►একটি হত্যা এবং অন্যান্য◄

হয়তো বা গল্পটি খুব ভয়ের নয়। তবে এখানের প্রতিটি বর্ণনা নিখুঁত এবং সত্য। যারা খুব বেশি ভয়ের গল্প পড়তে চান, তাদের বলছি। গল্পটি পড়ে হতাশ হতে পারেন। তাই নিজ দায়িত্বে পড়ুন।

এই ঘটনাটি আমি আমার কাকার মুখে শুনি। আমার কাকা একজন সরকারি চাকুরীজিবি। চাকুরীর খাতিরে উনাকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। একদিন আমাদের বাসায় আসার পর আমরা ৩ ভাইবোন মিলে উনাকে ধরি উনার এইসব ঘুরাঘুরির কাহিনীগুলো শোনার জন্য। কাকা আমাদের নানা ধরনের কাহিনী শোনান। কিছু কাহিনী শুনে তো আমরা হাসতে হাসতে শেষ। অবশেষে আমার ছোট ভাই নিলয় কাকাকে জিজ্ঞেস করল, ভূত প্রেত জাতীয় কোনও কাহিনী কাকা জানেন বা দেখেছেন কিনা। কাকা একটু খানি কি যেনও ভাবলেন, তারপর বললেন, একবার চোখের সামনেই দেখেছিলাম। কিন্তু তোমরা ছোট মানুষ, ভয় পাবে, এই বলে তিনি কাটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু নিলয় নাছোড়বান্দার মত লেগে রইলো। আসলে, আমি এই ব্যাপারগুলো একটু ভয় পাই, তাই খুব একটা ইচ্ছে ছিল না জানার জন্য। কিন্তু কৌতূহলের কাছে পরাজিত হলাম। তাই কাকা যখন ঘটনাটি বলছিলেন, তখন আমিও কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম।

কাকা সেবার অফিসিয়াল কাজে কুমিল্লার লাকসামে গিয়েছিলেন। একদিন উনার অফিসের বস তাকে নিজের বাড়িতে দাওয়াত করেন। কাকার খাওয়া দাওয়ার প্রতি তেমন আগ্রহ কোনও কালেই ছিল না। শুধুমাত্র নাম রক্ষার্থে উনি রাজি হন। যাই হোক, রাতের খাওয়ার পর খানিকক্ষণ বস এবং উনার ওয়াইফের সাথে গল্প করে তিনি যখন বের হন তখন ঘড়ির কাঁটা ১১ টা পেরিয়ে গেছে। উনার বস বলছিলেন লোক দিয়ে দেয়ার জন্য কিন্তু কাকা রাজি হলেন না। বাসা সেখান থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। হেঁটে যেতে ২০-২৫ মিনিট লাগে আর রিকশা পেলে তো কথাই নেই। কাকা বিদায় নিয়ে হেঁটে এগুতে লাগলেন। চাঁদের আলোতে পথ ঘাঁট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দূরে মাথের উপর আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে কৃষকরা। ধান কাটার পর যেইসব শুখনো খড় কুটা পড়ে থাকে তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। পরিষ্কারের ঝামেলা নেই। কাকা কিছুদূর এগিয়ে ডানে মোড় নিলেন। এই পথ দিয়ে কিছুদূর গেলেই রিকশা স্ট্যান্ড পাওয়া যাবে। সেখানে রিকশা পাওয়া গেলে ভালো, না পাওয়া গেলে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। কাকা সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কিছুই পেলেন না। হটাত রাস্তা দিয়ে হনহন করে কাউকে হেঁটে আসতে দেখলেন তিনি। সেই লোক এসে কাকার পাশেই দাঁড়ালেন। অনেক রাত্রি। এমনিতে কাকা খুব মিশুক প্রকৃতির। কিন্তু ঐ লোকের মধ্যে কথা বলার কোনও গরজ দেখা গেলো না। একমনে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। কাকা কয়েকবার গলা খাঁকারি দিলেন। কিন্তু আগুন্তক লোকটি শুনল কিনা বোঝা গেলো না। এবার কাকা নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, যাবেন কোথায়? উত্তর নেই। কাকা আরেকটু উঁচা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ভাইজান, যাবেন কোনদিকে? লোকটি চমকে কাকার দিকে তাকাল। আমতা আমতা করে বলল, আমাকে বললেন?

কাকা একটু অবাক হলেন, এখানে আর কেউ নেই যে জিজ্ঞেস করতে হবে “আমাকে বললেন”।

কিছুটা রাগ হল উনার। তারপরও চেপে গিয়ে বললেন, জি আপনাকে বলছি। যাবেন কতদুর?

লোকটি উত্তর দিলো, এইতো সামনের স্কুলের ধাঁরে।

কাকা বললেন, ওহ। এতো রাত, রিকশা তো মনে হয় পাওয়া যাবে না। চলেন গল্প করতে করতে হেঁটে চলে যাই।

লোকটিকে দেখে বোঝা গেলো না, সে ইচ্ছুক না অনিচ্ছুক। তবে কিছুক্ষণ ভাবার পর রাজি হয়ে গেলো।

কোনও রকম কথা ছাড়াই পথ চলতে লাগলেন দুজন। কাকা নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, কোন বাড়িতে থাকেন আপনি? আমি করিম সাহেবের বাড়িতে থাকি। ১ মাসের মত হল এসেছি। চলে যাবো কয়েকদিন পর।

লোকটি খুব নিছু গলায় বলল, আমি আগে মোল্লা সাহেবের বাড়িতে থাকতাম।

ওহ, এখন কোথায় থাকেন?

এই থাকি আরকি। আশেপাশেই।

কাকা কিছুটা অবাক হলেন। গ্রামের লোকেরা বাড়ির ঠিকানা দিয়ে সচারচর একে অন্যকে চিনে। এই লোকের মধ্যে পরিচিত হবার তেমন একটা ইচ্ছে দেখা গেলো না।

তো, ভাইজান, আপনি করেন কি? আমি একজন সরকারি চাকুরীজীবী। একটা কাজে এসেছিলাম আপনাদের গ্রামে।

লোকটি আনমনে উত্তর দিলো, আগে শিক্ষক ছিলাম। মোল্লার বাড়িতে উনার মেয়েকে পড়াতাম। তারপর কিসে কি হল। আমাকে নিয়ে নানান কথা উঠলো। আমি নাকি উনার মেয়ের সাথে প্রেম করি। এরপর চাকরিটা চলে গেলো। আমাকে বের করে দিলো বাসা থেকে।

কাকা অবাক হয়ে শুনছিলেন। এবার জিজ্ঞেস করলেন, এরপর? আপনি কিছু বললেন না?

লোকটি অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠলো। না ভাই, আমি কিছুই বলি নি। এমনকি মোল্লা বাড়ির বড় ছেলে যখন আমাকে তার ভাড়া করা গুন্ডা দিয়ে পিটালো তখনো কিছু বলিনি। বলার শক্তি ছিল না। মার খেয়ে সারারাত পড়ে ছিলাম রাস্তার পাশের বনে। কেউ দেখেনি। আপনি নতুন, তাই হয়তো জানেন না। এলাকার সবাই জানে।

কাকার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বলল, আপনার কথা শুনে কষ্ট পেলাম ভাই। কেউ প্রতিবাদ করল না। একটা নির্দোষ লোক মার খেলো। কেউ কিছু বলল না।

লোকটি আবারো হেসে বলল, বাদ দেন ভাই। স্কুল তো চলে এলো। আমি ডানে মোড় নেব। আপনি কোন পথে যাবেন?

কাকা বললেন, স্কুলের পিছনেই আমার বাড়ি।

আচ্ছা ভাই, গেলাম তাহলে। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো।

কাকা লোকটাকে বিদায় দিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। হটাত মনে পড়লো লোকটার নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি। সাথে সাথে ঘুরে লোকটিকে ডাক দিতে গেলেন।

সেখানে কেউ ছিল না। লোকটি কাকাকে বিদায় দিয়েছেন ২০ সেকেন্ডও হয়নি। এতো অল্প সময়ের মাঝে কোনোদিকে যাওয়া সম্ভব না। কাকা তবুও আঁতিপাঁতি করে খুজলেন। কিছুই মাথায় আসলো না। অবশেষে, কিছু বুঝে না পেয়ে বাড়ির দিকে চলে গেলেন।

পরের দিন সকালে দাঁত ব্রাশ করার সময় কাকার দেখা হয় করিম সাহেবের সাথে। কোশল বিনিময়ের পর কাকা উনাকে প্রশ্ন করলেন, মোল্লা বাড়ির শিক্ষক সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা।

করিম সাহেব প্রথমে একটু অবাক হলেন। বললেন, আপনাকে উনার সম্পর্কে কে বলল?

কাকা বললেন, উনার সাথে দেখা হয়েছিলো আমার। বেচারার মনে অনেক কষ্ট দেখলাম। উনার সাথে অবিচার হয়েছে। বারবার আমাকে সে কথা বলছিল।

করিম সাহেব কথাটি শুনে চমকে উঠলেন। এতটাই চমকালেন যে উনার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেলো।

কাকা লক্ষ্য করলেন ব্যাপারটা। বললেন, কোনও সমস্যা?

করিম সাহেব ভয়ার্ত গলায় বললেন, উনার সাথে আপনার কথা হয় কিভাবে? উনাকে তো বছর চারেক আগে পুরানো রিক্সা স্ট্যান্ডের পাশের জঙ্গল থেকে মৃত উদ্ধার করা হয়। লোকজন বলাবলি করছিলো, মোল্লা সাহেবের ছেলের কাজ। পুলিশ এসেছিলো। কিন্তু কোনও সুরাহা করতে পারেনি সুত্রের অভাবে।

কাকা যেনও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আস্তে আস্তে বললেন, উনার সাথে কি মোল্লা সাহেবের মেয়ের কোনও সম্পর্ক ছিল?

করিম সাহেব বললেন, জি। মোল্লা সাহেব মেয়েকে বিয়ে দেয়ার অনেক চেষ্টা করছিলো। কিন্তু মেয়ে ঐ শিক্ষককে পছন্দ করতো। তাই রাজি হচ্ছিল না। শেষে যখন শিক্ষকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, সেদিনই মেয়ে ঘরে ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। কিন্তু আপনাকে এতো সব বলল কে বলুন তো?

কাকা আপনমনে মাথা নাড়লেন। আর বললেন, আচ্ছা, ঐ শিক্ষক দেখতে কেমন ছিলেন?

দেখতে শুনতে ভালোই ছিলেন। কথাবার্তা খুব একটা বলতেন না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতেন শুধু। আর হ্যাঁ, কপালে একটা কাঁটা দাগ ছিল।

কাকা এবার চমকে উঠলেন। শেষবার যখন লোকটার মুখের দিকে ভালোভাবে তাকিয়েছিলেন তখন উনি ঐ কাঁটা দাগটা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন!

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!