স্বপ্ন সবাই দেখে। বিটিভির কিছুদিন আগের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র ম্যাকগাইভারও দেখবে নিশ্চয়। দেখেও। ম্যাকগাইভারের স্বপ্নের সঙ্গে আমাদের স্বপ্নের পার্থক্য দুটো। প্রথমত আমাদের স্বপ্ন আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, অন্য কারো সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু ম্যাকগাইভারের স্বপ্ন দেখতে পারে সবাই। দ্বিতীয়ত দেখা যায় ম্যাকগাইভার স্বপ্নে যে অঞ্চলে বিচরণ করে তার একটি স্মারক ঘুম ভাঙ্গার পর ম্যাকের কাছে থেকে যায়।
পরপর দু’সপ্তাহে বিটিভিতে দেখানো Good night Macgyver নামের পর্বেও এমনটি দেখানো হয়েছে। শেষ পর্যায়ে, তন্দ্রা টুটে যাবার পর দেখা গেল ম্যাকগাইভারের পকেটে রয়েছে কিং আর্থারের উপহার যা ম্যাক পেয়েছে স্বপ্নে। ‘ম্যাকগাইভার’ সিরিজটি আর দশটি টিভি সিরিজের মতো ভায়োলেন্স ও গাঁজাখুরি গল্প বিন্যাসের নয়। এখানে দেখানো হয় বিজ্ঞানের ওপর দখল আছে এমন একজন যুবক তার সাহস ও সত্যনিষ্ঠা নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছে। সমগ্র সিরিজটিতে প্রাধান্য পেয়েছে বিজ্ঞানের নানাবিধ কৌশল ও তার প্রয়োগ। তাই, এ ধরনের একটি সিরিজে ম্যাকগাইভারের স্বপ্নভঙ্গের পরের অংশটুকু যা পুরোপুরি অযৌক্তিক ও বিজ্ঞান বিরোধী, কিভাবে স্থান পায় তা আমাদের বোধগম্য নয়। ম্যাকগাইভার যেহেতু এদেশে চলচ্চিত্রায়িত নয়, কাজেই এর সমালোচনা অনেকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু, আমাদের মতো একটি অশিক্সিত, অর্ধশিক্ষিত ও কুশিক্ষিতের দেশে পশ্চিমা চলচ্চিত্রের প্রভাব প্রশ্নাতীত। কুসংস্কার বিশ্বাসী, অলৌকিক ধ্যান ধারণার বাহক জনগণের একটি বিরাট অংশ এই ধরনের চলচ্চিত্র থেকে নিজেদের অযৌক্তিক আচরণের ব্যাখ্যা পেয়ে যায়। অথচ স্বপ্ন শেষের ঐ অংশটুকু বাদ দিলে ম্যাকগাইভারের স্বপ্নের সবটুকুই ব্যাখ্যাযোগ্য, বিজ্ঞানের আলোয়। আমাদের ঘুম দু’রকমের। প্রথমটিতে শরীর-বৃদ্ধির হরমোন বিকশিত হয়। আর দ্বিতীয়টিতে র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা আর ই এম হয়। এই সময়টিতে মানুষ স্বপ্ন দেখে। প্রতিদিন আমাদের মগজে গাদা-গাদা তথ্য জমা হয়। এই সব তথ্যই স্বপ্নের মধ্যে গুছানো হয়ে থাকে।
আবার কোনো কোনো স্বপ্নে ‘সমাধানের’ও কাজ চলে। তবে এই সমাধান আমাদের সচেতন মন নিয়ন্ত্রণ করে না, করে অবচেতন মন। অবচেতন মনের অস্ত্র হচ্ছে স্মৃতি, কল্পনা ও ধারণা এবং সে চিন্তাভাবনা করে বিভিন্ন গল্পকথা বা প্রতীকের সাহায্যে। অবচেতন মন নিজস্ব ভঙ্গিতে সমাধানের নানা চেষ্টা করে। এই কারণে স্বপ্নের মধ্যে বিচিত্র সব বিষয় এসে যায়। মানুষ যাকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে স্বপ্নে তাকে সেমত স্থান দেয়, আর যাকে ঘৃণা যাকে ঘৃণা করে, তাকে হয়তো মেরে ফেলে। ম্যাকগাইভারের সর্বশেষ স্বপ্নটির কথাই ধরা যাক। সেই স্বপ্নে পিটের কিং আর্থার হওয়া আর ম্যাকগাইভারের চিরশত্র“ ম্যাডক-এর ডানকান রূপে আবির্ভূত হওয়া দুটোই ম্যাকগাইভারের ধ্যান ধারণাই ফসল। একই সঙ্গে স্বপ্নে দেখানো চীনাদের শ’খানেক বছর আগে পশ্চিমাদের গান পাউডার আবিষ্কারের ঘটনা প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করার পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রকাশ মাত্র।
কিন্তু স্বপ্ন শেষে পাওয়া উপহারের বাস্তব অবস্থিতি ম্যাকগাইভার নির্মাতাদের অন্য উদ্দেশ্য-প্রণোদিত বলেই মনে হয়। প্রথম কারণটি ব্যবসায়িক। কারণ, এই ধরনের রহস্যময়তা আরোপ করা হলে চলচ্চিত্রের ব্যবসা ভাল হয়। দ্বিতীয় কারণটি দার্শনিক। ও যাদুবিদ্যার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের জয় দেখানো নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত থাকাটা সংগত নয়, প্রতিক্রিয়াশীলতা ও পুঁজির স্বার্থে। আর সে জন্য এই রহস্যময়তা ও অলৌকিকতার সৃষ্টি।