অচেনা স্টেশনে সমু বাঙাল।বেকার সমু বাঙাল, প্রতিবাদী সমু বাঙাল। ঘটনাক্রমে টিকিট না কেটেই সমুকে একটা ট্রেনে উঠতে হয়। ট্রেনের টিকিট চেকারের আচরণ ও ব্যবস্থা সমুর চেতনায় আঘাত করে। তাই টিকিট চেকারের কাছ থেকে নয় বরং নিজেই একটা টিকিট নিতে এক রেল স্টেশনে নেমে পড়ে সমু। স্টেশনে নেমে টিকিট কাউন্টারের সামনে যেতেই সমুর চোখে পড়ে বেশ বড় করে লেখা ‘আলমখালি’ নামটা। এ স্টেশনের নাম তাহলে আলমখালি? থানা কি কালিগঞ্জ? এ নামের রেল স্টেশন নিশ্চয় বাংলাদেশে আর নেই। মায়ের মুখে সমু কতবার এই রেল স্টেশনের নাম শুনেছে। আলমখালি রেল স্টেশন থেকে কিছুদূর হেঁটে গেলেই মৌরিডাঙার ঘাট। সে ঘাট থেকে নৌকায় চড়ে ঘণ্টা তিনেক গেলেই যাদবপুর গ্রাম।
সমুর গল্প শুরু এখান থেকে।
যাদবপুর গ্রামে সমুর এক খালার বাড়ি। সমুর আম্মার খালাতো বোনের বাড়ি। বিয়ের আগেও কতবার সমুর আম্মা, এই খালা বাড়িতে এসেছেন বলে গল্প করতেন। সমু যখন একেবারেই আম্মার কোল ঘেঁষা তখন নাকি একবার সমুকে নিয়ে তার আম্মা, বড় ভাইয়া ও আববার সাথে এই আলমখালি হয়ে যাদবপুর গিয়েছিলেন। সমুর সে সব কথা মনে নেই। আম্মার কাছে শোনা। বিয়ের পরেও বেশ কয়েকবার তিনি স্বামী সন্তান নিয়ে যাদবপুর গ্রামে গিয়েছেন। দীর্ঘদিন আর সেই খালাদের সাথে সমুদের কোন যোগাযোগ নেই। এই সেই আলমখালি রেলস্টেশন! টিকিট কাউন্টারের সামনে থেকে সমু ফিরে আসে। এই ট্রেনে সে যাবে না। আবার তো ট্রেন আসবে। আজ না হোক কাল গেলেই বা তি কি! গন্তব্যহীন সমুর এত তাড়াই বা কিসের? নির্দিষ্ট সময় বিরতির পরে সমুকে এ স্টেশন পর্যন্ত বয়ে আনা ট্রেনটা স্থান ত্যাগ করার জন্য হুইসেল বাজায়। সমু ভ্রূক্ষেপ করে না। ট্রেনের মধ্যে শেষ পর্যন্ত সেই টিকিট চেকারের কী হলো সেটা জানারও কোনো আগ্রহ থাকেনা তার। জ্যৈষ্ঠ মাসের আকাশ ধোয়া সোনালি রোদে স্টেশন ও তার চারপাশের বাড়িঘর, মাঠ-ঘাট চক চক করছে তখন। সমু প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের পূর্বদিকে চলে আসে। প্ল্যাটফর্মের পূর্বদিকে রেল লাইনের পাশে কোন বাড়িঘর নেই। তবে দৃষ্টি সীমার মধ্যেই একটা গ্রাম চোখে পড়ে সমুর। ট্রেন থেকে নামা যাত্রীদের কেউ কেউ সে গ্রামের দিকে যাচ্ছে। রেল লাইনের পাশ থেকে শুরু হয়েছে দিগন্তবিস্তৃত ধান-পাটের ক্ষেত। সবুজের সমারোহে বিকেলের বাতাস তখন খেলা করছে।
সে সব বাতাসেরা নাচতে নাচতে সমুর কাছে চলে আসে- সমুর শরীরে শীতল পরশ বুলিয়ে যায়। নিদ্রাহীন-ঝক্কি-ঝামেলার বিগত চব্বিশ ঘণ্টা পরে এই প্রথম সমুর মনে কিছুটা স্বস্তি সঞ্চিত হয়। ট্রেনটা চলে যাবার পরে মফস্বলের এই আলমখালি নামক রেল স্টেশনটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কেবল স্টেশন মাস্টারের ঘরের সামনে কিছু মানুষ অপেক্ষা করছে। তারা বোধহয় বিপরীত দিকের সান্ধ্যকালীন ট্রেনের অপেক্ষায় আছে। সে সব অপেক্ষমান মানুষের ভিড়ে সমুর যেয়ে কাজ কি! আপাতত সমু স্টেশনের পূর্বদিকের পুরাতন সিমেন্টের বেঞ্চটাতেই বিশ্রাম নেবার পরিকল্পনা করে। বৃটিশদের হাতে গড়া পুরাতন বেঞ্চ। বেঞ্চটাতে একটা পায়ার অভাব মেটাতে কয়েকটা ইট ব্যবহার করা হয়েছে। বেঞ্চের ছাউনির বেশ খানিকটা ভাঙা। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বোধ হয় এতে বসেও না। সমু সেই বেঞ্চটাতে বসতে বসতে ভাবে, এই বেঞ্চে কি কোনদিন তার আম্মা বসেছেন? যখন তিনি যাদবপুরে তার বোনের বাড়ি যেতেন অভিভাবকদের সাথে কিংবা সমুর আব্বা সাথে? বেঞ্চটার যদি ভাষা থাকতো নিশ্চয় এ বিষয়ে তার কাছ থেকে কিছু জানা যেতো।নিরেট সিমেন্ট বালুর বেঞ্চটার কাছে তবু সমু প্রশ্ন করে, আমার আম্মাকে কি মনে আছে? হাজেরা বেগম? ওই যে যাদবপুরে যেতেন? আমার আব্বাজানকেও তো তোমার চেনার কথা? আওলাদ মাস্টার সাহেবকে তোমার মনে নেই? প্রাণহীন পাথুরে বেঞ্চটা কোনো জবাব না দিলেও কোনো এক অলক্ষ্য থেকে জবাব আসে, এ বেঞ্চে সমুর আম্মা অনেকবার বসেছেন। বেঞ্চটাতে বসার পরেই সমুর মনে হয় কারা যেন চারপাশে কথা বলছেন। তাদের মধ্যে কি আব্বা-আম্মা আছেন? আম্মার কথা মনে হতেই সমুর বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। সত্যি সত্যিই চোখ দু’টো ভিজে ওঠে। সমু চোখ দু’টোকে স্বাধীনতা দেয়। ইচ্ছেমতো ওরা সমুর দু’গাল বেয়ে অশ্রু ঝরাতে থাকে। এ অঞ্চলে সমুকে কেউ চেনে না।
সমুকে কাঁদতে দেখলেই বা কি! কে-ই বা খোঁজ নিতে আসছে তার! জমি-জমা, টাকা-পয়সা, লোকবল সবদিক থেকেই সমুদের পরিবার অনেককাল আগে থেকেই সমৃদ্ধ। সমাজে ভূমি ও অর্থবিত্তের মালিকেরাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সমুর পরদাদা-দাদা থেকে শুরু করে সমুর আব্বা
আওলাদ মাস্টার পর্যন্ত এলাকার সালিশ-দরবারে সমুদের পরিবারের প্রাধান্য ছিল। আধুনিক যুগে এসে এসব সালিশ-দরবারের প্রয়োজনীয়তা কমে এলেও সমাজে এর গুরুত্ব এখনও কম নয়। স্কুলে শিক্ষকতা, জমি-জমা দেখাশুনার পাশাপাশি সমুর আব্বাকে তাই নিজের গ্রাম ছাড়া আশেপাশের গ্রামেও বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য উপস্থিত থাকতে হতো। ঘটনার বিবরণ শোনার পরে সমুর আব্বা আওলাদ মাস্টার সাহেব যে রায় দিতেন তা সকলেই বিনা বাক্যে মেনে নিতো। বি.এ পাস মুক্তিযোদ্ধা আওলাদ মাস্টার শুধু এলাকার নামকরা মাতব্বরের ছেলেই ছিলেন না, কোর্ট-কাচারি, আইন-কানুনেরর লোকদের সাথেও তার ভালো খায়-খাতির ছিল। একরাতে পাশের গ্রাম থেকে সালিশের মিটিং সেরে ফেরার পথেই ঘটলো সেই ভয়াবহ ঘটনাটা। কয়েকজন লোক তাঁর সাইকেলের গতিরোধ করে দাঁড়ালো। সমুর আব্বা টর্চ ফেলে তাদেরকে চিনে ফেলেছিলেন। ভেবেছিলেন তারা কোন সমস্যা জানানোর জন্য কিংবা ওইদিনের সালিশের রায় সম্পর্কে কিছু বলতে চায়। কিন্তু তাদের পেছন থেকে মুখোশধারী দু’জন লোক এসেই এলাপাতাড়িভাবে রামদা দিয়ে কোপাতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত না করে তারা স্থান ত্যাগ করে না। সমুর একমাত্র বড়ভাই তখন কুষ্টিয়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। সংসার সম্পর্কে সে-ও তখন অনভিজ্ঞ। মাঠের জমি-জমা কার মধ্যে কতটা বর্গা দেওয়া, কোন জমি নিজেদের চাষের আওতায় এসব হিসেব-নিকেশ তখন সমুর আম্মা কিংবা তার বড় ভাইয়ের কেউই তখন ভালো বোঝেন না। সমুর আম্মাকে এসময় তাই বাধ্য হয়ে চাচাদের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। এ নির্ভরশীলতার ফলে বছর তিন-চারেক পরে দেখা গেল সমুর আব্বার নামের অনেক জমিই চাচাদের নামে রেকর্ড হয়ে গেছে। অনেক জমির খাজনা দেবার দাখিলায় চাচাদের নাম। সবকিছু জানতে পারলেও চাচাদের এসব অনাচার মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া সমুর আম্মার আর কিছুই করার ছিল না। শেষ পর্যন্ত যে বিঘা তিরিশেক জমি সমুর আম্মা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন তা দিয়েই তিনি দু’ছেলের লেখাপড়া আর সংসারটাকে সামলে নিচ্ছিলেন। এসময় গ্রামের কয়েকজন বর্গাচাষীও আওলাদ মাস্টারের পরিবারকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। এসব বর্গাচাষীদের পরিবার অনেককাল ধরে সমুদের জমিজমা চাষাবাদ করে খায়।
বি.এ পাস করার পরে সমুর বড় ভাইয়া বিদ্যুৎ বিভাগে চাকুরি পায়। বাড়িতে থেকেই সে এলাকার পল্লীবিদ্যুৎ অফিসে কাজ করতো। চাকুরি পাবার বছরখানেকের মধ্যে বড় ভাইয়াকে বিয়ে করানো হলো। বিয়ের পরে সমুর ভাইয়ার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। আম্মা বা ছোট ভাইকে সাহায্য করার চেয়ে শ্বশুর বাড়ির লোকদের জন্য খরচ করতেই সমুর বড় ভাইয়া বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে থাকে। বছর খানেকের মধ্যেই একমাত্র পুত্রবধূর সাথে সমুর আম্মার সম্পর্কের চরম অবনতি হতে থাকে। এক পর্যায়ে সমুর আম্মা সংসারের সব দায়-দায়িত্ব পুত্র-পুত্র বধূর উপর ছেড়ে দিলেন। সমু তখন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। শহরের কলেজ থেকে বাড়িতে গেলে সমু দেখতে পেতো আম্মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছেন। বড় ভাইয়া আর ভাবিই তখন সংসারের অভিভাবক। সমু কলেজ থেকে বাড়িতে গেলে আম্মা বাজার থেকে বিশেষ কোন মাছ বা মাংস আনতে বলার পরেও যখন তা আসতো না তখন আম্মা খুব কষ্ট পেতেন। নিজ হাতে গড়া সংসারে নিজের মতো কোনোকিছু করতে না পারার বেদনা তাঁকে ক্ষত-বিক্ষত করতো। তবু সমুর জন্য আম্মা কোন প্রতিবাদ করতেন না। পাছে সমুর পড়ার খরচ যদি বন্ধ হয়ে যায়। তবে কোনো প্রতিবাদ তিনি না করলেও একসময় সমুর জন্য অর্থ বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যায়। ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরে হলে সিট না পেয়ে বেশ কিছুদিন সমুকে ঢাকা শহরের একটা মেসবাড়িতে থাকতে হয়। ঢাকা শহরে সদ্য আসা, সদ্য ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া একজন ছাত্রের তখন নানান খরচ-নানান চাহিদা। সমুর বড় ভাইয়া মাস দুয়েক সেসব চাহিদা পূরণ করার পরে একদিন সাফ জানিয়ে দিলো, মাঠের ফসল ভালো হচ্ছে না। বর্গাচাষীরা ঠিকমতো ফসল দেয় না।
কাজেই সমুর ভার্সিটির খরচ বহন করা তার পক্ষে সম্ভব না। বাংলা সিনেমার কাহিনীর মতো সমু দেখতে পেলো, একজন মানুষ কিভাবে বউ এবং শ্বশুর বাড়ির লোকেদের পাল্লায় পড়ে নিজের মা-ভাই এর উপর থেকে নিজের দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ সরিয়ে নিলো। সমুর আম্মার নামে বিঘা চারেক জমি ছিল। সব জমি ফসল ফলানোর উপযোগী ছিল না। তবু এই চারবিঘা জমি থেকে যেটুকু আসতো তা আম্মা সমুর জন্য পাঠাতো। তীব্র প্রয়োজন অনুভব করে এবং অন্য কোনো সাহায্যের উৎস না থাকায় সমু ঢাকাতে দু’টো টিউশনি জোগাড় করে নিলো। এতে অন্তত মাছেভাতে না হলেও ডালভাতে খেয়ে টিকে থাকার মতো একটা অবস্থা সমুর তৈরি হলো। তবে খাওয়া-দাওয়া আর দৈনন্দিন কাগজ-কলমের খরচ টিউশনির টাকায় চললেও পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় বাড়তি টাকার প্রয়োজন হয়। একই সাথে ফরম পূরণ, হলের সিটভাড়া ইত্যাদি কারণে বেশ কিছু নগদ টাকার দরকার হয়। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার আগে ফরম পূরণের সময় একটা তীব্র অর্থ সংকট দেখা দিলো সমুর। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পরে সমুর টিউশনির ছাত্র-ছাত্রীরা তখন নানিবাড়ি- গ্রামের বাড়ি। মাসখানেক ধরে তখন টিউশনি বন্ধ। সমুর ইচ্ছে ছিলো শহরে একটা চাকরি-বাকরি জোটাতে পারলেই সমু মাকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসবে। সমুর আম্মাও বোধহয় সেই সুদিনের প্রতীক্ষায় দিন গুণতেন। বাড়িতে গেলেই আম্মা জিজ্ঞেস করতেন, অনার্স শেষ হতে আর কতদিন বাকি। সেশন জটের কারণে তখন সঠিক কোন সময় বলাও সম্ভব ছিল না। টিউশনির কারণে এমনিতেই সমু বাড়ি কম যেতো, তার উপর সমু বাড়িতে গেলে আম্মা তাকে একটু ভালো খাওয়ানোর জন্য বড়ভাইয়া-ভাবির কাছে কাকুতি মিনতি করতেন, হলে কী খায় ছেলেটা! একদম শুকিয়ে গেছে…..! কথাটা আম্মা মিথ্যে বলতেন না। কিন্তু নিজের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আম্মার এসব তৎপরতা সমুকে একদিকে যেমন বিব্রত করতো ঠিক তেমনি অন্যদিকে সেটা তার বুকের মধ্যে একটা জমাট কষ্টের পাথরে পরিণত করতো। ভার্সিটি থেকে অনেকদিন পরে ছেলে বাড়িতে গেলে মায়ের কি ইচ্ছে হবে না ছেলেকে একটু ভালো খাওয়াতে? আম্মার ইচ্ছে ছিল- সামর্থ ছিল না। সামর্থের অভাবে আম্মার ইচ্ছেগুলো যখন আহত পাখির মতো ছটফট করতো সন্তান হিসেবে সমু তা কিভাবে মেনে নেবে? তাই সমু বাড়িতে খুব কম যেতো। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার ফরম পূরণের আগে সমু হিসেব করে দেখলো কমপক্ষে হাজার চারেক টাকার দরকার। মাসখানেক টিউশনির টাকা না পাওয়ায় কিছু ধারদেনাও হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফরম পূরণ।
কিন্তু ঢাকা শহরে সমু টাকার কোন সংস্থান করতে পারলো না। টাকার প্রয়োজনে অবশেষে সমুকে বাড়ি আসতেই হলো। যেখান থেকেই হোক, যার কাছ থেকেই হোক টাকার জোগাড় হতেই হবে। জমিজমার ভাগবাটোয়ারা না হলেও এবং এক হাঁড়িতে রান্না-খাওয়া চললেও সমুর বড় ভাইয়া সেসময় অনেকটাই আলাদা হয়ে গেছে সংসার থেকে। সমুর এই তীব্র টাকার প্রয়োজনে বড় ভাইয়া যা বললো, তার মর্মার্থ হলো জমিজমা আছে। টাকার প্রয়োজন হলে বিক্রি করা যায়। বড় ভাইয়ার একথার পরে সমু ও তার আম্মা সিদ্ধাত্ম নিলো কিছু জমি বিক্রি করার। বিক্রি না হলেও অন্তত
বন্দক দিয়ে হলেও চার হাজার টাকার তখন বড্ড দরকার। জমি বিক্রয় বা বন্দক রাখার মতো গ্রামে কাউকে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না বলে বলা ভালো কেউ রাজি হলো না। সমুর চাচা কিংবা বড় ভাইয়া বোধহয় চায়নি বড়বাড়ির কোন জমি গ্রামের অন্য কেউ কিনুক বা বন্দক নিক। দু’একজনের ইচ্ছে থাকলেও তাই কেউ এ ব্যাপারে সাহস দেখায়নি। সমুর আম্মা গ্রামের বর্গাচাষীদের কারো কারো কাছে সমস্যাটা তুলে ধরলেন। সবকিছু শুনে সেসব দরিদ্র বর্গা চাষীদের কেউ নিজেদের যৎসামান্য দু’চারশো টাকা এমনিতেই ধার দিতে চাইলো কেউ জমি ক্রয় বা বন্দক নেবার কথা বললো না। সে সংগতিও তাদের ছিল না। সমুর টাকার প্রয়োজনে তার আম্মু বড়বাড়ির বউ হয়েও গ্রামের কারো বাড়ি বাদ রাখলেন না। রাতে-দিনে তাদের সাথে দেখা করেছেন, দু’চারশো করে হলেও দশজন দিলেই তো টাকাটা হয়ে যায়। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সময়মতো কেউই সমুর প্রয়োজনে কাজে এলো না। সমুর দুই মামা। ছোটমামা তখনও বেঁচে। আম্মা সিদ্ধাত্ম নিলেন ছোটমামার কাছে যাবেন এ টাকার জন্য। যদিও বড়ঘরের বউ হিসেবে আম্মা কখনো চাইতেন না সংসারের এসব সামান্য প্রয়োজনের কথা তার ভাই কিংবা ভাবিরা জানুক। কিন্তু সমুর জন্য আম্মা তা-ও করতে বাধ্য হলেন। সবকিছু শুনে ছোটমামা দু’দিন সময় চাইলেন। চাষী-গৃহস্ত বাড়িতে আসলেই সবসময় নগদ টাকা থাকে না। ছোটমামার আমত্মরিকতার কোন অভাব ছিল না।
আম্মা যেন মামাবাড়িতে দু’দিন থেকেই টাকাটা নিয়ে যান- ছোট মামা তেমনটিই চেয়েছিলেন। কিন্তু আম্মা বাড়িতে সমুকে রেখে এসেছেন। তাই তিনি মামাদের বাড়ি থাকতে চাইলেন না। ছোট মামাকে আম্মা দু’দিন সময় দিয়ে পালকীতে উঠলেন বাড়ি ফেরার জন্য। আম্মা যখন সমুর হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দিলেন তখন সমু ভেবেছিল টাকাটা বোধহয় ছোটমামাই দিয়েছেন। কিন্তু এই টাকার প্রকৃত রহস্য জানা যায়, মাসখানেক পরে আম্মার চিঠিতে। চিঠিতে সমুকে আম্মা জানিয়েছিলেন, ছোটমামাদের বাড়ি থেকে পালকীতে ফেরার পথে আম্মা মহিষবাথান গ্রামে সমুর ছোট ফুফুর বাড়িতে বিশ্রাম নিতে থামে। সমুর ছোট ফুফু সবকিছু শুনে তখনই আম্মার হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন। ছোট ফুফুর একমাত্র ছেলে তখন আবুধাবিতে কাজ করতো। বাড়িতে প্রতিমাসেই সে টাকা পাঠায়। সে টাকা থেকেই সমুর জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। তীব্র প্রয়োজনের মুহূর্তে সমুর আম্মা তখন একটা কঠিন শর্ত মাথায় নিয়েই হাত পেতে সেই টাকাটা নিয়েছিলেন। ক্রমে ক্রমে সেই শর্তের কথা সমু জানতে পেরেছে। শর্তটা জানার পরে আম্মার উপর সমুর প্রচন্ড রাগও হয়েছিল। সমু পরীক্ষা না হয় না দিতো! ছোট ফুফুর মেয়ে শেলী সহস্র জনের মধ্যে একজন সুশ্রী মেয়ে। তাই বলে গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত এই মেয়েটিকে আম্মা কিভাবে সমুর জন্য পছন্দ করলেন? সমু চিঠিতে আম্মাকে জানিয়ে দিলো, ছোটফুপুকে টাকা ফেরত দেওয়া হবে। আর আবেগের বশে ছোট ফুফুকে আম্মা যে সম্পর্কের কথা বলেছেন সেকথা যেন আর অগ্রসর না হয়। কিন্তু আম্মার পক্ষ থেকে বোধহয় সেকথা আর ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই পরের চিঠিতে আম্মা সমুকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তিনি প্রায় এক প্রকার পাকা কথা দিয়ে ফেলেছেন।
সমুর লেখাপড়া শেষ হলেই এই সম্পর্ক পাকা করা হবে। আম্মার চিঠির ভাষা সমুর মনে তীব্র অভিমানের জন্ম দেয়। আম্মা কেন যে ছোট ফুফুকে অমন প্রতিশ্রুতি দিতে গেলেন। কথা ছিল সমু অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার পরে বাড়িতে যাবে। কিন্তু সে যায়নি। টিউশানিসহ নানা কাজের দোহাই দিয়ে সমু ঢাকাতেই থেকেছে। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্টের কিছুদিন আগে এক সকাল বেলা মহসিন হল থেকে শিহাব এসে সেই নিষ্ঠুর কথাটা শুনিয়ে গেল, আম্মা নেই। শিহাব সমুদের পাশের গ্রামের ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিহাব সমুর নিচের ক্লাশের ছাত্র। তখন সবেমাত্র দেশে মোবাইল ফোন এসেছে। শিহাবও তখন মোবাইল ফোন কিনেছে। ওই মোবাইল ফোনেই খুব ভোরে শিহাবকে কেউ খবরটা দিয়েছিল।
খবর পেয়েই সমু বাড়ি ছুটেছিল। কবরে নামানোর আগে মায়ের মুখখানা সমুকে শেষবারের মতো দেখানো হলে সমু চিৎকার করে ওঠে, আম্মা- আম্মাগো! আর ক’দিন পরেই আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুবে……। আমি চাকরি পাবো। আম্মা…. সমুর শেষ কথা শেষ হয় না। আম্মার মুখখানা আবার সাদা কাফনে ঢেকে যায়।
উপস্থিত সকলেই বলতে থাকে ‘‘মিন্হা খালাক্নাকুম ওয়া ফিহা নঈদুকুম্ ওয়া মিনহানুখরিজুকুম ত্বারাতান্ উখরা” !
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।