‘কি মুসকিল, তোরা কি আমাকে পাগল করে দিবি’|

দেওয়ালে অথবা পোস্টারে, সাইনবোর্ডে কিংবা হোর্ডিংয়ে বিচিত্র বিপর্যয় আকছার চোখে পড়ে। তার কোনওটা, যে লিখেছে, তার বানান বোধের অভাব অথবা নিছক কোনও একটা শব্দ অসাবধানে বাদ পড়ে যাওয়াই হোক, কিংবা রসিকজনের ইচ্ছাকৃত কোনও শব্দ মুছে দেওয়াই হোক-এককথায় বিষয়টি মজাদার। কখনও কখনও আবার অতিরিক্ত একটি লাইন সংযোজনেও খেলাটা জমে ওঠে। যেমন আশির দশকের শেষের দিকে টালা ব্রিজের গায়ে বিশাল অক্ষরে লেখা ‘বাঙালি জাগো’-র ঠিক নিচেই কে যেন লিখেছিলেন-‘আঃ, কাঁচা ঘুম ভাঙাইবেন না।’ মনে পড়তে বাধ্য মনীভূষণ ভট্টাচার্যের সেই সপাটে চাবুক মারার মত ভাবনাটির কথা।

যেখানে সত্তর দশকের দেওয়াল লিখলে ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ জ্বল-জ্বল করে। ‘রাজনৈতিক’ শব্দটি কিভাবে যেন বাদ পড়ে যায়। বীরভূমের প্রান্তিক রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টারে দেখেছিলাম লেখা আছে- ‘টিকিঘর ছাড়িবার পূর্বে টিকি ও টাক দেখিয়া লইবেন।’ রসিক বাঙালি টিকিটের ‘ট’ এবং টাকার আ’কার একটু মাথা খাটিয়ে মুছে দিয়েছিলেন মাত্র। লিখন বিপর্যয়ের সুপার ডুপার হিট একটি গল্প অনেকেরই হয়তো জানা। অবশ্য সেটিকে মুদ্রণ বিপর্যয় বললেই যথোপযুক্ত হয়। খবর কাগজে ছাপা হল-পুলিশের গুলি খেয়ে দুই বকের মৃত্যু। বলা বাহুল্য ওটা আসলে গুলি খেয়ে যুবকের মৃত্যু। আমার বক্তব্য ওটা নয়, রসিক বাঙালি এর সঙ্গে যোগ করল আরও একটি মাত্রা। পরের দিন সংশোধনীতে লেখা হল – ওটি ‘পাছার’ ভুল ছিল। ছাপার এমন বিপর্যয় বাঙালি ছাড়া আর কারও মস্তিষ্কের আমদানি হতে পারে। ছাপাখানার ভূত কত যে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে চলে সারা দুনিয়া জুড়ে তার নজির মেলা ভার। কখনও যতি চিহ্ন বসিয়ে দেয় ভুল জায়গায় আর তার ফলে অর্থ যায় উল্টে। একসময় এইরকম একটি চিঠির কথা খুব শোনা যেত – আমাদের মেনি বেড়ালটি বমি করেছে শ্বশুরমশাইয়ের মুখে, ঘা হয়েছে পেঁপে গাছের, মগডালে মধুর চাক হয়েছে, শাশুড়িমায়ের কোমরে, ব্যথাটা বেড়েছে খোকার, একটি খেলনা এনে দিও ভুলো কুকুরের জন্য, আর তো পারা যায় না তোমার জন্য, মন খারাপ করে না, চিন্তা কোর, না আমি পথ চেয়ে, আছি ভাল, থেকো চিঠি, ইতি মৃণালিনী। স্কুল সার্ভিস কমিশন পূর্ববর্তী যুগে যখন এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে শিক্ষক পদপ্রার্থীদের নাম পাঠানো হত, আর হবু শিক্ষকদের ক্লাস নিতে হত, সেই আমলের কথা। পিছনে বসে আছেন তিন-চারজন হোমরা-চোমরা।

প্রধান শিক্ষক, এক্সপার্ট হিসেবে বাইরে থেকে আগত কোনও অধ্যাপক, পঞ্চায়েৎ থেকে মনোনীত একজন, এইরকম মানুষেরা। হবু শিক্ষককে পড়াতে দেওয়া হয়েছে মেঘনাদ বধ কাব্যের অংশ বিশেষ। বেশ পড়াচ্ছিলেন, হঠাৎ একটি লাইন এল – ‘হুহুঙ্কারে বাহিরিল বারণ’। অকালপক্ক একটি ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল -‘স্যর, বারণ মানে কি?’ হবু শিক্ষকের অবস্থা ঢিলে। বারণ মানে যে হাতি সেটি তাঁর জানা নেই, কিন্তু বাঙালি তো, জানি না বলতে শেখেননি। যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে তিনি বলে দিলেন ‘ওটা ছাপার ভুল, বারণ নয়, ওটা হবে রাবণ, রামায়ণ থেকে লেখা হয়েছে সেটা জানো না?’ লিখন না হলেও কথন বিপর্যয় জাতীয় একটা মজার খেলা আছে। এক সময় খেলাটিতে দক্ষ হয়ে উঠেছিলাম। অনায়াসে ওলোট-পালট কথা বলে যেতাম। গানও গাইতে পারতাম, যেমন – ‘রাঁওন শাতে যদি, অরণে শাসে মোরে, ঝাহিরে বড় বহে, বয়নে নারি ঝরেৃ’। আমরা বেশ কয়েকজন এই ওলোট-পালট বাক্যে কথাও বলতাম। হয়তো রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, অন্ধকার গ্রামের মেঠো পথ, সামনের বন্ধু হয়তো কাদায় পা দিয়েছেন, আমাকে সাবধান করে বলে উঠলেন-‘ধাবসান ধাবসান, কামনে সাদা’। আমরাই যে এমন মজাদার বাক্যক্রীড়ার আবিষ্কারক ছিলাম এমন দাবি করব না। আবহমান কাল থেকে বাঙালি এই চর্চা করে আসছে। মনে পড়ে ছেলেবেলায় মায়ের মুখে শুনতাম – লুলকো ফুচি, সিমকি নিঙারা আর এক চাপ কায়ের গল্প। অনেকে আবার সচেতন ভাবে নয়, স্বাভাবিক অভ্যাসেই কখন বিপর্যয়ের শিকার।

নিচু ক্লাসের একটি ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বয়ে আকার তয়ে আকার দন্ত্যসয়ে আকার, কি হয়?’ সে অম্লান বদলে বলল -বাসাতা। সে তো না হয় শিশু, আমরা বড়রাও কত অম্লান বদনে রিশকা অথবা ট্যাসকি চড়ে ঘুরে বেড়াই। খবরের কাগজে নৃশংসতার ঘটনা পড়ে বলে উঠি – ‘ওটা কি মানুষ? না পিচাশ?’ শুনেছিলাম চাটগাঁয়ের মানুষ নাকি ‘প’-কে ‘ফ’ বলেন। শোনা কথাটি ঠিক না ভুল তা পরীক্ষা করার জন্য একজন মাস্টার মশাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – ‘স্যার, আপনারা নাকি ‘প’-কে ‘ফ’ বলেন?’ স্যার বলেছিলেন- ‘ধুর ফাগল, তাই কেউ বলে নাকি!’ আসলে যিনি বলেন তিনি তো জানেন না যে তিনি কি বলেন। এ বিষয়ে চূড়ান্ত একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি।
আমাদের পাড়ায় জগাপাগলাকে খ্যাপাতো স্কুলের বাচ্চারা। একদিন চার-পাঁচটা ছেলে একসঙ্গে বিরক্ত করছে জগাকে। তিতিবিরক্ত হয়ে জগা বলে উঠল – ‘কি মুসকিল, তোরা কি আমাকে পাগল করে দিবি।’

অতনু বর্মণ

আরো পড়তে পারেন...

শিয়াল পণ্ডিত–উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

কুমির দেখলে, সে শিয়ালের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছে না। তখন ভাবলে, ‘ ও ঢের লেখাপড়া…

তিন কিশোরের কাণ্ড —স্বপন বুড়ো

তিনটি কিশোর এক সাথে পরীক্ষা দিতে বসেছিল।কিন্তু পরীক্ষার আগে ওরা পাকাপোক্ত ব্যাবস্থা করে গিয়েছিল।সুতো ঝুলিয়ে…

চাঁদা –বিশু মুখোপাধ্যায়

এর পর আর কোন দিন চাঁদা দেবে না ঠিক করে ফেললেন দীনদয়াল।এ পাড়ায় নতুন বারী…