সন্ধ্যার সময় ক্যাম্প ফায়ারের আলোতে বসে লেকের তীরে কথা বলছি সবাই। প্রফেসর নারায়ণ গাঙ্গুলিই বেশি কথা বলছেন। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাহিনও। ড. আবু তালেব ঝিম মেরে বসে আছেন। রাকিব এসেছে। ইভার জ্বর কমেছে দেখে চলে এসেছে। খুনের ঘটনার পর আসতে পারেনি। একটু আগে এলো। সঙ্গে কুকুরটাও। আমি সেই ছবির খাতাটা উল্টে দেখছি এখন ক্যাম্প ফায়ারের আলোয়।
“তার মানে কোম্পানির লোকদের শিকার হয়েছিল?” মাহিন বলল। খাতা থেকে মুখ তুলে তাকালাম। এলো মেলো কথা বলছে দেখে বুঝতে পারছি না ঠিক মত। মৃদু কাঁশলাম, “আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু গুছিয়ে বলবেন স্যার?”
প্রফেসর সাহেব ওপাশ থেকে উঠে এসে আমার পাশে বসলেন। চোখে চশমাটা ভাল করে লাগালেন, “মেজর সাহেব, তুমি শুরু থেকে পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকো। সবধানে, ভেঙ্গে যায় না যেন। আমি পুরো কাহিনী বলে যাচ্ছি।”
রাকিব উৎসাহি মুখে এগিয়ে এল দেখার জন্য। মাহিনও গলা বাড়িয়ে দিল।
প্রথম পৃষ্ঠায় চেয়ারে বসে থাকা অঞ্জন মিত্তিরের ছবি। সেটা আগে থেকেই জানা ছিল। তাই দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় গেলাম। তেল রঙ্গে এঁকেছেন। দেখা যাচ্ছে কোনো প্রাসাদের মাঝে বিয়ে করে নতুন বৌ নিয়ে এসেছেন বিহারী কোনো রাজা। বধূ বরণের অনুষ্ঠান হচ্ছে। প্রফেসর বলা শুরু করলেন এবার, “অঞ্জন মিত্তিরের নাম শুনেই বুঝতে পারছ লোকটা বাঙালী ছিল। কিন্তু বড় হয়েছে বিহারে। ছবির নিচেই নাম দেয়া আছে। বধূ বরণঃ রাজা হরিচন্দ্র জ্ঞাননাথের দ্বিতীয় বধূবরণ- শ্যামা মিত্তির। বিহারের সে সময়ের রাজা বাংলার নবাব সিরাজের অনুগত ছিল। সম্ভবত বশ্যতা স্বীকার হিসেবেই বাঙালী মেয়েকে বিয়ে করেছিল। মেয়েটার নাম শ্যামা মিত্তির।”
পৃষ্ঠা ওল্টালাম। ছোট একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে বিছানায় বসে আছে শ্যামা।
“এখানে শ্যামা মিত্তিরের নতুন ছেলে হয়েছে দেখাচ্ছে। খুব সম্ভব এই ছেলেটাই অঞ্জন মিত্তির। বাবার দিকের পদবী না নিয়ে মায়ের পরদবী লাগিয়েছে নামের শেষে। ঠিক কেন সেটা পরিষ্কার না।”
পরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে ছেলেটা তিন চার বছরের। গাছে থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। সবাই উদ্বিগ্ন মুখে ঘিরে আছে তাকে।
“সম্ভবত গাছ থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত লেগেছিল। হরমনের ব্যাপারটা সম্পর্কে কম জানি। গ্রোথ হরমন হয়ত আর হয়নি। যার কারণে বামন আকৃতির থেকে যায় অঞ্জন মিত্তির।”
পৃষ্ঠা উল্টে যাচ্ছি ক্রমাগত। প্রফেসর নারায়ণ গাঙ্গুলি একে একে বলে যাচ্ছেন কোথায় কোথায় কি হয়েছে। ছবি গুলোর দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে আমি নিজেও সেই সময়ে চলে গেছি। এতই জীবন্ত।
প্রফেসর নারায়ণ গাঙ্গুলি ঘোরের বশে বলে চলেছেন কথা গুলো, –
“অঞ্জন মিত্তির কিশোর বয়স থেকে ছবি আঁকা আর মূর্তি বানানো শুরু করে শখের বশে। দ্রুত ওর ছবি আঁকার প্রতিভা আর মূর্তি গড়ার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। বামন দশার জন্য লোকগন তাকে এড়িয়ে চলত একটু। সেটা নিয়ে সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকত। ব্যাপারটা লক্ষ করে তার বাবা হরিচন্দ্র তাকে অনেক দূরে ছবি আঁকা শেখার জন্য পাঠিয়ে দেন। ত্রিলোকেশ্বর বিদ্যা নিকেতন নাম একটা স্কুলে পড়াশোনার শুরু। ওখানেই বন্ধু জুটে যায় চারজন। চিত্বরঞ্জন সাহা, ইসকান্দর মির্জা, রতন ঠাকুর, হারাধন প্রসাদ নামের চার বন্ধু পায় সেখানে। মূর্তি বানানো আর ছবি আঁকায় ওরাও খুব ঝানু ছিল। কিন্তু অঞ্জনের মত কেউ এত নিঁখুত জিনিস তৈরি করতে পারতো না। সারাদিন মূর্তি বানানো আর রাতে তাস খেলা ছাড়া আর কোনো কাজ করত না কেউ। পড়াশোনাতেও ভীষণ অমনোযোগি ছিল সবাই।
বয়স যখন প্রায় ষোল সতেরোর দিকে অঞ্জনের- তখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারত বর্ষ গ্রাস করেছে। বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিমের পরাজয়েরও অনেক পরের কথা, ততদিনে ভারত বর্ষ ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রনে চলে এসেছে সিংহ ভাগ। রাজারা সব পথের ভিখারিতে পরিণত হচ্ছে বশ্যতা স্বীকার না করলে। ছবিতেই দেখা যাচ্ছে রাজা হরিচন্দ্রের রাজ্য দখল করে ফেলেছে কোম্পানীর লোক।
বাবার বিপদের কথা শুনে ছুটে আসে অঞ্জন। কিন্তু রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য বিচিত্র এক শ্বর্ত জুড়ে দেয় কোম্পানীর লেলিয়ে দেয়া পাদ্রীরা। শ্বর্ত হল খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে হবে তাকে। তাহলে আবার সব ফিরিয়ে দেয়া হবে। ব্যাপারটা প্রকাশ্যে নয়, গোপণে তাকে পাদ্রীরা এই কথাটা বলে। অঞ্জন উপায় না দেখে রাজ্য বাঁচাতে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। শুরু হয় মাইকেল অঞ্জন মিত্তিরের দ্বিতীয় জীবন।
দ্বিতীয় জীবনটা খুব একটা সুখের ছিল না। ধর্মান্তরিত হয়ার কারণে বাবা হরিচন্দ্র তাকে ত্যাজ্য করে চলে যান। মা শ্যামা মিত্তিরও মুখ ফিরিয়ে নেন। অঞ্জন ভেঙ্গে পড়ে দ্রুত। বন্ধুর বিপদ দেখে এ সময় এগিয়ে আসে তার চার বন্ধু।
অঞ্জন তার চার বন্ধুকে নিয়ে সমুদ্র যাত্রা করে ইটালীর ভ্যাটিকেন সিটির উদ্দেশ্যে। ইচ্ছা ছিল পোপকে গিয়ে ব্যাপারটা সম্পর্কে জানানো- ধর্মের অপব্যবহার চালাচ্ছে কোম্পানী।
কিন্তু ভ্যাটিকেনে পৌছে মনোভাব বদলে যেতে শুরু করে অঞ্জনের। ক্রমশ আকৃষ্ট হয়ে পরতে থাকে নতুন গ্রহণ করা ধর্মের প্রতি। কিন্তু দূর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়েনি। তৎকালীন পোপ চতুর্দশ ক্লেমেহটের শাসনামল তখন। ভ্যাটিকেনের সেবক রূপে কাজ নিলেও দারুণ অবহেলায় শিকার হন অঞ্জন মিত্তির। ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন ধর্ম খারাপ নয়- ধর্মের ধ্বজাধারীরাই যত খারাপের মূল। সত্যটা উপলব্ধি করতে গিয়ে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছিল তাকে। ভ্যাটিকেনের ক্যাথেড্রালে তাকে সেবক হিসেবে নেয়া হয়নি। বামন দশা আর উপমহাদেশ থেকে আসা গেঁয়ো ভূত বলে বার বার উপেক্ষিত হন অঞ্জন মিত্তির।
এর মাঝেই ভ্যাটিকেন ক্যাথেড্রালের এঞ্জেলো কৃর্তিগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। লাইব্রেরীতে ঘাটা ঘাটি করে মাইকেল এঞ্জেলোর জীবন কাহিনী খুঁজে বের করেন। অদ্ভুত মিল খুঁজে পান দুজনের জীবনে। পোপদের ক্রমাগত অত্যাচারে চোখের দৃষ্টি হারিয়েছিলেন এঞ্জেলো। আর এখনে এখনকার অ্যাডমিনিষ্ট্রেশনের অবহেলার শিকার তিনি। প্রতিভার মূল্য দিচ্ছে না কেউ। নিজে গিয়ে পোপকে অনুরোধ করেছিলেন খ্রিষ্টের মূর্তি বানাতে পারবেন ভ্যাটিকেন চত্বরে। কিন্তু পাত্তা দেননি পোপ। তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। একজন বামন কি করে খ্রিষ্টের মূর্তি বানাবে – এরকম কথা বলেছিলেন। হতাশ হয়ে পরেন অঞ্জন মিত্তির। ভ্যাটিকেনে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পরে পাদ্রী আর শিক্ষা নবিশদের অত্যাচারে। বামন বামন বলে ক্ষেপিয়ে দেয় তাকে।
ভ্যাটিকেনের সেই দুঃসময়ে তার চার বন্ধু পাশে ছিলেন। তাই অঞ্জন তার এই চার বন্ধুকে তাসের চার কার্ডের নামে ডাকতো। চিত্বরঞ্জনকে চিরতন, হারাধনকে হরতন, রতনকে রুইতন, আর ইসকান্দর মির্জাকে ইস্কাবন। ভ্যাটিকেন থেকে হতাশ হয়ে চলে আসেন অঞ্জন। কিন্তু জেদ চেপে গেল মনে। দেশে ফিরে সমস্ত রাজ্য, জমিজমা বিক্রি করে চার বন্ধুকে নিয়ে চলে আসেন বাংলাদেশের পাহাড়ি একটা অঞ্চলে। জন মানবহীন এই পাহাড়ি এলাকার পাদদেশে দুইশো বারো জন শ্রমিক এনে কাজ শুরু করেন এক বিশাল ক্যাথেড্রালের। সাহায্য করেন চার বন্ধু। কাজ শুরু হয় ১৭৮০ সাল থেকে। পৃথিবীর সব চেয়ে বড় ক্যাথেড্রালটা তৈরি করতে লেগে যায় পঞ্চাশ বছরের মত সময়! ১৮৩০ সালে ক্যাথেড্রালের নির্মান কাজ শেষ হয়। সাওমনের বিশাল চত্বরে যিশুর ক্রুশ বিদ্ধ মূর্তি তৈরি করেন পাঁচ বন্ধু মিলে। যদিও ক্যাথেড্রালের কাজ সমাপ্ত হবার আগেই তার দুই বন্ধু মারা যান। ইসকান্দর মির্জা এবং হারাধন প্রসাদ। তাদের কবর দেয়া হয় মূল ক্যাথেড্রালের নিচে একটা সমাধী কক্ষে। এবং কবরের ওপর তাদের আসল নামের বদলে ইতিহাস বিখ্যাত কিং ডেভিড ও আলেকজান্ডারের নাম দেন। কারণ তাসের স্পেড বা ইসকাবন এবং হার্ট বা হরতন এই রাজাদের নামে এসেছিল। অঞ্জন মিত্তির তার বন্ধুদের ইতিহাস খ্যাত সম্রাটদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে করতেন না।
কিন্তু ক্যাথেড্রাল তৈরির কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে এখানকার শ্রমিকদের মাঝে কালাজ্বর মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরে। দেখতে দেখতে সবাই মারা যায়। তার দুই বাকি বন্ধুও মারা যান। একা হয়ে পরেন অঞ্জন মিত্তির। প্রতিদিন সকালে পোপদের ম পোশাক পরে ক্যাথেড্রালের বারান্দায় গিয়ে চত্বরের হাজার হাজার মূর্তির উদ্দেশ্যে পাগলের মত ভাষণ দিতেন। চিৎকার করে ক্যাথেড্রালের মূর্তিগুলোকে বলতেন, “আমি তোমাদের অনেক ভালবাসি। এ জন্য নয় যে তোমাদের আমি সৃষ্টি করেছি- এজন্য যে আমার নিঃসঙ্গতায় এখনো তোমরা আমাকে ছেড়ে যাওনি। তাই, এই ক্যাথেড্রালের প্রহরী তোমাদের যুগ যুগ আগলে রাখবে বলে গেলাম আমি। আমি – দ্বিতীয় মাইকেল এঞ্জেলো! এই ক্যাথেড্রালের একজন সেবক……..” থামলেন প্রফেসর নারায়ণ। দম নিলেন। আমি বাকি পৃষ্ঠা গুলো ওল্টাতে থাকলাম।
এর পরের ঘটনা একটু অদ্ভূত এবং সংক্ষিপ্ত। ছবিগুলো নিয়ে প্রফেসর নিজেও দ্বিধান্বিত। কারণ দেখা যাচ্ছে অঞ্জন মিত্তির যিশুর বিশাল মূর্তিটার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে শাবল হাতে কিছু একটা খুঁড়ছেন। আরেকটা ছবিতে দেখা যাছে ক্যাথেড্রালের ডানজনে মশাল হাতে একা একা হাটছেন আর কত গুলো শূঁড়ের মত জিনিস তাকে অনুসরণ করছে…… অস্পষ্ট ছবিটা। বোঝা গেল না।
খাতাটার শেষের পৃষ্ঠা গুলো খালি। এক জায়গায় কয়েকটা লাইন লেখা। খুব কঠিন ধরণের সে সময়ের বাংলা। সহজ করে অর্থ করলে এরকম দাঁড়ায়ঃ-
“আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে পারলাম না, আমি অসহায়। আমাকে তোমাদের কেন্দ্রে স্থান দিও। ঈশ্বরের পায়েই বাকি ঘুমটা ঘুমাতে চাই।”
একদম শেষ পৃষ্ঠায় একটা ছড়া লেখা- লেখাটা খুব একটা প্রাচীন ছন্দে লেখা না-
“রইবে কিছু তাপান্তরি প্রশ্ন গাঁথা ছল,
মোর সমাধী ভাঙ্গলে কেহ-
নামবে প্রাচীন ঝড়-বাদল।
সব বাঁধিয়া রাখছে যারা,
সব দুয়ারে সুর-তালে;
সব হাহাকার প্রলয় শিখায়
নিত্য নাচায় দিকপালে।
চার মহাজন দুই পাশে মোর,
মদ্যি খানে এক পাখি,
বামন রাজার রং তুলিতে
এক মহাকাল ঠাই রাখি…..”
আমি বিড়বিড় করে বললাম, “ছড়াটার ভাষা কেমন যেন আধুনিক আধুনিক লাগছেন না?”
মাহিন সামান্য দ্বিধান্বিত গলায় বলল, “আঠারোশোর দিকে বাংলা লেখ্য ভাষাটা একটু অন্যরকম ছিল। চলিত তখনো আসেনি। কিন্তু অঞ্জন মিত্তিরের লেখা দেখে সেরকম লাগছে না। মনে হচ্ছে তিনি সে সময়েই লেখা লেখির নতুন প্যাটার্ন বের করেছিলেন। অনেকটা কথ্য কথ্য টাইপের। কট্টর সংষ্কৃত মেশানো বাংলা না, বেশ সহজ সরল বাংলা। লোকটা যে একটা বিষ্ময় ছিল- তাতে কোনো সন্দেহ নেই!”
খাতাটা বন্ধ করে মাহিনের দিকে তাকালাম, “বুঝতে পারছো আসল কবরটা কোথায়?”
মাথা ঝাঁকাল মাহিন। ক্যাম্প ফায়ারের আগুণের ওপর দিয়ে ওর দৃষ্টি চলে গেল লেকের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা খ্রিষ্টের বিশাল মূর্তিটার দিকে, ফিসফিস করে বলল ও, “খ্রীষ্টের মূর্তির পায়ের কাছে অঞ্জন মিত্তিরের আসল কবর! কিন্তু ক্যাথেড্রাল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সময় তো পানি উঠেছিল। মূর্তির পায়ের কাছে কবর দিলো কে?”
আমি হাসলাম, “সহজ। ডানজনের নিচের নদীটার পানি মূর্তিটার পায়ের নিচ দিয়ে ফোয়ারার মত বের হত। উনি আগে এখানে কবর খুঁড়ে ওপরটা সীল করে দিয়েছিলেন। আর নিচের অংশটা পাতাল নদীতে নামিয়ে দিয়েছিলেন ভাল করে খুঁড়ে। ফলে ডানজনে গিয়ে কিছু ভাসিয়ে দিলে সেটা গিয়ে সোজা উঠে আসত যিশুর মূর্তির পায়ের কাছে। পানি ঠেলে এনে দিবে। মৃত্যুর আগে অঞ্জন মিত্তির ডানজনের পাতাল নদীতে গিয়ে ডুব দিয়েছিলেন। লাশটা ভেসে ভেসে যিশুর মূর্তির নিচে এসে আটকে গিয়েছিল। সহজ ভাবে নিজের অন্তিম সৎকার। কিংবা আত্মহত্যা।”
দীর্ঘ একটা সময় ধরে নীরব রইল সবাই। চাপা একটা শিসের মত শব্দ ভেসে আসছে কোথাও থেকে।
“মোর সমাধী ভাঙ্গলে কেহ- নামবে প্রাচীন ঝড়-বাদল….. মানে কি এটার? সমাধী তো ভাঙ্গা হয়েছে- আবার হয়নি- দুটোই। ভূল সমাধী ভাঙ্গা হয়েছে।” জিজ্ঞেস করলাম হঠাৎ।
মাহিন জবাব দিতে পারল না। অখন্ড নীরবতা।
প্রফেসর নারায়ণ গাঙ্গুলি বিড়বিড় করে বললেন, “পৃথিবী নতুন একটা ধাক্কা খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে! প্রফেসর নারায়ণ গাঙ্গুলির অসামান্য আবিষ্কার! আর্কিওলোজির নতুন চ্যাপ্টার! ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ক্যাম্প ফায়ারের আগুণের আভায় দেখলাম জ্বলজ্বল করছে প্রফেসর সাহেবের দুই চোখ। খুব একটা ভূল না করলে সেই দৃষ্টিতে লোভের চিহ্ন ছিল…….
আমার হিসাবে সব তাল গোল পাকিয়ে গেল হঠাৎ……..
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
রাতে তাবুতে স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে মাথার নিচে দু হাত দিয়ে তাবুর ওপর দিকে তাকিয়ে বইলাম। মাহিন একটা মোম জ্বালিয়ে অঞ্জন মিত্তিরের খাতাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। বাহিরে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। তাবুর কাপড় গুলোর নড়া চড়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঝড়ের আকারটা নেহাত কম না। গত রাতের চেয়েও বড় ঝড় হচ্ছে।
“ড. এজাজ আহমেদের খুনের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলাম।” হঠাৎ গলা খাকারি দিলাম।
খাতা থেকে মুখ তুলল অবাক হয়ে মাহিন, “মানে?”
আবার বললাম, “ড. এজাজ আহমেদের খুনটা নিয়ে ভাবছিলাম। পিঠে নাকি ছ’টা পুরনো চাকু পাওয়া গিয়েছিল। হাতের কোনো ছাপ নেই।”
“গত রাতের ব্যাপারটার সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পেয়েছো?” চশমা খুলে তাকাল আমার দিকে।
“না। তবে অন্য কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছি।”
“কি?”
“খুনটা এই ক্যাম্পের কেউ করেছে। ড. আবু তালেবের টিমের লোক।”
“মানে!” হা হয়ে তাকাল।
আমি ওর দিকে তাকালাম, “বুঝতে পারছো আমি কাকে বোঝাচ্ছি?”
“কাকে? ড. আবু তালেব নিজে?”
“নাহ।” মাথা নাড়ালাম, “প্রফেসর নারায়ণ গাঙ্গুলি।” খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাটা বললাম।
জমে গেল যেন মাহিন। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত পর কথা ফুটল মুখে, “আন্দাজে ঢিল ছুড়ছো তুমি। ওনাকে মোটেও খুনি মনে হয় না।”
“চেহারা দেখে মানুষ চেনা বাদ দাও। প্রফেসর নারায়নের ডান হাতে সব সময় একটা প্লাষ্টিকের গ্লাভস থাকে। ঐ হাতে ছুড়ি ছয়টা কেন ছয় শোটা মারলেও হাতের ছাপ পরবে না।” কোনো রকম নাটকীয়তা ছাড়াই কথা গুলো বলে গেলাম। তাবুর ভেতর থম থমে নীরবতা। বাহিরে কেবল ঝড়ের শব্দ।
হঠাৎ মনে হল আমাদের তাবুটার বাহিরে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। পায়ের শব্দ পেলাম বলে মনে হল। কান খাড়া করে ফেললাম। লাগছে বাহিরে কেউ হাটা থামিয়ে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি দ্রুত উঠে পরলাম স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকে। যতক্ষণে তাবুর চেন খুলে বাহিরে বেরিয়েছি- পদশব্দটা ঝড়ের মাঝে মিলিয়ে গেছে। সত্যিই কেউ ছিল এখানে? নাকি মনের ভূল? খুঁত খুঁত করতে লাগল মন।
মাহিন স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেল। আমি ঝড়ের শব্দের মাঝ দিয়েই হাল্কা ভাবে শুনতে পাচ্ছি শিসের মত শব্দ। ক্যাথেড্রালের দিক থেকে। তার মাঝ দিয়েও কেন যেন মনে হল লেকের শব্দটা এপাশেও একই রকম শিসের মত শব্দ। নাকি শব্দটা এপাশেই হচ্ছে? মাহিনকে ঘুমিয়ে পরতে বলে আমিও শুয়ে পরলাম। এটা সেটা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি মনে নেই……..
মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হল আমাদের তাবুর ভেতর আরো মানুষ ঢুকেছে। অন্ধকার। আলতো ভাবে মাহিনকে ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে দিলাম। ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে শব্দ করতে নিষেধ করলাম। পিস্তলটা নেয়ার জন্য উঠে হাত বাড়িয়েছি সবে – দুদিক থেকে দুটো টর্চের আলো এসে চোখ ধাঁধিয়ে দিল। অন্ধকারে দুজন মানুষের অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। আমি কিছু করার আগেই এক পাশ থেকে খুব ভারী জাতীয় লোহার কিছু এসে বাড়ি লাগল আমার মাথায় প্রচন্ড জোরে। পিস্তল ধরার জন্য বাড়ানো হাতটা মাঝ পথেই থেমে গেল। কোনো রকম শব্দই করতে পারলাম না।
জ্ঞান হারানোর পূর্ব মুহূর্তে মাহিনের ভয়ার্ত চিৎকার শুনতে পেলাম বলে মনে হল………