►ক্যাথেড্রাল – তৃতীয় পর্ব◄

পানি থেকে ফটকের চৌকাঠের মত জায়গাটায় উঠে এলাম আমরা। এখানে ইলেক্ট্রিক তার আর হলুদ বাল্ভ দেখা যাচ্ছে দেয়ালে। বোধ হয় জেনারেটর থেকে লাইন দেয়া। সার্ভে টিমের লোকেরাই বসিয়েছে। গার্ড লোকটা আমাদের পৌছে দিয়ে চলে গেল নৌকা নিয়ে। একবার ভাবলাম লোকটাকে থাকতে বলি। পরে আর বললাম না। দিনের বেলা কয়েক মিনিটে কি হবে এখানে? তাছাড়া রাকিব তো আসছেইএকটু পর। মাহিন ইভাকে নিয়ে হাটতে লাগল। ইভা আগেও এসেছে, তাই চিনবে ভাল। আমি দাঁড়িয়ে না থেকে ওদের পেছন পেছন হাটতে লাগলাম। দিনের আলোতেও ক্যাথেড্রালের সব জায়গা আবছা অন্ধকার। চারপাশে তীব্র শ্যাওলা আর শামুক পঁচা গন্ধ। গন্ধটা সহ্য করা যাচ্ছে না। মাহিন আর ইভা রুমাল বের করে নাকে দিল। আমি শ্যাওলা বাঁচিয়ে সাবধানে হাটছি। ফ্লোর অস্বাভাবিক পিচ্ছিল হয়ে আছে পানি আর শ্যাওলা মিলে।

মাহিন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ করিডোর ধরে ডানে হেটে গেলে মূল প্রার্থনা কক্ষ। সোজা গেলে দরবার হলটা পাওয়া যাওয়ার কথা।”

চারপাশে মাটি আর মাটি। দেয়াল গুলো সব ঢেকে আছে মাটি দিয়ে। সার্ভের লোকজন শাবুল দিয়ে খুঁড়ে মাটি সরিয়ে অনেকটা পরিষ্কার করেছে। দেয়ালের কারুকার্য চোখে পরছে আবছা ভাবে।

আমি মাহিনের পেছন পেছন হাটতে লাগলাম। রাকিবের কথা মত ভেতরের ছাদ জুড়ে এঞ্জেলোর Sistine chapel celling  থাকার কথা। মাহিন সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। কারণ করিডোরের এখান সেখান থেকে বেরিয়ে থাকা জঙ্গলের মাঝ দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে এলো বিরাট একটা দরজার কাছে। ফেলে আসা করিডোরটার দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে সুড়ঙ্গ! পাহাড়ের ভেতর কেটে কেটে করিডোরটা বের করেছে সার্ভের লোকেরা। কিন্তু সুড়ঙ্গের মত হয়ে আছে। আলো বাতাস আসার জায়গা নেই। ইভা বড় একটা টর্চ নিয়ে এসেছে।ওটা জ্বালালো। সামনে দরজার ওপাশে ঘুট ঘুটে অন্ধকার।

টর্চ হাতে নিয়ে ইভা আমাদের দিকে তাকাল, “দরবার কক্ষ এটাই সম্ভবত। এসো।” পথ দেখালো। আমরা দুজন ওর পেছন পেছন ঢুকলাম।

ভেতরে ভ্যাপসা একটা গন্ধ। তবে টর্চের আলোয় বোঝা গেল বাহিরের মত বেহাল দশা ভেতরের নয়। ভেতরটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নই রয়েছে। মাটি ঢোকেনি। তবে আগাছা ঠিকই রয়েছে চিপায় চাপায়।

ঘুট ঘুটে অন্ধকার হল রূম। ইভার টর্চের আলোই যা কিছু সম্বল। মাহিন ওর হাত থেকে টর্চটা নিয়ে চারপাশে ঘোরাতেই অস্ফূট একটা চিৎকার দিল। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বলা যেতে পারে মাহিন আর আমি দুজনেই জমে গেলাম।

আমাদের চারপাশে অসংখ্য মানুষের মূর্তি। শুধু মানুষ না, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, হাতি- নানান ধরণের মূর্তি। সব গুলো এতই বেশি জীবন্ত যে মনে হচ্ছে এখনই চলা শুরু করবে! কম হলেও শ’খানেক মূর্তি! ময়লা আর শ্যাওলা ধরে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। অবাক করার মত ব্যপার হল প্রতিটা মূর্তির চোখ গুলো দামি কোনো পাথর দিয়ে বানানো। আলো পরার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলজ্বল করছে। মূর্তি গুলো আমাদের আকৃতির-ই। বাহিরের গুলোর মত দানবীয় নয়।

মাহিন ফিসফিস করে বলল, “মূল ভ্যাটিকেন প্রাসাদে এসব মূর্তি নেই রবি! এগুলো বানিয়েছে কে?”

আমি অর হাত থেকে টর্চটা নিয়ে ওপরে ছাদের দিকে তাক করলাম। স্তম্ভিত হতে হল দ্বিতীয় বারের মত। আমি ভ্যাটিকেন প্রাসাদে যাইনি। বইয়ে দেখেছি। ভেতরের ছাদটা ছাতার মত অনেকটা। সেখানে ভাগ ভাগ করে উজ্জ্বল রঙ দিয়ে তিনশো’র বেশি ছবি এঁকেছিলেন মাইকেল এঞ্জেলো। বাইবেলের ঘটনা নিয়ে।

আমাদের মাথার ওপরের ছাদেও অবিকল একই দৃশ্য! মলিন হয়ে এসেছে সব চিত্র লিপি- তবুও টর্চের আলোয় বোঝা যাচ্ছে ছবি গুলো।

মাহিন শব্দ করে ঢোক গিলল, “মনে হচ্ছে আমি ভ্যাটিকেনে দাঁড়িয়ে আছি! এত নিখুঁত করে কে তৈরি করেছে এই ক্যাথেড্রাল? ছবি গুলো রবি আমাকে ধরো। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে আমার।”

আমি ধরে ফেললাম মাহিনকে। মাহিন মোহ গ্রস্থের মত আমার দিকে তাকিয়ে নিজেকেই যেন বিড়বিড় করে বলল, “কে বানিয়েছে জানি না, কিন্তু এটা ঠিক- পৃথিবী খুব বড় মাপের কোনো শিল্পীকে হারিয়েছে সময়ের স্রোতে। কেউ তার সৃষ্টি কর্ম গুলো দেখতে পায়নি……”

আমি শংকিত গলায় বললাম, “মাহি তুমি ঠিক আছো তো? খারাপ লাগছে?”

হাসল মাহিন, “নাহ। একটু বেশি শকড হয়েছি এসব দেখে। তাই মাথা ঘোরাচ্ছে। একটু বসে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। আমাকে আমার ডায়েরিটা আর কলম দাও। লেখবো।”

আমি তাড়াতাড়ি ওকে মেঝেতে বসিয়ে ওর ব্যাগ থেকে ডায়েরি আর কলম বের করে দিলাম। টর্চের আলোয় নোট নেয়া শুরু করল মাহিন। ইভাকে বলল সব মূর্তি গুলোর আলাদা আলাদা ভাবে ছবি তুলতে। ইভা ছবি তোলা শুরু করল। আর আমাকে ছোট একটা তর্চ ধরিয়ে দিল মাহিন, সঙ্গে এনেছিল মনে হয়, “তুমি পুরো হল রুমের একটা ম্যাপ আঁকো। কোথায় কোনো মূর্তি আছে লিখে দাও একটা কাগজে।”

আমি একটা প্যাড আর পেন্সিল নিয়ে শুরু করে দিলাম কাজ। গুণতে গিয়ে দেখলাম মোট একশো পঁচিশটা মূর্তি এখানে। কোনটা কিসের মূর্তি সেটা ম্যাপে দেখাতে লাগলাম। সব মূর্তি গুলোর নাম আর ছোট বর্ণনা দিতে পারলেও পাঁচটা মূর্তির নাম দিতে পারলাম না। দেখে মনে হচ্ছে অন্য কোনো আমলের রাজা-সম্রাট হবে।

মাহিনকে ডাকলাম, “মাহি, এখানে পাঁচটা মূর্তি বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোনো রাজা বাদশার মূর্তি।”

মাহিন অন্য দিকে ছিল। আমার কথা শুনে এগিয়ে এলো অনেক গুলো মূর্তি পেরিয়ে, “কৈ দেখি? কোন মূর্তি?”

আমার দিকে কৌতুহলি মুখে তাকাল। আমি টর্চের আলো দিয়ে দেখালাম- পাশাপাশি পাঁচটা মূর্তি দাঁড়ানো। সামনের জন অস্বাভাবিক বেটে। মাথায় একটা পাদ্রীদের টুপি। গায়ের পোশাকও পাদ্রীদের মত। হাতে একটা লাঠি। চেহারাতেই স্পষ্ট- বামন।

বাকি চারজন চার ধরণের পোশাক পরা। মাহিন এক পলক দেখেই বলে উঠল, “এরা তো ইতিহাসের চার বিখ্যাত রাজা! কিং ডেভিড, আলেকজান্ডার দি গ্রেট, চার্লস দি গ্রেট, জুলিয়াস সিজার! কিং ডেভিড হল ইসরায়েলের রাজা! খ্রিষ্ট পূর্ব ১০১০ থেকে ৯৭০ পর্যন্ত শাসন করেছেন। বেথেলহেম থেকে তার জীবনের শুরু। মেষপালক থেকে সম্রাট হন পরে। আর আলেকজান্ডারের কথা বাদ-ই দিলাম। সবাই চেনে। চার্লস দি গ্রেট রোমান সম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন। ৭৪২ থেকে ৮১৪ পর্যন্ত জীবন কাল তাঁর। অনেক প্রতাপশালী রোমান সম্রাট ছিলেন। জুলিয়াস সিজারকে তো প্রায় সবাই চেনে।”

আমি হা হয়ে গেলাম, “তুমি কি সব মুখস্ত করে রাখো?”

“পড়তে পড়তে মুখস্ত হয়ে গেছে।” হাসল মাহিন।

বেটে বামন পাদ্রীটাকে দেখালাম, “এটা কে?”

“নাহ। একে তো চিনলাম না।” এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল মাহিন।

আমি টর্চের আলো ফেললাম ওটার মুখে। শ্যাওলায় ঢেকে আছে ওপরটা। কেবল হীরের মত জ্বলজ্বল করছে চোখের নীলচে মণি দুটা। দামি কোনো রত্ন হবে। কেমন অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে আছে মূর্তিটার ঠোঁটের কোনায়। মনে হচ্ছে জীবন্ত! লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভাবটা দেখে মনে হচ্ছে পেছনের চার সম্রাটের বাদশা সে!

মাহিন ছুয়ে দেখল মূর্তিটা। মন্তব্য করল, “পাথরের। পাথর কেটে বানিয়েছে।” বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওটার দিকে।

বাহিরে করিডোরে পদশব্দ আর রাকিবের গলা শোনা গেল, “রবি? মাহিন? ইভা? কোথায় তোরা?”

ইভা গলা চড়িয়ে ডাকল, “এইখানে বাবা! হল রূমে!”

বেশ কয়েকটা টর্চের আলো দেখা গেল দরজার কাছে।

“বাহ! আগে আগেই চলে এসেছে! কিছু ধরোনি তো?” মুখ দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু গলা শুনেই বোঝা গেল ড. আবু তালেব।

তেঁতো হয়ে গেল মনটা। এরকম লোকের সঙ্গে আর্মিতে বহু ঘুরেছি। পন্ডিত স্বভাবের এসব ছাগলকে সহ্য করা আমার পক্ষে কঠিনতর কাজ!

শুনতে পেলাম প্রোফেসর নারায়ণ গম্ভীর গলায় বলছেন, “ধরতে না দিলে বুঝবে কেমন করে কেমন জিনিস? নবিশের মর যত সাওব কথা বার্তা!” মাথায় টর্চ লাগানো হ্যালমেট নিয়ে হল রূমে ঢুকলেন।

মাহিন হাসি চাপল মুখে হাত দিয়ে। রাকিবের কথা দেখছি ঠিক। নারায়ণ গাঙ্গুলিও কম বদ মেজেজী না। তবে সেটা ভালোর দিকে। ড. আবু তালেবের মত খারাপ দিকের না। যদিও ড. তলেবকে দেখে মনে হল না প্রোফেসরের কথা গায়ে মেখেছেন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক টর্চ মেরে দেখে নিচ্ছেন যেন মূর্তি গুলোকে কিছু করেছি নাকি আমরা।

মাহিন গলা উঁচিয়ে প্রোফেসর নারায়ণকে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, এই বামন মূর্তিটা কার বলতে পারবেন? বাকি চারটা তো চার রাজার তাই না?”

“খাসা বলেছো! বুদ্ধি আছে দেখি মেয়ের।” খুশি হলেন তিনি। এগিয়ে এলেন, “বেটে পাদ্রীকে আমিও চিনি না। অনেক ঘেটেছি। পাইনি। মনে হয় কারিগর নিজের আদলে বানিয়েছিলেন, কিংবা শখের বশে এমনি বানিয়েছেন একটা বামনকে।”

মাহিন বিড়বিড় করল, “কারিগর নিজেই না তো?”

“হতে পারে বললামই তো।” মাথা চুলকাতে দিয়ে প্রোফেসর সাহেব আবিষ্কার করলেন সেখানে হ্যালমেট, “চল, ভেতরে গিয়ে দেখি। অনেক কিছু দেখার আছে।” আগে আগে হাটতে লাগলেন। আমরা ওনার পেছন পেছন হাটতে লাগলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম ড. আবু তালেব টর্চ আর ছোত স্ক্রু ড্রাইভার হাতে একটা ঘোড়ার চোখের পাথরটা ওঠানোর চেষ্টা করছেন। আমি কাঁশি দিতেই তাড়াতাড়ি স্ক্রু ড্রাইভার পকেটে ঢুকিয়ে আমাদের সঙ্গে হাটতে লাগলেন। রাকিবও দেখেছে ব্যপারটা। টর্চের আলোয় ভাল করে মুখ দেখা যাচ্ছে না কারোই, তবে বোঝা গেল গম্ভীর হয়ে গেছে ওর মুখ। আমি গলা খাদে নামিয়ে ওকে বললাম, “তোর তালেব ভাই তো দেখি সিঁদেল চোরের গুষ্টির! রাতে এখানে লোক না লাগিয়ে তালেবের তাবুতে পাহারা লাগাস। হাত টানের অভ্যাস আছে দেখি ব্যাটার!”

রাকিব ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, “সেটাই করতে হবে দেখছিঃ। ঘরের ইঁদুরই যখন বেড়া কাটবে- তাহলে আর এত পাহারা বসিয়ে লাভ কি?”

আমি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ালাম।

আমরা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মত কিছু একটা দিয়ে হাটছি। মাথার ওপর ছাদ নেমে এসেছে। কোথাও কোথাও এতই নিচে নেমে এসেছে যে ঝুঁকে হাটতে হয়। দেয়াল থেকে নানা রকম লতা পাতা ঝুলছে। চারপাশের মাটিতে আঁশটে কেমন একটা গন্ধ। কয়েক জায়গায় সুড়ঙ্গের মেঝেতে পানি জমে রয়েছে। হাটার সময় ছপ ছপ শব্দ করছে। কেউ কথা বললেই সুড়ুঙ্গের দেয়ালে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। সামনের দিক থেকে এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছেন প্রোফেসর নারায়ণ গাঙ্গুলি, “আমি প্রথমে নিজেই অবাক হিয়ে গিয়েছিলাম। অবিকল একই রকম করে এখানে কে ভ্যাটিকেনের ক্যাথেড্রাল বানালো? পরে খোঁড়া খুঁড়ি করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম হুবহু ভ্যাটিকেন প্রাসাদের আদলে বানানো হয়নি। কয়েকটা কক্ষ অতিরিক্ত রয়েছে মাটির নিচে। পানি জমে ছিল। পাম্প বসিয়ে পানি সেঁচে পরিষ্কার করেছি। নিচে বিশাল একটা সমাধী কক্ষ আছে, যেটা মূল ভ্যাটিকেনে নেই।”

মাহিন বলল, “আমরা কি এখন সেখানে যাচ্ছি স্যার?”

“হ্যা। দেখলে বুঝবে কি হূল স্থূল কারবার করে গেছে এই ক্যাথেড্রালের কারিগররা।”

অনুভব করলাম সুড়ঙ্গটা ক্রমশ নিচু হচ্ছে। নেমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে পাহাড়ের আরো গভীরে প্রবেশ ক্রেছে। রাকিবের দিকে তাকালাম, অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না, “এত যে ভেতরে যাচ্ছি বাতাসে অক্সিজেন আছে তো? নাকি শ্বাস বন্ধ হয়ে মরতে হবে?”

“আরে নাহ। ভেতরে বাতাস আছে ঠিকই। জেনারেটরের লাইন দেয়া আছে। কোনো আগুণ জ্বালানো হয়নি। বাতাস খারাপ না। তাছাড়া ভেতরে সিগারেট টানাও নিষেধ। নারায়ণ গাঙ্গুলি নিজেই তাঁর চুরুটের প্যাকেট লেকের পানিতে ফেলে দিয়েছেন, নয়ত ভূলে যদি ভেতরে এসে ধরিয়ে বসেন।”

আমি দুবার পা পিছলাতে গিয়েও সামলে নিলাম। মাহিনকে নিয়ে ভয় পাচ্ছি। পা পিছলালে আর দেখতে হবে না!

আমাকে বেশিক্ষণ ভয় পেতে হল না। সুড়ঙ্গের অন্য মাথায় একটা উঁচু মঞ্চের মত চত্বরে বেরিয়ে এলাম। পাথরের মঞ্চ। রাকিব কোথাও সুইচ টিপে দিতেই ম্লান হলুদ বাল্ভ জ্বলে উঠল পুরো রূমটা জুড়ে।

অবাক হয়ে তাকালাম আমি। বিরাট কোনো সমাধী কক্ষে দাঁড়িয়ে আছি আমরা! লম্বা লম্বি ভাবে প্রায় কোয়ার্টার মাইল। প্রস্থেও অনেক বড়। বড় বড় থামের ওপর নিচু ছাদটা ঝুঁকে আছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গেছে নিচের সমাধী গুলোর দিকে। নিচে হাটু পানি জমে আছে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় কোয়ার্টার মাইল লম্বা একটা সুইমিং পুল! কিংবা বড় কোনো দীঘি! তার মাঝ দিয়ে পানি টেনে তোলা হয়েছে। পুরো রূমটার দেয়ালে তার দিয়ে হলুদ বাল্ভ ঝুলিয়ে দিয়েছে সার্ভের লোকজন। ম্লান আলোতে সব কিছু অদ্ভূত লাগছে। মনে হচ্ছে পরাবাস্তব জগতের কোনো দৃশ্য দেখছি! ঘাড়ের কাছে শিরশির করে উঠল। ওপরে তাকালাম। ছাদটা এত নিচু এখানে যে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে পারবো। সিঁড়ি দিয়ে নামলে ছাদের সঙ্গে পার্থক্য বাড়তে থাকে।

মাহিন ফিসফিস করে বলল, “ওহ খোদা! এখানে তো কম করে হলেও দুইশো কবর হবে!”

মাথা ঝাঁকালেন প্রোফেসর গাঙ্গুলি, “হ্যা। মোট দুইশো সতেরোটা কবর আছে।”

পেছন থেকে গলা উঁচিয়ে ড. আবু তালেব বললেন, “আমাদের ধারণা এগুলো সেই সব শ্রমিকদের কবর যারা এই ক্যাথেড্রালের নির্মান কাজ করেছে।”

আমি ফিরে তাকালাম, ওনার মুখ দেখে মনে হল না এটা তার ধারণা। নারায়ণ সাহেবের হতে পারে।

“হ্যা। আমার তাই ধারণা, এগুলো লেবারদের কবর হতে পারে। কবরগুলোয় ভারতীয়দের নাম আর জন্ম সাল, মৃত্যু সাল দেয়া আছে। শংকর নারায়ণ, হেমন্ত- এসব নাম।” মাহিনকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে গেলেন।

নিচে পানি আসলেই অনেক কম। প্রোফেসর সাহেব গাম বুট পরে এসেছেন। পা দিতেই দুই বিঘতের মত পানির নিচে ঢুকল পা। মাহিন কেডস খুলে জিন্সের পা গুটিয়ে নিল। আমিও এগিয়ে গেলাম। কেডস খুলে সিঁড়িতে রেখে ওর হাত ধরে পানিতে নামলাম। বরফের মত ঠান্ডা পানি। পা দেয়ার সাথে সাথে মনে হল পা দুটো জমে গেল! মাহিনের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে একটা হাসি দিলাম, চোখ টিপে নিচু গলায় বললাম, “মাহি জানু, জমে গেলাম তো ঠান্ডায়! কাছে আসো, একটু গরম হয়ে নি!”

চোখ গরম করে তাকাল আমার দিকে ও, “এক দম চুপ। কি সব অসভ্য কথা বার্তা! জায়গা অজায়গা বোঝো না?”

প্রোফেসর সাহেব অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। আমরা তাড়াতাড়ি তাঁর পিছু ধরলাম। ঠান্ডায় এর মাঝেই হি হি করে কাঁপা শুরু করেছি। বাকিরা এলো না। আগেও এসেছে। মাহিন ইভার কাছ থেকে ক্যামেরাটা চেয়ে নিল। ঠান্ডা পানিতে নতুন করে নামার দরকার নেই ইভার।

আমরা একতা প্যাসেজের মত জায়গা দিয়ে হাটছি। দুপাশে সারি সারি কবর। শ্যাওলা ঢেকে কালো হয়ে গেছে কবরগুলো। জায়গায় জায়গায় শামুক বসে আছে।

মাহিনকে সতর্ক করে দিলাম, “সাবধানে হাঁটো। পঁচা শামুকে পা কেটো না আবার।”

মাথা ঝাঁকালো কেবল।

প্রোফেসর হাটতে হাটতে আমাদের একেবারে রূমের শেষ প্রান্তে নিয়ে এলেন। এতক্ষণ আমি করব গুলোর নাম ফলক দেখছিলাম। সব ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের নাম, এমনকি যেখান থেকে এসেছে সেসব জায়গা গুলো আসাম, ত্রিপুরা, বিহার- এসব ভারতীয় অঙ্গ রাজ্য। তবে কোনো বিশেষত্ব নেই।

কিন্তু রূমের শেষ মাথায় পাঁচটা সাওমাধী আলাদা আলাদা ভাবে উঁচুতে বেদীর মত করে তৈরি করা। পানি থেকেও দুহাত উঁচু। ম্লান আলোতেও বোঝা গেল এই পাঁচটা কবরকে ঘষে মেজে সাফ করা হয়েছে।

প্রোফেসর সাহেবের হেলমেটের টর্চের আলো গিয়ে পরল কবর গুলোর ওপর। পাশাপাশি পাঁচটা কবর। মাঝখানের কবরটা অস্বাভাবিক ছোট। দেখেই মনে হল বাচ্চা কারো কবর। নামটার ওপর চোখ পরতেই বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল আমার আর মাহিনের। খোদাই করে লেখাঃ

“Michelangelo di Lodivico Buonarroti Simoni  (||)

Date of Birth: 1758 Nov. Death: 1832 August”

মাহিন বিড়বিড় করে বলল, “লোকটা বামন ছিল!”

মাথা ঝাঁকালেন প্রোফেসর নারায়ণ গাঙ্গুলি, “হ্যা। দুপাশের কবর গুলো দেখো- কিছু বুঝতে পারো?”

ওনার কথা মত দুপাশের চারটা কবরের দিকে তাকালাম। তাসের স্পেড, ক্লাব, হার্ট আর ডায়মন্ড আঁকা চারটা কবরের ওপর আলাদা আলাদা ভাবে! বেশ বড় করে আঁকা।

স্পেড আঁকা কবরটার নাম ফলকে লেখাঃ

“King David- (ll)

1755 – 1820”

স্পেড বা পান পাতা চিহ্নটা পুরো কবর জুড়ে বিশাল করে আঁকা। তার ডানপাশে ক্লাব বা তিন ফোটা পাতার মত চিহ্ন দেয়া কবর। সেটায় লেখাঃ

“Alexander lV of Macedon

1754 – 1821”

সেটার ডান পাশে বামনের কবরটা। তারও ডানে রয়েছে হার্ট আঁকা কবর। লেখা রয়েছেঃ

“Charlemagne – ll (Charles the Great 2)

1750 – 1821”

এবং তার পাশে ডায়মন্ড আঁকা কবর –

“Julius Sizar – (ll)

1759 – 1832”

মাহিন অবাক হয়ে বলল, “সবাই তো ইতিহাস খ্যাত ব্যক্তি। যদিও কারো নামের দ্বিতীয় বলে কেউ নেই! আলেকজান্ডার ফোর বলে কেউ নেই! এদের আগের সিরিয়ালটা পর্যন্ত রয়েছে! এরা কারা?”

“সেটা পরে বের করা যাবে। তার আগে একটা জিনিষ খেয়াল করে দেখো। তাসের চারটা সিম্বল দেয়া কবর গুলোয়।” হাসলেন নারায়ণ গাঙ্গুলি। “কি মনে হয় এটা দেখলে?” চোখে বুদ্ধিদীপ্ত হাসির ঝলক। যেন মাহিনকে ধাঁধাঁয় ফেলে মজা পাচ্ছেন।

মাহিন কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল কবর গুলোর দিকে। মাথা চুলকালো। তারপর দেখলাম ওর মুখ হঠাৎ একশো ওয়াট বাল্ভের মত জ্বলে উঠেছে। উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “বুঝেছি স্যার! তাস খেলার চার রাজা ইতিহাসের বিখ্যাত চার জন রাজার পরিচয় বহন করে! স্পেড হল কিং ডেভিড! এখানেও তাই আঁকা! ডেভিডের কবরের ওপর স্পেড বা পানপাতা আঁকা! বাকি গুলোতেও তাই! ক্লাব হল আলেকজান্ডারের প্রতীক, হার্ট হল চার্লস দি গ্রেট আর ডায়মন্ড হল…….”

“জুলিয়াস সিজারের প্রতীক।” শেষ করে দিলেন কথাটা প্রোফেসর সাহেব। মুখের হাসিটা আরো চওড়া হল, “নাহ, তোমার বুদ্ধি আহে বলতেই হবে! আবু তালেবটা তো সাইন বোর্ড নিয়ে ঘরে! মাথায় গোবর পোঁড়া!”

আমি আড় চোখে মঞ্চটার দিকে তাকালাম। শুনতে পেয়েছে কিনা বোঝা গেল না আবু তালেবের মুখ দেখে। এত দূর থেকে শোনার কথা না, কিন্তু বেশি নির্জন জায়গা বলে শুনে থাকতেও পারেন।

মাহিনের এসব খেয়াল নেই, ও উত্তেজিত গলায় বলল, “স্যার, হল রূমের ঐ পাঁচ মূর্তির সাথে এগুলোর কোথাও যোগাযোগ আছে, তাই না? ঐ বামনের মূর্তিটার মতই কিন্তু এই এঞ্জেলোর কবরটা। আর ঐ চার মূর্তির মতই কিন্তু এই বাকি চার কবর। ঠিক না স্যার?”

“হুম। আমারও তাই ধারণা।”

“কিন্তু ….” থেমে গেল মাহিন।

“কি?” চশমা ঠিক করলেন নারায়ণ গাঙ্গুলি।

“এতগুলো ভারতীয় কবরের মাঝে এই পাঁচটা বিদেশী নামধারী রাজা আর ভাষ্করের কবর কেনো? নাকি ছদ্ম নাম?”

শ্রাগ করলেন প্রোফেসর, “হতে পারে ছদ্ম নাম। এছাড়া আর ভালো কোনো যুক্তিও নেই।”

“হ্যা স্যার। খেয়াল করে দেখুন সবার জন্ম-মৃত্যুর সাল গুলো খুব কাছাকাছি। একই সময়ের ছিল সবাই। একটু আগে পরে মারা গিয়েছিল। মনে হচ্ছে মূল আর্কিটেক্ট এই পাঁচ জন।”

আমি পায়ের ভার বদল করলাম, “এই হরতন, রুইতন, চিরতন আর ইসকাপনের ঘটনাটা বুঝলাম না। বামন শিল্পী নিজের মূর্তি ঠিকই বানিয়েছিলেন। কিন্তু বাকি চারজনের জায়গায় ইতিহাসের মূল চার রাজাদের মূর্তি বানালো কেন?”

কাঁশলেন প্রোফেসর নারায়ণ, “সেটাই তো কোটি টাকার প্রশ্ন মেজর সাহেব! ইতিহাস অনেক বড় ধাক্কা খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। তিন শতক মাটির নিচে চাপা পরে থাকা ইতিহাস খুব সোজা কথা না। সেটা যদি হয় ভ্যাটিকেন আর এঞ্জেলো রিলেটেড!” চোখ নাঁচালেন, “কি মনে হয়? রহস্যময়, তাই না?”

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!