দেয়ালে পেরেকের ক্ষতচিহ্ন

যে কোনো পাড়া মহল্লাতেই কিছু কিছু তরুণ থাকে, যুবক থাকে। পুরো মহল্লার কোথায় কী হচ্ছে, কোথায় কে এলো আর কে গেল তার সকল খবরাখবর তাদের জানা থাকে। এরা মহল্লার মুরব্বিদের দেখলে সমীহ করে। দূর থেকে সালাম দিয়ে মাথা নীচু করে থাকে। এ রকম শ্রদ্ধা সম্মান আবার তারাও আশা করে তাদের ছোটোদের কাছ থেকে। মহল্লার কোনো কমবয়সী ছেলে যদি কোনো উল্টাপাল্টা কাজ করে বসে তখন তারাই সেগুলো দেখাশুনা করে।

এরকমই এক যুবক সকাল বেলা বাসা থেকে বেরিয়ে সারাটাদিন এখানে ওখানে কাটিয়ে রাতে বাসায় ফিরতো। তার নাম ছিল সবুজ। সবুজ দুপুর বেলায় খুব কমই বাসায় যেত খাবার খেতে, বাইরেই খেত সে, বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় কিংবা অন্য কোথাও।

বাসায় এলেই মা বকা দেয়…শাসন করার চেষ্টা করে.. মহল্লার অমুককে কেন ভয় দেখিয়েছিস, তমুককে কেন মেরেছিস…তুই কি মাস্তান হয়েছিস, নাকি এই মহল্লার চেয়ারম্যান তুই….তোর জ্বালায় তো এই মহল্লায় আর বাস করা যাবে না… ইত্যাদি..ইত্যাদি…বলে মা যখন বকা দেয় সবুজকে, সবুজ তখন জবাব দিতে পারে না..বিরক্ত লাগে তার।

এই বিরক্তির কারণেই বাসা থেকে দূরে থাকতো সে। তাছাড়া ও তো নিজেই অন্যদের শাসন করে বেড়ায়…তাই তাকে কেউ শাসন করলে তার ভালো লাগে না। একদিন হলো কি…! মা সবুজের বাবার কাছে ছেলের কথা সব বলে দিল। বাবা শুনে কিছুটা বিব্রত বোধ করলো..মানে ছেলে সম্পর্কে এরকম ধারণাই ছিল না তাঁর। হঠাৎ এরকম উল্টপাল্টা কথা শুনে বাবা খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

বাবা আবার খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। হুট করেই তিনি মাথা গরম করে ফেলেন না বা রেগেমেগে লাল হয়ে যান না। বরং ভাবেন কীভাবে সমস্যাটার সমাধান করা যায়। অনেকক্ষণ চুপ থেকে অনেক ভেবেচিন্তে তিনি সবুজকে ডাকলেন। সবুজ এলো বাবার কাছে। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো অপরাধীর মতো।

বাবা সবুজকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার ব্যাপারে মহল্লার বহু মানুষের অভিযোগ আছে..তুমি নাকি সবার সাথে খুব বাজে আচরণ করো…

ছেলেঃ না বাবা.. বাজে আচরণ তো আমি কারো সাথে করি না…

বাবাঃ সত্যি বলবে কিন্তু…

ছেলেঃ বাবা আমি তোমার সাথে মিথ্যা বলবো না…

বাবাঃ কেন..বিপ্লবকে তুমি ধমকাও নি….

ছেলেঃ হ্যাঁ বাবা ধমক দিয়েছি…

বাবাঃ কেন দিয়েছো…

ছেলেঃ বাবা! ও ডাস্টবিনে ময়লা না ফেলে এক গাদা ময়লা রাস্তার উপরে ফেলেছে, প্রায়ই এ রকম করে..এজন্যে ওকে বলেছি আর কোনোদিন যদি এ কাজ করে তাহলে পুরো এক সপ্তাহ ঐ গলির সকল ময়লা তাকে পরিষ্কার করতে হবে।

বাবাঃ ঠিক আছে…কিন্তু কথাটা তো সুন্দর করেও বলা যায়..আর রনির বাবার সাথে কী হয়েছে..উনি তো মুরব্বি মানুষ..উনি কেন তোর ব্যাপারে অভিযোগ করবে….

ছেলেঃ বাবা! রনির বাবার সাথে আমার কিছুই হয় নি…রনি মোস্তাককে..কিছু টাকা হাওলাত দিয়েছিল..

বাবাঃ মোস্তাক কে…?

ছেলেঃ ঐ যে গলির মাথার দোকানদার…

বাবাঃ আচ্ছা..

ছেলেঃ তো..দোকানদার সব টাকা পরিশোধ করতে পারে নি,বলেছে যারা তার দোকানে বাকিটাকি খায় তারা মাসের শেষে বেতন পেয়ে বাকি টাকা পরিশোধ করলে তার টাকাটা সে দিয়ে দেবে…রনি নিজেও মোস্তাকের দোকানে বাকিবক্কা করেছিল প্রচুর…সারা বছরই তো বাকি নেয় তার কাছ থেকে…

বাবাঃ তাতে কী হলো..

ছেলেঃ না..হয়েছে কী..ও এখন বলছে তাকে সুদ দিতে হবে..মোস্তাক আমাদের মহল্লার ছেলে..তার দোকানে আমরা সবাই আড্ডা দেই..যখন যার তেল-নুন-আটা-ময়দা-চাল যা প্রয়োজন নেয়..রনির বাবা নিজেও প্রচুর টাকা দেনা আছে..অথচ রনি এখন তার কাছ থেকে সুদ চাচ্ছে..

বাবাঃ এটি তোমাদের ব্যাপার.. রনির বাবা কেন অভিযোগ করলো…

সবুজঃ বাবা দ্যাখো! রনির সাথে মোস্তাকের এ নিয়ে যখন কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো..তখন তার বাবা মসজিদ থেকে নামায পড়ে দোকানের সামনে দিয়ে আসছিল..উনি সব কথা শুনলেন আর তসবি গুনলেন..কিন্তু একটা কথাও বললেন না রনিকে..উল্টা আমি যখন রনিকে বললাম তুই যদি সুদ খাস..তাহলে এই মহল্লায় তোকে বয়কট করা হবে.. উনি আমাকে বললেন..

বাবাঃ কী বললেনঃ

ছেলেঃ বললেন ‘তুই এর মাঝে নাক গলানোর কে রে.. রনির ব্যাপার রনিকেই বুঝতে দে..বেশি মাতবরি করা ঠিক না’…..আচ্ছা বাবা তুমিই বলো..আমি কি কোনো অন্যায় করেছি…!

বাবা কোনো উত্তর দিলেন না। কিছুক্ষণ নীরবতার ফাঁকে সবুজই আবার মুখ খুললো।

তবে বাবা আমি… রাগের মাথায় একটা কাজ করে বসেছি..’
বাবাঃ কী করেছো..?
সবুজঃ ওনাদের বাসার দেয়াল আছে না..ঐ দেয়ালে একটা কাগজ সেঁটে দিয়েছি,
বাবাঃ কাগজে কী লিখেছো…
সবুজঃ লিখেছিঃ সুদখোর রনির হে দাড়িওয়ালা বাপ তসবি গুণে মুছবে না সুদ খাবার পাপ
বাবাঃ কাগজটা তুমি লাগিয়েছো..
সবুজঃ না বাবা! আমার ফ্রেন্ড বিপ্লবকে বলেছি..ও লাগিয়ে দিয়েছে…

বাবা কিছু না বলে মনে মনে ভাবলোঃ সবুজ তো মনে হয় খারাপ কিছু করে নি…তবে তার আচরণরীতিটা অর্থাৎ যেভাবে সে কাজটা করেছে সেটা ভালো ছিল না…তিনি আস্তে করে বললেনঃ কাজটা কি ঠিক হলো..
সবুজঃ বাবা আমিও বুঝি…কিন্তু কেন জানি মেজাজ কন্ট্রোল করতে পারি না…মাথা গরম হয়ে যায়..
ঠিক আছে’ এই বলে বাবা সবুজকে বললেন বিছানায় যেতে..আর তিনি বেশ খানিক্ষণ ভাবলেন কীভাবে কী করা যায়…

পরদিন বাসায় ফিরে সবুজের হাতে একটা হাতুড়ি দিলেন,আর কিছু পেরেক দিলেন। ওগুলো দিয়ে বললেনঃ যখনই তোর মেজাজ খারাপ হবে তখনি দেয়ালে হাতুড়ি দিয়ে একটি করে পেরেক মারবি।
সবুজ প্রথম দিন শক্ত দেয়ালে জোরে জোরে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে অনেকগুলো পেরেক মারলো। বাবার আদেশ, মারতে তো হবেই… সবুজ পেরেক মারলো। দিনশেষে সে হিসেব করতে পারলো সারাটা দিন তার রাগ-বিরক্তি আর মেজাজের কী দশা ছিল…এভাবে পরবর্তী দিনগুলোতেও সে চেষ্টা করলো তার রাগের মাত্রা কমিয়ে আনতে… অর্থাৎ দেয়ালে পেরেক মারার পরিমাণ কমিয়ে আনতে।

এভাবে প্রত্যেক রাতেই সবুজ দেয়ালে বিরক্তির পেরেক, মেজাজের পেরেক, খারাপ ব্যবহারের পেরেক মেরে মেরে তার আচরণ নিয়ে ভাবতে লাগলো। পেরেক মারার সংখ্যা প্রতিদিনই কমতে লাগলো।

একদিন দেয়ালের পেরেকের দিকে তাকিয়ে থাকলো সবুজ। পেরেকের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে দেখে খুশি হয়ে উঠলো সে। সবুজ বুঝতে পারছিল তার আচরণে আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসছে। মেজাজও অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। এভাবে একটা সময় দেখা গেল দেয়ালে পেরেকের সংখ্যা কমে গেছে। সবুজও বুঝলো তার মেজাজ আগের মতো নেই, সে এখন হুট করেই রেগেমেগে যায় না। সে তার বাবাকে বিষয়টা জানালো।

সবুজের বাবা তো খুবই বুদ্ধিমান এবং মেধাবি লোক। কেবল মেধাবিই নন, ওর বাবা একজন মনোবিজ্ঞানীও। তিনি এবার সবুজকে বললেনঃ যেদিন তোমার মেজাজ খারাপ হবে না অর্থাৎ মেজাজ ভালো থাকবে সেদিনই তুমি দেয়ালে যে পেরেকগুলো মেরেছিলে, সেগুলো একটা একটা করে তুলবে।
সবুজ তাই করলো। যেদিন তার মেজাজ খারাপ হতো না..সেদিনই সে পেরেক তুলতো…এভাবে বেশ কিছুদিন পর দেখা গেল দেয়ালে আর কোনো পেরেক নেই। সব পেরেক তোলা হয়ে গেছে।

এরপর সবুজের বাবা সবুজের হাত ধরে নিয়ে গেল দেয়ালের কাছে যেখানে সে পেরেকগুলো মেরেছিল। শত ছিদ্রময় দেয়ালের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সবুজকে বললোঃ দেয়ালের ছিদ্রগুলোর দিকে তাকাও! দেখেছো কতোশতো ছিদ্র..।
সবুজঃ হ্যাঁ বাবা দেখেছি..।
বাবাঃ তুমি যখন মানুষের সাথে খারাপ আচরণ করতে, তাদের সাথে মেজাজ দেখাতে, তখন তাদের মনের দেয়ালেও এই পেরেকের ছিদ্রের মতোই ছিদ্র হতো। তাদের অন্তরে যেরকম আঘাত দিয়েছো, সেই আঘাতগুলোও দেয়ালের এই ছিদ্রগুলোর মতোই, এই আঘাতগুলোর সংশোধন সহজ কাজ নয়। তুমি ভালো হয়ে গেলেও তাদের মনের কষ্টগুলো কিন্তু থেকেই গেছে। এই দাগ সহজে মুছবে না…

সবুজঃ তাহলে কী করতে হবে….
বাবাঃ মুছে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
সবুজঃ কীভাবে
বাবাঃ দেয়ালে কেউ কিছু লিখলে তা পরিষ্কার করার জন্যে যেমন রং লাগাতে হয়..তেমনি যাদের মনে তুমি কষ্টের দাগ দিয়েছো, তাদের মনেও রঙ লাগাতে হবে..
সবুজঃ এটা কী করে সম্ভব..
বাবাঃ সম্ভব..সম্ভব..শ্রদ্ধার মাধ্যমে, সম্মানের মাধ্যমে। যাদেরকে কষ্ট দিয়েছো, তাদেরকে সালাম দিয়ে বিনয়ের সাথে ক্ষমা চাইবে..

পরদিন সকাল বেলা বাসা থেকে বেরিয়ে মোস্তাকের দোকানের দিতে যেতেই রনির বাবার সাথে সবুজের দেখা হয়ে গেল। সবুজ তাঁকে সালাম দিয়ে বললোঃ আঙ্কেল স্যরি, আমি বুঝতে পারি নি, ভুল করে ফেলেছি..আপনাকে কষ্ট দিয়েছি.. ওভাবে পোস্টার লাগানোটা ঠিক হয় নি..আমাকে মাফ করে দেবেন..দোয়া করবেন প্লিজ…ওরকম আর হবে না…

এভাবেই সবুজ নিজেকে সংশোধন করার এই ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করলো। সবার সাথে সে সদ্ব্যবহার করতে লাগলো। কারো সাথে আর মেজাজ দেখিয়ে কথা বলতো না। মহল্লার ছেলে-বুড়ো সবাই যে যেরকম সমস্যায় পড়তো অমনি সবুজকে খোঁজ করতো। সবুজও সাধ্যমতো সবাইকে সাহায্য করতো।

সবুজ মনে মনে ভাবলোঃ সত্যিই, অন্যায় দিয়ে অন্যায়কে দমন করা যায় না। তার কাজগুলো তো সবই ভালোই ছিল। কিন্তু যেভাবে সে কাজগুলো করেছিল যেমন ধমক দিয়ে কিংবা পোস্টার লাগিয়ে অপমান করে…সেটা ঠিক না। মানুষকে ন্যায়ের পথে ডাকতে হবে সুন্দর কথা বা বক্তব্যের মাধ্যমে, বুদ্ধিমত্তার সাথে, কৌশলে। ঠিক সবুজের বাবার মতো।

পাখির বন্ধু

‘সুঁইয়ের সূতোটা ছোটো রাখতে হয়’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *