►ক্যাথেড্রাল – চতুর্থ পর্ব◄

প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিলো সবারই। ক্যাথেড্রালের মূল ফটকের সেই নৌকা ভেড়ানো ঘাটে যখন এলাম তখন বিকেল তিনটা বাজে। ভেতরে থাকা অবস্থায় বোঝাযায়নি- বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। সামনের লেকের পানিতে ঝমঝমিয়ে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামছে। নৌকাটা সিঁড়ির কাছে বাঁধা।

রাকিব চিন্তিত গলায় বলল- “বৃষ্টি শুরু হয়ে তো সমস্যা করে ফেলল! এমনিতেই পাহাড়ী এলাকা, ড্রেনেজ সিস্টেম জঘন্য। একটু বৃষ্টি হলেই চারপাশের যত পানিএসে এই লেকে জমা শুরু হয়। পানি বাড়তে থাকলে তো ঝামেলা হয়ে যাবে।”

মাহিন বোধহয় বুঝতে পারেনি কথাটা। অবাক হয়ে বলল, “মানে? কি ঝামেলা হবে?”

ফিরে তাকালো রাকিব, “আগে লেকে এত পানি ছিল না। সামনে লেকের নিচের মূর্তিগুলো ওপর দিকে বেড়িয়েছিল । গত দু’সপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে লেকের পানিবেড়েছে । চারপাশের উঁচু পাহাড়গুলো থেকে পানি গড়িয়ে এসে লেকে জমা হয়েছে । ফলে মূর্তিগুলো পানির নিচে চলে গেছে । এই হারে বৃষ্টি চলতে থাকলেক্যাথেড্রালের ফটকের মুখটাও পানির নিচে চলে যাবে। এই সিঁড়িগুলো কিন্তু আগে ওপরেই ছিল। এখন পানি উঠেছে।”

মাহিন ব্যাপারটা বোঝার সাথে সাথে চিন্তিত হয়ে পড়ল, “ভেতরে পানি ঢুকলে তো সমস্যা ! রিসার্চের কাজ তো আটকে যাবে! তাছাড়া অনেক জিনিস নষ্ট হয়েযেতে পারে।”

রাকিব এক মুহূর্ত লেকের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোদের থেকে যেতে হবে আজকে। যাওয়ার সময় নেই হাতে। বৃষ্টি কখন থামে ঠিক নেই। চাচ্ছিলাম তোরা থেকে একটু দেখলি সব?” আমার দিকে ফিরল, “মিডিয়া থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রাখার ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন লাগছে। তাই তুই থাকলে ভাল হত।”

আমি কিছু বললাম না। কেবল মাথা ঝাকালাম।

প্রফেসর নারায়ণ পকেট ডায়েরীতে কিছু লিখছিলেন একটা মোটা পিলারের গায়ে হেলান দিয়ে। সেদিকে তাকিয়েই আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মেজর সাহেব,পানি আটকাবার কোনো ব্যবস্থা বাতলাতে পারবেন? যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে আর আবহাওয়া বার্তার কথা মতে আগামী পাঁচ ছ’দিন এরকম ভারি বৃষ্টি চলবে। ভেতরেরিসার্চের কাজ চালাতে হবে তখন ইঁদুর চোবানি খেতে খেতে।”

আমি তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম, “কি করতে হবে আমাকে?”

ডায়েরীর পাতা থেকে মুখ তুললেন তিনি, চোখে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি, “সেটা আমার থেকে তুমি ভালো বলতে পারবে। নদীর গতিপথ যদি কৃত্রিম ভাবে পালটানো যেতেপারে-বদ্ধ লেকের পানি নয় কেন?” চোখ মটকালেন।

আমি দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে একটা হাসি ফুটল, “আপনি যে একটা জিনিয়াস সেটা দেখে কেউ বলতে পারবেনা!”

বৃষ্টির কারণে লেকের অন্যপাশের ক্যাম্পে যাওয়া যাচ্ছে না। তাই খিদের চোটে সবার অবস্থাই খারাপ । রাকিব বার বার ঘড়ি দেখছে। সন্ধ্যা নেমে গেলে সমস্যায়পড়তে হবে। বাসায় যাওয়াটা তখন অনেক কঠিন হয়ে যাবে । বিশেষ করে মাহিনের এ অবস্থায় বাংলোতে ফেরাটা কঠিন। ফটকের চত্বরে পায়চারি করছে রাকিবঅনেকক্ষণ হল। মাহিন সিঁড়িতে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে রয়েছে। ওর পাশে ইভা। চিন্তিত ভঙ্গিতে কথা বলছে দু’জন। ড. আবু তালেব একটা ভাঙ্গা পাথরের বেঞ্চেবসে বিরক্ত মুখে বৃষ্টি দেখছেন। কেবল প্রোফেসর সাহেব কে খুব একটা বিচলিত মনে হল না। ডায়েরি খুলে কিসব হিসাব কষে যাচ্ছেন। লিখছেন এক নাগারে। খুবব্যস্ত। আমি ঘাঁটালাম না তাকে। রাকিবকে কেবল বললাম, “তোর এই পুরো সার্কেল ভ্যালির একটা নিখুঁত ম্যাপ দিস আমাকে। একটা ছোট পাহাড়ি ছড়া কাটতেহবে লেকের পানির ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক করতে।”

সিগারেট ধরালো, “দেয়া যাবে। আগেতো ক্যাম্পে যাই। ক্যাম্পের লোকগুলোর কাছে ছাতা নেই। নাহলে একটা ব্যবস্থা করে ফেলা যেত।”

আমি প্রবল বৃষ্টির মাঝ দিয়ে খ্রিষ্টের মূর্তিটার হাতের নিচ দিয়ে অন্য পাড়ের ক্যাম্পের দিকে তাকালাম। দুই মাইল দূরে। এত দূর থেকে বোঝাও যাচ্ছে না ঠিকমতঅন্যপাশে ক্যাম্প আছে কি নেই। বৃষ্টির কারণে ধোঁয়াটে হয়ে আছে সব।

এর মাঝেই শব্দ করে ক্যাথেড্রালের একপাশের পাহাড়ের বিশাল অংশের মাটি ধ্বসে পড়ল লেকের পানিতে। আমি চমকে উঠলেও রাকিব খুব একটা চমকালো না ।সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, “বৃষ্টির কারণে ক্যাথেড্রালের বাহিরের মাটির আলগা আস্তরণ খসে পড়ছে! মানে পাহাড়ে ভাঙ্গন ধরেছে!”

আমি খুব অবাক হলাম । ডান দিকে গলা বাড়িয়ে তাকালাম। আসলেই। ক্যাথেড্রালের দ্বিতীয় তলার বারান্দাটা বেরিয়ে এসেছে পাহাড় ভেঙ্গে পড়ায়!

মাহিন সিঁড়ি থেকে উঠে এল শুকনো মুখে। আমি এক নজর তাকিয়ে বুঝলাম কিছু বলতে চাচ্ছে। গলা নামিয়ে বললাম, “কোনো প্রবলেম?”

মাহিন এদিক সেদিক তাকিয়ে দ্বিধান্বিত গলায় বলল, “রাতটা বোধহয় এখানেই থেকে যেতে হবে আজ রবি।”

“সেরকমই তো মনে হচ্ছে আমারও।” অন্যদিকে তাকালাম । “এলাম ছুটি কাটাতে- আর তুমি কিনা পুরাত্বত্ত নিয়ে বসে পড়েছো!”

মাহিন অনুযোগের সুরে বলল, “এরকম করো কেন? একটু শখ করে সার্ভের কাজ করলে দোষ কি? কত নতুন কিছু শিখতে পারছি।”

“হুম বুঝলাম।” মাথা ঝাঁকালাম, “তারমানে রাতে থেকে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছো?”

“হ্যা……” একটু সংকোচ করলো যেন,গলা নামিয়ে বলল, “কিন্তু একটা প্রবলেম হয়ে গেল যে রবি।”

“কি প্রবলেম?” মাথা ঝুঁকিয়ে আনলাম ওর কাছে ।

“ইয়ে………বোঝইতো! এই টাইট জিন্স পরে রাত কাটানো আমার দ্বারা সম্ভব না!” আড়চোখে অন্যদের দিকে তাকালো ।

“অ! এক্সট্রা কাপড়ের যখন দরকারই পড়বে সাথে নিয়ে আসতে পারোনা? টাইট জিন্স ছাড়া থাকা যায় না?”

“চুপ করো তো! সবার সামনে…..!” লজ্জা পেল। “রাতে জিন্স পড়ে ঘুমাতে পারব না। ছোটো ব্যাগটায় নাইটি আছে”।

হাসলাম আমি, “চিন্তা করোনা। আমি গিয়ে তোমার ছোট ব্যাগটা নিয়ে আসছি। ঘন্টাখানেক লাগবে”। নৌকাটার দিকে পা বাড়াতেই রাকিব অবাক গলায় বলল, “এই বৃষ্টির মাঝে নৌকা নিয়ে কই যাবি?”

“একটু দরকার আছে। বাংলোয় যেতে হবে । তোর কোনো গার্ডকে বললে গাড়িতে করে পৌঁছে দিতে পারবে না?” নৌকায় বসে দাঁড় তুলে নিলাম।

“দিবে না কেন? কিন্তু ভিজে যাবি তো!”

“আরে রাখ! আর্মিতে ড্রেনে গোসল করে করে দিন পার করেছি! এটাতো শাওয়ার!” নৌকা দিয়ে লেকের তুমুল বৃষ্টির মাঝে বেরিয়ে এলাম। অদ্ভুত! যেন অন্যকোনো জগতে প্রবেশ করেছি! চারপাশে কেবল বৃষ্টির পানির আছড়ে পড়ার শব্দ! গায়ে হুল ফোঁটাচ্ছে সূচের মত বৃষ্টির কণাগুলো। ভালো লাগছে ভীষণ! যিশুরক্রুসবিদ্ধ মূর্তিটা পাশ কাটানোর সময় খেয়াল করলাম মুর্তিটার চারপাশে একহাত জুড়ে জায়গা দিয়ে পানি উঠছে! যেন নিচে কোনো পানির উৎস আছে! পানি উঠছেবেশ জোরেই। অবাক হলাম। রাকিব কিংবা প্রফেসর নারায়ণ দেখেছেন এটা?

গাড়িতে করে বাংলোয় আসার পথে গাড়ির ড্রাইভার মিজানের সঙ্গে অনেক কথা হল। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে।বৃষতি থামার নাম নেই। ক্যাথেড্রালের সামনেরক্যাম্পে গিয়ে তখন বলে এসেছিলাম খাবার পাঠিয়ে দিতে রাকিবদের কাছে। পারলে যেন ওদেরকে নিয়ে আসে।এত বড় ক্যাম্পে কোথাও ছাতা নেই দেখে খুব বিরক্তহয়েছিলাম। যেখানে টানা দুই সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হচ্ছে সেখানে ছাতা থাকবেনা-এ কেমন কথা? তাঁবু থাকলে আর রেইনকোট থাকলেই হল? এখানে গিয়ে তো আরধমক দেয়া সম্ভব না, কেউ অফিস স্টাফ না আমার-তাই নরম গলায় অনুরোধ করে এলাম রেইনকোট পাঠিয়ে দেয় যেন মাহিনদের।এর বেসি আর কি করতেপারি? আমি নিজেও একতা রেইনকোট চেয়ে নিয়ে এসেছি। একমাইল খাড়া পাহাড় বৃষ্টিতে ভিজে বাইতে গেলে নিউমোনিয়া ধরে যাবে!

গাড়িতে করে আসার সময় হঠাৎ মনে পড়ল ড. এজাজ আহমেদ নামে কেউ খুন হয়েছে ক্যাথেড্রালের ওখানে। যখন গিয়েছিলাম তখনও পুলিশ দেখেছি- অথচএকবারও ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করার কথা মাথায় আসেনি আমার কিংবা মাহিনের। ক্যাথেড্রাল দেখে এতই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে খুনের কথা বেমালুম ভুলেগিয়েছিলাম! ড্রাইভারের নেমট্যাগে লেখা “মিজান।” পাশপাশি বসেছিল দু’জন।

“মিজান সাহেব”।

“জী স্যার?” রাস্তার উপর চোখ রেখে বলল।

“শুনলাম ড. এজাজ আহমেদ নামে কেউ একজন খুন হয়েছিল ক্যাথেড্রালে? ব্যপারটা কি বলেন তো?”

“উনি প্রথম আর্কিওলোজিষ্ট হিসেবে এখানে এসেছিলেন। দু সপ্তাহ আগের কথা। তখনও ড. তালেবের টিম এখানে আসেনি। একদিন রাতে ক্যাথেড্রালের ভেতরে গিয়েছিলেন একা একা। কাউকে কিছু বলে যাননি। পরদিন সকাল থেকেই উনি লাপাত্তা। অনেক খোঁজা খুঁজির পর ওনার লাশ পাওয়া গেল মাটির নিচের বড় সমাধী কক্ষটায়। পানিতে ভাসছিল লাশটা উপুর হয়ে। পিঠে ছয়টা পুরনো আমলের জং ধরা চাকু ঢুকে ছিল খাড়া ভাবে।” একটু থামল।

“খুন? নাকি দূর্ঘটনা? এসব জায়গায় তো বুবি ট্র্যাপ জাতীয় জিনিস থাকে খুব।”

হাসল সে, “নাহ, বুবি ট্র্যাপ জাতীয় কিছু না। প্রোফেসর সাহেব প্রথম দিন ঘুরেই বলে দিয়েছিলেন এটা নিখাঁদ একটা ক্যাথেড্রাল, গুপ্তধনের কিছু নেই যে বুবি ট্র্যাপ থাকবে। ড. এজাজের ব্যাপারটা আসলেই খুন। কে বা কারা করেছে এটা অবশ্য জানতে পারিনি। ছুরির হাতলে হাতের ছাপ ছিল না।”

আমি ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললাম, “ড. তালেবের টিম খুনের পর এসেছিল?”

“টিম পরে এসেছিল। কিন্তু ড. তালেব এক দম শুরু থেকেই ছিলেন এখানে। ওপর মহলে অনেক প্রভাব ওনার।”

“কিভাবে বুঝলেন?”

“খুনের পর উনি ব্যাপারটাকে ব্লাষ্ট হতে দেননি। যদি বাহিরের দেশ এই ক্যাথেড্রাল সম্পর্কে খোঁজ পেয়ে যায়, তাই। মিডিয়াকেও থামিয়ে রেখেছেন। ফোন করে ইচ্ছা মত লোক আনাচ্ছেন আমাদের ফাঁড়ি থেকে।”

আমি বাহিরের অন্ধকারের মাঝ দিয়ে আবছা পাহাড় গুলোর দিকে তাকালাম। আপন মনেই বিড়বিড় করে বললাম, “ড. তালেবকে তো সুবিধার লোক মনে হয়নি এক বারও। ড. এজাজকে আবার খুন টুন করে বসেননি তো? ক্রেডিট অনেক বড় শব্দ। বইয়ের পাতায় নিজের নাম দেখতে অনেকেই ভালবাসে, পাগল থাকে এক রকম!”

দাঁত বের করে হাসল মিজান, “শুধু আপনি না, ক্যাম্পের সবারই তাই ধারণা। কিন্তু সাহস করে কেউ বলে না। প্রোফেসর সাহেব তো এজন্যই ড. তালেবকে সহ্য করতে পারেন না। বোধ হয় উনিও তাই ভাবেন।”

“আচ্ছা প্রোফেসর সাহেব কবে এসেছিলেন এখানে?” বাহিরে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বললাম।

“ড. এজাজ খুন হবার দুই দিন আগে। খুব ভাল বন্ধু ওনারা। তারাই তো এক সাথে মিলে মাটির নিচের সমাধীটা বের করেছেন। প্রোফেসর সাহেব ঝানু মানুষ, আসার সঙ্গে সঙ্গে সমাধীটা বের করে ফেলেছেন।”

“ও……. ড. তালেবের টিমে নাকি কাজ করেন প্রোফেসর সাহেব?”

“হ্যা। মানে টাকা দেয় ড. তালেব। কিন্তু কাজ সব করেন প্রোফেসর সাহেবই। আমার তো মনে হয় সারা জীবন প্রোফেসরকে ঠকিয়ে খেয়ে এসেছে ড. তালেব।”

আমি আর কোনো কথা বললাম না। রাকিবের কথা বলে ক্যাম্প থেকে পুর সার্কেল ভ্যালির একটা ম্যাপ নিয়ে এসেছি। কৃত্রিম একটা নালা বানাতে হবে। দিনের বেলা জায়গাটা ঘুরে দেখতে হবে। নয়তো শুধু ম্যাপ দেখে বোঝা সম্ভব না। জানালার কাঁচ তুলে দিয়ে হেলান দিলাম সিটে। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে।

বাংলোয় পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বেজে গেল। আমি মিজানকে অপেক্ষা করতে বলে দৌড়ে গেষ্ট রূমে গিয়ে মাহিনের ছোট ব্যাগটা নিয়ে নিলাম। খুব খিদে পেয়েছিল। আসগরকে বলতেই চট করে দুটো ডিম ওমলেট করে দিল। পাউরুটি দিয়ে খেয়ে নিলাম। মিজানকে খেতে ডাকলাম এর মাঝে একবার। খাবে না, খেয়ে বেরিয়েছে।

রাকিবের বিশাল কালো কুকুরটা মালিককে না দেখে আমার চারপাশে ঘুর ঘুর করছিল যখন খাচ্ছিলাম। আসগর জিজ্ঞেস করল, “বড় সাব আসবেন না আজকে?”

“নাহ। কাজে আটকে গেছে।”

“তাইলে কুকুরটারেও নিয়া যান। মালিক ছাড়া কিছু খায় না। সকাল থেকে না খেয়ে আছে। সাবকে দেখলে হয়ত কিছু খাবে।”

আড় চোখে বিশালদেহী কুকুরটার দিকে তাকালাম। কুকুর টুকুর আমার এমনিতেই অপছন্দ। আর সেটা যদি হয় এরকম দানবীয় কুকুর তাহলে তো কথাই নেই। অস্বস্তি ভরা গলায় বললাম, “কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করলেই তো পারো। গাড়িতে করে এত দূর পথ নিয়ে যাবো এটাকে? চিল্লা ফাল্লা করে তো মাথা ঘোল করে দেবে।”

“চিল্লাবে না সাব। পোষা কুকুর। চুপচাপ থাকবে। চেন বাধে দিবো। আপনি নিয়া যাবেন। না খায়ে আছে তো। মায়া লাগে।”

আমি কুকুরটার দিকে তাকালাম। পেছনের দুই পা ভাজ করে বসে আছে। মনোযোগ দিয়ে আমার খাওয়া দেখছে। চোখে মুখে কৌতুহল। হিংস্র বলে মনে হল না। সামনের দুই থাবায় থুত্নি রেখে শুয়ে পড়ল।

আমি শুঁকনো মুখে বললাম, “ঠিক আছে। চেন দিয়ে ভাল করে বেধে দাও। আমি খেয়ে এখনই বেরুবো।”

ফেরার পথ পুরো রাস্তা আমি প্রায় সামনের দিকে ঝুকে থাকলাম। কারণ কুকুরটাকে জিপের পেছনে তোলা হলেও বেটা একদম আমার ঘাড়ের কাছে মুখ এনে রেখেছে! যেন মিজানের কাছ থেকে ড্রাইভিং শিখবে! জিহ্বাটা ঝুলিয়ে রেখে আমার সিটার মাথার কাছেই- কি জঘন্য!

অন্ধকারের জন্য দেখা না গেলেও বুঝতে পারলাম মিজান আমার কুকুর ভীতি দেখে হাসছে নিঃশ্বব্দে। আমি আর কি করবো- বাঘ, ভালুক, সাপ-খোঁপে আমার ভয় নেই। কিন্তু সৃষ্টি জগতে এই কুকুর জিনিসটাকেই আমার যত ভায়!

এক মাইলের মত সেই পাহাড়ী পথ পুরোটাই কুকুরটাকে সামলালো মিজান। আমি দূরে দূরে রইলাম। চারপাশে ঘুট ঘুটে অন্ধকার। দুজনের হাতেই টর্চ। কুকুরটা জিহবা দুলিয়ে আগে আগে হাটছে। কাঠ বেড়ালি কিংবা পাহাড়ী ইঁদুর দেখলেই ‘হুফ হুফ’ করে ধমক দিচ্ছে, সাথে সাথে পালাচ্ছে ওগুলো। তখন মাথা ঘুরিয়ে বীরের মত তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমি তখন অন্য দিকে তাকাই।

বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু কুয়াশার থেকে একটু ভারী মিহি ধরণের কুয়াশা বৃষ্টি হচ্ছ। রেন কোট থেকে মাথা বের করলেই চুল ভিজে যাচ্ছে। টর্চের আলোতে দেখতে পাচ্ছি কুকুরটার কালো শরীরটাও ভিজে চকচক করছে। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকা আর গিরগিটিদের ডাক। তার বাহিরে অখন্ড নিস্তব্ধতা।

ক্যাম্পে মাহিনদের কাছে যখন পৌছালাম তখন বাজে নয়টার মত। লেকের তীরে ক্যাম্প ফায়ার জ্বালিয়েছে কয়েকটা। দূর থেকে দেখলে কেমন পিকনিক- বার্বিকিউ মনে হয়।

আজ রাতে নতুন অতিথিদের জন্য আরো দুটো তাবু বানানো হয়েছে দেখলাম। দূরে অন্ধকারের মাঝে ক্যাথেড্রালটা প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। তবে জেনারেটরের ম্লান হলুদ বাল্ভ গুলোর কারণে সেটার আবছা অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে। মাহিনরা এপাশে ক্যাম্পে চলে এসেছে। আর একটু আগে বাইশজন অস্ত্রধারি গার্ডকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ক্যাথেড্রালের পাহারার জন্য। রেডিওতে প্রতি আধ ঘন্টা পরপর যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। বড় সার্চ লাইট জ্বলছে পাহাড় গুলোর ওপর থেকে। সারা জঙ্গলময় ছুটে বেড়াচ্ছে সেই আলো। লেকের ওপরের যিশুর মূর্তির ওপর সার্চ লাইটের আলো পরলেই অদ্ভূত একটা গা গা শিরশিরে অনুভূতি হয়। যিশুর ক্রুশ বিদ্ধ অনেক মূর্তি দেখেছি। কিন্তু এটা কেমন যেন অন্য রকম। সামনের দিকে গলা বাড়িয়ে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছেন! যেন এখনই ক্রুশ থেকে হাত খুলে ঝাঁপিয়ে পরবেন সামনের অদৃশ্য প্রতিপক্ষের ওপর। সার্চ লাইটের আল ওপর থেকে পরার কারণেই সেটা আরো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ভ্রুঁ কুঁঞ্চিত করে রেখেছেন যিশু। দুই ঠোঁটে চাপা ক্রোধ। চোখের লাল পাথর গুলো জ্বলছে আলো পরে। অন্য ভূবনের কেউ মনে হয় যেন!

আমি ক্যাম্পে এসে মাহিনকে খুঁজলাম এদিক সেদিক তাকিয়ে। দূরে একটা পাথরের ওপর পা ঝুলিয়ে একা একা বসে আছে, টর্চ জ্বালিয়ে নিজের ডায়েরীতে কিছু লিখছে আর ইভার সেই ক্যামেরাটার মনিটরে বারবার কি যেন দেখছে। ওর আশে পাশে কেউ নেই। কেবল ক্যাম্প ফায়ারের আগুণ জ্বলছে সামনে। কাছাকাছি যাওয়ার পর দেখলাম পাশেই একতা বড় কফির মগ রাখা। কফি খাচ্ছে একটু পর পর। গভীর মনোযোগের সাথে ডায়েরী লিখছে। আমি যে এসেছি খেয়াল করেনি একদম।

মৃদু কাঁশলাম।

ডায়েরী থেকে চোখ তুলে তাকাল এক নজর আমার দিকে। আবার লেখতে থাকল, “কখন আসলে?”

“এই তো, পাঁচ মিনিট হল।” ওর কফির মগটা হাতে নিয়ে সেখানে বসে পরলাম।

“আমার ব্যাগ এনেছো?”

“হ্যা।” পায়ের কাছে ফেলে রাখা ব্যাগটা দেখালাম, “কি লেখো?”

“এই তো ক্যাথেড্রালের কোথায় কি আছে সেটা।” ইভার ক্যামেরাটার মনিটরে সেই হল রূমের মূর্তি গুলোর ছবি দেখছে এক এক করে।

“খেয়েছো? নাকি কফি দিয়েই চলছে কাজ?”

“হু। খেয়েছি। তুমি?”

“আমি হাল্কা খেয়ে এসেছি। এখানে খেতে হবে। কি দিয়ে খেলে?” আড় মোড়া ভাঙ্গার মত করলাম হাত পা সোজা করে।

“নাস্তা করেছি শুধু। রাতের খাবার খাইনি। তোমার সঙ্গে খাব।” ডায়েরিতে লিখেই যাচ্ছে।

“বাহ! একেবারে স্বামী ভক্ত স্ত্রী! স্বামীকে ছাড়া খাওয়া যায় না! আহা!” হাসলাম। দূরে তাকালাম রাকিবের কুকুরটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুখে একটা বড় সড় হাড্ডি। ভাল জায়গা খুঁজছে বসে খাওয়ার জন্য। এদিকে না এলিই বাঁচি।

মাহিনের দিকে তাকালাম আবার। ক্যাম্প ফায়ারের লালচে আলোতে অদ্ভূত সুন্দর লাগছে ওকে। এক গোছা চুল এসে পরেছে মুখের ওপর, না সরিয়ে লিখে যাচ্ছে। চোখে গাবদা গোবদা একটা চশমা। লেখা লেখির সময় ছাড়া কখনো পরে না এটা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম বোধ হয়, মাহিন মুখ তুলে তাকাতেই চোখা চোখি হল। চশমার ওপাশের চোখ দুটোটে হাসি ফুটল, “কি? ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছো কেনো?”

“তোমাকে দেখি।”

“আমাকে দেখার কি হল? ঘরের বৌকে মানুষ তো ফিরেও দেখে না।” হাসল।

“আমি তো ঘার ঘুড়িয়ে নাইন্টি ডিগ্রী এঙ্গেলে তোমার দিকে তাকিয়ে আছি। তুমি কি আমার বৌ না?” গম্ভীর গলায় বললাম।

“ও! তাই নাকি! এই এক বছরেও তাহলে পুরনো হইনি।” চশমার ওপর দিয়ে ভ্রুঁ নাঁচাতে গিয়ে হেসে ফেলল।

“বিয়ের সময় শ্বশুড় মহাশয় তো এক্সপেয়ার ডেট জাতীয় কোনো সিল টিল দেয়নি। দিলে বোঝা যেত।”

ডায়েরীটা খটাস করে বন্ধ করে বলল, “এই চুপ! সব সময় অসভ্য সব কথা বার্তা!”

উদাস গলায় বললাম, “আমি যা-ই বলি সবই তো তোমার কাছে অসভ্য কথা বার্তা! বিয়ের সময় ভাগ্যিস দুই ঘর এই পাশে আমি কবুল বলেছিলাম। নাহলে সেখানেও বলে বসতে ‘এই চুপ! অসভ্য কথা বার্তা বলবে না’!”

খপ করে মাহিন আমার রেন কোটের কলার চেপে ধরল দুই হাতে। ক্যাম ফায়ারের আগুণে দেখতে পেলাম অদ্ভূত একটা দৃষ্টি ফুটে উঠেছে ওর চোখের তাঁরায়, ঠোঁটের কোনে রহস্যময় একটা হাসি। কলার টেনে ওর কাছে নিয়ে এল আমাকে, ফিসফিস করে বলল, “অসভ্য ছেলে! আর্মিতে এসব শিখেছো?”

“আই.এস.এস.বি. তে অসভ্যরাই চান্স পায়। তোমার গর্ব করা উচিত।” ওর চশমাটা খুলে নিলাম। “এত হাই ভোল্টেজের চোখ তোমার- দুনিয়ার সব ছেলে এক দৃষ্টিবাণেই কাত হয়ে যাবে, চশমা পরে থেকো ওদের সামনে। আমার সামনে না পরলেও চলবে।”

“কেন? তোমাকে কাত করার জন্য?” আরো কাছে এল।

“সে তো কবেই হয়েছি। চার্জের জন্য। তোমার চোখে তাকালে মনে হয় কয়েক কিলোওয়াট চার্জ হয়ে গেছে শরীরে! আগামি দশ দিন হাইকিং করেও শেষ হবে না।”

“ও! তাই বুঝি?” ঝুঁকে এসে আমার ডান কান কামড়ে দিল, ফিসফিস করে বলল, “লাবু কলম্বাসের আব্বু!”

আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম, ওর গাঢ় নিঃশ্বাস টের পাচ্ছি আমার ঠোঁটের ওপর। বিড়বিড় করে বললাম, “যে হারে কান কামড়া কামড়ি করো- তোমার কলম্বাস বাবাজী দুনিয়ায় এসেও মনে হয় আমার কানের পেছনে পরবে!”

হেসে ফেলল মাহিন। প্রথমে ভাবলাম আমার কথা শুনে হেসেছে। কিন্তু ও আমার মাথার পেছনের চুল খামচে ধরে বামে ঘুরিয়ে ক্যাম্প ফায়ারের দিকে ফেরাল, “দেখো কান্ড!” হাসি চেপে বলল ও।

তাকিয়ে দেখি ক্যাম্প ফায়ারের কমে আসা আগুণের কাছে গিয়ে পেছনের পা উঁচিয়ে ছট কাজ করছে রাকিবের কুকুরটা! মুখে হাড্ডি। আগুণ হয়তো আরো অনেক পরে নিভত, কিন্তু জল বর্ষণের কারণে সেটা এখনি নিভে গেল! লেজ নাড়াতে নাড়াতে অন্য দিকে চলে গেল কুকুর মহাশয়। অন্ধকার হয়ে গেল আমাদের এ পাশটা। আমি গম্ভীর গলায় বললাম, “বাহ! কুকুর সাহেবের তো জ্ঞান বুদ্ধি অনেক! আরো দুটো হাড্ডি পাওয়া উচিত! এত দিন জানতাম খুঁটি ছাড়া এনাদের কাজ কর্ম হয় না, এই প্রথম দেখছি অগ্নি কুন্ডে এ কাজ করতে! সাহসী কুকুর! কুকুরদের মিলিটারিটে ঢুকলে এতদিনে জেনারেল হয়ে এত!”

মাহিন ফিক করে হেসে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুরে ওকে শক্ত করে চেপে ধরলাম। মাহিন ভয় পাওয়া গলায় বলল, “ক-কি! ছাড়ো তো! অসভ্য!” দূর্বল হয়ে এসেছে কন্ঠটা…..

ওর কাঁপা নিঃশ্বাস টের পাচ্ছি। ফিসফিস করে বলল, “পাজি কোথাকার……” শেষ করতে পারল না কথাটা।

সে রাতে আমি আর মাহিন নিভে যাওয়া ক্যাম্প ফায়ারের ওখান থেকে যখন মূল ক্যাম্পের দিকে চলে আসছিলাম তখন হঠাৎ মনে হল আমাদের পেছন দিয়ে কেউ পা হেঁচড়ে চলে গেল! মাহিন টের পায়নি। আমি অবাক হয়ে পেছনে তাকালাম। সেই পাথরটার পাশের গাছ দুটোর ডাল নড়ছে। পাখি টাখি বসেছিল নাকি? কিন্তু এই এলাকায় তো পাখি দেখলাম না একতাও। পা হেঁচড়ে হাটলো কে?

“কি হল? দাঁড়ালে যে?” মাহিন হাত ধরে টানল, “চল না, খিদে পেয়েছে তো!”

“হু, চল।” হাটতে লাগলাম। খেয়াল করলাম পেছন আবারও পা হেঁচড়ে হাটার শব্দ হল আর পানির শব্দ পেলাম, অনেকটা ঝপ করে পরার মত শব্দ।

ঝট করে পেছনে ঘুরলাম। দূর থেকে আসা ক্যাম্প ফায়ারের ম্লান আলতে মনে হল লেকের এই অংশের পানিতে হাল্কা ঢেউ। কিছু একটা নামলে যেমন বৃত্তাকার ঢেউ হয় তেমন।

মাহিনের দিকে ফিরতে যাবো হঠাৎ চোখ চলে গেল পাথরের পাশের গাছ গুলোর দিকে। ভ্রুঁ আপনা আপনি কুঁচকে গেল। একটা গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে! একটু আগেও তো দুটো গাছ দেখেছিলাম মনে হয়! নাকি চোখের ভূল? একটা গাছ-ই ছিল? চারপাশে এত বেশি জঙ্গল আর গাছপালা যে পাথরের পাশের গাছ “দুটো” বুঝতে ভূল হতেই পারে। হয়ত একটাই দেখেছি। অন্ধকারে দুটো লেগেছে। মাহিনকে নিয়ে চলে এলাম সবার কাছে। কিন্তু খুঁত খুঁত করতে লাগল মনটা। কোনো কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার এড়িয়ে গেছি কিংবা মিস করেছি মনে হচ্ছে বার বার।

top

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!