাকা পরে দেবে তাই পুলিশ পিয়ন মতিনকে কঙ্কালটি দিয়ে দিল।
মিনুর মৃত্যুর এক বছর পর- মতিন সকাল ১০ টায় দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। মাথায় উস্কু খুস্কু চুল। গালে দাড়ি মোচের ঘন জঙ্গল। যেন তার মাথায় অনেক দুশ্চিন্তা।
নতুন ব্যাচের একটা মেয়ে মতিনকে এসে বলল- মতিন ভাই, একটা কঙ্কাল জোগাড় করে দেননা।
টাকার সমস্যা তাই নতুন কিনতে পারব না। মতিন বলল- আফা, কোন ছিন্তা কইরেন না। আমার কাছে একটা আছে।
এক আপা পাস করে যাওয়ার সময় আমাকে দিয়ে গেছে। আপনের বাসার ঠিকানা দিয়ে যান আমি সন্ধায় ডিউটি শেষ করে দিয়ে আসবো। মেয়েটি সরল মনে ঠিকানা দিয়ে হাসি মুখে চলে যাচ্ছে।
কিন্তু মেয়েটি যদি একটু পিছনে ফিরে তাকাত দেখতে পেত মতিনের মুখে ক্রুর হাসি, হাসির দমকে মতিনের হনুর হাড় দুপাশে ফুলে উঠেছে। অস্বাভাবিক ভাবে।