এবার তোমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের এক মজার বন্ধুর সাথে। তার নাম হিরোতাদা ওতোতা। তোমরা শুনলে হয়তো আতকে উঠবে। আসলে তিনি জন্মগতভাবেই জন্মেছিলেন সম্পূর্ণ হাত পা ছাড়াই। আল্লাহর এই পৃথিবীতে কোন মানুষই স্বয়ংম্পূর্ণ নয়। তাই কারো দুটি হাত পা থাকলেই যেমন গর্ব করা উচিত নয়, ঠিক তেমনি যাদের এক্ষেত্রে অপূর্ণতা আছে, তাদেরও ভেঙ্গে পড়া উচিত নয়। তাই ২৩ বৎসর বয়োসি ওতোতা মুখ গোমরা করে বসে থাকেননি, সম্পূর্ণ হাত-পা ছাড়াই তিনি তার যোগ্যতা প্রমান করেছেন। এই বিকলাঙ্গ জাপানী তরুণের লেখা বই সম্প্রতি জাপানে তো বটেই সারা বিশ্বেই আলোড়ন তুলেছে। ছবিতে তার এক বই ‘নো ওয়ান্স পারফেক্ট ‘এর ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে তিনি এক তরুণীর সাথে কথা বলেছেন। তিনি এই বইয়ে জাপানের সামর্থ্যবান লোক ও বিকলাঙ্গ লোকদের পার্থক্য ঘুচিয়ে দেয়ার আহবান করেছেন। অর্থাৎ ওতোতা আজ জীবন যুদ্ধে এক বিজয়ী বীর। আমাদের অনেক বন্ধুই আছে যারা এরকম প্রতিবন্ধী হওয়ার পরও আজ আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
আমার প্রিয়বন্ধু দশম শ্রেনীর ছাত্র জন্মান্ধ আজাহার এর কথা আজ মনে পড়ে। সে অন্ধ হয়েও দাবা খেলায় এক সময়কার গাজীপুর জেলা চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে দিয়েছিল। আমার এক খালাতো ভাই সাহস করে তার সাথে খেলতে গিয়ে গো-হারা হলো। প্রথম সাক্ষাতের সময় সে আমাকে একটি শুভ্র কাগজে অন্ধদের ব্রেইলী পদ্ধতিতে একটি লেখা লিখে দিয়েছিল। আজও যা আমার নিত্যসঙ্গী, তাতে লেখা আছে ‘আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন, আমাদের দেখতে আসার জন্যে ধন্যবাদ।’আরেক বন্ধু লিটন অস্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। জন্মগতভাবে সে বোবা, অথচ মন তার সর্বদা কথা বলার জন্য আঁকুপাঁকু করে। প্রথম সাক্ষাতেই সে তার একটি কাগজে লিখলো,আমার নাম লিটন, আমাকে কি তোমার ভাল লেগেছে? তাকে ভালো না বেসে কেউ থাকতে পারবে না। সে একজন মৃৎশিল্পের দক্ষ কারিগর, তার দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় মাটির ক্যানভাসে ফুটে ওঠে বর্ণাঢ্য সব প্রাকৃতিক দৃশ্য। আর হৃদয়েও তার সেই বর্ণাঢ্যতার বাগান, আমাদের হাত ধরে জোর করে তার নিজহাতে মোছা সবচেয়ে বড় চেয়ারগুলোতে বসিয়ে দিল। বাজার থেকে চা আনালো, কোন ভাবেই না খেয়ে যেতে দেবে না। তার সেই আকুতিভরা ছলছল চোখের আবেদন ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসে এটা কার সাধ্য! আরেক ভাই কাজল, সত্যিই চোখ তার কাজল কালো কিন্তু একটি চোখে আলো নেই, একটি পা প্যারালাইজড। কম্পিউটারে রয়েছে তার প্রচন্ড দক্ষতা।জীবন সংগ্রামে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে চলতে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শুধু তাই নয়,সারাদেশের মানসিক প্রতিবন্ধীদের সংগঠন ডব্লুসিডি -এর সে একজন কেন্দ্রীয় নেতা। অনেক যোগ্যতা থাকার পরও হয়তো তারা আমাদের দেশের সামগ্রিক অব্যবস্থার কারণে দ্রুত এগুতে পারছে না। কিন্তু উন্নত দেশগুলিতে কি অবস্থা? চলো আমরা একটু খোঁজ নেই মাইকেল কোলম্যান, আইবিএম কোম্পানির গ্লোবাল অপারেশনস বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, বোমা বিকল করতে গিয়ে দুটো হাতেরই কব্জি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু সাহস হারাননি। যুদ্ধ শেষে আজ জীবনযুদ্ধে তিনি এখন বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ সিপাহসালার। ক্রিস হারম্যান, আমেরিকার ক্রেস্টর ব্যাংকের কাস্টমার সার্ভিস রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসাবে কাজ করছেন। তিনি একজন কোয়ড্রিপ্লেজিক অর্র্থাৎ দুটো হাত এবং দুটো পায়ের কোনকিছুই নাড়াতে পারেন না। চাকরিতে জয়েন করার সময় আবেদনপত্র স্বাক্ষরের জন্য তার মুখে কলম গুজে দিতে হয়েছিল রিক্র’টিং বোর্ডের চেয়ারম্যাকে। ভয়েস অ্যাক্টিভেটেড টেকনোলজি বা কন্ঠস্বর চালিত প্রযুক্তির সাহায্যে হারম্যান শুধু তার কম্পিউটারকে বলে দেন কি কি করতে হবে। মুহূর্তের মধ্যে সেসব আদেশ তামিল হয়ে ফুঠে ওঠে কম্পিউটারের মনিটরে। শুধুমাত্র আমেরিকাতে এসব বিশেষ নাগরিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি। এদের ভিতর যারা কর্মজীবী তাদের ওপর প্রায় ত্রিশ বছর লাগাতার সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, কিছু কিছু কাজে এরা সাধারণ মানুষদের চাইতে দক্ষতায় এগিয়ে আছে। তাদের গড়পরতা দক্ষতা, বিশ্বস্ততা আর নিয়মনিষ্ঠ উপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রেই তাদের এগিয়ে নিয়ে যায় মালিক পক্ষের খুবই কাছাকাছি। বর্তমান শতাব্দীর বেস্টসেলার বুক ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম ‘গ্রন্থের লেখক স্টিফেন হকিং।
বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে প্রতিভাধর এই বিজ্ঞানী মটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হয়েও ভয়েস এক্টিভেটেড টেকনোলজি ব্যবহার করে হুইলচেয়ারে বসে শুধু কথাবার্তা, এমনকি চোখের পাতা নড়াচড়ার মাধ্যমে একের পর এক তার গবেষণার কাজ শেষ করছেন। হায়! আমাদের দেশেও যদি সেই পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করা যেত, যাতে করে এই সকল প্রতিবন্ধীদের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতো জিনিয়াসরা। আমরা প্রাণ খুলে সেই সকল বন্ধুদের জন্য দোয়া করবো। চলো এবার শুরু করি আমাদের আলোচনার ধারাবাহিকতা, কেমন? আল-কিন্দী মুসলিম জগতের ‘আল ফাইলাসুফ ‘বা শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসাবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন; পাশাপাশি মৌলিক বিজ্ঞান সাধনায়ও তার নাম আরব জগতে সবচাইতে বিখ্যাত। তার পুরো নাম ছিল আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল কিন্দী। তিনি ৮১৩ সালে কুফায় জন্মগ্রহন করেন। আল কিন্দী একাধারে কুরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইতিহাস, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, রাজনীতি . চিকিৎসাবিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান,অংকশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যায় বিশারদ ছিলেন। আর সঙ্গীতেও তার আকর্ষণ কম ছিলনা। এরকম বারোটি স্বতন্ত্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার পরও তিনি আরবী, গ্রীক, হিব্রু, ইরানী, সিরীয়াক এমনকি সংস্কৃতসহ ছয়টি ভাষায় অসাধারণ বুৎপত্তি অর্জন করেন। ষোল শতক পর্যন্ত জগতে যে সব মহামনীষী জন্মগ্রহন করেছেন তাদের মধ্যে বার জনের ভিতর একজন হিসাবে আল কিন্দীকে গণ্য করা হয়। তিনি দর্শন,ভাষাতত্ত্ব, রাজনীতি, অংকশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যায় এবং সংগীতের ওপর প্রায় দুইশত পয়ষট্টিখানা গ্রন্থ রচনা করেন।
আজও ইউরোপে আল-কিন্দীকে দর্শনের প্রথম পরিচায়ক ও ভাষ্যকার হিসাবে শ্রদ্ধা করা হয়। তিব্বিয়া বা চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলিমদের ভিতর সর্বাপেক্ষা প্রথম উল্লেখযোগ্য সাধক ছিলেন আলী ইবনে সহল রব্বান আল তাবারী। তিনি সম্ভবত আট শতকের শেষের দিকে তাবারীস্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আরবি ছাড়াও সিরিয়াক,ফারসি, হিব্রু ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। আলী তাবারী চিকিৎসা বিষয়ে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে ‘ফেরদৌস আল হিকমাহ ফি আল -তিব্বত বা ঔষধের স্বর্গ নামক গ্রন্থটিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এটিকে আরবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রথম বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে। বর্তমান ইরানের রাজধানী তেহরানের অন্তর্গত রায নগরে ৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে আবু বকর মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া জন্মগ্রহণ করেন। ১২২০ সালে মোঙ্গলদের হাতে ধ্বংসের আগে এ শহরটি মুসলিম জাহানে জ্ঞানবিজ্ঞানের জন্য বিখ্যাত ছিল। সেই জন্য আবু বকর জন্মভূমির নামানুসারে নিজের নিসব আল রাযী গ্রহণ করেন।তিনি আলকেমী নিয়ে গবেষনা করতেন কিন্তু তার সবচেয়ে বড় অবদান চিকিৎসাশাস্ত্রে। তিনি নানা বিষয়ে কমপক্ষে দুইশত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তার ভিতর চিকিৎসাশাস্ত্রেই প্রায় একশত। তার সবচেযে বড় কীর্র্তি হচ্ছে বসন্ত ও হাম রোগ সম্বন্ধে ‘আল জুদারী ওয়াল হাসাবাহ’নামক পুস্তকটি। এই গ্রন্থটি ল্যাটিন ও ইউরোপীয় সকল ভাষাতেই তরজমা করা হয়। শুধু ইংরেজি ভাষাতেই ১৪৯৮ সাল থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত এটি চল্লিশবার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। তার আরেকটি শ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে ‘আল-হাবী ‘সর্বপ্রকার রোগ সম্বন্ধে বিশদ আলোচনাসহ চিকিৎসা প্রণালী ও ঔষধের ব্যবস্থা সম্বলিত একখানি আভিধানিক গ্রন্থ। এটি কুড়ি খন্ডে সমাপ্ত হয়। বর্তমানে এর দশটি খন্ডের অস্তিত্ব আছে। আল-হাবী ইউরোপীয় চিন্তারাজ্যে অসামান্য প্রভাব বিস্তার করেন। ১৪৮৬ সালের পর হতে ইউরোপের প্রত্যেক দেশেই এই বইটি ক্রমাগত দ্রুত ও প্রকাশিত হতে থাকে। এর নবম খন্ডটি ইউরোপের প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ পুস্তক হিসাবে ষোলশতক পর্যন্ত নির্দিষ্ট ছিল।
আল রাযীর জ্ঞানার্জনের কেমন আগ্রহ ছিল এটি তার নিম্নোক্ত বক্তব্য থেকেই বুঝা যায় “ যারা আমার সাহচর্যে এসেছেন, কিংবা আমার খোঁজ রাখেন, তারাই জানেন জ্ঞান আহরণের আমার কী আকুল আগ্রহ, কী তীব্র নেশা। কিশোরকাল হতেই আমার সকল উদ্যম, এই একটি মাত্র নেশায় ব্যয়িত হয়েছে। যখনই কোন নতুন বই হাতের কাছে পেয়েছি, কিংবা কোন জ্ঞানীর সন্ধান পেয়েছি তখনই অন্য সকল কাজ ফেলে, বহু আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করেও নিবিষ্ট মনে বইখানা পাঠ করেছি কিংবা সে জ্ঞানীর নিকট যথাসাধ্য শিক্ষা গ্রহণ করেছি। জ্ঞান সাধনায় আমার এমন অদম্য উৎসাহ ও অসাধারণ সহিষ্ণুতার ফলেই মাত্র এক বৎসরে আমি কুড়ি হাজার পৃষ্ঠার মৌলিক রচনা লিখেছি (প্রতিদিন প্রায় ষাট পৃষ্ঠা করে ) এবং তাও তাবিজ লেখার মতোই ঝরঝরে অক্ষরে। প্রায় পনের বৎসর আমি ব্যয় করেছি আমার বিরাট চিকিৎসাবিধান লিখতে। দিনরাত্রে এমন কঠোর পরিশ্রম করেছি যে, শেষে আমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলি। কিন্তু এখনও আমার জ্ঞান পিপাসা মেটেনি। আজও আমি অন্যকে দিয়ে বই পড়িয়ে শুনি কিংবা আমার রচনা লেখাই।” আবু জাফর মুহাম্মদ ইসনে জরীর আল তাবারী ছিলেন জাতিতে ইরানী। তিনি ইরানের সবচেয়ে গিরিসংকুল স্থান তাবারিস্থানে ৮৩৮ সালে জন্মগ্রহন করেন।তিনি আরবী ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, তর্কশাস্ত্র ও ভূতত্ত্বে গভীর জ্ঞানার্জন করেন। এ সময় তার সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ ছিলো কুরআনের তাফসির ও হাদিসে। তিনি জ্ঞানীদের সংস্পর্শে গিয়ে সরাসরি জ্ঞানার্জনের জন্য আরব ছাড়াও মিসর,সিরিয়া ইরাক ইরান প্রভৃতি দেশ কয়েক বছর সফর করেন। এসময় তাকে বহুদিন অর্ধাহারে এমনকি অনাহারেও কাটাতে হয়েছে। একবার অবস্থা এত শোচনীয় হয়ে ওঠে যে, উপর্যুপরি কয়েকদিন অনাহারে কাটিয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিজের জামার দুটি হাতারই বিনিময়ে তাকে রুটি সংগ্রহ করতে হয়েছিল।
আল তাবারী ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন একজন শ্রেষ্ঠ তাফসীরে কুরআন এবং একজন শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক হিসেবে। তার তাফসিরের নাম ‘জামি আল-বায়ান ফি তাফসীর আর-কুরআন। এটি বর্তমানে সুবৃহৎ ত্রিশটি খন্ডে প্রকাশিত। তাবারীর বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থের নাম ‘আখবার আল রাসূল ওয়াল মুলুক ’অর্থাৎ পয়গাম্বর ও রাজাদের ইতিহাস। বর্তমানে ইতিহাস গ্রন্থখানি মাত্র পনের খন্ডে প্রকাশিত হয়। কিন্তু পন্ডিতদের বিশ্বাস, আসল ইতিহাস গ্রন্থখানি এর কমপক্ষে দশগুন ছিল। কথিত আছে যে, একশত পঞ্চাশখন্ডে সমাপ্ত এই বিশাল ইতিহাস যখন তার ছাত্ররা পড়তে অস্বীকার করে, তখন তিনি আক্ষেপ করে অধুনা প্রকাশিত পনেরো খন্ডের সার সংকলনটি করেছিলেন। এই বিরাট গ্রন্থে সৃষ্টির আদিকাল থেকে ৯১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ইতিহাসের বর্ণনা আছে। জ্ঞানানুশীলনে তার জীবনকে তিনি কিভাবে উৎসর্গ করেছিলেন তার পরিচয় মেলে যখন আমরা জানতে পারি যে, তিনি ক্রমাগত চল্লিশ বছর যাবত দৈনিক চল্লিশ পৃষ্ঠা করে মৌলিক লেখা রচনা করতেন (অর্থাৎ এ সময়ে তিনি রচনা করেন প্রায় পাঁচ লক্ষ চুরাশি হাজার পৃষ্ঠা ) ৮৫৮ সালে হাররান অঞ্চলে আল-বাত্তানী জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তিনি বাগদাদের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষা লাভ করেন। মাত্র উনিশ বৎসর বয়সেই আল-বাত্তানী বাগদাদ ত্যাগ করে ফোরাত নদীর পূর্ব উপকূলস্থ আল রাক্কা নামক স্থানে গমন এবং সেখানে আমৃত্যু তিনি গবেষণায় লিপ্ত থাকেন। এখানে তার নিজস্ব গবেষণাগার ও গবেষণার উপযোগী প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল। তিনি গণিতশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিদ্যায় একজন মৌলিক গবেষক ছিলেন। এদুটি বিষয়ে তিনি অনেক মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার অধিকাংশই আজ কালের করালগ্রাসে হারিয়ে গেছে।
দশ শতকের মাঝামাঝি একজন শান্ত প্রকৃতির ক্ষুদ্রাকৃতি তুর্কী পোশাক -পরা বৃদ্ধলোক আলেপ্পোর হামদানী আমীর সায়েফউদ্দৌলার দরবারে উপস্থিত হন। তাকে আট -দশটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে দেখে এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্বে, দর্শন, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, এমনকি কবিতা ও গানে তার অগাধ পান্ডিত্য ও পারদর্শিতা দেখে গুণগ্রাহী আমীর তাকে সম্মানের সাথে আপন দরবারে স্থান দেন। এর কিছুদিনের ভিতরই তাকে সভাপতির মর্যাদা দান করেন। এই জ্ঞানী লোকটিই প্রাচ্যের মুয়াল্লিম-সানী তথা দ্বিতীয় শিক্ষাগুরু আবু নাসর মুহাম্মাদ আল ফারাবী। তিনি আকৃতিতে ক্ষুদ্র, চক্ষুতারকা আরো ক্ষুদ্র এবং সামান্য কয়েক গাছি শ্মশ্রুশোভিত পুরুষ ছিলেন। তিনি বিবাহ করেছিলেন কিনা বা তার পুত্র-কন্যা ছিল কিনা, কিছুই জানা যায় না। কিন্তু অদম্য জ্ঞানস্পৃহা তাকে জন্মভূমি ত্যাগ করতে প্রলুব্ধ করে। কাজীর মতো সম্মানিত পদে ইস্তফা দিয়ে পঁচিশ বৎসর বয়সে তৎকালীন জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমি বাগদাদে তিনি গমন করেন। প্রায় সত্তরটি বিরাট নোটবুকে দর্শনশাস্ত্রের সারাংশ তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
ফারাবী এরিস্টিটলের আত্মা সম্বন্ধীয় গ্রন্থটি একশরও বেশি বার এবং পদার্থবিদ্যা বিষয়টি চল্লিশবার পাঠ করেছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, প্রাচ্যের সুধী সমাজে এরিস্টটল মুয়াল্লিম আউয়াল বা আদিগুরু ও ফারাবী মুয়াল্লিম সানী বা দ্বিতীয় গুরু হিসাবে পরিচিত। মুসলিম দার্শনিকদের পিরামিডে তার নাম সর্বোচ্চ। তিনিই ইসলামের প্রথম বিশ্বকোষ রচয়িতা ও মুসলিম তর্কশাস্ত্রের জন্মদাতা। ঐতিহাসিক ও ভূতাত্ত্বিক হাসান আলি আল মাসুদী বাগদাদে সম্ভবত নয় শতকের শেষের দিকে জন্মগ্রহন করেন। আল-মাসুদী বাল্যেই উচ্চ শিক্ষা প্রাপ্ত হন। ইতিহাস, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, ভূগোল, জ্যোতিষশাস্ত্র ও প্রানীতত্ত্বে তার অসাধারণ বুৎপত্তি জন্মে, সাহিত্য-সংগীত ও কবিতা রচনাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি সমসাময়িক আলেমদের মতোই বিশ্বাস করতেন “ আর -রিহলাহ ফি-তালাব আল ইলম “ অর্থাৎ সফর করলে জ্ঞানবৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। তাই পথের মোহে যৌবনেই তিনি ভ্রমণে বহির্গত হন ও প্রায় অর্ধ শতাব্দীব্যাপী তৎকালীন দুনিয়া চষে বেড়ান।
আল মাসুদী তার দীর্ঘ সফরের অভিজ্ঞতা থেকে শেষ জীবনে সুবৃহৎ গ্রন্থ ‘মারুফ আল-যাহাব ওয় মায়াদিন আল জওহর ’বা ‘সোনালী ময়দান হীরার খনি।’প্রণয়ন করেন।এই বিরাট ইতিহাস ভূগোলের বিশ্বকোষ খানি ত্রিশটি খন্ডে সমাপ্ত। এই জন্য তাকে মুসলিম ঐতিহাসিকদের ভিতর হেরোডোটাস বলা হয়। উক্ত গ্রন্থের উপক্রমনিকায় মাসুদী নিজেই বলেছেন ‘ইতিহাস রচনার পূর্বে তিনি পঞ্চাশজন মশহুর ঐতিহাসিকের গ্রন্থ পাঠ করে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এটির অসম্পূর্ণ অংশ ত্রিশ খন্ডে ভিয়েনার গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে। আল্লাহপাক মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “ তোমরাই সর্বোত্তম জাতি। মানবতার কল্যাণের জন্যে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে” অথচ আজ আমরা পৃথিবীর যে দিকেই তাকাই না কেন, কী দেখতে পাই? দেখতে পাই সারা পৃথিবীতে মুসলমানেরা আজকে চরম পশ্চাতপদতা, বঞ্চনা আর সর্বগ্রাসী নির্যাতনের শিকার।
তাহলে কি আল্লাহর ঘোষণা কখনও মিথ্যা হতে পারে? না বরং আসল সত্য হলো, যাদের উদ্দেশ্যে এই ঘোষণা দিয়েছেন আমরা সেই সত্যিকার মুসলমান হতে পারিনি।