►ক্যাথেড্রাল – পঞ্চম পর্ব◄

সকাল দশটা বাজে। সার্কেল ভ্যালির ম্যাপটা হাতে একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দাঁড়িয়ে আছি একা একা। একটা দূরবীন নিয়ে পুরো এলাকাটা দেখছি। প্রফেসরনারায়ণ গাঙ্গুলির কথা শুনে নালা কাটার কাজে হাত দেয়াটা বোকামী হয়েছে এখন বুঝতে পারছি। দূরবীন দিয়ে চারপাশটা এক নজর দেখেই দমে গেছি। পুরাসার্কেল ভ্যালিটাকে বিশাল কোনো ফানেল কিংবা চোঙ কল্পনা করলে সেটার নিচের অংশটা হবে এই বিশাল লেকটা। দুই কিলোমিটার ব্যাসের এই লেকেরচারপাশের পরিধিই হবে বারো তেরো কিলোমিটারের মত। এই পুরো অংশটা লেক। যত পানি আছে এলাকার-সব গড়িয়ে এসে জমা হয় এখানে। এটাই সবচেয়েনিচু জায়গা। খাল কেটে সারা জীবনেও পানি কমানো সম্ভব না। হতাশ মুখে ম্যাপটা ভাঁজ করে রাখলাম পকেটে। আকাশের দিকে তাকালাম। ঘন কালো মেঘে ছেয়েআছে পুরো আকাশটা। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। ক্যাথেড্রালের গবেষনার জন্য প্রকৃতির উপরই নির্ভর করতে হবে। বৃষ্টি হলে লেকের পানি বাড়বে।তাতে ক্যাথেড্রালে ঢোকার মুখটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর বৃষ্টি না হলে নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যাওয়া যাবে।

দূরবীনটা দিয়ে লেকটার দিকে তাকালাম আবার। সবুজাভ পানিগুলো স্থির হয়ে আছে। বাতাসের কারণে হালকা তরঙ্গের রেশ। তবে কোনো স্রোত নেই। যিশুর মূর্তিটাদানবের মত ঠিক লেকের কেন্দ্রবিন্দুতে হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছন বরাবর ক্যাথেড্রাল। মাহিনরা সবাই এখন ক্যাথেড্রালের ভেতরে। খালি নৌকাগুলোক্যাথেড্রালের মূল ফটকের সিঁড়ির গোঁড়ায় বেঁধে রাখা। এপাশের ক্যাম্পের দিকে দূরবীন ঘোরালাম। রাকিবের কুকুরটাকে দেখা গেল। একা একা ঘুরে বেরাচ্ছে।গার্ডগুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে পুরো লেকটা ঘিরে যতটা পারছে টহল দিচ্ছে। পুরো এলাকার পাহাড় আর জঙ্গল গুলোতে চোখ বোলালাম। কোথাও কোনো পাখিদেখতে পেলাম না। আশ্চর্য! জঙ্গলেই না পাখি থাকে। এখানে দেখি একটা পাখিও নেই।

ক্যাথেড্রালের দিকে আবার দূরবীন ঘোরালাম। বিশাল কোনো রাজপ্রাসাদ লেক আর পাহাড়ের নিচে ডুবে আছে! একপাশে কাত হয়ে আছে। গতকাল বিকেলে পাহাড়ভেঙে দোতলার বারান্দার যে অংশটা বেরিয়েছিল সেটার দিকে তাকালাম। কালো হয়ে আছে বারান্দা আর ভাঙ্গা রেলিংটা। বামপাশে কাত হয়ে আছে সমস্তবারান্দাটা। কেউ হাঁটতে পারবেনা, পিছলে সোজা লেকের পানিতে পড়বে। ভাঙ্গা রেলিং এর শেষ মাথায় একটা নারী মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেটাও কালো। হেলেরয়েছে। কখন যে ভেঙ্গে পানিতে আছড়ে পড়বে কে জানে। মূল ভ্যাটিকানের ক্যাথেড্রালে এরকম কোনো মূর্তির অস্তিত্ব নেই, কেবল ছাদের রেলিং বা কার্ণিশে মূর্তি আছে যতটা জানি। মাহিন হয়ত আরো ভালো জানবে।

দূরবীন নামিয়ে ফেলেছিলাম প্রায় হঠাৎ মনে হল বারান্দাটার ওপর দিকে কিছু একটা নড়ে উঠল। সাথে সাথে তাকালাম। পাহাড়ের ভাঙ্গা অংশ থেকে একটা গাছঝুলে রয়েছে বারান্দাটার ওপর। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম। গাছটার ডাল নড়ছে এখনো, কেউ ছিল নাকি একটু আগে? থাকলেও ওরকম বিদঘুটে একটা জায়গায় কিকরতে যাবে? পড়ে তো হাত পা ভাঙ্গবে!

তাকিয়ে রইলাম অনেক্ষণ। কাউকে দেখতে পেলাম না। চোখে দেখার ভূল হতে পারে। দূরবীন নামিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে লাগলাম ক্যাম্পের দিকে। মাঝামাঝি একটু নেমে কি মনে হতে দূরবীণ দিয়ে আবার তাকালাম বারান্দাটার দিকে। আগের মতই সব। দূরবীণ কোমরে ঝুলিয়ে আবার নামতে যাবো- থমকে গেলাম হঠাৎ। ঝট করে দূরবীণ তুলে আবার ক্যাথেড্রালের বারান্দায়  তাকালাম – সেই ঝুলে থাকা গাছটা নেই! মাটি ভেঙ্গে পড়ে গেল নাকি? লেকের দিকে তাকালাম। কৈ? সব তো স্বাভাবিক! গাছটা গেল কোথায়! ঢোক গিললাম। দিনে দুপুরে ভূতুড়ে কান্ড!

পাহাড়টা অনেক উঁচু। নামতে অনেক সময় নিচ্ছে। দুবার পা হড়কে যেতে যেতে সামলে নিলাম। মাটি খাঁমচে নামার সময় একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম- ছোট ছোট পাথর, ইট আর থামের মত কিছু জিনিস হাতে লাগল। পা পিছলে যাবার সময় দুই বারই মাটি ভেঙ্গে সবে গিয়েছিল। ভাঙ্গা অংশ থেকে বেরিয়ে এসেছে কোনো ভবনের বারান্দার রেলিং এর অংশ বিশেষ। খটকা লাগল। পায়ে কেডস ছিল, তা দিয়েই লাথি দিয়ে কিছু অংশের মাটি চেঙ্গে সরালাম। আবার লাথি মারতেই পাথুরে কিছুতে খুব জোরে বাড়ি লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে ওখানেই বসে পড়লাম। ব্যথাটা হজম করে ভাওল করে তাকাতেই যা দেখলাম তাতে পায়ের ব্যথাটা মুহূর্তেই উবে গেল।

ভাঙ্গা অংশটা দিয়ে বেরিয়ে আছে একটা নারী মূর্তির মুখের অংশ! চোখ গুলোতে দামী নীল পাথর। এতই নিখুঁত যে মনে হল কালো মূর্তিটা আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে!

আমি বিষ্ময়ের ধাক্কাটা কাটাতেই দু হাতে খাঁমচে মাটি সরাতে লাগলাম। অনেকটা ক্ষ্যাপা মানুষের মত। মাটি খুব নরম। টান দিলেই ছুটে যাচ্ছে। দেখতে দেখতেপুরো মূর্তিটা বের করে ফেললাম। পায়ের দিকে খুঁড়তেই দেখলাম একটা রেলিং এর ওপর বসানো মূর্তিটা। কোনো বারান্দার রেলিং। কেমন যেন সন্দেহ হল।দূরবীনটা হাতে নিয়ে ক্যাথেড্রালের বাম দিকের সেই বারান্দাটার দিকে তাকালাম। সেখানেও রেলিং এর ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা রমণী মূর্তি। এত দূর থেকেওবোঝা যাচ্ছে- অবিকল একই মূর্তি! এখানেরটাও একটা রেলিং এর ওপর দাঁড়ানো……

আমি আস্তে আস্তে আমার সামনে দাঁড়ানো মূর্তিটার দিকে তাকালাম। বিচিত্র একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল মনের ভেতর। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। চারপাশেরপাহাড়গুলোর দিকে তাকালাম এক নজর। বৃত্তাকার ভাবে লেকটাকে ঘিরে রেখেছে। কেন্দ্রে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি, লেকের নিচেও অসংখ্য মূর্তি।

যতটা মনে পড়ে মূল ভ্যাটিকান প্রাসাদটাও ঠিক এরকম বৃত্তাকার। প্রাচীর আর ভবন দ্বারা ঘেরা, মাঝখানে বিশাল একটা চত্বর। আর এখানের ক্যাথেড্রালটাপাহাড়ের যেখান থেকে বেরিয়ে রয়েছে- মূল ভ্যাটিকানের ওরকম একটা জায়গায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে পোপ জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। এখানে বৃত্তাকার ভবনেরবদলে রয়েছে সার্কেল ভ্যালি……… তার মানে হল- এই পাহাড়গুলোর ভেতরেই সেই বৃত্তাকার ভবনগুলো রয়েছে! যেগুলো গোল হয়ে ঘুরে গিয়ে ভ্যাটিকানের প্রাসাদেযুক্ত হয়েছে! বারো তেরো কিলোমিটার পরিধির এই বৃত্তাকার পাহাড়গুলো তিনশো বছর পূর্বে ক্যাথেড্রালের অনুষদ ভবন ছিল! মাটি চাপা পড়ে এখন পাহাড় হয়েগেছে! ভ্যাটিকান সিটির ক্যাথেড্রালের চেয়েও কয়েকগুণ বড় এই ক্যাথেড্রাল!

হা হয়ে গেলাম আরো একবারের জন্য। বানালো কি করে এই ক্যাথেড্রাল? হিসেব করলে এটাই তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্যাথেড্রাল! মাটি আর পাহাড় খুঁড়লেরীতিমত কোনো শহর বেরিয়ে পরবে!

বৃষ্টি নেমেছে। বেশ জোরে সোরেই। আমি গায়ে রেইনকোট চাপিয়ে নৌকার দাঁড় বাইছি। ক্যাথেড্রালে যাচ্ছি। নৌকায় আর কেউ নেই। প্রায় মধ্য দুপুর। কিন্তুচারপাশে এত কম আলো যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে মনে হয়। আকাশে ঘন কালো মেঘ। লেকের পানিতে বড় বড় ফোঁটাগুলো আছড়ে পড়ছে বিচিত্র শব্দ তুলে। লেকেরনিচে ডুবে থাকা মূর্তিগুলো বোঝা যাচ্ছে না বৃষ্টির পানি পড়ার কারণে। ক্রুশবিদ্ধ খ্রিস্টের মূর্তিটা পাশ কাটাবার সময় লক্ষ করলাম আজও একহাত জায়গা জুড়েপানি উঠছে মূর্তিটার নিচ থেকে। নিচে পানির উৎস আছে নাকি? এভাবে পানি উঠছে কেন? বৃষ্টি হলেই কেবল পানি ওঠে। কারণ গতকাল প্রথমবার যখন এপাশদিয়ে যাচ্ছিলাম তখন পানি উঠতে দেখিনি- তখন বৃষ্টিও হচ্ছিল না।

ক্যাথেড্রালের সিঁড়ির কাছে নৌকা ভেড়ালাম। দুই কিলোমিটার নৌকা বাওয়া মুখের কথা না। দুই হাতের পেশি টন টন করছে। বার কয়েক হাত ঝাঁকালাম। এদিকসেদিক তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। ভেতরে বোধহয় সবাই। গতকাল আসার সময় কোথায় কি আছে দেখেছি ভালমত। তাই একা একাই ঢুকে পড়লাম। হল রুমপেরিয়ে আরো কয়েকটা বড় বড় রুমে ঢুকলাম। জেনারেটরের লাইন দেয়া। হলুদ লাইট জ্বলছে সব রুমগুলোয়। অবাক হয়ে দেখছি ঘরগুলো। দেয়াল গুলো নানানলতাপাতা আর আগাছা-শ্যাওলায় ঢেকে গেলেও বর্ণীল চিত্রকর্ম আর খোদাই করা শিলালিপি গুলো ঢাকতে পারেনি। পকেট থেকে একটা টিস্যু পেপার নিয়ে বড়ঘরটার দেয়ালের নিচের দিকে একটা মাঝারি সাইজের পেইন্টিং মুছে শ্যাওলা সরালাম। কাঁচ দিয়ে বাঁধানো। তাই এত বছরেও নষ্ট হয়নি। খুব উজ্জ্বল রঙ দিয়েবাইবেলের great flood এর একটা দৃশ্য এঁকেছেন শিল্পী। আমি ছবি কম বুঝি। মান কেমন তাও বুঝিনা। তবে এটুকু বুঝতে পারলাম খুব নিখুঁত একটা ছবি এটা!এতই জীবন্ত যে মনে হচ্ছে ছবির ভেতরের উন্মাত্ত সাগরের পাহাড় প্রমাণ ঢেউ এখনি আছড়ে পড়বে ছবির ফ্রেম ছাড়িয়ে এই ঘরের ভেতর। ফ্রেমের কোনার দিকেশিল্পীর সাক্ষর- Angelo (।।). কিন্তু ছবির নামটা পড়তে গিয়ে ভ্রূ কুঁচকে গেল আপনাআপনি- “The Great Flood of Cathedral” ।

অবাক হয়ে ছবিটার দিকে তাকালাম। নূহ নবীর সেই বজরা ভাসছে সাগরের ওপর, পাহাড়ের মত বিশাল বিশাল ঢেউ। ক্যাথেড্রালের তো কোনো চিহ্নই নেই!

হাত বুলালাম কাঁচের কভারের উপর। প্রফেসর নারায়ণ কি এগুলো দেখেননি এখনো? প্রশ্ন জাগলো মনে। পেছনে পায়ের শব্দ হতেই ফিরে তাকালাম। মাহিন আররাকিব ঢুকেছে এই রুমে। আমাকে দেখে রাকিব অবাক হল, “কখন এলি? সাড়া শব্দ পেলাম না যে।”

“এইতো মিনিট দশেক হবে।” মাহিন আমার পেছনের ছবিটার দিকে তাকালো, “কি দেখছিলে?”

“এই ছবিটা। ছবির নাম দেয়া ক্যাথেড্রালের বন্যা। অথচ ক্যাথেড্রালের কোনো চিহ্নই নেই।”

চোখে চশমা লাগিয়ে কৌতুহলী মুখে এগিয়ে এল, “এই রুমটা একটা আর্ট গ্যালারি। পরে দেখবো ভেবে আর আসিনি।” ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়েদেখতে লাগল। একেবার কাঁচের সামনে চোখ এনে দেখল। দেখলাম বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠেছে ওর মুখে।

“কি ব্যাপার?”

“এই দ্বিতীয় মাইকেল এঞ্জেলোর তো ভক্ত হয়ে যাচ্ছি আমি- যতই দেখছি!”

“মানে?”

“দারুণ এক জিনিয়াস ছিল লোকটা-মানতেই হবে!”

“হেয়ালি রেখে আসল কথা বলো তো।” অধৈর্য্য হলাম। রাকিবও এগিয়ে এল। চোখে মুখে কৌতুহল। ফিরে তাকাল মাহিন, মুখে হাসি-যেন বিরাট কিছু আবিষ্কারকরে ফেলেছে।

“এখানে একসাথে তিনটার মত পেইন্টিং আছে।”

“বুঝলাম না।” রাকিব বোকার মত আমার দিকে তাকালো।

“বুঝিয়ে দিচ্ছি। রাকিব ভাই, আপনি ছবিটার ডানদিকে যান। আর রবি যাও বাম দিকে। দেখো তো কি দেখা যায়?”

আমি কোনো প্রশ্ন করলাম না। যা বলল করলাম। বামপাশে গিয়ে ছবিটার দিকে তাকানোর সাথে সাথে অদ্ভুত জিনিস দেখলাম! একটু আগে দেখা বজরা আরসাগরের ছবি বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে! তার জায়গায় দেখা যাচ্ছে বিশাল একটা ক্যাথেড্রালের ছবি! সেটার সামনে সূর্য ডোবার আলোতে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ মুর্তি!এই ক্যাথেড্রাল্টাই-কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আগের ছবিটা……. হঠাৎ বুঝে ফেললাম পুরো ব্যাপারটা! আগেকালের ছোটো বাচ্চাদের বেল্টের বাকলসে এক ধরনেরকার্টুন আঁকা থাকত প্লাস্টিকের পরতে। দুই দিক থেকে দেখতে দুই রকম। মনে হত কার্টুনটা নড়ছে। আসলে দুই ধরনের সরু উচু নিচু লাইনিং দিয়ে ঐ ছবিগুলোতৈরী করা হতো। দুই দিকে  দুই রকম ভাবে দেখাতো সেইজন্য। এখানেও তাই! আমি বামপাশে এসেছি বলে এখানে অন্য ছবি দেখাচ্ছে, সামনে গেলে আবার- Great Flood। হেঁটে রাকিবের পাশে আসতেই তৃতীয় দৃশ্য দেখলাম। ক্যাথেড্রালটা পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে, সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার ছবি। তার মাঝেও অষ্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে ক্যাথেড্রালের দরজা জানালাগুলো দিয়ে খুব বড় বড় শূড়ের মত কিছু বের হয়ে রয়েছে! এটার কোনায় একই লেখা- “The Great Flood of Cathedral”, তবে শেষে একটা সাল উল্লেখ করা-1832, July.

মাহিনের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। মিটিমিটি হাসছে ও। দু’হাত বুকে আড়াআড়ি ভাজ করে রেখেছে, “বোঝা গেল? এখানে মোটে তিনটা সরু উঁচু লাইনিং দিয়েছবিটা এঁকেছে এঞ্জেলো সাহেব। কত চালাক ছিল বুঝতে পারছো?”

বিমূঢ়ের মত মাথা নাড়ালাম, “আমাকে মেরে ফেললেও জীবনে এইরকম কিছু আমার মাথা দিয়ে বের হবে না! লোকটা আদৌ মানুষ ছিল নাকি দেবতা?”

“কি ছিল জানি না” ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল, “তবে আসলে এঞ্জেলোর চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না এটা পরিষ্কার।”

রাকিব বাকি পেইন্টিং গুলোর দিকে তাকালো, “বাকিগুলোও ফেলে না রেখে দেখা উচিত। ক্যাথেড্রালটা বোধহয় বড় কোনো বন্যায় ডুবেছিল। এখানে তো বৃষ্টি হলেইপাহাড় ধ্বসে।”

আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে বাকি পেইন্টিংগুলোও মোছা শুরু করে দিলাম। আমার দেখা দেখি রাকিবও শুরু করল। মাহিনও বসসে থাকল না। মোছার সঙ্গেসঙ্গে ছবিগুলো নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিল। কাজ এগুতে লাগল দ্রুত। সর্বমোট ১৯টা পেইন্টিং। ঘন্টাখানেকের মধ্যে মাহিন ঘোষনা দিল এই উনিশটা ছবিতেতিনটা করে মোট সাতান্নটা ছবি এঁকেছেন দ্বিতীয় এঞ্জেলো সাহেব। তারমধ্যে উনিশটা হল বাইবেলের Great Flood এর কিছু দৃশ্য। বাকি আটত্রিশটা ছবি হল এইক্যাথেড্রাল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দৃশ্য! পাশাপাশিভাবে এই আটত্রিশটা ছবিকে সাজালে যা দাঁড়ায় তার সারাংশ হলঃ

প্রবল বর্ষনের কারণে খ্রিষ্টের মূর্তিটার নিচ থেকে ফোয়ারার মত পানি উঠত। পানিতে ডুবে যায় চত্বরটা। দ্রুত ক্যাথেড্রালের চারপাশ ডুবে যেতে থাকে। পাহাড়ধ্বস শুরু হয়। একে একে সব ভবন মাটি চাপা পরতে থাকে। রাতের অন্ধকারে কোনো বিশাল শূড়ওয়ালা প্রাণী ক্যাথেড্রালটাকে গ্রাস করে মাটির নিচে হারিয়ে যায়।পাহাড় ধ্বসে পড়ে ক্যাথেড্রালের ওপর। চিরতরে হারিয়ে যায় এই ক্যাথেড্রাল।

আমি অবাক হয়ে মাহিনের দিকে তাকালাম, “এই ছবিগুলো ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে এঁকেছিল নাকি এঞ্জেলো? আসলেও তো তাই ঘটেছে। যদিও শূঁড়গুলোর কোনোব্যখ্যা পাচ্ছি না। কিন্তু পাহাড় ধ্বসের কারণেই তো এটা ডুবে গেছে। এতসব ভবিষ্যদ্বাণী করল কি করে?”

মাহিন দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ছবিগুলোর দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “এগুলো কোনোটাই ভবিষ্যদ্বাণী না রবি……..দ্বিতীয় এঞ্জেলো খুব কাছ থেকেএই ঘটনাগুলো দেখেছিলেন। তারপর এঁকেছেন। সাল আর তারিখ দেখলেই বোঝা যায়। ক্যাথেড্রাল ধ্বংস হয়েছিল ১৮৩২ জুলাই, মোট উনিশ দিনে আটত্রিশ ধাপে।আর শিল্পী মারা গিয়েছিলেন ১৮৩২ নভেম্বর। কবরের গায়ে লেখা।” আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো, “ক্যাথেড্রাল মাটি চাপা পরার পরও উনি এর ভেতরেইছিলেন! একা একা এই ছবিগুলো এঁকেছিলেন! মৃত্যু্র পূর্ব মুহূর্তে নিজের জন্য বানিয়ে রাখা কবরে ঢুকে পড়ে ওপরের পাথরটা টেনে দিয়েছিলেন! কিংবা হয়তকবরটাতে ঢোকার সময় পাননি, তার আগেই মারা গিয়েছিলেন। পাথরের ফলকে এমনি আন্দাজে লিখে রেখেছিলেন নভেম্বরে মারা যাবেন।”

“এটা কি তুমি জেনে বলছো? নাকি আন্দাজে?”

“অনুমান। যুক্তি মিলিয়ে অনুমান করছি। এর থেকে ভাল কোনো ব্যখ্যা আপাতত আমার কাছে নেই। প্রফেসর সাহেবকে দেখালে হয়ত উনি আরো ভালোকোনো যুক্তি দিতে পারবেন।” ক্লান্ত গলায় বলল।

আমি ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে। বিশাল বিশাল শূড়গুলোর ওপর চোখ আটকে যাচ্ছে বার বার…….কি প্রাণী এটা?

top

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!