►ক্যাথেড্রাল – শেষ পর্ব◄

প্রচন্ড যন্ত্রণায় মাথার বাম পাশটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। চোখ খুলতে পারছি না ঠিক মত। চট চটে আঁঠালো কিছু দিয়ে বাম চোখের পাতা আর পাপড়ি জোড়া লেগে গেছে। দু হাত আর পা পিছ মোড়া করে বেঁধে রেখেছে। অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকালাম। সব কিছু ঘোলাটে লাগছে। মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে আমাকে। মাথা ঘোরাবার শক্তি পাচ্ছি না। যতটা দেখতে পাচ্ছি বোঝা গেল আমি ক্যাথেড্রালের সেই হল রূমে শুয়ে আছি। আমার চার পাশে নানা রকম মূর্তি। হলুদ বাতি জ্বলছে জেনারেটরের। আমি নড়ার চেষ্টা করতেই তীব্র একটা ব্যথা মাথা থেকে দৌড়ে পায়ের দিকে চলে গেল। বাহিরে প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে। ছাদের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে বজ্রপাতের আলো।

মাহিনের কথা মনে পরতেই মাথার ব্যথা ভূলে গিয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। আমার পাশেই শুয়ে আছে। অজ্ঞান। হাত বাধা পিছ মোড়া করে। পা বাঁধেনি ওর। কালচে রক্তের ক্ষিণ একটা ধারা ওর মাথার একপাশ থেকে বেয়ে মেঝেতে নেমেছে। ধক করে উঠল বুকটা। হাঁচড়ে পাঁচড়ে গড়িয়ে ওর কাছে গেলাম। মুখের কাছে মুখ এনে বুঝতে পারলাম খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে। দূর্বল হয়ে গেছে। আমি ভয় পাওয়া গলায় ডাকলাম, “মাহি? মাহি? শুনতে পাচ্ছো?” মুখ দিকে আলতো ধাক্কা দিলাম।

নড়ে উঠল মাহিন। ধীরে ধীরে চোখ মেলল। প্রথমে বুঝতে পারলো না কোথায় আছে। তারপর আমাকে দেখে ভয়ার্ত গলায় বলল, “কি হয়েছে তোমার রবি? এত রক্ত কেন?”

আমি দূর্বল ভাবে হাসলাম, “কিছু হয়নি। তুমি ঠিক আছো?”

“মাথার ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যথায়।” কঁকিয়ে উঠল।

“বেশি?” উদ্বিগ্ন হলাম।

“নাহ। সহ্য করতে পারবো……. এখানে এলাম কি করে?”

আমি জবাব দেয়ার আগেই আমাদের মাথার দিক থেকে প্রফেসর নারায়ণ গাঙ্গুলির গলা শুনতে পেলাম, “আমি এনেছি।”

আমি মাথা ঘুরিয়ে অনেক কষ্টে তাকালাম, “হ্যালো স্যার! শুভ মধ্যরাত্রি! এমনি ডাকলেই তো চলে আসতাম। মাঝ রাতে গজিনি স্টাইলে হকি না খেললেও হতো।” খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম।

হাতে একটা লোহার রড নিয়ে আমাদের মাথার কাছে এসে বসলেন প্রফেসর গাঙ্গুলি। সহজ সরল একটা হাসি তাঁর মুখে, “বাহ! মেজর সাহেবের মুখে তো খৈ ফুটেছে! আমি তো ভেবেছিলাম মানুষ জনকেই আর চিনবে না।”

“কি করবো, আর্মি তো। মাথার খুলি লোহা হয়ে গেছে কমান্ডো ট্রেনিং এর সময়।”

“আমি জানতাম তুমি উল্টো পাল্টা কিছু করবে…… খাল কাটার কাজ দিলাম- সেটা না করে বৌয়ের পেছন পেছন ঘুর ঘুর করতে লাগলে।” হতাশ মুখে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। যেন স্নেহের হাত বুলালেন।

আমি দাঁত বের করে হাসলাম, “হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দেবো এই ভয়ে? ড. এজাজের খুন আপনি করেছে সেটা বুঝে ফেলবো- তাই না?”

“হুম। তোমার মাথা যে খুব পরিষ্কার সেটা প্রথম দিনেই বুঝে গিয়েছিলাম। তারপরও যে কেন গ্লাভস পরে কাজ করার বোকামিটা করলাম….” আফসোসের গলায় বললেন।

“তাও ঠিক। তা জানতে পারি আজ তাবুর বাহিরে কান পেতেছিল কে? আপনি? না তালেব সাহেব?”

“আমি। খাতাটা চাইতে গিয়েছিলাম মাহিনের কাছ থেকে। কিন্তু গিয়ে দেখি কি সব ভয়ংকর ভয়ংকর কথা আলোচনা করছো! ছোট মানুষ- অথচ এসব নিয়ে কথা বলছো!”

“বাহ! একেবারে সময় মত!” তেঁতো হাসি হাসলাম। মাহিনের দিকে তাকিয়ে দেখি ভয়ে মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেছে। রা নেই মুখে।

“ড. এজাজ আহমেদকে খুন করলেন কেন হঠাৎ? শুনলাম তিনি নাকি মারা যাওয়ার দু দিন আগে এসেছিলেন। এসেই খুন?” জিজ্ঞেস করলাম।

উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর সাহেব, মূর্তি গুলোর চারপাশে হেটে বেড়াতে লাগলেন। ছাঁদের দিকে তাকালেন। বজ্রপাতের আলো আর বৃষ্টির ছটা আসছে ভাঙ্গা অংশটা দিয়ে। গম্ভীর গলায় বললেন, “নাম ছড়াবার ব্যাপারটার সাথে বোধ হয় পরিচিত না তুমি। তাহলে জিজ্ঞেস করতে না। এত বড় একটা আবিষ্কার হবে- নতুন ইতিহাস তৈরি হবে, অথচ সেখানে নাম থাকবে ড. এজাজের- ব্যাপারটা কেমন যেন বেখাপ্পা দেখায়…. নাম থাকা উচিত আমার মত মানুষদের- যারা সারা জীবন এসব নিয়ে পড়ে ছিল। ড. এজাজ কোথাকার কে? কোনো যোগ্যতাই নেই ঐ ছাগলটার এত বড় একটা আবিষ্কারের অংশ হওয়ার। দুই মাস চষে যে সমাধী কক্ষ বের করতে পারেনি, আমি দুই দিনে সেটা করে দিয়েছি- যোগ্যতা কার বেশি? অবশ্যই আমার! তাই উটকো ঝামেলা রাখতে চাইনি। মেরে ফেললাম।” অবলীলায় বলে গেলেন কথা গুলো। যেন গল্প বলছেন। “মাঝ রাতে ক্যাথেড্রালে যাবার নাম করে নিয়ে এলাম- পরপর ছয়টা চাকু গেঁথে দিলাম পিঠে। ব্যস, কাজ শেষ।”

“গার্ডদের এড়ালেন কি করে?”

“সে সময় গার্ড ছিল না। আজ অবশ্য আছে। অল্প ক’জনকে টাকা খাইয়ে হাতে রাখা হয়েছে। টুকিটাকি দামি জিনিস পত্র বেচে যা লাভ হচ্ছে তাতেই গার্ড গুলোকে বাগাতে পেরেছি। কোনো কষ্ট হয়নি।”

“বাহ! তার মানে ছোট ছোট চুরি আসলে হচ্ছিল না। ওগুলো আপনারাই সরাচ্ছিলেন? ঘরের ইঁদুরই বেড়া কেঁটেছে!” নিমের তেঁতো ঝড়ল কন্ঠ থেকে আমার।

“হু…. এখন অবশ্য তোমাদের মত অতি বুদ্ধিমানদের নিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেলাম। কি করা যায় তোমাদের নিয়ে?” চিন্তিত মুখে তাকালেন। যেন প্রশ্ন করলেন আমাকে।

“একটা আইডিয়া দিতে পারিঃ ছেড়ে দিতে পারেন।”

“নাহ…… সেটা করা যাবে না। তুমি বেশ ভাল বক্তা। সাংবাদিক ডেকে বক্তৃতা দিয়ে দেবে আমার মহৎপ্রাণ কাজের ওপর। তাই না মেরে উপায় পাচ্ছি না।”

“মেরেই ফেলবেন? বাকিদের কি জবাব দেবেন?” সামান্য হতাশ মুখে বললাম।

মৃদু হাসলেন, “সমস্যা নেই। মাহিন সমস্যাটা দূর করে দিয়েছে। বলে দেবো মাঝরাতে লেবার পেইন উঠেছিল। মেজর শাহরিয়ার তার ওয়াইফকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। তারপর যা বোঝার ওরা বুঝুক। খুঁজে না পেলে ভেবে নেবে এক্সিডেন্ট করে পরলোক গমন করেছো। এমনিতেই পাহাড়ি রাস্তা, এক্সিডেন্ট করা অস্বাভাবিক কিছু না। আর চারপাশে এত খাদ, কেউ পড়ে গেলে খুঁজতেও যাবে না।”

মাহিন মড়িয়া হয়ে বলল, “স্যার আমাদের ছেড়ে দিন প্লিজ। আমরা কাউকে কিচ্ছু বলবো না! আই ইনসিষ্ট! প্লিজ আমাদের ছেড়ে দিন!”

জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করতে করতে হল রূমে ঢুকল ড. তালেব, “তা বলে তো লাভ নেই মেয়ে! যা হওয়ার হয়ে গেছে। স্যরি ফর দ্য কিড!” কাছে এসে মাহিনকে চুল ধরে টেনে তুলে দাঁড় করালো। আর্তনাদ করে উঠল মাহিন। আমি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলাম ব্যাপারটা।

“চল, তোমাকে আগে গুম করা প্রয়োজন। তারপর এই মেজর সাহেবকে।” ওর পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে নিয়ে যেতে লাগল দোতলার সিঁড়ির দিকে।

আমি অসহায় চোখে তাকিয়ে আছি। বাধা দেয়ার কোনো উপায় নেই। হাতে শক্ত নাইলনের দড়ি। হাত মুচড়াতেই দড়িটা চামড়া কেটে বসে যেতে লাগল…..

মাহিন করুণ মুখে ফিরে তাকালো একবার। তারপর হারিয়ে গেল সিঁড়ি ঘরের আড়ালে।

আমি ব্যর্থ আস্ফালন করে একটা চিৎকার দিলাম। বদ্ধ হল রূমে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল চিৎকারটা। তার মাঝেই শুনতে পেলাম শিসের মত তীক্ষ্ণ একটা শব্দ আর বজ্রপাতের শব্দে মেশানো মাহিনের চিৎকার।

রাগে ক্ষোভে চোখ বন্ধ করে ফেললাম…….

হঠাৎ করেই গোলাগুলির শব্দ শুরু হল। আমি চোখ মেলতেই অবাক হয়ে দেখলাম কোত্থেকে রাকিব ডাইভ দিয়ে হল রূমের ভেতরে এসে পড়লো! এক গড়ান খেয়েই সোজা হয়ে পিস্তল তুলে গুলি করল প্রফেসরের পা লক্ষ করে। প্রফেসর তার আগেই অন্য দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। মূর্তির আড়ালে চলে গেছেন।

রাকিব নিজে একটা মূর্তির আড়ালে ঠাঁই নিল। আমার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “রবি? তুই ঠিক আছিস? মাহিন কোথায়?”

“আমি ঠিক আছি। তুই মাহিনকে বাঁচা। হারামজাদার তালেব কি করেছে কে জানে! সিঁড়ি ঘরের দিকে গেছে ওরা।”

রাকিব কোনো কথা না বলে কিছু একটা ছুড়ে মারল আমার দিকে। মেঝেতে পড়তেই শব্দ শুনে বুঝে গেলাম জিনিসটা চাকু। দ্রুত গড়ান দিয়ে চাকুটা হাতে নিয়ে নিলাম পেছন দিক দিয়ে। ট্রেনিং এর সময় বহুবার এই কাজ করেছি। চাকু দিয়ে হাত আর পায়ের বাঁধন যতক্ষণে কাটা ধরেছি, রাকিব দৌড়ে চলে গেল সিঁড়ি ঘরের দিকে। আমি পাগলের মত চাকু চালাচ্ছি। হাত কেটে রক্তে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে- তাও পাত্তা দিচ্ছি না। হাত সবে মুক্ত করে পায়ের বাঁধনে চাকু ছুয়েছি- সামনে তাকিয়ে দেখি লোহার রডটা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন প্রফেসর সাহেব। হিংস্র দৃষ্টি চশমার ওপাশের চোখ দুটোয়। কিছু বোঝার আগেই প্রচন্ড জোরে আমার মাথায় বাড়ি মারলেন লোহার রডটা দিয়ে। জায়গা মত লাগলে এ দফায় আর বাঁচতাম না। লাফিয়ে পেছনে সরে গেলাম। যদিও আঘাতটা পুরোপুরি এড়াতে পারলাম না। ডান কাঁধে লাগল বাড়িটা। মনে হল ডান কাঁধ পুরোটা অবশ হয়ে গেল! পায়ের বাঁধনে হোচট খেয়ে একটা মূর্তির গায়ে পড়ে গেলাম।

প্রফেসর আবারও পাগলের মত রডটা দিয়ে বাড়ি মারলেন। আমি গড়ান দিয়ে সরে গেলাম, পেছনের মূর্তিটা রডের বাড়ি লেগে ভাঙ্গে পড়ল। ধূলো উড়তে লাগল। আমি টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। চাকুটা পড়ে গেছে, ডান হাত নড়ছে না। বাম হাতে টান দিয়ে পায়ের বাঁধন খুলে ফেললাম এবার।

প্রফেসর উন্মাদ হয়ে গেছেন। প্রচন্ড রাগে অন্ধ হয়ে আবার লোহার রডটা দিয়ে আমাকে বাড়ি দেয়ার জন্য তুলতেই ঠেকানোর জন্য তৈরি হলাম আমি।

কিন্তু বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল তখন। হঠাৎ করে বাহিরের করিডোরের দিক থেকে বিশাল বিশাল দানবীয় একেকটা “গাছের শেকড়” কিংবা “লতা” এসে ঢুকল হল রূমের ভেতর! কিছু বোঝার আগেই প্রচন্ড জোরে শিস দেয়ার মত শব্দ ভেসে এল শেকড় গুলোর দিক থেকে! আমি হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বিরাট দানবীয় একটা গাছ প্রবেশ করছে হল রূমের ভেতর জীবন্ত প্রাণির মত! গাছ যে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আকারে রীতিমত চার তলা কোনো বিল্ডিং এর মত উঁচু! শেকড় গুলো মাটিতে বিছিয়ে রয়েছে। জীবন্ত প্রাণির মত নড়ছে। ডাল পালা, লতা পাতা গুলোও নড়ছে! পাতা গুলো সাপের মত দাঁতওয়ালা, খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে!

বিষ্ময়ে আমি আর প্রফেসর জমে গেছি। দুজনেই বুঝতে পারছি জিনিসটা কি! মাদাগাস্কারের মানুষ খেকো গাছের কথা বইয়ে পড়েছিলাম এতদিন। সেটা কোন প্রজাতির জানি না, তবে আমাদের সামনে দাঁড়ানো দানব গাছটা যে রাক্ষুসে খাদক গাছ – তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আকার আকৃতিতেই বোঝা যাচ্ছে অনেক বয়স গাছটার।

সঙ্গে সঙ্গে কত গুলো ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল। সেই রাতে লেকের পাড়ে আসলে দুটো গাছই দেখেছিলাম। এমনকি পরের দিন ক্যাথেড্রালের দোতলার বারান্দার ওপর ঝুলে থাকা গাছ সত্যিই দেখেছি – ওগুলো এই গাছটার বংশদ্ভূত ছোট গাছ। এটাই সম্ভবত ‘মা’ গাছ। সমস্ত সার্কেল ভ্যালিতে এ কারণেই পাখি দেখা যায় না, এদের ভয়ে পাখি আসে না। গত রাতের পাঁচটা খুনের জন্য এই দানব গাছটা যে দায়ী সেটা বলে দিতে হল না। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি আর প্রফেসর নারায়ণ গাঙ্গুলি। নড়তেও ভূলে গেছি যেন।

গাছটা ভেতরে ঢুকেই প্রফেসর আর আমাকে ধরার জন্য শূঁড় বাড়িয়ে দিল দ্রুত বেগে। আমি সতবিৎ ফিরে পেলাম হঠাৎ করেই, লাফিয়ে সরে গেলাম এক পাশে। কিন্তু প্রফেসর তখনো বিষ্ময়ের ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি, তাই সামলাতে পারলেন না। শূঁড়ের প্রচন্ড বাড়ি লেগে রীতিমত উড়ে গেলেন অনেক গুলো মূর্তির ওপর দিয়ে। কয়েকটা মূর্তিকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে বিশাল দেহ নিয়ে ধরাশায়ি হলেন। উঠার লক্ষণ দেখা গেল না। জ্ঞান হারিয়েছেন মনে হয়। চারপাশে ধূলার ঝড় উঠেছে।

গাছটার ক্ষিপ্রতা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। নয়তো আরো সতর্ক হতাম। হুট করে কোত্থেকে বিরাট একটা শেকড় এসে এত জোরে বাড়ি দিল যে আমি ফ্লোরে পিছলে দু তিনটা মূর্তির পায়ের ফাঁক দিয়ে সোজা সিঁড়ি ঘরের কাছে গিয়ে পড়লাম।

বিদ্যুতের বেগে গাছটা ঘুরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি দ্রুত চিন্তা করতে পারছি না কোনো কিছুই। এই দানব গাছটার চোখ নেই যে বুঝতে পারবে আমি কোথায় আছি। তবে আন্দাজ করতে পারছি খুব সম্ভব কম্পনের মাধ্যমে অনুভব করতে পারছে আমার অস্তিত্ব। গাছটা খুবই দ্রুত আমাকে খুঁজে বের করে ফেলল। বিশাল একটা শূঁড় বাড়িয়ে দিল আমাকে ধরার জন্য। আমি বুঝে গেছি এভাবে সম্ভব না। হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলার দিকে দৌড়াতে লাগলাম। পেছনে না তাকিয়ে পাগলের মত হাত পা দুটোই ব্যাবহার করে দোতলার করিডোরে উঠে এলাম। অন্ধকার, জেনারেটরের লাইন থাকলেও বাল্ভ গুলো জ্বলছে না। তবে খোলা করিডোর। বাহিরের বজ্রপাতের আলো আর বৃষ্টির পানি এসে পড়ছে করিডোরে। বিশাল করিডোর। বৃত্তাকার সার্কেল ভ্যালির সঙ্গে সঙ্গে করিডোরও গোল হয়ে ঘুরে গেছে যত দূর চোখ যায়। বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা পাগলের মত লাফাচ্ছে। হাফাতে হাফাতে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখলাম সিঁড়ি বেয়ে গাছটা উঠে আসছে! সব কিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে আসছে যেন! তীক্ষ্ণ শিসের মত শব্দ হচ্ছে। আমি আর দাঁড়ালাম না। ছুটতে শুরু করলাম করিডোর ধরে। দূরে পাহাড়ের ওপরে সার্চ লাইটের আলো ঘুরতে ঘুরতে যিশুর মূর্তি পার হয়ে দোতলার এই বারান্দায় এসে আবার চলে যাচ্ছে। রীতিমত ঝড় হচ্ছে! আমি ভূতে তাড়া খাওয়ার মত দৌড়াচ্ছি লম্বা, বৃত্তাকার করিডোর ধরে। তার মাঝ দিয়ে আরো ভয়ংকর দৃশ্য দেখলাম। সামনের সেই কাঁত হয়ে পরা বারান্দাটার ওখানে পিস্তল হাতে মাহিনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাকিব। হতভম্ব হয়ে গেছে দুজনেই। ওদের সামনেই বাঁকা বারান্দার রেলিং ধরে উঠে আসছে আরো একটা দানব বৃক্ষ! আমার পেছনের গাছটার মতই বড়! সেটার একটা শূঁড় থেকে ঝুলছে ড. তালেব! পেঁচিয়ে ধরেছে তাকে সেটা। তাস্বরে চেঁচাচ্ছেন!

বুঝে গেলাম দানব গাছ একটা না, আরো আছে! আমি দৌড়াতে দৌড়াতে ওদের দিকে যেতে যেতে চেঁচিয়ে বললাম, “রাকিব! মাহিনকে নিয়ে লেকের পানিতে জাম্প কর! এরা সংখ্যায় অনেক! পারা অসম্ভব!”

রাকিব পিস্তল তুলে দ্বিধান্বিত পায়ে আগু পিছু করতে লাগল। কারণ রেলিং-এর নিচ থেকেই গাছটা উঠে আসছে ওপরে।

আমার পেছনের গাছটাও প্রায় চলে এসেছে। আমি পাগলের মত মাহিনের দিকে ছুটছি। তার মাঝেই রাকিব বিশাল একটা শূঁড়ের বাড়ি খেয়ে উড়ে গিয়ে ক্যাথেড্রালের তিন তলার দেয়ালে বাড়ি খেল! ওখান থেকে লেকের পানিতে।

আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সার্চ লাইট আর বজ্রপাতের আলোয় বিশাল আরেকটা শূঁড় এসে আঘাত করতে যাচ্ছে মাহিনকে। আমার পেছনের গাছটাও শেকড় দিয়ে বাড়ি মারতে যাচ্ছে আমাকে। আমি শরীরের সব শক্তি দিয়ে দৌড়ে এসে মাহিনের কোমরে জড়িয়ে ধরে কয়েকটা শূঁড়ের গায়ে সিঁড়ির ধাপের মত পাড়া দিয়ে লাফিয়ে রেলিং হয়ে সোজা ঝড়ের মাঝে লেকের পানিতে ঝাপ দিলাম।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত যেন শূণ্যে ভেসে রইলাম প্রচন্ড ঝড়, দানব গাছের শিস আর সার্চ লাইটের বিক্ষিপ্ত আলোর মাঝে। পরক্ষণেই পানির ভেতর নিস্তব্ধ একটা জগতে ঢুকে গেলাম! নিচে হাজার হাজার মূর্তি। আমি মাহিনকে ধরে রেখেছিলাম। ওকে সামলাতে গিয়ে আমি একটা ডুবন্ত মূর্তির গায়ে বাড়ি খেলাম।

পানির নিচে থেকেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম ক্যাথেড্রালের দোতলার বারান্দাটা পুরোটা ভেঙ্গে ঠিক আমাদের ওপর পড়ছে! আমি মাহিনকে টান দিয়ে মূর্তি গুলোর নিচে নেমে এলাম। নিস্তব্ধ পানিতে ভয়ংকর একটা কম্পন তুলে বিশাল বারান্দাটা ভেঙ্গে পড়ল! ভাগ্যিস এখানে ঘন মূর্তি ছিল নিচে। এগুলো পিলারের মত আটকে দিল বারান্দাটাকে। আমি মাহিনকে নিয়ে দ্রুত ডুব সাঁতার দিয়ে বারান্দার ভাঙ্গা অংশটার নিচ থেকে বেরিয়ে এলাম। ডান হাত আর কাঁধ একেবারে অবশ হয়ে আছে। মাহিন প্রায় অজ্ঞান, ওকে ধরে রেখে ওপর দিকে উঠতে গিয়ে মনে হল ফুসফুস ফেটে যাবে। পায়ের জোর কমে আসছে দ্রুত। তবু পাগলের মত ওপরে ওঠার চেষ্টা করে যাচ্ছি……

ভুস করে পানির ওপর মাথা তুলতেই হা হয়ে শ্বাস নিরে লাগলাম। মাহিনকে ধরে রাখলাম, পাগলের মত দম নিচ্ছে ও। পেছনে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম আমাদের খুব কাছেই গার্ডদের একটা নৌকা। রাকিবের গলা শোনা গেল। চেঁচিয়ে ডাকছে, “রবি? মাহিন? তোরা এখানে আছিস?”

আমি হাত তুলে দূর্বল গলায় ডাক দিতেই নৌকাটা থেকে কয়েকটা টর্চের আলো এসে পড়ল আমাদের ওপর। এগিয়ে আসতে লাগল নৌকাটা। টেনে তুলল আমাদের। ডান হাতটায় এতক্ষণে একটু সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। একটু নাড়াতে পারছি। একেবারে অকেজো হয়ে যাইনি বোঝা গেল। চারজন গার্ড রয়েছে নৌকায়, সঙ্গে রাকিবের কুকুরটাও। মৃদু ঘউ ঘউ করল আমাদের দেখে। রাকিবের দিকে তাকালাম। পুরো ভিজে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল, “যাক, বেঁচে আছিস তাহলে!”

“দাঁত না দেখিয়ে পালানোর ব্যবস্থা কর গাধা! এই দানব গাছ গুলো সব ধ্বংস করে ফেলবে আজকে! পেছনে তাকিয়ে দ্যাখ, যিশুর মূর্তিটার গায়ে তিনটা উঠেছে। ভেঙ্গে ফেললে নিচ থেকে পানি উঠে সব ডুবে যাবে।”

বলেও সারল না! বিশাল ক্রুশ বিদ্ধ খ্রিষ্টের মূর্তিটা দু হাত দুপাশে ছড়িয়ে সোজা সামনের দিকে হেলে পড়তে লাগল! দানব গাছ গুলো শূঁড় আর শেকড় দিয়ে টেনে ভেঙ্গে ফেলছে ওটা……..

বিশাল খ্রিষ্টের মূর্তিটা পানিতে রীতিমত পাহাড়ের মত ঢেউ তৈরি করল লেক জুড়ে। ঢেউয়ের চোটে এই নৌকাটা যেন খড় খূটোর মত উড়ে যাবে! মাহিন ভয় পেয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কথা বলতে পারছে না।

লেকের চারপাশের তীর জুড়ে হাজার হাজার খুদে দানব গাছ এগিয়ে এসেছে। যিশুর মূর্তির নিচ থেকে ফোয়ারার মত প্রচন্ড স্রোতে পানি ওঠা শুরু করেছে। অন্য দিকে ক্যাথেড্রালটা তুমুল আক্রোশে ভেঙ্গে ফেলা শুরু করেছে গাছ গুলো! প্রথমে খেয়াল করিনি। সার্চ লাইটের আলো আমাদের নৌকার পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম একটা মাঝারি দানব গাছ পানি সাঁতরে আমাদের নৌকার একেবারে কাছে চলে এসেছে! রাকিবের কুকুরটা সেদিকে তাকিয়ে পাগলের মত ঘৌ ঘৌ শুরু করল। লম্বা একটা ডাল শূঁড়ের মত করে বাড়িয়ে দিয়েছে নৌকাটা ধরার জন্য। কথা বলার সময় নেই, অন্যরা খেয়াল করল কিনা বোঝার উপায় নেই। আমি পাশের গার্ডের হাত থেকে রাইফেলটা টেনে নিয়ে সোজা ফায়ার করলাম ডালটার দিকে। মাহিন ভয়ে দু হাতে কান চেপে ধরল। সার্চ লাইটের আলোয় অবাক হয়ে দেখলাম ডালটা যে যে জায়গায় গুলি লেগেছে সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হবার মত সবুজ তরল পদার্থ বের হচ্ছে! সেই সঙ্গে তীক্ষ্ণ শিসের মত শব্দ। মগজ ফুড়ে যাচ্ছে শব্দের চোটে। অবাক হবার বেশি সময় পেলাম না – অন্য দিক থেকে আরো দুটো শূঁড় বাড়িয়ে দিয়েছে গাছটা। রাকিব বৈঠা তুলে বাড়ি মারল একটা শূঁড়কে। কিন্তু অন্য শূঁড়টা একটা গার্ডের গলা পেঁচিয়ে ধরল! শূণ্যে তুলে ফেলল নৌকার পাটাতন থেকে। তাস্বরে চেঁচাচ্ছে লোকটা ভয়ংকর আতংকে। আমি উপায় না দেখে গুলি করতে লাগলাম শূঁড়টা লক্ষ করে। লাভ হল না, লোকটাকে রীতিমত খেলনা পুতুলের মত তুলে ছুড়ে মারলো লেকের মধ্যের অন্য গাছ গুলোর দিকে। বজ্রপাত, ঘুরতে থাকা সার্চ লাইট আর বৃষ্টির মাঝ দিয়ে লোকটাকে উড়ে যেতে দেখলাম যিশুর মূর্তির ফোয়ারাটার দিকে! হারিয়ে গেল প্রবল স্রোতের মাঝে।

সেদিকে তাকিয়ে থাকার সময় নেই। রাইফেল তুলে পাগলের মত ফায়ার শুরু করলাম গাছটাকে – যাতে নৌকাটা ছেড়ে দূরে সরে যায়। আমার দেখা দেখি বাকিরাও তাই শুরু করল। ফায়ারিং এর প্রচন্ড শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে।  গুলি করে আটকে রাখা যাবে – কিন্তু কতক্ষণ?

টানা গুলি করতে করতে রাকিবের দিকে তাকিয়ে আমি জরুরী কন্ঠে বললাম, “প্রচুর তেল আর বারুদ লাগবে। আগুণ ছাড়া এসবের হাত থেকে আজ বাঁচা যাবে না! ফায়ারিং করে অযথাই বুলেট নষ্ট করছি।”

রাকিব অবাক হয়ে বলল, “ক্যাম্পের পাশেই তো তেলের ড্রাম গুলো!” হাত তুলে দেখালো আমাকে। জেনারেটরের জন্য এত তেল আনা হয়েছিল। আমি বললাম, “লোক দিয়ে মশাল বানা। আগুণ লাগিয়ে তীর থেকে গাছ গুলোকে সরিয়ে ড্রাম গুলো পার করে জঙ্গলে চলে যেতে হবে। যাওয়ার সময় ড্রামে আগুণ ধরিয়ে লেকে ছেড়ে দিবি।”

দ্রুত কথা মত কাজ করা হল। নৌকায় বসেই শার্ট দিয়ে মশাল করে আগুণ জ্বালালো গার্ডরা। তীরের কাছে যেতেই দেখা গেল আগুণ ভয় পাচ্ছে গাছ গুলো। দূরে সরে যাচ্ছে আগুণ দেখলেই। আগুণ দেখিয়ে আমরা ড্রাম গুলোর অন্য পাশে চলে এলাম। একটা ছোট ড্রাম রেখে বাকি গুলো চারপাশে তেল ঢেলে লেকের দিকে গড়িয়ে দিলাম। পালাতে লাগলাম আমরা। পানি বেড়ে গিয়ে ক্যাথেড্রাল ডুবতে শুরু করেছে! পালানোর সময় রাকিব পিস্তল দিয়ে ফায়ার করল লেকের দিকে। সাথে সাথে লেকের তীর, লেকের পানিতে দাউ দাউ করে আগুণ জ্বলে উঠল। লেকের দানব গাছ গুলো উঠে আসতে পারল না। আগুণ লেগে গেল পানিতে থাকা গাছ গুলোর ডালপালায়। তীরের গাছ গুলো আগুণ দেখে ভয়ে পালাতে লাগল একেক দিক। মোট কথা – ছত্র ভঙ্গ হয়ে গেল পুরো দানব বৃক্ষ দলটা।

ঝড়ের মাঝে পালাচ্ছি যখন জঙ্গল দিয়ে, তখন সার্কেল ভ্যালির ক্যাথেড্রালটা পানির নিচ তলিয়ে গেছে। মাহিন জ্ঞান হারিয়েছে। বৃষ্টির মাঝে ওকে কোলে করে নিয়ে পাহাড় বাইতে হচ্ছে আমাকে। মশালের আলোয় দেখতে পাচ্ছি নিষ্পাপ মুখটায় অদ্ভূত একটা প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে…….

“মাঝরাতে টের পেলি কি করে আমি আর মাহিন কোথায় আছি?” বরফের ব্যাগটা মাথার বামপাশে চেপে ধরে বললাম। বসে আছি রাকিবদের গেষ্ট রূমের বিছানায়। ইভা বসে আছে একটা সোফায়। মাহিন শুয়ে রয়েছে আমার পাশে। একটু আগে জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার এসেছিল। মাহিনের কপালের একপাশে দুটো স্টিচ পরেছে। বেশি কিছু হয়নি দেখে ওকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য চাপ দেননি ডাক্তার। তবে বলেছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা এক্স-রে করিয়ে নিতে, সাথে ভাল করে একবার চেক আপ। গত রাতের ঘটনার কারণে পেটের বাচ্চার ওপর কোনো ইফেক্ট পরেছে কিনা দেখা দরকার। আমার অবশ্য তেমন কিছু হয়নি। সেলাই করতে দেইনি আমার মাথা। ব্যান্ডেজ করে নিয়েছি। সেলাই জিনিসটা কেন জানি সহ্য করতে পারি না। বেশি ফাটেনি, তাই ডাক্তারও জোর করেনি।

ঘরের ভেতর লেজ দুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাকিবের কুকুরটা। সেদিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল রাকিব, “এটার জন্য। রাতে তোদের নৌকায় তুলে নিয়ে যেতে দেখেছিল বোধ হয়। ছুটে এসে আমার শার্ট ধরে টানাটানি শুরু করল তাবুর ভেতর। বুঝে গেলাম কিছু একটা হয়েছে। দেরি না করে কুকুরটার পিছু পিছু বেরিয়ে এলাম। তোদের তাবুতে নিয়ে গেল আমাকে। গিয়ে চারপাশের হূল স্থূল অবস্থা দেখেই বুঝে গেলাম কি ঘটেছে। ক্যাথেড্রালের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইল যেন কুকুরটা। আন্দাজ করলাম তোরা ওখানেই আছিস। বিশ্বস্ত কয়েকজন গার্ড নিয়ে নৌকায় করে রওনা দিলাম। সব গার্ডকে আসলে হাত করতে পারেনি প্রফেসর। দশ বারো জনকে টাকা খাইয়ে হাত করেছিল।”

আমি অবাক চোখে কুকুরটার দিকে তাকালাম। কুকুরটা বোধ হয় বুঝতে পারল তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। পেছনের পা ভাজ করে বসে পড়ল, জিহ্বা বের করে তাকাতে লাগল আমাদের দিকে।

মাহিন দূর্বল গলায় বলল, “ভাগ্যিস আপনি এসেছিলেন। ড. তালেব তো আরেকটু হলে আমার মাথায় গুলি করে দোতলার একটা টানেল দিয়ে ডানজনের নদীতে ফেলে দিত।”

“আমাকে বলে লাভ নেই। নিচ থেকে দানব গাছটা না উঠলে বাঁচাতে পারতাম না আপনাকে। ওটাকে দেখেই তো ড. তালেব হকচকিয়ে গেল। কিছু বোঝার আগেই লতা পাতা দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলেছিল।” রাকিব গম্ভীর গলায় বলল।

আমি কুকুরটার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বললাম, “প্রোফেসর নারায়ণ আর ড. তালেব বেঁচে আছে কিনা…….”

“থাকলে তো ভালই। সার্চ পার্টি নিয়ে যাবো। খুঁজে বের করা দরকার কালপ্রিট দুটোকে।” কঠিন মুখে বলল রাকিব।

“ওখানে তো এখন সমুদ্র। পাবি নাকি? তার ওপর ওসব গাছ।”

“গাছ গুলো দিনের বেলায় বের হয় না। চুপচাপ থাকে। তখন গিয়ে খুঁজতে হবে। দুজন মানুষ গায়েব হয়ে যাবে এটা তো সম্ভব না। তাছাড়া আমাদের নিজেরদের কিছু গার্ডও পানিতে পড়ে গিয়েছিল, ওদেরকেও খোঁজা দরকার।”

মাহিন আস্তে আস্তে বলল, “অঞ্জন মিত্তিরের ক্যাথেড্রালের প্রহরী কি তাহলে এই দানব গাছ গুলোই?”

আমি মাথায় ব্যাগটা চেপে ধরে ঠান্ডা গলায় বললাম, “আইডি কার্ড দেখার সুযোগ পাইনি। তবে হাব ভাবে সেরকমই তো মনে হল। অঞ্জন মিত্তিরের কবর ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথেড্রালে কেয়ামত শুরু হয়ে গেল।”

“প্রহরী-ই যদি হবে, ভাঙ্গল কেন সব?” ইভা অবাক মুখে বলল।

“বোধ হয় অঞ্জনকে ভালবাসত গাছ গুলো। ওর কবরটা নষ্ট হয়ে যেতে দেখে গাছ গুলো ভেবেছিল ক্যাথেড্রালের আর প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া তো কোনো যুক্তি মাথায় আসছে না।” আমি বললাম।

মাহিন বাধা দিয়ে বলল, “কিন্তু ওটা তো আসল কবর না। নকল।”

“হয়ত গাছ গুলোর কাছে ওটাই আসল কবর ছিল। দুইশো বছর আগের কথা – সব জানবো কি করে। তাহলে তো প্রশ্ন করতেই পারো হারাধনের কবর হল কেন? সে তো হিন্দু ছিল। শুধু সে-ই না, শ্রমিকরাও প্রায় সবাই হিন্দু ছিল। খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল নাকি? ইস্কান্দর মির্জা তো মুসলিম ছিল- ক্যাথেড্রাল বানানোতে সে সাহায্য করল কেন যখন ঐ সময়ে মুসলমান-খ্রিষ্টানে দ্বন্দ্ব বিদ্বেষ চলছিল? শিল্পীরা শখটাকে বড় করে দেখে মানলাম- তার পরেও ক্যাথেড্রালের মত বিশাল ধর্মিয় উপাসনালয় বানাতে হেল্প করবেন বন্ধুকে?” একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, “সব প্রশ্নের জবাব মেলা কঠিন। দশ বছর আগের জিনিসেরই ঠিক মত হদিস মেলে না, এখানে তো দুইশো বছরের ব্যাপার।” বরফের ব্যাগটা মাথায় চেপে ধরে বিছানায় বালিস দাঁড় করিয়ে হেলান দিলাম। “তবে ক্যাথেড্রালটা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। পানি কমাবার ব্যবস্থা করলে অঞ্জন মিত্তিরের কাজ গুলো উদ্ধার করা যাবে। পৃথিবীর ২য় এঞ্জেলোর কাজ গুলো সংরক্ষণ করা দরকার। কয়েক শতাব্দীতেও এরকম প্রতিভাধর শিল্পী জন্মায় না।”

আমি থামার পর কয়েক মুহূর্ত নীরবতা বিরাজ করল রূমে। কেবল ফ্যানের শব্দ।

“আচ্ছা এত বড় বড় গাছ গুলো থাকতো কোথায়?” মাহিন প্রশ্ন করল হঠাৎ।

“আর কোথায়? ডানজনে। ওখানে অন্ধকারের মাঝে ওগুলো মিশে গিয়েছিল। বোঝার উপায় ছিল না। কেবল শিসের মত শব্দ শুনে বোঝা যেত ওখানে কিছু আছে।” ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললাম। “বাংলাদেশের উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন প্রজাতির গাছ পাওয়া গেল। সাড়া পড়ে যাবে চারদিকে।”

রাকিব উঠে দাঁড়াল, “তোরা রেষ্ট কর। সারা রাত অনেক ধকল গেছে তোদের ওপর দিয়ে।”

ইভাও উঠে পরল। বাবার সঙ্গে বেরিয়ে গেল। কুকুরটাও।

মাহিন দূর্বল গলায় বলল, “স্যরি রবি।”

“কেন?” অবাক হয়ে তাকালাম।

হাসল ক্লান্ত ভাবে, “তোমার নিষেধ না শুনে ওসবে গিয়েছি দেখে। না গেলে এসব হত না। আরেকটু হলে তো মরেই গিয়েছিলাম।”

আমি কিছু বললাম না। কেবল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে। অব্য হয়ে গেছে শরীরটা………

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাহিরে অনেক বৃষ্টি। তার মাঝ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছি আমি। পাশে মাহিন। ঢাকা ফিরছি। উন্ডশীল্ডের ওয়াইপার দুটো এক নাগাড়ে এপাশ ওপাশ করে যাচ্ছে। ইঞ্জিন আর বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। গম্ভীর মুখে গাড়ি চালাচ্ছি আমি।

“মুখটাকে এরকম হাড়ির মত করে রেখেছো কেন?” অনু্যোগের সুরে বলল মাহিন, “ক্যাথেড্রালের ঘটনার পর থেকে একদম থম মেরে আছো। বলেছি তো স্যরি…… তোমার কথার বাহিরে আর কখনো এক পা যাবো না।”

আমি গাড়ি চালাচ্ছি। জবাব দিলাম না। রাস্তার দিকে চোখ।

“এই? কি হল? কথা বলো?” মাহিনের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে এল।

আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ওর দিকে তাকালাম, “মা হতে যাচ্ছো তুমি, বাচ্চার প্রতি একটু হলেও কেয়ারফুল হও।”

মুখ কালো করে ফেলল, “স্যরি বলেছি তো!”

হাসলাম হঠাৎ, মায়া লাগছে বেচারির জন্য। একটু বেশিই রাগ দেখিয়ে ফেলেছি মনে হল। মৃদু স্বরে বললাম, “কলম্বাসের আম্মার কান কামড়ানো মিস করছি খুব!”

যেটা ঘটল সেটা একেবারেই আশা করিনি। মাহিন সোজা দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল! আরেকটু হলে গাড়ি নামিয়ে দিয়েছিলাম রাস্তার বাহিরে! তাড়াতাড়ি ব্রেক চেপে থামিয়ে দিলাম। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি আর বজ্রপাত। আমি আস্তে আস্তে মাহিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। কান্নার দমকে কেঁপে উঠছে বার বার। আমি ফিসফিস করে বললাম, “লাভ ইউ মাহি…..”

অনুভব করলাম মাহিন আমার কানে মুখ ঘষছে পাগলের মত, “আই লাভ ইউ টু রবি…. অ্যাম সো স্যরি। আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবো না।”

“মনে থাকে যেন! কলম্বাস একা হলে ঠিক আছে। কিন্তু কলম্বাস সহ ওর মাকে নিয়ে পাহাড় বাওয়া মুখের কথা? হাতি টেনে তুলেছি মনে হচ্ছিল তখন…..” কথা শেষ করতে পারলাম না। মাঝ পথেই থেমে যেতে হল।

ওর ঘন নিঃশ্বাস আর কান্না ভেজা চোখের পাপড়ি লাগছে মুখে…..

“অসভ্য কোথাকার! লাবু কলম্বাসের আব্বু!”

“মি……..” শেষ করা গেল না!

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!