►ক্যাথেড্রাল – প্রথম পর্ব◄

একটানা ড্রাইভ করতে করতে বিরক্তি এসে গেছে। তার ওপর রাত নেমেছে দু ঘণ্টা হল। বৃষ্টি শুরু হয়েছে সন্ধ্যার পর থেকে। যাচ্ছি এক বন্ধুর বাসায়। সে আবার ফরেষ্ট অফিসার। খাগড়াছড়ি যাবার পথে হিয়াকো নামের একটা জায়গা আছে, যার আগের প্রায় ছয় সাত কিলোমিটার পথটা পুরোটাই পাহাড়ি পথ। যেন তেন পাহাড়ি পথ বললে ভূল হবে। রীতিমত ভয়াবহ রকমের খাঁড়া আর সরু। সুপাশে গভীর খাদ আর জংগল। বৃষ্টির কারণে রাস্তা এমনিতেই পিচ্ছিল হয়ে আছে, তার ওপর যখন খাড়া উঁচু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আমার পুরনো ফোর্ডটা তোলার চেষ্টা করি- ইঞ্জিন প্রায় ইহলোক ত্যাগ করে করে অবস্থা। এমন ভাবে গোঁ গোঁ করা শুরু করে যে দম আটকে আসে- এই বুঝি বন্ধ হয়ে গেল! ইঞ্চি ইঞ্চি করে যেন উঠতে থাকে। আমি তিল তিল করে ঘামতে থাকি, গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে এক্সেলেটরে পা চেপে ধরি। শামুকের গতিতে উঠতে থাকে গাড়িটা। দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকি। কোন সময় চাকা হড়কাবে- আর গাড়ি সোজা পেছনে নেমে গিয়ে খাদে পরবে ঠিক নেই। একা হলেও না হয় কথা ছিল। সঙ্গে আমার স্ত্রী মাহিন। সে আবার কনসিভ করছে ছয় মাস হল। ওকে নিয়ে কোথাও যাওয়া মুশকিল। কিন্তু সে এসব শুনলে তো। কনসিভ করার পর থেকেই ওর মাথায় ভূত চেপেছে ঘোরাঘুরি করার। সারা বাংলাদেশ চষে ফেলেছে আমাকে নিয়ে। আজ এখানে তো কাল ওখানে। আমি কিছু বললেই মুখ কালো করে ফেলে, “দেখো, এ সময় কিন্তু মেয়েদের সব সময় হাসি খুশি রাখতে হয়। তুমি এরকম করো কেন? একটু ঘুরলে কি হয়? সারাক্ষণ মুখ প্যাঁচার মত করে থাকো!” আমি আর কি বলবো। লাভ ম্যারেজ করেছি বলে ঠেকে গেছি। এরেঞ্জ ম্যারেজ হলেও না হয় একটু ঝারি টারি দেয়া যেত। কিন্তু এমন করুণ মুখ করে তাকায় যে কিছুই বলতে পারি না।

পাহাড়ি এলাকায় রাত যে ঝুপ করে নেমে আসে সেটা বই পত্রে পড়েছিলাম এতদিন। আজকে সচোক্ষে দেখলাম। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই ঘুট ঘুটে অন্ধকার। যেন কালি গুলে দেয়া হয়েছে। তার ওপর বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দশ হাত সামনে কি আছে দেখা যায় না। তাই গাড়ির স্পিড কমাতে হল। গাড়ি কখনো দুটো পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে, কখনো বা পাহাড়ের ওপর দিয়ে। পাশাপাশি দুটো গাড়ি যাওয়া কঠিন। আর মাঝে মাঝেই লোহার পুরনো ব্রীজ। ভেঙ্গে চুরে এমন অবস্থা যে দুপাশ দুটো গাড়ি ওঠে না এই ভয়ে যে ভেঙ্গে পরতে পারে। চারপাশের জঙ্গল আর পাহাড় নিয়ে পুরো এলাকাটা অদ্ভূত এক রহস্যময়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ হঠাৎ করে বুকের ভেতর অন্যরকম একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আমি গাড়ি চালাচ্ছি বলে এত কিছু দেখার সময় পাচ্ছি না। গাড়ির হেড লাইটের আলো বৃষ্টির কারণে আটকে যাচ্ছে অল্প গিয়ে। তাই সাবধানে ড্রাইভ করে যাচ্ছি। আশেপাশে আর কোথাও আলো নেই। আর খুব একটা গাড়িও দেখতে পাচ্ছি না। আধ ঘন্টা পরপর হয়ত দু একটা জিপ গাড়ি চোখে পরে। সেগুলো আগাগোড়া মানুষ আর মালপত্রে বোঝাই। এক তিল জায়গাও বাকি নেই। ‘চাঁদের গাড়ি’ নাম সে সব জিপের। পাহাড়ি রাস্তায় এসব গাড়িই উপযুক্ত, আমার পুরনো ফোর্ড না।

মাহিন আমার পাশে বসে কানে এয়ার ফোন লাগিয়ে গান শুনছে আর গভীর মনোযোগ দিয়ে জানালার কাঁচ নামিয়ে বাহিরের অন্ধকার দেখছে। বৃষ্টির ছটা এসে যে তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই।

আমি সামনের দিকে চোখ রেখে ওকে বললাম, “ জানালার কাঁচ নামিয়েছো কেনো? বৃষ্টি আসছে ভেতরে। বন্ধ করো।”

“উফ! সব কিছুতেই এমন করো কেন? একটু ভিজলে কি দুনিয়া উল্টে যাবে?” বিরক্ত হল মাহিন।

“ দুনিয়া না ওল্টালেও জ্বর টর বাধাবে। তুমি তো আর একা না, সঙ্গে বাচ্চাটাও কষ্ট পাবে।” গম্ভীর গলায় বললাম।

“ তোমাকে ওসব ভাবতে হবে না। আমার বৃষ্টিতে ভিজে অভ্যাস আছে। বাবুর কিছু হবে না।” আবার জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো।

স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, “ তুমি যে এরকম আগে জানলে বিয়েই করতাম না! সারা জীবন আমার এখন জার্নি করে করে যাবে!”

ফিরে তাকালো মাহিন, হাসতে লাগল, “কেন বাবা? আমি কি করেছি?”

“কি করোনি? বিয়ের পর দিনই তোমার শখ হল বাচ্চা নেয়ার। তাও বাংলাদেশে বসে না! বিশ্ব ভ্রমন করে! সারা দুনিয়া ঘোরালে হানিমুনে! তারপর কনসিভ করার পর এখন সারা দেশ ঘোরাচ্ছো! তোমার ছেলে তো ওয়ার্ল্ড ম্যাপ নিয়ে দুনিয়ায় আসবে! ক্রিস্টোফার কলম্বাস! মা এত গুলো বাঁশ দিলো, কলম্বাস বাবাজী কত গুলো দেয় কে জানে!”

মাহিন হেসে ফেলল আবার, “ ছেলেই হবে কে বলল তোমাকে? মেয়েও তো হতে পারে।”

“আমি আর কোনো ছেলের জীবনে এত বড় দূর্ঘটনা সহ্য করতে পারবো না! তুমি এক মেয়েই আমার এ হাল করে ফেলেছো। তোমার মেয়ে হবে তোমার দশ গুণ। সে যে ছেলেকে বিয়ে করবে – সে নিশ্চই নাসার বিজ্ঞানী কিংবা এস্ট্রনট হবে- তার হানিমুন করার শখ হবে মঙ্গল গ্রহে। মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে জামাই বাবাজীকে বলবে- “ওগো শুনছো? চল না হানিমুনে মঙ্গল কিংবা চাঁদে যাই?” গম্ভীর মুখে মাহিনের দিকে তাকালাম।

মাহিন হাসল না দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। তাকিয়ে রইল আমার দিকে, “তুমি না হেসে কথা বল কেমন করে রবি?”

“কেন? আমি আবার কি করলাম?” রাস্তার দিকে চোখ ফেরালাম।

“তুমি গম্ভীর মুখে এমন সব কথা বল যে মানুষ শুনলে হাসতে হাসতে মুখ একদিনে দুই ইঞ্চি চওড়া করে ফেলবে।” ঠান্ডা গলায় বলল।

“তুমি তো হাসছো না।” নাকের ডগা চুলকালাম।

আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। মাহিন হঠাৎ করেই ঝুঁকে এলো আমার দিকে। শার্টের কলার টেনে বাম কানে কামড় দিলো, ফিসফিস করে বলল, “ এজন্যই তোমাকে আমার এত ভালো লাগে। হট কফি! লাবু জানু!”

গত এক বছরে মাহিনকে চেনা হয়ে গেছে। ওর হুট হাট ভালবাসা এ নিয়ে তিনটা কার একসিডেন্ট করিয়েছে আমার। তাই ওর নাকের ডগা তর্জনী দিয়ে ঠেলে ওকে সিটে বসিয়ে দিলাম শান্ত মুখে, “ মি টু মাহি। এবারের দফায় গাড়ি নিয়ে খাদে লাফাতে চাচ্ছি না জান! বংশের বাতি নিয়ে কথা।” গাড়ি চালানোয় মন দিলাম।

মাহিন হেসে ফেলল। লজ্জা পেয়েছে। সেটা ঢাকার জন্যই হাসছে। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো ও। আড় চোখে ওর দিকে তাকালাম। জানালা দিয়ে আসা বৃষ্টি-বাতাসে ওর ঘন চুল গুলো উড়ছে, গলায় এদিক সেদিক এনে এনে ফেলছে। আমি জোর করে অন্য দিকে তাকালাম। বিড়বিড় করলাম, “ড্রাইভিং আইনে সুন্দরী বৌ নিয়ে ড্রাইভ করাটা নিষিদ্ধ করা হলে ভাল হত। পাশে এরকম বৌ থাকলে পাহাড় থেকে গাড়ি নিয়ে লাফিয়ে স্কাই ডাইভিং করার শখ জাগে!”

ফিরে তাকালো মাহিন, চোখে দুষ্টুমী ধরে ফেলেছে- এরকম একটা হাসি। শুনতে পেয়েছে বোধ হয় কথাটা। কেবল গম্ভীর গলায় বলল, “গাড়ি চালাও। এদিকে তাকাতে হবে না।”

“জী ম্যাডাম সেটাই তো করছি। নেক্সট টাইম আপনাকে বোরখা ছাড়া গাড়িতে তোলা যাবে না।” গাড়ির স্পিড বাড়ালাম। বৃষ্টি কমে এসেছে। আমার বন্ধুর বাংলোটা আরো দু কিলোমিটার, ম্যাপের কথা অনুযায়ি।

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

যার বাসায় যাচ্ছি তার নাম রাকিব। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু ।  দুজন দুই প্রফেশনে চলে আসার পরও যোগাযোগটা ছাড়িনি । ঢাকায় গেলে প্রাই আমার বাসায়আসে । মাহিনকে নিয়ে অবশ্য এবারই প্রথম আসা এখানে। আগে ছিল সিলেটে। এখানে এসেছে অল্প কিছুদিন হল ।

বাংলোটা পাহাড়ের ওপর। দূর থেকেই বোঝা যায় পাহাড়ের ওপর যে একটা বিরাট দোতলা বাংলো আছে। কারণ বাংলোর বাউন্ডারির উঁচু দেয়াল গুলোর চারকোনায় বসানো বড় বড় সার্চ লাইটের আলো রাতের অন্ধকার চিরে চারপাশের পাহাড়ি জংগলে গিয়ে পরেছে। বেশ কিছু খাকি পোশাকধারী গার্ড পাহারা দিচ্ছেবাংলোর গেট। কুকুরের ডাক শুনে বোঝা গেলো শিকারী কুকুরও রয়েছে বাংলোয় ।

রাকিব বোধ হয় গেটের আশে পাশেই ছিল, আমি গাড়ি নিয়ে গেটের সামনে হর্ন বাজাতেই বিশাল লোহার গেট খুলে গেল। দেখি সাদা ট্রাক স্যুট পরে হাসি মুখেদাঁড়িয়ে আছে রাকিব। আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো, “কিরে? পথে আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? ভাবী ঠিক আছে?” ওর পাশে বিশাল একটা কুকুর,কালো রঙের। এটাই বোধ হয় চেঁচাচ্ছিল।

আমি গাড়িটা ভেতরের চত্বরে নিয়ে একটা পানির ফোয়ারার পাশে পার্ক করতে করতে ভেতর থেকেই বললাম, “ চারপাশে যে সিকিউরিটির বহর দেখলাম-ভাবলাম ভূল করে প্রধান মন্ত্রীর বাস ভবনে চলে আসিনি তো!”

হাসতে লাগল রাকিব, “এখানে জংলী জানোয়ার আর হাতি আছে। তাই এত সব ব্যবস্থা। মাঝরাতে নয়তো হাতির অত্যাচারে গাছে উঠে থাকতে হবে।”

মাহিন দরজা খুলে নামল। রাকিবের দিকে তাকিয়ে হাসল, “ কেমন আছেন রাকিব ভাই? বিয়ের সময়ই কেবল দেখেছিলাম আপনাকে। আর তো ঢাকায় এলেননা?”

“আমার আর যাওয়ার সুযোগ হয় নাকি? গরু মহিষ তাড়িয়ে তাড়িয়ে সারা জীবন গেল! ফরেস্ট ছেড়ে আসলে কোথাও গিয়ে থিতু হওয়াটা কঠিন। এখানেই আটকেআছি তাই। আপনার কি খবর? পথে আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

আমি গাড়ি থেকে নেমে আড় মোড়া ভাংতে ভাংতে বললাম, “ ওকে জিজ্ঞেস না করে আমাকে জিজ্ঞেস কর। ও তো জার্নির পোঁকা, ওকে বিয়ে করে আমি ফেঁসেগেছি! সারা জীবন চাক্কার ওপর কাটাতে হবে যে অবস্থা শুরু হয়েছে!”

হাসতে লাগল রাকিব, “ ভেতরে চল। ইভা আছে। ভাবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।”

আমি ব্যাগ নিতে যাচ্ছিলাম। নিষেধ করল, “ তোর নেয়া লাগবে না। লোক আছে। নিয়ে নেবে।” গলা চড়িয়ে ডাকল, “ আসগর? এসে মাল পত্র গুলো নিয়র যাওতো।” একজন মধ্য বয়সী লোক বেরিয়ে এল। দাড়িওয়ালা, শক্ত সামর্থ চেহারা। গলায় গামছা। গাড়ির ডিক্কি থেকে ব্যাগ নামিয়ে নিয়ে আমাদের আগে আগে চলেগেল ভেতরে।

আমরা ভেতরে ড্রইং রুমে ঢুকতেই ইভাকে দেখতে পেলাম। সোফায় বসে টিভি দেখছিল। আমাদেরকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো, আমার দিকে তাকিয়েহাসল, “ রেবু চাচা? কেমন আছো?” হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেকের জন্য।

আমি শিস দিয়ে উঠলাম, “ওরে সর্বনাশ! তুই এই দুই বছরে এত বড় হয়ে গেছিস! তোকে তো চিনতেই পারিনিও প্রথমে। একেবারে হলিউডের নায়িকা! বয়ফ্রেন্ডজুটেছে নাকি?” এগিয়ে ওর হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিলাম। “নে পরিচয় করিয়ে দি, এ হল তোর চাচি, মাহিন।”

মাহিন অবাক হয়ে বলল, “ রাকিব ভাইয়ের এত বড় মেয়ে আছে! জানতামই না! আপনাকে তো দেখেও বোঝা যায় না!”

রাকিব উদার গলায় হাসল, “ আর বলবেন না ভাবী! চাইল্ডহুড ম্যারেজ, চাইল্ডহুড ভালবাসা, চাইল্ডহুড ডটার! আমার আঠারো আর ওর মার বয়স ছিল চোদ্দ-যখন ইভা হয়।”

আমি হাসলাম, “ কলেজে থাকতে প্রায়ই ক্লাসে নিয়ে আসতো ইভাকে। মার কাছে একদমই থাকতে চাইতো না। বাপ পাগল মেয়ে। ক্লাসের সবাই যে কত ওকেকোলে নিয়ে ঘুরেছে!” ইভার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। লজ্জা পেয়েছে বেচারি।। লাল হয়ে গেছে ।

“ভাবী কোথায়? ইভা একা এসেছে নাকি?” সোফায় বসলাম।

“ ছোট ছেলেটার পরীক্ষা চলছে। শেষ হলে দুজনেই আসবে। ইভার পরিক্ষা আগেই শেষ। তাই বললাম বাড়িতে একা বসে মাছি মারার চেয়ে এখানে এসে ঘুরে যা।ভাল লাগবে। ব্যস চলে এলো।”

“ কোন ক্লাসে পড়ো এখন?” মাহিন জিজ্ঞেস করল ইভাকে।

“ ক্লাস টেন।”

“ সায়েন্স?”

“ হ্যা।”

“ বাহ। আর কদিন পরেই তো ম্যাট্রিক দিয়ে কলেজে উঠে যাবে!”

ঠিক এ সময় আসগর এসে বলল, “ মালপত্র রাখে দিছি। খানা লাগাবো সাব?”

রাকিব ব্যস্ত গলায় বলল, “ কথা অনেক হবে। আগে গোসল টোসল সেরে ফ্রেস হয়ে নে। আসগর তুই খাবার দে। লম্বা জার্নি করে এসেছে। পথে কি না কিখেয়েছে।”

“ ভাই ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আমাদের এখনো খিদে পায়নি।” মাহিন ভদ্রতা করে বলল। যদিও জানি দুজনেরই অবস্থা খারাপ খিদের চোটে।

“ ওসব বলে লাভ নেই। বাচ্চার কথাও ভাবতে হয়। তাড়াতাড়ি যান। খাবার দেয়া হচ্ছে।” এক রকম ঠেলে পাঠিয়ে দিল আমাদের গেষ্ট রুমে। বেশ বড় সড় গেষ্টরুম। ব্যাগ গুলো এখানে এনে রেখেছে। আমি বিছানায় ধপ করে শুয়ে পরলাম লম্বা হয়ে।

মাহিন হ্যান্ড ব্যাগটা বেড সাইড টেবিলে রেখে বলল, “ কি হল? শুয়ে পরলে যে? ওঠো। আগে তুমি যাও বাথরুমে। গোসল করে নাও।”

“ তুমি যাও। আমি একটু গড়িয়ে নেই।”

হাত ধরে টানল, “ তুমি যাও তো! আমার সময় নেবে। তুমি গোসল করে ফেলো।”

কি আর করা। উঠে পরলাম। টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। ভেতর থেকেই শুনতে পেলাম মাহিন গুন গুন করে গান ধরেছে, ব্যাগ খুলে কাপড় চোপড় বেরকরছে।

রাতে খাবার টেবিলে বসে রাকিব মাহিনকে বলল, “ আমি শুনেছিলাম আপনি নাকি পুরাতত্ত্ব-প্রত্নতত্ত্বের ওপর পড়াশোনা করেছেন?”

পানির গ্লাসটা নামিয়ে রাখল মাহিন, “ হ্যা, আর্কিওলোজি ছিল আমার সাবজেক্ট। বেথুনে করেছিলাম।”

“বাহিরেই ছিলেন?”

“নাহ। স্কুলে থাকতে চলে গিয়েছিলাম। পড়াশোনা শেষে চলে এসেছি।” মাহিন একটু থেমে যোগ করল, “ শুনলাম আপনি নাকি আমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্য আলাদা ভাবে রবিকে বলেছিলেন?”

আমি কাতল মাছের একটা পিস তুলে নিলাম, “হ্যা। বেশ কয়েক মাস ধরে তুই বলছিলি মাহিনকে এখানে নিয়ে আসতে- ব্যাপারটা কি?” চোখ নাঁচালাম, “ আমার বউয়ের প্রেমে পড়েছিস নাকি?”

মাহিন টেবিলের নিচ দিয়ে আমার পায়ে লাথি দিল। কথা বার্তায় আমি বরাবরই একটু সিগন্যাল-বেরিকেড বিহীন। সামনে ইভা থাকলেও অতটা পাত্তা দিলাম না। সবাই বড় হয়েছে।

রাকিব হাসতে লাগল, “ তাহলে তো তোর ভাবী আমাকে দোনলা বন্দুক হাতে ম্যারাথনের দৌড়ানি দিবে!”

“তাহলে ঘটনাটা কি? ঝেড়ে কেঁশে ফেল। আমি গোয়েন্দা বিভাগের লোক। গলা শুনেই বলে দিতে পারি কি হচ্ছে না হচ্ছে। ফোনে তোর গলা শুনেই বুঝেছি কোনো একটা ঘাপলা বেধেছে কোথাও।” ঝোল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে নির্লিপ্ত গলায় বললাম।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ হয়ে থাকল রাকিব। তারপর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, “আমি অত ভনিতায় যাবো না, সরাসরি পয়েন্টে চলে আসি। ভূমিকা বেশি হয়ে গেলে মূল ঘটনা আর বোঝা যায় না।” পানির গ্লাস তুলে ঢক ঢক করে সবটা খেয়ে ফেলল। আমি মাহিন আর ইভার দিকে তাকালাম। দুজনেই কৌতুহলি মুখে তাকিয়ে আছে রাকিবের দিকে।

গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখল, “ ভ্যাটিক্যান প্রাসাদ কিংবা ভ্যাটিক্যান সিটির নাম শুনেছিস?” প্রশ্নটা আমাকেই করা হয়েছে।

“খ্রিস্টানদের মক্কা? রোমান ক্যাথলিক চার্চ, মানে পোপের মূল ক্যাথেড্রালটা ভ্যাটিক্যান সিটিতেই, ইটালিতে। হঠাৎ এটার কথা জিজ্ঞেস করলি কেন?”

“গুড। যদিও গোয়েন্দার লোক তুই। তাও ভাবলাম জানিস কি না।” সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো রাকিব। “ছোট চার্চ গুলোকে কেবল চার্চ বা গির্জা বলে। কিন্তু কোথাও ওটার এডমিনিষ্ট্রেশন চালানোর জন্য প্রিষ্ট, হায়ার প্রিষ্ট, নান, পোপ- নিয়ে কাউন্সিল থাকে। সেটা যেখানে হয় সেটা বিশাল কোনো চার্চেই হয়। তাই ঐ বিশাল চার্চকে আলাদা ভাবে বোঝানোর জন্য অন্য নাম দেয়া হয়- ক্যাথেড্রাল। দুনিয়াতে ক্যাথেড্রালের সংখ্যা খুব বেশি না। হাতে গুণলেই হয়। বাংলাদেশি আছে মাত্র দুটো। ময়মনসিংহ আর রাজশাহীতে। আর কোথাও নেই।” থামল একটু। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম ওর পরবর্তী কথা গুলো শোনার জন্য।

“তোরা তো জানিসই যে ক্যাথেড্রালে থাকে খুব দামি দামি ভাস্কর্য আর চিত্রকর্ম। ভ্যাটিক্যান প্রাসাদের উদাহারণটাই দেয়া যায়। ওখানে এঞ্জেলোর খুব মূল্যবান কিছু কাজ রয়েছে। Sistine Chapel Ceiling অন্যতম। ক্যাথেড্রালের সিলিং জুড়ে তিনশোটার মত চিত্র। বাইবেল থেকে নেয়া চিত্রলিপি। নানান ঘটনার। জানিস এসব?”

আমি মাথা নাড়ালাম, “নাহ। এত সব আমি জানি না।” মাহিনকে দেখালাম, “ একে জিজ্ঞেস কর। আমার জ্ঞানের দৌড় শেষ।” খেতে লাগলাম।

মাহিন একটু অবাক হয়ে বলল, “ সবখানে থাকে না। যদি কেউ দান করে কিংবা ক্যাথেড্রাল কর্তৃপক্ষ বানানোর নির্দেশ দেয়- তাহলেই ওসব স্থান পায়। মাইকেল এঞ্জেলোকে মোট বারোটা দৃশ্য বাইবেল থেকে আঁকতে বলা হয়েছিল। সে সময়ের  পোপ জুলিয়াস টু, মানে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস কাজটা এক রকম প্রতিশোধ কিংবা ঈর্ষান্বিত হয়ে চাপিয়ে দিয়েছিল এঞ্জেলোর ওপর। তিনি জানতেন যে এঞ্জেলো ভাস্কর, চিত্র শিল্পী নয়। কিন্তু ছবি আঁকার কাজ দেন, সেটাও ক্যাথেড্রালের আভ্যন্তরীণ ছাদ জুড়ে। কাজটা করার জন্য সে সময় অত উঁচুতে পৌছানো সম্ভব ছিল না। মাইকেল এঞ্জেলোই সর্ব প্রথম Scaffolding বা মাঁচা তৈরি করেন। অনেকই জানে না এঞ্জেলো যে আর্কিটেক্ট ছিলেন। সে সময়ের পোপের খুব প্রিয় পাত্র ছিলেন আর্কিটেক্ট ডোনেতো ব্রামান্তে। তাকে ভার দেয়া হয়েছিল ছাদ পর্যন্ত পৌছাবার জন্য মাঁচা তৈরি করার। কিন্তু তিনি খুব ভূয়া টাইপের জিনিস বানিয়েছিলেন দেখে এঞ্জেলো হেসেছিল সেটা নিয়ে। সেখানেই সমস্যা হল। ডোনেতো নালিশ করলেন পোপ জুলিয়াসকে। তিনি এখন এঞ্জেলোকেই ডেকে বললেন নিজে যেন এ রকম কিছু বানিয়ে দেখান। তখন প্রথম বানানো হয় Scaffolding। ১৫০৮ থেকে শুরু করে ১৫১২ পর্যন্ত রাত দিন পরিশ্রম করে  The Book of Genesis থেকে মোট তিনশোটার বেশি ছবি আঁকেন। প্রায় অন্ধ হয়ে যান তিনি। কিন্তু পোপদের অত্যাচার থামেনি। ১৫৩৫ এর দিকে পোপ তৃতীয় পল তাকে আবার ডেকে আরো কিছু ছবি আঁকতে দেন ক্যাথেড্রালে। তখন Adam and eve, Garden of Eden, Great flood – এসব এঁকে দেন। শেষ বয়সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন রাত দিন অমানুষিক কষ্ট করে ছবি আঁকার কারণে। অবাক করা ব্যাপার ছিল সে সময় ক্যাথেড্রালে এঞ্জেলোর কোনো ভাস্কর্য দেয়া হয়নি। পরে হয়েছিল।” থামল মাহিন।

ইভা আর আমি খুব মনোযোগ দিয়ে মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে কথা গুলো শুনছিলাম।

“হুম।” চেয়ারে হেলান দিল রাকিব। আঙ্গুল দিয়ে প্লেটের ভাত গুলোর মাঝে বৃত্ত আঁকছে আপন মনে।

“ তুই বলেছিলি ভূমিকা করবি না। এখন তো মনে হচ্ছে ভূমিকা দিয়ে ইতিহাস বই বানিয়ে ফেলেছিস?” গলা খাকারি দিলাম।

কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর রাকিব মাহিনের দিকে সরাসরি তাকাল, “ তিন মাস আগে এখানে পাহাড়ী এলাকায় বিশাল ঢল নেমেছিল বৃষ্টির পানি জমে। ঢলের কারণে অনেক গভীরে খাদের ভেতর দিকের পাহাড়ের মাটি ভেঙ্গে সরে গিয়েছে। এবং মাটি ভেঙ্গে পাহাড়ের ভেতর থেকে অবিকল ভ্যাটিক্যান সিটির “প্রাসাদ” বেরিয়েছে অল্প একটু। বাকিটা মাটির নিচে, মানে পানির নিচে এবং পাহাড়ের ভেতরে। বোঝা গেল?”

আমি মাহিনের দিকে তাকালাম। দেখলাম বিস্ময়ে ওর চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। ফিসফিস করে বলল, “ ভ্যাটিক্যানের ক্যাথলিক চার্চ?”

“শুধু চার্চ না, ভেতরের সব কিছুই। মাটি খুঁড়ে যতটুকু ঢুকতে পেরেছি Sistine Chapel Ceiling অবিকল একই ভাবে আঁকা চার্চের ছাদ জুড়ে। এবং অসংখ্য মূর্তি রয়েছে – যেগুলো আসল ভ্যাটিক্যান প্রাসাদে নেই। সব চেয়ে বড় ব্যাপার হল এখানে মাটির নিচে অতিরিক্ত একটা কক্ষ আছে যেখানে সমাধী রয়েছে বেশ কিছু মানুষের। সেখানের একটা ফলকে লেখা –

“Michelangelo di Lodovico Buonarrati Simoni (||)

1758 nov – 1832”

মাহিনকে দেখে মনে হল ও আকাশ থেকে পরেছে! কেবল বিড়বিড় করে বলল, “ দ্বিতীয় মাইকেল এঞ্জেলো? ইতিহাসে এই নামে কেউ নেই! সমাধীটা কার?”

রাকিব কাষ্ট হাসি হেসে চেয়ারে হেলান দিল, “এখানেই তো প্রশ্ন। পাহাড়ের ভেতর এই প্রাসাদ এলো কোত্থেকে? কে বানালো? কেনই বা বানিয়েছে? এত জায়পগা থাকতে এখানে কেন? আর তার থেকে বড় কথা এই সমাধীটা আসল ভ্যাটিক্যানে নেই। আসল এঞ্জেলোকে ক্যাথেড্রালে কবর দেয়া হয়নি। এই সমাধী কক্ষের প্রতিটা কবরই প্রকৃত ভ্যাটিক্যান কিংবা ইতিহাসের কোনো না কোনো ব্যক্তির দ্বিতীয় বা তৃতীয় নামের কেউ। এত দিন জানতাম মৌর্জ সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে এদেশে। ভ্যাটিকেনের থাকবে- এটা আশা করিনি!”

আমি কেবল একটা শব্দ উচ্চারণ করলাম, “মিডিয়া?”

“ওপর থেকে কড়া নিষেধ। খবরটা যেন না ছড়ায়। বাহিরের থেকে কাউকে আনা যাবে হবে না। আগে নিজস্ব লোক দিয়ে কাজ করানো হবে। মাহিনকে তাই আনতে বলেছিলাম।”

“দেশে আরো বাঘা বাঘা আর্কিওলোজিষ্ট আছে।” শান্ত গলায় বললাম।

“জানি। কিন্তু এখনো কোনো হদিসই বের করতে পারছে না তারা। তার ওপর কিছু দিন আগে আর্কিওলোজিষ্ট ড. এজাজ আহমেদ খুন হয়েছেন রাতের বেলা ওখানে। তাই, পুলিশি গন্ধ লেগে গেছে ব্যাপারটায়। মাহিনকে ডেকেছি যাতে ও একটু দেখে আন্দাজ করে কেমন করে হল এসব।”

“ সি ইজ প্রেগনেন্ট, তোর ধারণা যেখানে মানুষ খুন হয় সেখানে আমি এ অবস্থায় ওকে পাঠাবো?”

“সে জন্যই তো তোকেও ডেকেছি। ওর সিকিউরিটি হিসেবে। মাহিনকে ডাকার মূল কারণ হল মাহিন প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছে। ভ্যাটিক্যান আমি বইয়ে পড়েছি। মাহিন নিজে দেখেছে। ও ভাল বুঝবে সব। অবশ্য তোর নিষেধ থাকলে আমার কিছু বলার নেই। কারণ এটা ব্যক্তিগত ভাবে আমি বলেছি।”

আমি কিছু বলার আগেই মাহিন বলে উঠল, “ আমি দেখবো জায়গাটা। দ্বিতীয় এঞ্জেলোকে দেখার ইচ্ছাটা দমাতে পারছি না।”

আমি পানির গ্লাসটা খালি করে ওর দিকে তাকালাম গম্ভীর মুখে, “তুমি বুঝে বলছো কথাটা?”

“হ্যা।” আমার দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকালো মাহিন। একটা হাত বাড়িয়ে মৃদু চাপ দিল আমার হাতে।

আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললাম, “ঠিক আছে। তোমার কলম্বাস পেটে থাকতেই এত দৌড়াচ্ছে- বের হলে যে কই কই যায় চিন্তায় আছি!”

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!