
চাদরটা দাদু হিয়াকে দিয়েছিল ওর জন্মদিনে। গাঢ় নীল। চাদরজুড়ে ছিল রুপালি কাপড় কেটে বসানো অনেক তারা। মাঝে একটা চাঁদ। চাঁদের মুখে হাসি দেখে মনে হয় রাতের আকাশে চকচক করে জ্বলছে। চাদরটা ছিল নরম তুলতুলে। ওটা হিয়ার প্রিয় চাদর। বেশ শীত পড়েছে। মা হিয়াকে একটা নতুন কম্বল কিনে দিল। কম্বলটাও ভীষণ সুন্দর! গোলাপি রঙের উপরে হলুদ জামা পরা পরীর ছবি আঁকা। যেমন সুন্দর ওদের পাখা, তেমনি সুন্দর চোখ। সেই চোখ দিয়ে যেন তারা হিয়াকেই দেখছে। তারপরও হিয়া নীল চাদরটা হাতছাড়া করতে চাইল না।
সে বলল, মা, ওটা তুলে রাখ। আমি নীল-তারা চাদর নিয়েই ঘুমাব। মা বলল, ওটা ময়লা হয়ে গেছে। আজ ধুয়ে দেব। উহু। পরে ধুয়ে দিলেই হবে। চাদরটা তোর খুব প্রিয়, তাই না? আচ্ছা, চাদরটা গায় দিয়ে যখন ঘুমিয়ে থাকিস, তখন ঘুমের মধ্যে এতো হাসিস কেন? হিয়ার আসলে কথাটা বলাই হয়নি। সে খুব কৌতূহল নিয়ে বলে, মা জানো, ওই চাদরটা গায়ে দিয়ে ঘুমালে আমি মজার মজার সব স্বপ্ন দেখি! তাই নাকি! হ্যাঁ, যেমন ধরো, কখনও দেখি তারার দেশে আমি তারাদের রাজা হয়ে গেছি। আবার কখনও দেখি, আমি চাঁদের দেশে পৌঁছে গেছি। সেখানে অনেক ছোট ছোট বন্ধু আছে আমার। ওরা আমার সাথে গান গায়, খেলা করে। আবার চাঁদের বুড়ি আমাদের সঙ্গে মজার মজার গল্পও বলে। মা হাসতে হাসতে হিয়াকে সরিয়ে চাদরটা তুলে নেয়। তারপর ধুয়ে ছাদে উঠে মেলে দিয়ে আসে। শীতের ঠান্ডা হাওয়া বইছিল সেদিন। বিকালের দিকে হঠাৎ দমকা হাওয়ায় চাদরটা উড়ে গিয়ে হিয়াদের ছাদ পেড়িয়ে বাসার সামনের বড় পেয়ারা গাছে গিয়ে আটকে গেল। বাসার কেউ ঘটনাটা টেরই পেল না। পেয়ারা গাছের নিচে দুঃখী দুই বোন থাকত। এক বোনের নাম তানিয়া, আরেকজনের নাম তাসলিমা। তানিয়া ছিল হিয়ার বয়সের, তাসলিমা আরো ছোট। এই ঠান্ডায় ওদের খুব কষ্ট হচ্ছিল। সেদিন তানিয়া পেয়ারা গাছের নিচে জমে থাকা পানিতে কাগজের নৌকা বানিয়ে আপন মনে খেলছিল। হঠাৎ পানিতে ছায়া দেখে উপরে তাকাল সে। আর তখনই গাছের ডালে ঝুলে থাকা চাদরটা দেখল। তানিয়া তাসলিমাকে ডেকে চাদরটা দেখাল। তারপর বলল, তুই নিচে দাঁড়া, আমি চাদরটা নিয়ে আসি। তানিয়া গাছে উঠে খুব কষ্ট করে চাদরটা নিয়ে গাছ থেকে নেমে এলো। তারপর তাসলিমাকে বলল, দেখ, চাদরটা কত্ত সুন্দর! চাদরটা তাসলিমারও খুব পছন্দ হলো। সে বলল, চল ঘরে রেখে দেই। রাতে গায়ে দিয়ে ঘুমানো যাবে। সন্ধ্যায় ছাদ থেকে কাপড় তুলে আনার সময় হিয়া দেখল সেখানে চাদরটা নেই। হিয়া দৌড়ে নিচে নেমে বাসার আশপাশে খুঁজে দেখল, কিন্তু কোথাও পেল না। হিয়ার প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে গেল। তার মন খারাপ দেখে বাবা-মাও খুঁজতে শুরু করল। কিন্তু চাদরটা যেন হঠাৎ করেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। হিয়ার বাবা হিয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, মন খারাপ করো না মা, আমি ওরকম চাদর তোমাকে আরেকটা কিনে দেব। হিয়া বুঝতে পারল তার প্রিয় চাদরটা সত্যি সত্যি হারিয়ে গেছে।
হিয়ারা ঘরে ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় দারোয়ান চাচা এসে হিয়ার বাবাকে বলল, স্যার, চাদরটা কে নিছে আমি জানি। কে? আমি চা খাইতে গেছিলাম রাস্তার ওপাড়ের চায়ের দোকানে। হঠাৎ দেখলাম পেয়ারা গাছ থেইকা একটা মাইয়া চাদর নামাইতেছে। আমার মনে হয়, ওইডাই হিয়া সোনামণির চাদর। হিয়া বাবার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, বাবা এখুনি চলো, চাদরটা নিয়ে আসি। বাবা রাজি হলো না। উল্টো বলল, হিয়া মা, তোমাকে বলেছি তো আমি আরেকটা চাদর এনে দেব। না বাবা, ওই চাদরটাই আমার লাগবে। বাবা হিয়াকে কোলে তুলে নিল। তারপর বলল, ঠিক আছে, তোমাকে আমি নিয়ে যাব ওদের কাছে। কিন্তু আমার কিছু কথা আছে। যদি শোনো তাহলেই নিয়ে যাব। বাবা পুনরায় বলল, ধরো, এই ঠান্ডায় তোমার কোনো চাদর নেই, কম্বল নেই, এমনকি শীতের কাপড়ও নেই তাহলে এখন যেভাবে আরাম করে ঘুমাও সেভাবে ঘুমাতে পারবে? হিয়া বলল, না, তাহলে তো ঠান্ডাতেই মরে যাব। তাহলে এবার বলো, যে মেয়ে দুটো চাদর পেয়েছে, ওদের তো শীতের চাদর নেই, কম্বল নেই। ওরা এই শীতে কত কষ্ট করে। চাদরটা পেয়ে ওরা নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছে। এখন কি ওদের কাছ থেকে চাদরটি ফিরিয়ে আনা ঠিক হবে? হিয়া এবার অধৈর্য কণ্ঠে বলল, কিন্তু বাবা ওটা তো আমার চাদর। বাবা এবার হিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে বলল, ওকে, চলো তোমাকে ওদের কাছে তাহলে নিয়ে যাই। বাবা হিয়াকে মাফলার, মোজা, টুপি পরিয়ে ওর ছোট্ট হাত ধরে রওনা হলো। হিয়া হাঁটছে আর বাবার কথাগুলো চিন্তা করছে। সে ভাবছে, বাবা যাই বলুক, চাদরটা সে নিয়ে আসবেই।
খুব বেশি সময় লাগল না। ওরা দ্রুতই তাসলিমাদের খুপরি ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরের মধ্যে উঁকি দিতেই চেঁচিয়ে উঠল হিয়া, ঐ যে আমার চাদর। বাবা কিছু বলল না। হঠাৎ হিয়ার খেয়াল হলো, মেয়ে দুটো ওর চাদর গায়ে জড়িয়ে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। হিয়া ওদের দিকে এগিয়ে গেল। আরে! ঘুমের মধ্যে মেয়েটা হাসছে। হিয়ার মনে পড়ে গেল, তার মাও তাকে বলেছিল, সেও নাকি ওভাবে ঘুমের মধ্যে একা একা হাসে। হিয়া বুঝল, ওরা স্বপ্ন দেখছে। ওরকম স্বপ্ন হিয়াও দেখেছে। হঠাৎ হিয়ার মন ভালো হয়ে গেল। সে বাবার কাছে ফিরে এসে বলল, বাবা চলো আমরা ফিরে যাই। ওরা ঘুমাক। হিয়া মনে মনে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ নীল-তারা। আর দেখা হবে না, কিন্তু তোমাকে অনেক ভালবাসি। নতুন বন্ধুদের সাথে ভালো থেকো তুমি।