রাখী — সিক্তা দাস

“দিদি, দাও না বানিয়ে, আর ত মাত্র কয়েকটা দিন” সামনের সোমবারই রাখীপূর্ণিমা। মিমির একটাও রাখী তৈরী হয় নি। অথচ পঁচিশটা রাখী তো বানাতেই হবে কম করে। প্রত্যেকবার মিমির দিদি সুমি অনেক আগে থেকেই রাখী বানানো শুরু করে দেয় বোনের জন্য, ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি রঙিন সব রাখী। মিমি মহানন্দে ছোট্ট ব্যাগে ভরে সব রাখী নিয়ে চলে যায় স্কুলে, বন্ধুদের, আন্টিদের পরাবে বলে।বোনের জন্য সুমি বানায় একটা স্পেশাল বড়ো রাখী। মিমি এসব পারে না। মায়ের সঙ্গে গিয়ে দোকান থেকে একটা রাখী পছন্দ করে কিনে দিদিকে পরিয়ে দেয়। খুব মজা হয় সেদিন। দিদি একটা বড়ো চকলেট ও উপহার দেয়। সুমি এবার ক্লাস টুয়েলভে উঠেছে। মায়ের থেকে যা হাতখরচ পায়, তার থেকেই কিছু জমিয়ে দরকারে ছোটোখাট উপহার কেনে।

তাতেই ওর আনন্দ বেশী। এ বছর সুমি একটাও রাখী বানিয়ে দেয় নি মিমিকে। বেশ শাসনের ভঙ্গিতে বলেছে, “এবার তুই নিজে বানাবি।প্রত্যেকবার তো দেখতে পাচ্ছিস, কেমন করে বানাতে হয়।“ কাঁদো কাঁদো গলায় মিমি বলে,”আমি তো পারিনা দিদি”। আবার সুমির বকুনি, “কেন পারবি না? কতবার বলেছি, বসে বসে আমায় হেল্প কর। করিস নি তো। চেষ্টাও করিস নি।“ মিমি বলতেই থাকে, ”এবার করে দাও দিদি, পরেরবার থেকে নিজেই বানাবো।প্রমিস।“ “না, আর আমি বানিয়ে দেব না, প্রমিস তো গতবারও করেছিলি, মনে নেই তোর?” বারো বছরের মিমির বায়না চলতেই থাকে,” প্লিজ দিদি, প্লিজ” “উহুঁ, আমি বানিয়েও দেব না, এমন কি তোর থেকে, আর কেনা রাখীও পড়ব না।নিজের হাতে রাখী বানিয়ে তবে আমায় পরাবি” সুমি বেশ বড়দের মতো মুখভঙ্গি করে নিজের পড়ায় মন দেয়। আরও একটা দিন চলে গেল।

মিমি বন্ধুদের কাছে খোঁজ় নিয়ে জ়েনেছে, ওদের প্রায় সব রাখী বানানো হয়ে গেছে। শুধু কিছু পুতি, চুমকি বসানো আর রিবন আটকানো বাকি। মিমির খুব মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর তো সময়ও নেই।মায়ের কাছেও বলেছিলো সব কথা। কিন্তু মাও তো বললেন, “নিজের কাজ নিজে করতে শেখ, বড় হয়েছো।“ বাবা তখন শুধু খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আর মাত্র দুটো দিন বাকি। মিমি এবার কি করবে? একটাও রাখী বানানো হল না যে। অন্যান্যবার সবাই মিমির রাখীর কত প্রশংসা করে। মিমির বুকটা আনন্দে, গর্বে ভরে ওঠে। সবকিছু ভেবে মিমির চোখদুটো জলে ভরে ওঠে। খাওয়ার টেবিলে চুপচাপ কোনোরকমে খেয়ে ওঠে। একটাও কথা বলে না। খেলতেও যাচ্ছে না কদিন ধরে। মা বলেছেন, দিদিকে পরানোর জন্য রাখীটাও কিনে দেবেন না।

আর কিই বা হবে কিনে, দিদি তো কেনা রাখী পরবে না বলেছে। কি যে করে মিমি। কিন্তু নিজের দিদিকে রাখী পরাবে না, তাও আবার হয় নাকি? ও দেখেছে, দিদি একটা খুব সুন্দর গোলাপী রঙের রাখি বানাচ্ছে, তাতে সাদা পুঁতির কাজ। ও জানে, ওটা ওর জন্য। দিদি রাখীর দিন সকালবেলায় মিমিকে রাখী পরিয়ে একটা চকলেট বার হাতে দিয়ে, গালে একটা চুমু দেবে। তখন কি করবে? কিছু পরাবে না দিদিকে? এবার লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদে ফেলে মিমি। না, আর কাউকে কিছু বলবে না। সময়ও তো নেই। কি আর করবে। এই প্রথমবার মিমি স্কুলের কাউকে রাখী পরাবে না। ভাবলেই মিমির খালি কান্না পাচ্ছে। কিন্তু দিদি! দিদিকে যেমন করেই হোক, রাখী পরাতেই হবে। সেদিন রবিবার। ছুটির দিনে মা সব পছন্দের রান্না করেন আর সবাই মিলে একসাথে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হয়, গল্প হয়।

মিমি একসাথে বসেও যেন আলাদা।চুপচাপ খাচ্ছে। খুব অবাক লাগছে মিমির, এই যে মিমি চুপ হয়ে রয়েছে, কেউ কিছু জিগ্যেস করছে না, এমন কি মাও না! দুপুরবেলা মা ঘুমিয়ে পড়েছেন, বাবা বই পড়ছেন এক মনে, আর দিদি গেছে তিতির দিদির বাড়িতে, একসাথে অঙ্ক করবে বলে। মিমি মায়ের পাশ থেকে আস্তে আস্তে উঠে পড়ে। তারপর পড়ার ঘরে যায়। ওদের দু বোনের জন্য একটা বড়ো ক্র্যাফ্ট বক্স বানিয়ে দিয়েছেন মা। তাতে কতো কি থাকে! রঙিন সুতো, স্পঞ্জ, নানারঙের পুঁতি, চুমকি, সিল্কের রিবন, আঠা, কাঁচি, ছোট্ট ছুরি, রঙিন কাগজের টুকরো, আরোও কত কি!! সব সুন্দর করে আলাদা আলাদা খোপে সাজানো। মিমি বক্সটাকে বার করে ফেলে সেলফ থেকে, তারপর খুলে দেখতে থাকে। কি সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে দিদি।

সব কাজেতেই ও কতো ভালো। বড্ড প্রিয় দিদি ওর। বন্ধুদের কাছে কত গল্প করেছে ও দিদিকে নিয়ে। আর সেই দিদিকে একটা রাখি পরাবে না? তা হতেই পারে না। বক্সের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকে, চুপি চুপি আজ বিকেলের মধ্যেই সবাই দেখার আগে একটা রাখী বানিয়ে ফেলতেই হবে, তা যেমনই হোক। হয়তো একদম সুন্দর হবে না, তবুও। এবার আস্তে আস্তে মিমি বক্সের জিনিসগুলো হাত দিয়ে দেখতে থাকে। তারপর তুলে নেয় দুধ ধবধবে একটা সাদা স্পঞ্জের টুকরো। দিদির মতন করে কৌটোর ঢাকনা বসিয়ে একটা গোল টুকরো কেটে নেয়। এ ভাবে সন্তর্পণে আরোও দু-একটা রঙিন টুকরো কাটে। একটু যেন সাহস আর আত্মবিশ্বাস বাড়ে মিমির। তারপর সাদা টুকরোর ওপর ধাপে ধাপে রঙ্গিন টুকরোগুলো আঠা দিয়ে বসিয়ে দেয়।

এবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মিমির মনে হয়, যেন ঠিক গোল করে কাটা হয় নি। তবু আর ভাবে না। খুব যত্ন করে আঠা দিয়ে নিজের মনের মতো করে পুঁতি চুমকি দিয়ে সাজিয়ে দেয়। ঠিক মাঝখানে একটা কাপড়ের ফুল আটকে দেয়। আর তার পাশে আর একটা কাগজের টুকরো আটকে তাতে লিখে দেয়, ”আমার দিদিকে”। বাকি রইল রিবন আটকানো।সেটাও মিমি করে ফেলে, একটা নীল রঙের রিবন আটকে দেয়। তারপর আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মিমি নিশ্চিন্ত হয়ে রাখীটাকে সযত্নে লুকিয়ে রাখে। মিমি খেয়ালই করেনি বিকেল ফুরিয়ে গেছে। নিচে নেমে দেখে মা চা বানাচ্ছেন, দিদিও এইমাত্র এল মনে হচ্ছে। অথচ কেউ ওকে ডাকে নি! আশ্চর্য হয়ে যায় মিমি। পরদিন, সকালবেলায় মিমি স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে, স্কুল-বাস এসে যাবে এক্ষুনি।

যাওয়ার ঠিক আগেই দিদিকে রাখীটা পরিয়ে দেবে। মা এসে মিমির স্কুল ব্যাগে টিফিনবক্স ভরে দেন। সেইসময় সুমি এসে বোনের হাতটা ধরে যত্ন করে সুন্দর গোলাপী রঙের রাখীটা পরিয়ে যেই না চুমা দিতে যাবে, মিমি তক্ষুনি হাত ছিটকে ছুট্টে চলে যায় দোতলার পড়ার ঘরে। আর হাতের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে আসে অর বানানো রাখীটা। তারপর মাথা নিচু করে পরিয়ে দেয় দিদির হাতে। দিদি,মা,বাবা সবাই যেন চমকে ওঠে আর খুব প্রশংসা করতে থাকে রাখীটার। দিদি বলে, “এই তো, দেখ তুই পারিস। আমার থেকেও সুন্দর বানিয়েছিস। মিমির মনে খুব আনন্দ হয়। তবু মনটা খচখচ করতেই থাকে বন্ধুদের আর আন্টিদের কথা ভেবে। হাসতে পারেনা মিমি।

এবার সুমি সুন্দর র‌্যাপাড়ে মোড়া একটা গিফট্ বক্স মিমির হাতে তুলে দেয়। মাথা নিচু করে মিমি বক্সটা নেয়। দেখে, এবার আর দিদি চকোলেট দেয় নি। সুমি বলে,”নে, খুলে দেখ্” “স্কুল থেকে এসে দেখব দিদি।“ “না না, এখনই দেখ চটপট।“ মাও বলেন, “দেখে নাও। স্কুলবাস চলে আসবে এক্ষুনি।” মিমি আস্তে আস্তে রিবনটা খোলে, বাক্সটা খুলেই চমকে ওঠে মিমি। বাক্স ভর্তি ঝলমল করছে কতোগুলো ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি মিষ্টি রাখী! একপাশে একটা চকোলেট। দেখে তো মনে হচ্ছে রাখীগুলো দিদিরই বানানো। ভীষণ অবাক হয়ে যায় মিমি, একই সঙ্গে আনন্দে কেঁদে ফেলে। মা, বাবা চুপ করে সব কিছু দেখতে থাকেন।

সুমি আলতো হাতে মিমির মাথাটাকে বূকের কাছে টেনে একটা চুমা দিয়ে বলে, “তুই নিজের হাতে বানানো রাখি পরিয়েছিস বলে, এটা তোর পুরস্কার।তুই খুশি তো?” মিমির চোখ দিয়ে তখনও টপটপ করে জল পড়তে থাকে,দিদির কথায় মাথা তুলে দিদির দিকে তাকায়। স্কুলবাসের হর্ণ বেজে ওঠে। মিমি খুব খুশি হয়ে বক্সটা স্কুলব্যাগে ভরে নেয়। সবাইকে ‘বাই’ বলে বেরোনোর সময় থমকে দাঁড়ায়,ঘাড় ঘুরিয়ে সুমির দিকে তাকায়। জিগ্যেস করে “কখন বানালে দিদি?” সুমি স্নেহ ঝরা চোখে বোনের দিকে তাকায়।

বলে, “আমি তো জানতাম, তুই একটা রাখী অন্তত বানাবিই আমার জন্যে।মা তো কিনে দেবেন না বলেছেন। আমি তো চেয়েছিলাম, তুই নিজে বানাতে শেখ। আর সেটা তুই করবি, এ আমি জানতাম। তাই আগে থেকে বানিয়ে রেখেহিলাম।” মিমি এবার এক ছুট্টে এসে দিদিকে জড়িয়ে ধরে দিদির গালে একটা চুমু দিয়েই দৌড়ে স্কুলবাসের দিকে চলে যায়। (সমাপ্ত)

আরো পড়তে পারেন...

সুবর্ণগোলক—-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

কৈলাসশিখরে, নবমুকুলশোভিত দেবদারুতলায় শার্দ্দুলচর্ম্মাসনে বসিয়া হরপার্ব্বতী পাশা খেলিতেছিলেন। বাজি একটি স্বর্ণগোলক। মহাদেবের খেলায় দোষ এই-আড়ি…

বসন্ত এবং বিরহ—-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

রামী। সখি, ঋতুরাজ বসন্ত আসিয়া ধরাতলে উদয় হইয়াছেন। আইস, আমরা বসন্ত বর্ণনা করি। বিশেষ আমরা…

গর্দ্দভ– বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

হে গর্দ্দভ! আমার প্রদত্ত, এই নবীন সকল ভোজন করুন।১ , আমি বহুযত্নে, গোবৎসাদির অগম্য প্রান্তর…