এক ধূর্ত কবির গল্প

আজ থেকে ৯০০ বছর আগের কথা। ততকালীন পারস্য তথা ইরানের খোরাসান রাজ্যের সেলজুক বংশের সুলতান ছিলেন আহমদ সন্‌জর বিন মালিক শাহ। সুলতান সনজর যেমন ছিলেন কাব্য রসিক তেমনি দিতেন জ্ঞানীদের মর্যাদা। সে কারণে তার রাজধানীতে ছিল বিদ্বান লোকের ছড়াছড়ি। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরা কবিরা এসে তার দরবারে ভিড় জমাতেন। তবে, সব কবিই যে তাঁর দরবারে হাজির হয়ে তাঁকে কবিতা শুনাতে পারতেন তা কিন্তু নয়। তার দরবারের প্রধান কবি ছিলেন মুয়িজ্জী। সেই মুয়িজ্জীর অনুমতি ছাড়া কেউই সুলতানের দরবারে ঢুকতে পারতেন না।

বন্ধুরা, এই ফাঁকে তোমাদেরকে একটা কথা চুপি চুপি বলে রাখি। কথাটি হচ্ছে- কবি মুয়িজ্জী ছিলেন একটা বিশেষ গুণের অধিকারী। তার ছিল অদ্ভুত স্মরণশক্তি। তিনি একবার যে কবিতা শুনতে পরক্ষণে তা অবিকল গড় গড় করে আবৃত্তি করতে পারতেন। শুধু কি তাই? তার ছিল এক গুণধর ছেলে। ছেলেটি দু’বার যা শুনতো বাপের মতই তা হুবহু আবৃত্তি করতে পারত। এমনকি যে চাকরটি সবসময় মুয়িজ্জীর পাশে থাকত সেও কম গুণধর ছিল না। সেও যে কবিতা তিনবার শুনত তা অবিকল তোতাপাখির মতো আবৃত্তি করতে পারত।

যাইহোক, কবি মুয়িজ্জী ছিলেন যেমনি চালাক তেমনি হিংসুটে। তিনি নিজের চাকরি ঠিক রাখার জন্য কখনই চাইতেন না- অন্য কোনো কবি তার কবিতা শুনিয়ে সুলতানের মন জয় করুক। তাই তিনি যখন দরবারের অন্যান্য কবিদের সাথে নিয়ে নবাগত কবিদের কবিতা নির্বাচন করতেন তখন সেখানে নিজের পুত্র ও চাকরটিকেও সঙ্গে রাখতেন।

যখনই কোনো প্রতিভাবান কবি তার নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি শুরু করতেন তখনও মুয়িজ্জী সজাগ হতেন। এছাড়া সজাগ করে দিতেন তার ছেলে ও চাকরকেও।

এপর্যন্ত নতুন কবির কবিতা পড়া শেষ হলেই কবি মুয়িজ্জী সগর্বে বলে উঠতেন, ‘আরে! এতো আমারই লেখা কবিতা। তুমি পারলে নতুন কোনো কবিতা শোনাও।’ এ কথা শুনে নতুন কবি আশ্চর্য হয়ে যেতেন। আশ্চর্য হওয়াই কথা- কারণ কবিতাটি তিনি আজই লিখেছেন। নতুন কবি যখন দাবি করলেন যে কবিতাটি তারই লেখা তখন মুয়িজ্জী তা অবিকল আবৃত্তি করে শোনাতেন। কবিতাটি যে তারই লেখা তা প্রমাণ করার জন্য নিজের আবৃত্তি শেষ হবার সাথে সাথেই বলে উঠতেন, এ কবিতাটি যে আমারই লেখা তার বড় প্রমাণ হলো-এটি আমার ছেলেরও মুখস্ত।

এই বলে তিনি ছেলেও মুখের দিকে তাকাতেন। যোগ্য পিতার যোগ্য পুত্র হিসেবে কবিতাটি যেহেতু তার দু’বার শোনা হয়েছে সেহেতু আবৃত্তি করতে তার কোনো সমস্যাই হতো না। সে দাঁড়ি-কমাসহ পুরো কবিতাটি হুবহু আবৃত্তি করে যেত। এরপর আরো প্রমাণের জন্য কবি মুয়িজ্জী তার গুণধর চাকরকেও কবিতাটি আবৃত্তি করতে বলতেন। চাকরটি ততক্ষণে কবিতাটি যেহেতু তিনবার শুনেছে, সেহেতু তারও তা মুখস্থ হয়ে যাওয়ায় তোতা পাখির মত সেও গড় গড় করে আবৃত্তি করে যেত।

দরবারে উপস্থিত কবিরা এতোগুলো প্রমাণ পাওয়ার পর মুয়িজ্জীকে আর কোনোভাবেই অবিশ্বাস করতে পারতো না। ফলে, প্রতিভাবান নতুন কবিরা সুলতান সন্‌জরের দরবারে প্রবেশের অনুমতি না পেয়ে মনের কষ্টে ফিরে যেত। কবিতা বাছাই সভার অন্য কবিরা মুয়িজ্জীর চালাকি ধরতে না পারলেও যারা প্রতারিত হতো তারা ঠিকই বুঝতে পারত। কিন্তু সেই সভায় বসে প্রতিবাদ করার সাহস তাদের হতো না। কেবলমাত্র বাড়ি গিয়ে পাড়া-প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছে মুয়িজ্জী, তার ছেলে ও চাকরের অদ্ভুত স্মরণশক্তি ও প্রতারণার কথা বলে বেড়াত।

ওই সময় খোরাসান রাজ্যের এক গ্রামে উদয় ঘটে কবি আনোয়ারীর। যুবক আনোয়ারীর মধ্যে কাব্য প্রতিভা গজগজ করলেও ‘কবিতা লিখে ভাগ্য পরিবর্তন করা যায় না’- এ বিশ্বাস থেকে তিনি তা বাদ দিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে লাগলেন। কিন্তু একদিন তিনি যখন কোনো এক শাহী দরবারের কবিকে হাতীর ওপর চড়ে বেড়াতে দেখলেন- তখন তখন তিনি ভাবলেন- এতদিন ধরে তিনি যা জেনে এসেছেন তা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।

যেই ভাবা সেই কাজ। বিজ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে আবারো কাব্যচর্চা শুরু করলেন কবি আনোয়ারী। প্রথম দিনই সুলতান সন্‌জরের প্রশংসা করে অনেক বড় একটা কবিতা লিখলেন তিনি। কবিতাটি তিনি বারবার পড়লেন এবং প্রতিবেশিদেরকেও শোনালেন। শুনে বাহবা দিলো সবাই। প্রশংসা শুনে আনোয়ারীর চেহারা খুশীতে টগবগ করে উঠল। কিন্তু একটু পরই তার মনে পড়ে গেল ধুর্ত কবি মুয়িজ্জীর কথা। আনোয়ারী শুনেছিলেন- সুলতানের দরবারে গেলে প্রধান কবি মুয়িজ্জীর ছাত্রপত্র লাগে। তাছাড়া ওই কবি নাকি নতুন কবিদের কবিতাগুলো নিজের কবিতা হিসেবে প্রমাণ করে সবাইকে প্রতারিত করেন।

এইসব কথা ভেবে কবি আনোয়ারী খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর মুয়িজ্জীকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য একটা বুদ্ধি পেয়ে গেলেন আনোয়ারী। এরপর একটা ভাল দিন দেখে খোরাসানের দিকে রওনা দিলেন তিনি। খোরাসানে পৌঁছার পর সুলতানের দরবারে ঢোকার অনুমতি নিতে কবি মুয়িজ্জীর বাড়িতে গেলেন যুবক আনোয়ারী। মুয়িজ্জীকে বাগে আনার জন্য আগে থেকেই কৌশল ঠিক করে রেখেছিলেন আনোয়ারী। কৌশল অনুযায়ী তিনি ভালো জামা-কাপড়ের উপরে ছেঁড়া জামা-কাপড় পড়লেন। তারপর নানা ধরনের অঙ্গভঙ্গী করতে করতে হাজির হলেন মুয়িজ্জীর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে তিনি মজার একটা প্যারোডি গান গাইলেন। মুয়িজ্জী তাকে একজন কৌতুককারী ভাঁড় মনে করে জিজ্ঞেস করলেন, কি চাও তুমি?

কবি আনোয়ারী আগের মতই অঙ্গভঙ্গি করে বললেন, হুজুরের মেহেরবানী হলে- এ বান্দা শাহানশাহকে একটা ছড়া শুনিয়ে ভাগ্যবান হতে চায়। মুয়িজ্জী বললেন, এতে আর আপত্তির কি আছে! ঠিকাছে- আমি একটু পরেই শাহী দরবারের যাবো। তখন সঙ্গে যেও।

একটু পর মুয়িজ্জী কবি আনোয়ারীকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করলেন সুলতান সন্‌জরের দরবারে। যেতে যেতে তিনি ভাবলেন- এই লোকটার ভাঁড়ামিতে দরবারের আজ কি কৌতুকই না হবে! মুয়িজ্জী দরবারে পৌঁছার পর আনোয়ারীকে সরাসরি হাজির না করে সবাইকে হাসির খোরাক দেয়ার জন্য তাকে রাখলেন পর্দার অন্তরালে। কিছুক্ষণ পর সুলতান সন্‌জর এসে দরবারে বসলেন। সুলতানের পর উজির-নাজির, আমির-ওমরাহ সবাই বলে পড়লেন। এ সময় মুয়িজ্জী ইশরা করলে পর্দার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন কবি আনোয়ারী। কিন্তু এ কী! তার ছেঁড়া জামা-কাপড় গেল কোথায়? তাকে তো ভাঁড়ামি করতেও দেখা যাচ্ছে না!

আনোয়ারীকে দেখে মুয়িজ্জী অবাক হলেন।

কিন্তু আনোয়ারী সেদিকে না তাকিয়ে সুলতানকে সালাম জানালেন এবং তার লেখা কবিতাটি পড়া শুরু করলেন। কবিতার প্রথম স্তবক পাঠ করেই থামলেন তিনি। তাকালেন ধুর্ত কবি মুয়িজ্জীর দিকে। বিনয়ের সাথে একটা খোঁচা দিয়ে বললেন, “এ কবিতা যদি হুজুরের রচিত হয়ে থাকে তাহলে আর বাকীটুকু পড়তে চাই না। হুজুরের মধুর কণ্ঠেই তা ভালো শুনাবে। আর শাহানশাহও খুশি হবেন।”

আনোয়ারীর খোঁচা মারা কথা শুনে মুহূর্তেই কালো হয়ে গেল মুয়িজ্জীর মুখ। তিনি যে কোনো কবিতা একবার শুনেই মুখস্থ বলতে পারেন বটে, কিন্তু না শোনা কবিতা তো আর আবৃত্তি করতে পারেন না। আর তাই স্পষ্টই বুঝলেন, এবার তিনি কোনো সহজ লোকের পাল্লায় পড়েননি। অন্যকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব হলেও আনোয়ারীকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব হবে না।

কবি আনোয়ারীর কথা শুনে সুলতান তাকালেন মুয়িজ্জীর দিকে। অমনি ফাঁদে পড়া মুয়িজ্জী বিষণ্ন কণ্ঠে বলেন, না, জাঁহাপনা এ কবিতাটা আমার নয়। এরপর আনোয়ারী তার কবিতার বাকী অংশ পড়ে শেষ করলেন। আর অমনি দরবারের চারদিকে ধন্য ধন্য রব পড়ে গেল।

কবিতাটি শুনে সুলতান সন্‌জর এত খুশি হলেন যে, সোনা-দানা ও মনিমুক্তায় কবির দু’হাত ভরে দিলেন। এরপর তিনি কবি আনোয়ারীকে বসালেন মুয়িজ্জীর আসনে। আর মুয়িজ্জীকে হুকুম দিলেন দরবারের অধঃস্তন কবিদের আসনে বসার।

পরশ্রীকাতর মুয়িজ্জী নিরুপায় হয়ে শুকনো মুখে কবি আনোয়ারীর প্রশংসা করতে করতে দরবারের অধস্তন কবিদের আসনে গিয়ে বসলেন।

মৃগয়া

তৃতীয় নয়নের বিপদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *