জ্যোতিষীর ভাগ্য

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই এমন কিছু লোককে দেখেছো, যারা অদৃশ্য বস্তু ও ভবিষ্যত সম্পর্কে অনেক কিছু জানে বলে দাবি করে থাকে। এদেরকে গণক, ভবিষ্যদ্বক্তা, জ্যোতিষী প্রভৃতি নামে ডাকা হয়। ইসলামে ভাগ্য গণনাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “আল্লাহ ছাড়া আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, এদের কেউই অদৃশ্য জগতের কিছু জানে না” (সূরা আন্ নামল, আয়াত ৬৫)। অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কেউ কোন গণক, গায়বী বিষয়ের সংবাদদাতা বা ভবিষ্যদ্বক্তার কাছে যায় এবং তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, তবে ৪০ দিন পর্যন্ত তার কোন নামায কবুল হবে না।’ ইসলামের কঠোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও অনেকেই ভাগ্য গণনার নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে থাকে। রংধনু আসরে আমরা তেমনি এক ভণ্ড জ্যোতিষীর কাহিনী প্রচার করেছি।

অনেক দিন আগে ইরানের ঐতিহাসিক শিরাজ নগরীতে বাস করত এক গরীব লোক। একদিন লোকটির স্ত্রী গেল পাশের এক হাম্মামখানায় গোসল করতে। সেখানে গিয়ে দেখতে পেল অতি উত্তম পোশাক পরা এক মহিলা এসেছে হাম্মামখানায় গোসল করতে। হাম্মামের খাদেমরা সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত। গরীব মহিলাটির দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না। সে যখন গোসল করতে গেল তখন একজন এসে তাকে বাধা দিল এবং ধনী মহিলাকে আগে গোসল করার সুযোগ দিল। রাগে-দুঃখে গরীব মহিলাটি গোসল না করেই ফিরে এল। ফিরে আসার পথে একজনের কাছে জিজ্ঞেস করে সে জানতে পারল, গোসল করতে আসা ধনী মহিলাটি এক রাজ-জ্যোতিষীর স্ত্রী। টাকা-পয়সার অভাব নেই তার। এজন্য সমাজে তার এত আদর, এত সম্মান। গোসল করার সুযোগ না পেয়ে গরীব মহিলাটির মন খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে এসে সে স্বামীকে সব কথা খুলে বলল। এরপর বলল : সংসার সম্পর্কে তোমার কোন চিন্তা-ভাবনা আছে? রাজ-জ্যোতিষী হতে না পারলেও অন্তত সাধারণ এক জ্যোতিষী হও, দেখবে কত টাকা-পয়সা আসে।

গরীব লোকটি ছিল সহজ-সরল ও গো-বেচারা মানুষ। সে স্ত্রীকে বোঝাল লাগল: “আরে ইচ্ছে করলেই কি জ্যোতিষী হওয়া যায়? এ জন্য লেখাপড়া দরকার, প্রচুর জ্ঞান দরকার। আমার কি তা আছে?” এ কথা শুনে স্ত্রী আরো ক্ষেপে গেল। সে স্বামীর মুখের ওপর বলে দিল: “তোমার কোন কথাই আমি শুনতে চাই না, হয় তুমি জ্যোতিষী হও, না হয় আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব।” এ কথা শুনে গরীব বেচারা চমকে উঠল। সে ভাবল, হোক ভণ্ডামী, তবু সে জ্যোতিষী হবে। অভাবের কারণে স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যাবে এটা সে সহ্য করতে পারবে না।

এ ঘটনার পর গরীব লোকটি কয়েকটি ফাল-নামার বই জোগাড় করল। কাগজের মধ্যে খোপ খোপ করে ঘর তৈরি করে তাতে নম্বর দিল, নম্বরের সঙ্গে লিখে রাখল আরবী বর্ণমালা আলিফ, বে, সে ইত্যাদি। হাতে রাখল অনেকগুলো গুটি। এরপর এসব নিয়ে গিয়ে বসল হাম্মাম-খানার পাশে মানুষের ভবিষ্যৎ গণনা করতে। প্রথম দিনেই ঘটে গেল এক অলৌকিক ঘটনা। সেদিন হাম্মামখানায় গোসল করতে এলেন সিরাজের রাজকন্যা। তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকজন দাসী-বাঁদী। রাজকন্যার মূল্যবান একটি হীরের আংটি এক দাসীর হাতে রেখে গেল গোসল করতে। দাসী আংটিটি হারিয়ে ফেলার ভয়ে দেয়ালের একটি ছোট ফাটলে গুঁজে রাখল এবং চিহ্নস্বরূপ সেখানে রেখে দিল তার মাথার কয়েকটি চুল। আংটি ওখানে রেখেই দাসী অন্যান্যদের সঙ্গে খেলাধুলা ও গল্প-গুজবে মেতে উঠল। এক সময় সে বেমালুম ভুলে গেল আংটিটির কথা।

রাজকন্যা গোসল সেরে বাইরে এসে তার আংটি চাইল। কিন্তু দাসী কোনোভাবেই আংটির কথা মনে করতে পারল না। রাজকন্যা ভাবল, দাসী নিশ্চয়ই আংটিটি চুরি করেছে। তাই সে যেখান থেকে হোক আংটি ফেরত আনার নির্দেশ দিল এবং আংটি আনতে না পারলে দাসীর প্রাণ যাবে বলেও হুমকি দিল। দাসী প্রাণভয়ে কাঁদতে কাঁদতে গেল হাম্মামের পাশে বসা জ্যোতিষীর কাছে। তার কাছে সব খুলে বলল। কিন্তু জ্যোতিষী কি বলবে? সে কি গণনার কিছু জানে! সে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে দাসীর দিকে তাকিয়ে থাকল। দাসীর বোরকা ছিল একটু ছেঁড়া। ছেঁড়ার ফাঁক দিয়ে দাসীর কালো চুল বের হতে দেখে ভণ্ড জ্যোতিষী বলে উঠল : কী ভাল, কী ভাল বিলকুল, বাতাসে দুলছে কালো চুল।

এ কথা শুনে দাসীর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আরে তাইতো! হীরের আংটিটি সে দেয়ালের গায়ে লুকিয়ে রেখেছিল আর সেখানে রাখা ছিল কয়েকটি চুল। নিশ্চয়ই তা বাতাসে দুলছে। জ্যোতিষী তো ঠিকই বলেছে। দাসী দৌড়ে গেল দেয়ালের পাশে। গিয়ে দেখতে পেল আংটি সেখানেই আছে। এরপর আংটিটি এনে রাজকন্যাকে ফেরত দিল এবং সবকিছু খুলে বলল। আর রাজকন্যা গিয়ে বলল রাজার কাছে। রাজা তখনই জ্যোতিষীকে রাজদরবারে ডেকে পাঠালেন এবং তাকে রাজ-জ্যোতিষী হিসেবে নিয়োগ দিলেন।

এতবড় মর্যাদা পেয়েও জ্যোতিষী খুশী হতে পারল না। সে কেবলি ভাবতে লাগল-এই বুঝি তার জারি-জুড়ি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। সেই রাতেই রাজার কোষাগার লুট হলো। রাজা জ্যোতিষীকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, কে বা কারা এই লুটের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে খুঁজে বের করতে। সব শুনে জ্যোতিষী বললেন, “ঠিক আছে, আমাকে চল্লিশ দিন সময় দিন। দেখবেন আমি ঠিকই অপরাধীদের বের করে ফেলব।” রাজার কাছ থেকে চল্লিশ দিন সময় নিয়ে জ্যোতিষী এল বাড়ীতে। তার বুকটা অজানা ভয়ে কাঁপতে লাগল। স্ত্রীর হাতে সবকিছু খুলে বলে তার হাতে চল্লিশটি খেজুর দিয়ে বলল: “এসব রাখ। শোবার আগে প্রতি রাতে একটা করে খেজুর আমাকে দেবে। চল্লিশ রাতে চল্লিশটা শেষ করে তবেই যাব রাজ-দরবারে।”

স্ত্রীর হাতে খেজুর দেয়ার সময় জ্যোতিষী ছড়া কাটল:
“নাও গুণে এক হাতে, দেখ বিশ আছে তাতে
অন্য হাতে আছে বিশ, দুইয়ে মিলে চল্লিশ।”

রাজা কোষাগার লুট করার সময় ডাকাতরা ছিল দুই দলে বিভক্ত। প্রতি দলে ছিল বিশজন করে। রাজা ডাকাতদের ধরার জন্য জ্যোতিষীকে নির্দেশ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাকাত সর্দার গোপনে খবর নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল-জ্যোতিষী কি করে তা দেখার জন্য। রাতে যখন জ্যোতিষী ছড়া কাটল তখন ডাকাতদের একজন ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে তা শুনল। সে ভাবল, জ্যোতিষী তো ঠিকই খবর পেয়েছে যে, তারা ছিল চল্লিশজন। কিছুক্ষণ পর জ্যোতিষীর স্ত্রী তার হাতে একটা খেজুর দিয়ে বলল:
“চল্লিশের এক নাও, মজা করে খুব খাও।”
এ কথা শুনে ডাকাত দৌড়ে পালিয়ে গেল। সে গিয়ে ডাকাত সর্দারের কাছে সবকিছু বলে দিল।

ডাকাত সর্দার পরদিন দু’জনকে পাঠাল। তারা এসে জ্যোতিষীর ঘরের পেছনে কান খাড়া করে বসে রইল। জ্যোতিষী শোবার সময় ঘনিয়ে এলে তার স্ত্রী নিয়মমতো একটি খেজুর দিয়ে বলল: “চল্লিশের এই দুই, খেয়ে-দেয়ে চল শুই।”

এবার দুই ডাকাত ভাবল। জ্যোতিষী তো ঠিকই জানে। নইলে আজকে দুইজন এসেছি সে দেখল কি করে! তাদেরাও সর্দারের কাছে এই খবর পৌঁছে দিল। এভাবে উনচল্লিশ রাত কেটে গেল। সব রাতেই ডাকাতরা এসেছে খবর নিতে এবং সঠিক খবর শুনে দৌড়ে পালিয়েছে। চল্লিশতম রাতে ডাকাত সর্দার নিজেই এল। ওদিকে চল্লিশ খেজুর খাওয়ার আজকেই শেষ রাত। ভোরেই যেতে হবে বাদশার-দরবারে।

ভাগ্যক্রমে শেষ খেজুরটি ছিল আকারে বড় এবং মোটা। অন্যদিকে ডাকাত সর্দারও ছিল মোটা-সোটা। জ্যোতিষীর স্ত্রী শেষ খেজুরটা জ্যোতিষীর হাতে দিয়ে বলল: “চল্লিশের এই শেষ, মোটা-সোটা বেশ বেশ।”

ডাকাত সর্দার ভাবল, জ্যোতিষী তো ঠিক ধরেছে। নইলে আজ আমি নিজে এসেছি এ কথা জানলো কি করে? ভয়ে ডাকাত সর্দার কাঁপতে লাগল। সে দৌড়ে গিয়ে ডাকাত সর্দারের পায়ে পড়ে বলল, ডাকাত সর্দার: “জ্যোতিষী বাবা, কোষাগারের সব সোনা-দানা আমরাই লুট করেছি। এক্ষুনি সব এনে দিচ্ছি, আপনি আমাদের বাঁচান।”

ডাকাত সর্দারকে হাতের মুঠোয় পেয়ে জ্যোতিষীর আনন্দ আর দেখে কে? সে এবার উত্তেজিত হয়ে বলল: “ব্যাটা, বেঈমান। এক্ষুনি সব নিয়ে আয়।। নইলে তোদেরকে ফাঁসিতে ঝুলাবো।” জ্যোতিষীর হুকুমে রাতের মধ্যেই সব সোনা-দানা হাজির করল ডাকাতেরা। জ্যোতিষী পরদিন সকালে তা নিয়ে রাজদরবারে পৌঁছে দিল। ডাকাতি হওয়া জিনিস ফেরত পেয়ে বাদশাহ তো মহাখুশী। তিনি জ্যোতিষীকে অনেক পুরস্কার দিলেন। জ্যোতিষীর প্রতি বাদশাহ’র বিশ্বাস আরো বেড়ে গেল।

ইসলাম অবমাননা

অসুরের শক্তি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *