
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই আগুনে পোড়ানো ইট চেন। দালান বানাতে এই ইটের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ইট কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। সিরামিক ইট আর আগুনে পোড়ানো ইট-এই দু’রকমের ইট সচরাচর আমরা ব্যবহৃত হতে দেখি। কিন্তু প্রাচীনকালে আরেক ধরনের ইট ব্যবহার করা হত। সেই ইট কাদামাটি ছাঁচে ফেলে রোদে শুকানো হত, পোড়ানো হত না। এই ইটকে কাঁচা ইটও বলা হত।
তো এ ধরনের একটি ইটের ভাটায় কাজ করত দুই বন্ধু। সকালে তারা একসাথে ইটের ভাটায় যেত আর সেই রাত পর্যন্ত সেখানে কাজ করত। তাদের বানানো ইটগুলো ব্যবহার করত অন্যরা। তারা শুধু জীবিকা নির্বাহ করার জন্য কাজ করত। ইট ভাটার মালিক তাদেরকে বেতন দিত, সেই বেতন বা মজুরির টাকায় তাদের সংসার চলত। তাদের কাজের মধ্যে ছিল মাটিকে পানিতে মিশিয়ে কাদা বানানো। মাটির মিশ্রণটা এমনভাবে করতে হত দেখতে যেন রুটি বানানোর খামিরের মতো লাগে। তারপর কাঠের তৈরি ডাইজ বা ছাঁচে ওই কাদা ফেলে পূর্ণ করতে হত। ওই ছাঁচ ভর্তি কাদাই সমতল ময়দানে ঢেলে রাখতে হত। সেটাই রোদে শুকিয়ে গেলে তৈরি হত ইট।
যত সহজে আমরা ইট তৈরি করার বর্ণনাটা দিলাম, বাস্তবে কিন্তু তত সহজ নয় ইট বানানো। বেশ শ্রমসাধ্য একটা কাজ এটি। সেজন্য খুব দ্রুত তারা ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ত। একদিন সকাল থেকে এভাবে কাজ করতে করতে দুই বন্ধু বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ল। এক বন্ধু অপর বন্ধুকে বলে উঠল: ‘এত কষ্ট করে সারাদিন কাজ করি তবু ভাগ্য ফেরে না। আজ পর্যন্ত কিছুই হলো না। দিন এনে দিন খাই। জমে না কিছুই। একটু পেট পুরে যে খাওয়া-দাওয়া করব সেই পরিমাণ টাকাও থাকে না পকেটে।
যেই মজুরি পাই তাতে রুটি কেনা ছাড়া তো ভালো কিছু কেনার জো নেই। সেই ভালো, ক্ষুধা যখন লেগেছেই তুই এক কাজ কর। কিছু রুটি কিনে নিয়ে আয়। আমি বরং এই ফাঁকে আরো কিছু ইট তৈরি করি। কাজ এগিয়ে রাখি’। বন্ধু তার পকেটে যা পয়সাপাতি ছিল তা নিয়েই বাজারে চলে গেল রুটি কিনতে। বাজারে যেতেই তার নাকে এল কাবাব পোড়ানোর ঘ্রাণ। তার মনে হলো কাবাব তো নয় আসলে তার কলিজা পুড়ছে, জিহ্বা পুড়ছে। কাবাবের দোকানের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল তার কেনাবেচার ভিড়। কত মানুষ ভিড় জমিয়েছে কাবাব কেনার জন্য। দোকানদার একের পর এক কাবাব প্যাকেটে পুরে দিচ্ছে আর সবাই নিয়ে যাচ্ছে গরম গরম আগুনে পোড়া কাবাব।
শুধু কি কাবাব! তার নজরে পড়ল আরো অনেক খাবার। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, টমেটো পোড়া, সালাদ আরও কতো কি! মনটা ভেঙে গেল তার অতশত খাবারের আইটেম দেখে। কিন্তু দুঃখ করে কী লাভ। তার পকেটে তো ওসব কেনার মতো পয়সা নেই। কিছুতেই তার ইচ্ছে করছিল না ওইসব মজার মজার খাবারের আয়োজন পেছনে ফেলে রুটির দোকানের দিকে যেতে। তারপরও তাকে যেতেই হলো।
যতই সে কাবাবের দোকান পেছনে ফেলে সামনের দিকে যাচ্ছিল ততই মনের ভেতরে কাবাবগুলো বিনি সূতোর মতো কিংবা পাতলা রবারের মতো লম্বা হতে হতে এক সময় ছিঁড়ে গেল। রুটির দোকানে যাবার পথে একটা ফলের দোকান পড়ল। ওই ফলের দোকানে বিশাল বিশাল সাইজের তরমুজ সারি করে সাজানো ছিল। দু’একটা তরমুজের পেট কেটে টুকরোটা বাইরে সাজিয়ে রেখেছিল দোকানদার। তরমুজের ফালিটা আর কাটা তরমুজের বুকটা তার কাছে নিজের হৃৎপিণ্ডের মতো একই রঙের মনে হলো। দুটোই লাল এবং দুটোই রসালো। আহা! কতোকাল যে তরমুজ খাওয়া হয়নি। হায়রে তরমুজ!
তরমুজগুলো দেখে তার পা সামনে চলছিল না। আহা রে! যদি আরও কিছু পয়সা বেশি থাকত পকেটে তাহলে রুটি আর তরমুজ দিয়ে আজকের দুপুরের খাবারটা জমপেশ হত। হায়রে কপাল! কী পরিতাপের বিষয়, এইটুকু পয়সাও পকেটে নেই।
সিদ্ধান্ত নিল তরমুজের দিকে আর তাকাবে না। চোখ সরিয়ে নিয়ে রুটির দোকানের দিকে পা বাড়াল। দুই পা যেতেই মনে মনে ভাবল: আচ্ছা! রুটি না কিনে যদি তরমুজ কিনি, তাহলে কেমন হয়। তরমুজ খেয়েও তো পেট ভরে যাবে। পকেট হাতড়িয়ে যা টাকা ছিল সব তরমুজ বিক্রেতাকে দিয়ে একটা তরমুজ কিনে ভাটায় ফিরে যাবার পথ ধরল। কিছুটা পথ অতিক্রম করে মনে মনে সে ভাবল: আচ্ছা, রুটি না কিনে তরমুজ যে কিনলাম আমার বন্ধু আমাকে ধন্যবাদ দেবে তো? সে ভাবছিল রুটি না কিনে তরমুজ কিনে মহান একটা কাজ করে ফেলেছে।
যাই হোক, এটা সেটা ভাবতে ভাবতে তরমুজ নিয়ে শেষ পর্যন্ত ইটের ভাটায় গিয়ে হাজির হলো সে। তার বন্ধু তখনো কাজে ব্যস্ত ছিল। বন্ধুর কপাল বেয়ে, চেহারা বেয়ে এমনকি সারা শরীর বেয়ে রক্তের মতো ঘাম ঝরছিল। স্বাভাবিকভাবেই বন্ধু ক্ষিদেয় কষ্ট পাচ্ছিল। বন্ধুর সাথে হালকা লুকোচুরি খেলল সে। তরমুজটাকে পিঠের দিকে লুকিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলো: বলতে পারবে, কী কিনে এনেছি? বন্ধু সোজাসাপ্টা জবাব দিল: তাড়াতাড়ি রুটি দে তো! ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে। যেই টাকা ছিল তা দিয়ে রুটি ছাড়া আর কী কিনতে পারবি, সেটা তো জানাই আছে। তাড়াতাড়ি করে দস্তরখান বিছিয়ে নে, আমি হাত মুখ ধুয়ে আসছি।
বন্ধুর কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেল সে। ভাবল তরমুজে যদি আমার এবং দোস্তের পেট না ভরে! হাত মুখ ধুয়ে এসে বন্ধু দেখল তার সাথী দুই হাত বগলের নীচে চেপে কী যেন ভাবছে আর তার পাশে রুটির পরিবর্তে পড়ে আছে তরমুজ।
উদ্বিগ্ন অবস্থা দেখেই সে বুঝে ফেলল ব্যাপারটা। তাই কোনোরকম রাগ না দেখিয়ে প্রশান্তভাবে বলল: বাহ্ বাহ্! তরমুজ তোমার মনটা কেড়ে নিয়েছে দেখছি। দোস্ত! তুমি কি মনে কর তরমুজ খেয়ে আমরা সেই রাত পর্যন্ত ইট বানানোর মতো শক্ত কাজ করে যেতে পারব, ক্ষিদে লাগবে না! না রে দোস্ত! রুটিতে আলাদা একটা শক্তি আছে। তরমুজ যতই মিষ্টি লাগুক না কেন, পুরোটাই পানি।
কিন্তু কী আর করা। দুই বন্ধু সেদিন দুপুরবেলা রুটি না খেয়ে তরমুজ খেয়েই থাকল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই দুই বন্ধুর পেটে গুট গুট, পুট পুট, গুটুর গাটুর বিচিত্র শব্দ হতে লাগল। ক্ষিদে লাগলে মানে পেট খালি থাকলে পেটের ভেতর এরকম গুটগাট শব্দ হয়। অনেক কষ্টে তারা সেদিন রাত পর্যন্ত কাজ করল। তার পর থেকে যখনই কেউ কাজের কথা রেখে অকাজের কথা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছুর পরিবর্তে অগুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে কথা বলতো, তখনই বলত: ‘রুটির চিন্তা করো, তরমুজ তো পানি।’
বন্ধুরা, এ গল্পে তরমুজকে পানি বলা হলেও এ ফলটি বেশ পুষ্টিকর ও সুস্বাদু।অসহ্য গরমে ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে বাড়ি ফেরার পর এক ফালি রসালো তরমুজ না হলে অনেকের চলেই না। কেউ কেউ আবার তৃষ্ণা মেটাতে রাস্তায় দাঁড়িয়েই তরমুজ খাওয়া শুরু করে দেয়। এই ফলের শতকরা প্রায় ৯২ ভাগই হচ্ছে পানি। তাই তরমুজ খেলে সহজেই পানির তৃষ্ণা মেটে। গরমে শরীর ঠাণ্ডা রাখতে তরমুজের জুড়ি মেলা ভার।
তাছাড়া, তরমুজের রয়েছে নানা রকম উপকারিতা। তরমুজের বিশেষ কয়েক ধরনের অ্যামাইনো এসিড নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি করে রক্তের স্বাভাবিক কার্যপ্রণালী বজায় রাখে। উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। তরমুজে বিটা ক্যারোটিনের পরিমাণও অনেক। বিটা ক্যারোটিন চোখ ভালো রাখতে সাহায্য করে।
শুধু কি তাই? পুষ্টি বিজ্ঞানীদের বলেন, তরমুজ খেলে ত্বক উজ্জ্বল ও সুস্থ থাকে। কারণ ভিটামিন এ ত্বককে ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে। তরমুজের ভিটামিন বি৬, ভিটামিন বি১ শরীরে এনার্জি তৈরিতে সাহায্য করে। প্রতিদিন দুই কাপ পরিমাণ তরমুজ খেলে শরীরে ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি’র চাহিদা মেটে। তরমুজে আরও আছে পটাশিয়াম, যা উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকিও কমায়। পটাশিয়াম শরীরে ফ্লুইড ও মিনারেলসের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
সবুজ খোসাসহ তরমুজ ক্যানসার রোগীদের জন্য খুবই আদর্শ। এছাড়া, প্রতিদিন এক টুকরো তরমুজ খেলে শরীরে ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল বা চর্বি গঠন বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। এছাড়া ওজন নিয়ন্ত্রণেও তরমুজ বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।
তরমুজের উপকারিতা সম্পর্কে জানলে। তাই সময়-সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যেই এ ফলটি খাওয়ার চেষ্টা করবে কেমন?