►ক্যাথেড্রাল – ষষ্ঠ পর্ব◄

পরের এক সপ্তাহ কাজে তেমন কোনো অগ্রগতি হল না। ড. আবু তালেবের লোকজন মাটি খুঁড়ে ক্যাথেড্রালের আরো বেশ কয়েকটা রূম বের করল। মাটির নিচে ডানজন পাওয়া গেল গেল অনেক বড়। ঠিক কি কাজে ব্যবহার করা হত সেটা বোঝা গেল না। তবে ডানজনের অল্প নিচ দিয়েই পাতাল নদীর মত একটা অববাহিকা পাওয়া গেল। প্রফেসর নারায়ণের ধারণা মতে যিশুর মূর্তির নিচের পানির উৎসটা এই পাতাল নদীর সঙ্গে যুক্ত। বৃষ্টির কারণে পানি বেড়ে গেলে অতিরিক্ত পানি খ্রিষ্টের মূর্তির নিচ থেকে বেরিয়ে আসে।

এ কদিন আমি ডানজনটায় ঘুরে বেড়াতাম একা একা। প্রচুর লতা পাতা আর ঝোপঝার এখানে, রীতিমত জঙ্গল। বোঝাই যায় না কি আছে। এখানেও গাছ পালার মত হাজার হাজার ডাল পালা এদিক সেদিক ছড়িয়ে রয়েছে। কোত্থেকে যে শুরু আর কোথায় যে শেষ বোঝার জো নেই। ডানজনের ভেতরে নামলেই বিচিত্র একটা শব্দ পাওয়া যেত। অনেকটা চিকন সুরে শিস দেয়ার মত। আমি শব্দের উৎসটা হাজার চেষ্টা করেও খুঁজে পাইনি। বড় বড় গাছের শেকড় আর মোটা মোটা লতা পাতা ছাড়া আর কিছু নেই এখানে। শিস দেয় কে?

এর মাঝে আরো কিছু ঝামেলা বাঁধলো। ইভার জ্বর ধরায় বাসায় পাঠিয়ে দিল রাকিব। মেয়ে বাসায় একা একা কি করবে- তাই রাকিবও চলে গেল। অন্য দিকে টানা বৃষ্টির কারণে দ্রুত ক্যাথেড্রালের ফটক দিয়ে পানি ঢোকা শুরু করল। লেকের পানির লেভেল বেড়ে গেছে। আমি কয়েকজন গার্ডকে নিয়ে বস্তায় বালু ভরে ক্যাথেড্রালের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম উঁচু করে। তাতে ভেতরে পানি ঢোকা বন্ধ হল সাময়িক ভাবে। কিন্তু কতক্ষণ? বৃষ্টি তো থামার নামই নিচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে ঠিকই ক্যাথেড্রালে পানি ঢুকবে। বস্তা দিয়েও ঠেকানো সম্ভব না লেকের পানি।

প্রফেসর গাঙ্গুলি লোক লাগিয়ে সেই পাঁচটা সমাধী ভাঙ্গার কাজ শুরু করেছেন গত পরশু থেকে। কেন ভাংছেন জানি না। প্রায়ই দেখি এক হাতে একটা গ্লাভস পরে এটা সেটা নেড়ে চেড়ে দেখেন আর গম্ভীর মুখে ডায়েরিতে নোট টুকে নেন।

দ্বিতীয় কিং ডেভিডের কবরটা ভাঙ্গা হয়েছে সবার প্রথমে। গতকাল সকালে ভাঙ্গা হয়। আমি নিজেও ছিলাম। ভেতরে কিছুই পাওয়া যায়নি। কেবল কংকালের হাঁড় গোড় আর মলিন কাপড়। দেখে কোনো রাজা বলে মনে হল না। বেশ ভূষা এক কালে হয়তো যাও বা ছিল- এখন বলার মত নেই। দাঁত বের করে হাসছে যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে। মাহিন খুব হতাশ হলেও প্রফেসর গাঙ্গুলি হননি। এক হাতে গ্লাভস পরে হাঁড় গুলো ধরে ধরে দেখছেন। দেখলাম কংকালের ফিমারের হাঁড় দুটো তুলে কি যেন মাপলেন। তারপর কলম দিয়ে খসখস করে ডায়েরিতে লিখলেন কিছু।

গত কাল সারাদিনে উল্লেখ যোগ্য কোনো ঘটনা না ঘটলেও রাতে একটা অঘটন ঘটল। গত রাতে ক্যাথেড্রালের পাহারায় যে কয়জন গার্ড পাঠানো হয়েছিল- মোট দশজন গার্ড, তার মধ্যে পাঁচ জন গার্ড গায়েব হয়ে গেল। বাকি পাঁচ জনকে পেলাম মৃত অবস্থায়।

প্রতি আধ ঘন্টা পরপর রেডিওতে যোগাযোগ রাখা হচ্ছিল গার্ড গুলোর সঙ্গে। কিন্তু রাত দেড়টার দিকে হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এমনিতেই তখন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। ক্যাথেড্রালের দিকে সার্চ লাইটের আলো ফেলা থাকলেও বোঝা যাচ্ছিল না কি হচ্ছে ভেতরে। বার কয়েক গুলির শব্দ শোনা যায়। তারপর সব নিস্তব্ধ। রেডিওতেও যোগাযোগ করা যায়নি।

আমার ঘুম এমনিতেই হাল্কা। একটু শব্দ হলেই জেগে উঠি। গত রাতে গুলির শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাবুর বাহিরে লোকজনের ব্যস্ত হৈ চৈ আর উত্তেজিত কথা বার্তা শুনে উঠে বসলাম। মাহিন ঘুমাচ্ছে- ঘুমাক। ওকে না জাগিয়ে বেরিয়ে এলাম।

বাহিরের অন্ধকার আর ঝড় বৃষ্টির মাঝেই দেখলাম সার্চ লাইটের আলো পাগলের মত ছুটে বেরাচ্ছে ক্যাথেড্রালের ওপর। যিশুর মূর্তির ওপর যতবার আলো পড়ছে ততবার মনে হচ্ছে ঝড়ের মাঝে ক্রুদ্ধো চোখে তাকিয়ে রয়েছে এদিকে!

আমি ড. তালেবকে দেখে এগিয়ে গেলাম, “কি হয়েছে? এত হৈ চৈ কেন?”

বিরক্ত মুখে তাকালেন আমার দিকে। ভাল করে রেইন কোটের হুডটা টেনে নিলেন মুখের ওপর, “ক্যাথেড্রালের গার্ড গুলোর কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। রেডিওর ধারে কাছে নেই একটাও। তারওপর ক্যাথেড্রালের দিক থেকে গোলা গুলির শব্দ এসেছে। মনে হচ্ছে ঝামেলা লেগেছে। চোর ডাকাত ঢুকেছে নাকি!”

“লোক পাঠিয়েছেন?” ক্যাথড্রালের দিকে তাকালাম। ভিজে যাচ্ছি বৃষ্টিতে। রেইন কোট ভূলে পরা হয়নি।

“যাবে এখন। আপনি যাবেন?” ড. তালেব জিজ্ঞেস করলেন।

“হু। আপত্তি নেই। সঙ্গে আর্মস থাকলে আরেকটু ভাল হত আর কি।” কপালের ওপর এসে পরা চুল গুলোকে আঙ্গুল দিয়ে পেছনে পাঠিয়ে দিলাম।

“সমস্যা নেই। গার্ডদের থেকে একটা পিস্তল চেয়ে নিন আমার কথা বলে, দিয়ে দেবে।”

“আপনি যাবেন না?”

“আমি আবার গোলাগুলির মাঝে গিয়ে কি করবো?” ইতস্তত গলায় বললেন। আমি আর কিছু বললাম না।

নৌকা তৈরি হয়ে ছিল। আমি গিয়ে ওঠা মাত্র ছেড়ে দিল। মোট বারো জন গার্ড আর আমি। আসার সময় একটা রিভলভার নিয়ে এসেছি। মাত্র ছ’টা গুলি। কাজে না লাগলেই খুশি হব। আর্মি লাইফের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বলে গুলি ছুড়লে সংখ্যাটা ছয়ের নিচে আসলে কাজে দেয় না। নূন্যতম ছয়টা গুলি করতে হয় প্রতি পক্ষকে ধরাশায়ি করতে। এক গুলিতে বাজি মাতের ঘটনা গল্প উপন্যাসেই থাকে। বাস্তবে ব্যপারটা ভিন্ন।

ক্যাথেড্রালে যখন যাচ্ছিলাম নৌকায় করে, সার্ক্স লাইটের আলো বার বার এসে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল।

ক্যাথেড্রালের সিঁড়িতে নেমেই আমি গার্ডের দলটাকে তিন ভাগে ভাগ করে তিন দিকে পাঠিয়ে দিলাম। আমার সঙ্গে নিলাম দুই জনকে। মূল দরজার বালির বস্তার সামনে এসে দু দিকে বসলাম আমি আর একজন গার্ড। এখানে হাটু পানি। অন্যজন লাফিয়ে টর্চ আর অস্ত্র হাতে ভেতরে ঢুকে গেল। ও সংকেত দেয়া মাত্র আমরা দুজন লাফিয়ে ঢুকলাম বালির বস্তার বাঁধ ডিঙ্গিয়ে।

কিন্তু ভেতরে ঢুকে ছোট খাট ধাক্কার মত খেলাম। টর্চের আলোয় দেখা যাচ্ছে করিডোরের অল্প পানিতে উপুর হয়ে আছে একজন গার্ডের লাশ! এক নজর দেখেই বোঝা গেল শরীরের কোনো হাঁড় আস্ত নেই। খুব শক্তিশালী কিছু একটা একে পেঁচিয়ে চাপ দিয়ে হাড় মাংস এক করে ফেলেছে! মাংসের দলার মত পরে আছে লাশটা।

আমি খুব সাবধানে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম করিডোর ধরে। স্যাস্টিন চ্যাপেলের ছবির সেই হল রূমে ঢুকে যেটা দেখলাম তাতে জমে গেলাম সবাই।

দানবের মত কিছু একটা আরো চার জন গার্ডকে এই বিশাল রূমের ছাদে, দেয়ালে আর ফ্লোরে প্রচন্ড আক্রোশে ছুড়ে মেরেছে! অনেক গুলো মূর্তি ভেঙ্গে মেঝেতে পড়ে আছে। বাকি গুলো কোনো কোনোটা হেলে গেছে। ছাদের কাঁচের ছবির অংশ গুলোর জায়গায় জায়গায় রক্ত লেগে আছে, দেয়ালে রক্ত, মাথা ফেটে মগজ লেপ্টে আছে দেয়ালের অনেক ওপর দিকে। এখানে শত শত মূর্তির ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাশ গুলো। দেয়াল আর ছাদে গুলির ছিদ্র। বোঝাই যাচ্ছে ফায়ারিং এই ঘরেই হয়েছিল। হল রূমের বদ্ধ বাতাসে এখনো বারুদের গন্ধ। বেশিক্ষণ আগে ঘটেনি ঘটনা। আন্য পাঁচ জনকে পেলাম না তন্ন তন্ন করে খুঁজেও। গায়েব হয়ে গেছে যেন একেবারে!

সমস্ত ফ্লোর জুড়ে সবুজাভ এক ধরণের তরল, চিটচিটে পদার্থ। লাশ গুলোর গায়েও লেগে আছে সবুজাভ তরল গুলো। দূর থেকে ডানজনের সেই হাল্কা শিসের মত শব্দটা ভেসে আসছে……. বজ্রপাতের আলো আসছে ছাদের ফাটল দিয়ে……

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এভাবে কাউকে খুন করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না! দানবের পক্ষেই সম্ভব!

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

পরদিন সকালে মাহিনকে ঘটনা গুলো জানালাম। শুনে কেমন যেন ঝিম মেরে রইল অনেক্ষণ।

“মাহিন আমি তোমাকে আর তোমার কলম্বাসকে নিয়ে ভয়ে আছি। জীবনে দূর্ঘটনা তো আর কম দেখিনি। এখানে পরপর খুন হচ্ছে। তার মাঝে তোমাকে এভাবে ছেড়ে দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না। আমার মনে হয় তোমার এখন ফেরা উচিত।” হাতের নখ গুলোর দিকে অহেতুক তাকিয়ে রইলাম।

মাহিন করুণ চোখে তাকাল, “এ রকম ইন্টারেস্টিং একটা সাইট থেকে এ অসময়ে – মাঝ পথে চলে যেতে হবে? প্লিজ রবি………..”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললাম, “তোমাদের ভাল দিকটা ভাবা আমার দায়িত্ব। কিন্তু কিছু চাপিয়ে দেবো না তোমার ওপর। আশা করি তুমি তোমার আমার সন্তানের মঙ্গলের জন্যই সিদ্ধান্ত বদলাবে।”

বাহিরে পুলিশ এসেছে লাশ গুলো নিতে। ড. আবু তালেব আসলেই কড়িৎ কর্মা লোক। পুলিশি ঝামেলা কিভাবে সামলাতে হয় ভাল করেই জানেন। সে ভাবেই কাজ করলেন। ব্যপারটা নিয়ে তাই খুব একটা হৈ চৈ হল না আর। ড. এজাজ আহমেদের খুনের ব্যপারে বলতে পারি না, তবে গত রাতের খুন গুলো কোনো মানুষ যে করেনি এটা হলপ করে বলতে পারি। তাই এই প্রথমবার ড. আবু তালেবের চতুরামিটা খারাপ লাগল না।

মাহিন আর আমি তাবুর ভেতরে বসেছিলাম। সকাল দশটা বাজে। প্রফেসরের “কবর খোঁড়া” টিম এতক্ষণে চলে গেছে ক্যাথেড্রালে পাঁচ সমাধী ভাঙতে। ভেতরে বসেই শুনতে পেলাম প্রফেসর লোক গুলোকে বলছেন, “আজকে অন্য সমাধী গুলো ভাঙ্গার দরকার নেই। ড্রিল করে বেটে কবরটাই আগে খোলো।”

মাহিন আমার দিকে তাকাল অর্থ পূর্ণ দৃষ্টিতে, “বাকি তিন সম্রাটের কবর একই রকম হবে- তাই দ্বিতীয় এঞ্জেলোর কবরটা ভাঙবে আজ। সময় বাঁচল।”

আমি মাহিনের দিকে ফিরে তাকালাম, “এখনই যেতে চাও? নাকি আরেকটু পরে যাবে?”

“দেখি। একটু পরেই যাবো। ড্রিলিং এর সময় উড়তে থাকা ধূলো বালি সহ্য করতে পারি না।” ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করল মাহিন। চোখে বড় চশমাটা লাগিয়ে পৃষ্ঠা ওল্টাতে লাগল।

আমি আপন মনে গত রাতে নেয়া পিস্তলটা নিয়ে ম্যাগাজিন খোলা-বন্ধ করতে লাগলাম। ফেরত দিতে ভূলে গেছি। আপন মনেই বললাম, “আচ্ছা পুরাতত্ত্বের কাজ করার সময় হাতে গ্লাভস, ব্রাস এসব থাকার দরকারটা কি?”

ডায়েরী থেকে মুখ না তুলে বলল মাহিন, “যাতে কোনো ক্ষতি না হয় অ্যানটিকের। স্পট পড়ে গেলে অ্যানটিকের ভ্যালু কমে যায়।”

“অ!” আর কিছু বললাম না।

ভারি ড্রিল মাশিনের একটানা গোঁ গোঁ শব্দ আর ধূলো বালিতে বদ্ধ সমাধী কক্ষটা অসহ্য লাগছিল। দেয়ালে শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে প্রচন্ড শব্দ তুলেছে। আমি মাহিনের সঙ্গে উঁচু সিড়িঁর প্লাটফর্মে বসে আছি। নিচের ঠান্ডা পানিতে নামছি না। আগে এঞ্জেলোর কবর ভাঙ্গে হোক। তারপর যাবো। মাঝে মাঝেই উবু হয়ে তাকিয়ে দেখছি কাজ কত দূর হল। প্রফেসর সাহেব পাঁচ কবরের একটা কবরের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে ডায়েরী লিখছেন। একটা সমাধীর ওপর যে বসে আছেন- সেটা তাঁর মুখ দেখে বোঝা গেল না। যেন সোফায় বসে আছেন! ভাল করে তাকিয়ে বুঝলাম ওটা আলেকজান্ডারের সমাধীটা।

কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তারওপর ছোট কবর। তাই দ্রুত কবরের ওপরের আস্তরণ বাঙ্গার কাজ এগোচ্ছে।

দুপুর হয়ে এসেছে প্রায়। ড্রিল মেশিনের এক ঘেয়ে শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। কেউ কথা বলছে না। আমি এক দৃষ্টিতে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছি অনেকক্ষণ ধরে। হঠাৎ মাহিন আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভূত গলায় বলল, “কেন যেন মনে হচ্ছে কবরটার ভেতর কিছু পাবো না।”

“মানে?” অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম।

“জানি না আসলে……” বিভ্রান্তের মত দেখালো ওকে। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ড্রিলিং করতে থাকা লোকটার গলা শুনলাম, “প্রফেসর- কাজ শেষ। পাথরটা সরানো যাবে এখন।”

মাহিন তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে ছুটল পানি ভেঙ্গে সমাধীটার দিকে। আমিও পেছন পেছন এলাম। পা জমে যাচ্ছে ঠান্ডায়। প্রফেসর হাত নেড়ে ইসারা করলেন পাথরটা সরাতে সমাধীর ওপর থেকে।

বড় দুটো শাবল দিয়ে চাড় মেরে ধীরে ধীরে সরাতে লাগল আয়তাকার পাথরটা। আমি মাহিনের দিকে তাকালাম। উত্তেজিত মুখে তাকিয়ে রয়েছে সমাধীটার দিকে। আমিও কৌতুহলি মুখে তাকালাম। দ্বিতীয় এঞ্জেলো সাহেবের কংকাল দেখতে কেমন হবে আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম।

ধীরে ধীরে ইঞ্চি ইঞ্চি করে পাথরটা সরতে থাকল। ভীষণ ভারী পাথরটা। তিন জন লোক মিলে ঠেলছে শাবল দুটো। সরতে অনেক সময় নিচ্ছে। প্রায় তিন চার মিনিট লাগিয়ে পাথরটা সরানো হল। মাহিন উৎসুক মুখে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিতেই পালটে গেল মুখোভাব। আমি নিজেও এগিয়ে গেলাম। ভেতরে প্রচুর মাকড়শার জাল আর ময়লা। কোনো কংকাল কিংবা লাশ নেই! তার বদলে রয়েছে বিশাল একটা মোটা ড্রয়িং খাতার মত একটা খাতা। কালো হয়ে এসেছে কভারটা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে। আমার পাশে এসে গলা বাড়িয়ে উঁকি দিলেন প্রফেসর নারায়ণ। অবাক গলায় বললেন, “লাশের বদলে ডায়েরী? তারমানে দ্বিতীয় এঞ্জেলোর আসল কবর এটা না?” কন্ঠ শুনেই বোঝা গেল খুব হতাশ হয়েছেন।

মাহিন আস্তে আস্তে বলল, “যখন সবাই ড্রিল মেশিন নিয়ে কবর খোলায় লেগে গেল- তখনই আন্দাজ করেছিলাম এটাতে দ্বিতীয় এঞ্জেলোর লাশ থাকবে না। একে তো সীল করা কবর, তার ওপর এত ভারী পাথর উনি নিজের ওপর টেনে নিতে পারতেন না একা একা কখনই। কারণ উনিই শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। একা একা কবরে ঢুকে পাথর টেনে নেয়া ওনার পক্ষে অসম্ভব।”

আমি মাহিনের দিকে তাকালাম। জ্বলজ্বল করছে ওর চোখ দুটো। একপাশে ফেলে রাখা প্রফেসর নারায়ণের ব্রাশ তুলে নিল কাঁপা হাতে। কবরের ভেতরের খাতাটার কভারটা ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করল খুব সাবধানে।

পরিষ্কার করার পর কভারের নামটা বেরিয়ে এল। গুঁটিগুঁটি হাতে রূপালি অক্ষরে খুব আগের বাংলা লিপিতে লেখাঃ-

“মাইকেল অঞ্জন মিত্তির

জয়পুর, বিহার।”

খুব সাবধানে খাতাটা দু হাতে তুলে নিল মাহিন। সম্মোহিতের মত বিড়বিড় করে বলল, “তাহলে দ্বিতীয় মাইকেল এঞ্জেলোর আসল নাম – অঞ্জন মিত্তির! বাঙ্গালী!!”

প্রথম পাতাটা ওল্টাতেই চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল তেল রঙ্গে আঁকা ছবি- একটা চেয়ারে বসে জমিদারদের মত তাকিয়ে রয়েছে একজন বামন কিশোর। মুখে শিশুর সারল্য মাখা হাসি…… দ্বিতীয় এঞ্জেলো! যার আসল নাম অঞ্জন মিত্তির।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!