দূর সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ । সেখানে কেবল তাসের সাহেব , তাসের বিবি , টেক্কা এবং গোলামের বাস । দুরি তিরি হইতে নহলা-দহলা পর্যন্ত আরো অনেক-ঘর গৃহস্থ আছে, কিন্তু তাহারা উচ্চজাতীয় নহে । টেক্কা সাহেব গোলাম এই তিনটেই প্রধান বর্ণ, নহলা-দহলারা অন্ত্যজ- তাহাদের সহিত এক পঙ্ক্তিতে বসিবার যোগ্য নহে ।
কিন্তু, চমৎকার শৃঙ্খলা । কাহার কত মূল্য এবং মর্যাদা তাহা বহুকাল হইতে স্থির হইয়া গেছে , তাহার রেখামাত্র ইতস্তত হইবার জো নাই । সকলেই যথানির্দিষ্ট মতে আপন আপন কাজ করিয়া যায়। বংশাবলিক্রমে কেবল পূর্ববর্তীদিগের উপর দাগা বুলাইয়া চলা । সে যে কী কাজ তাহা বিদেশীর পক্ষে বোঝা শক্ত । হঠাৎ খেলা বলিয়া ভ্রম হয় । কেবল নিয়মে চলাফেরা , নিয়মে যাওয়া-আসা , নিয়মে ওঠাপড়া । অদৃশ্য হস্তে তাহাদিগকে চালনা করিতেছে এবং তাহারা চলিতেছে । তাহাদের মুখে কোনো ভাবের পরিবর্তন নাই । চিরকাল একমাত্র ভাব ছাপ মারা রহিয়াছে । যেন ফ্যাল্-ফ্যাল্ ছবির মতো । মান্ধাতার আমল হইতে মাথার টুপি অবধি পায়ের জুতা পর্যন্ত অবিকল সমভাবে রহিয়াছে ।
কখনো কাহাকেও চিন্তা করিতে হয় না , বিবেচনা করিতে হয় না ; সকলেই মৌন নির্জীবভাবে নিঃশব্দে পদচারণা করিয়া বেড়ায় ; পতনের সময় নিঃশব্দে পড়িয়া যায় এবং অবিচলিত মুখশ্রী লইয়া চিৎ হইয়া আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকে । কাহারো কোনো আশা নাই , অভিলাষ নাই , ভয় নাই, নূতন পথে চলিবার চেষ্টা নাই , হাসি নাই , কান্না নাই , সন্দেহ নাই , দ্বিধা নাই । খাঁচার মধ্যে যেমন পাখি ঝট্পট্ করে , এই চিত্রিতবৎ মূর্তিগুলির অন্তরে সেরূপ কোনো-একটা জীবন্ত প্রাণীর অশান্ত আক্ষেপের লক্ষণ দেখা যায় না । অথচ এককালে এই খাঁচাগুলির মধ্যে জীবের বসতি ছিল — তখন খাঁচা দুলিত এবং ভিতর হইতে পাখার শব্দ এবং গান শোনা যাইত । গভীর অরণ্য এবং বিস্তৃত আকাশের কথা মনে পড়িত ।
এখন কেবল পিঞ্জরের সংকীর্ণতা এবং সুশৃঙ্খল শ্রেণী-বিন্যস্ত লৌহশলাকাগুলাই অনুভব করা যায়— পাখি উড়িয়াছে কি মরিয়াছে কি জীবন্মৃত হইয়া আছে , তাহা কে বলিতে পারে । আশ্চর্য স্তব্ধতা এবং শান্তি । পরিপূর্ণ স্বস্তি এবং সন্তোষ । পথে ঘাটে গৃহে সকলই সুসংহত , সুবিহিত — শব্দ নাই , দ্বন্দ্ব নাই , উৎসাহ নাই , আগ্রহ নাই — কেবল নিত্য-নৈমিত্তিক ক্ষুদ্র কাজ এবং ক্ষুদ্র বিশ্রাম । সমুদ্র অবিশ্রাম একতানশব্দপূর্বক তটের উপর সহস্র ফেনশুভ্র কোমল করতলের আঘাত করিয়া সমস্ত দ্বীপকে নিদ্রাবেশে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে — পক্ষীমাতার দুই প্রসারিত নীলপক্ষের মতো আকাশ দিগ্দিগন্তের শান্তিরক্ষা করিতেছে । অতিদূর পরপারে গাঢ় নীল রেখার মতো বিদেশের আভাস দেখা যায় — সেখান হইতে রাগদ্বেষের দ্বন্দ্বকোলাহল সমুদ্র পার হইয়া আসিতে পারে না ।
সেই পরপারে , সেই বিদেশে, এক দুয়ারানীর ছেলে এক রাজপুত্র বাস করে । সে তাহার নির্বাসিত মাতার সহিত সমুদ্রতীরে আপনমনে বাল্যকাল যাপন করিতে থাকে । সে একা বসিয়া বসিয়া মনে মনে এক অত্যন্ত বৃহৎ অভিলাষের জাল বুনিতেছে ।
সেই জাল দিগ্দিগন্তরে নিক্ষেপ করিয়া কল্পনায় বিশ্বজগতের নব নব রহস্যরাশি সংগ্রহ করিয়া আপনার দ্বারের কাছে টানিয়া তুলিতেছে । তাহার অশান্ত চিত্ত সমুদ্রের তীরে আকাশের সীমায় ঐ দিগন্তরোধী নীল গিরিমালার পরপারে সর্বদা সঞ্চরণ করিয়া ফিরিতেছে — খুঁজিতে চায় কোথায় পক্ষীরাজ ঘোড়া , সাপের মাথায় মানিক , পারিজাত পুষ্প , সোনার কাঠি , রুপার কাঠি পাওয়া যায়, কোথায় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে দুর্গম দৈত্যভবনে স্বপ্নসম্ভবা অলোকসুন্দরী রাজকুমারী ঘুমাইয়া রহিয়াছেন । রাজপুত্র পাঠশালে পড়িতে যায় , সেখানে পাঠান্তে সদাগরের পুত্রের কাছে দেশ-বিদেশের কথা এবং কোটালের পুত্রের কাছে তাল-বেতালের কাহিনী শোনে । ঝুপ্ ঝুপ্ করিয়া বৃষ্টি পড়ে , মেঘে অন্ধকার হইয়া থাকে — গৃহদ্বারে মায়ের কাছে বসিয়া সমুদ্রের দিকে চাহিয়া রাজপুত্র বলে , মা , একটা খুব দূর দেশের গল্প বলো ।
মা অনেক ক্ষণ ধরিয়া তাঁহার বাল্যশ্রুত এক অপূর্ব দেশের অপূর্ব গল্প বলিতেন- বৃষ্টির ঝর্ঝর্ শব্দের মধ্যে সেই গল্প শুনিয়া রাজপুত্রের হৃদয় উদাস হইয়া যাইত । একদিন সদাগরের পুত্র আসিয়া রাজপুত্রকে কহিল , সাঙাত , পড়াশুনা তো সাঙ্গ করিয়াছি, এখন একবার দেশভ্রমণে বাহির হইব, তাই বিদায় লইতে আসিলাম । ” রাজার পুত্র কহিল , “ আমিও তোমার সঙ্গে যাইব । ” কোটালের পুত্র কহিল , “ আমাকে কি একা ফেলিয়া যাইবে। আমিও তোমাদের সঙ্গী । ” রাজপুত্র দুঃখিনী মাকে গিয়া বলিল , “ মা , আমি ভ্রমণে বাহির হইতেছি — এবার তোমার দুঃখমোচনের উপায় করিয়া আসিব । ” তিন বন্ধুতে বাহির হইয়া পড়িল ।
সমুদ্রে সদাগরের দ্বাদশতরী প্রস্তুত ছিল- তিন বন্ধু চড়িয়া বসিল । দক্ষিণের বাতাসে পাল ভরিয়া উঠিল, নৌকাগুলা রাজপুত্রের হৃদয়বাসনার মতো ছুটিয়া চলিল ।
শঙ্খদ্বীপে গিয়া একনৌকা শঙ্খ , চন্দনদ্বীপে গিয়া এক-নৌকা চন্দন , প্রবালদ্বীপে গিয়া এক-নৌকা প্রবাল বোঝাই হইল । তাহার পর আর চারি বৎসরে গজদন্ত মৃগনাভি লবঙ্গ জায়ফলে যখন আর-চারিটি নৌকা পূর্ণ হইল তখন সহসা একটা বিপর্যয় ঝড় আসিল । সব-কটা নৌকা ডুবিল , কেবল একটি নৌকা তিন বন্ধুকে একটা দ্বীপে আছাড়িয়া ফেলিয়া খান্ খান্ হইয়া গেল ।
এই দ্বীপে তাসের টেক্কা , তাসের সাহেব , তাসের বিবি , তাসের গোলাম যথানিয়মে বাস করে এবং দহলা-নহলাগুলাও তাহাদের পদানুবর্তী হইয়া যথানিয়মে কাল কাটায় ।
তাসের রাজ্যে এতদিন কোনো উপদ্রব ছিল না । এই প্রথম গোলযোগের সূত্রপাত হইল ।
এতদিন পরে প্রথম এই একটা তর্ক উঠিল — এই-যে তিনটে লোক হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলায় সমুদ্র হইতে উঠিয়া আসিল , ইহাদিগকে কোন্ শ্রেণীতে ফেলা যাইবে । প্রথমত , ইহারা কোন্ জাতি — টেক্কা , সাহেব , গোলাম না দহলা-নহলা ? দ্বিতীয়ত , ইহারা কোন্ গোত্র — ইস্কাবন , চিড়েতন , হরতন অথবা রুহিতন ? এ-সমস্ত স্থির না হইলে ইহাদের সহিত কোনোরূপ ব্যবহার করাই কঠিন । ইহারা কাহার অন্ন খাইবে , কাহার সহিত বাস করিবে, ইহাদের মধ্যে অধিকারভেদে কেই বা বায়ুকোণে , কেই বা নৈর্ঋতকোণে , কেই বা ঈশানকোণে মাথা রাখিয়া এবং কেই বা দণ্ডায়মান হইয়া নিদ্রা দিবে, তাহার কিছুই স্থির হয় না । এ রাজ্যে এতবড়ো বিষম দুশ্চিন্তার কারণ ইতিপূর্বে আর কখনো ঘটে নাই । কিন্তু ক্ষুধাকাতর বিদেশী বন্ধু তিনটির এ-সকল গুরুতর বিষয়ে তিলমাত্র চিন্তা নাই । তাহারা কোনো গতিকে আহার পাইলে বাঁচে । যখন দেখিল তাহাদের আহারাদি দিতে সকলে ইতস্তত করিতে লাগিল এবং বিধান খুঁজিবার জন্য টেক্কারা বিরাট সভা আহ্বান করিল , তখন তাহারা যে যেখানে যে-খাদ্য পাইল খাইতে আরম্ভ করিয়া দিল । এই ব্যবহারে দুরি তিরি পর্যন্ত অবাক । তিরি কহিল , ভাই দুরি , ইহাদের বাচবিচার কিছুই নাই ।
দুরি কহিল , “ ভাই তিরি , বেশ দেখিতেছি ইহারা আমাদের অপেক্ষাও নীচজাতীয় ” । আহারাদি করিয়া ঠাণ্ডা হইয়া তিন বন্ধু দেখিল , এখানকার মানুষগুলা কিছু নূতন রকমের । যেন জগতে ইহাদের কোথাও মূল নাই । যেন ইহাদের টিকি ধরিয়া কে উৎপাটন করিয়া লইয়াছে , ইহারা একপ্রকার হতবুদ্ধিভাবে সংসারের স্পর্শ পরিত্যাগ করিয়া দুলিয়া দুলিয়া বেড়াইতেছে । যাহা-কিছু করিতেছে তাহা যেন আর-একজন কে করাইতেছে । ঠিক যেন পুৎলাবাজির দোদুল্যমান পুতুলগুলি মতো । তাই কাহারও মুখে ভাব নাই , ভাবনা নাই , সকলেই নিরতিশয় গম্ভীর চালে যথানিয়মে চলাফেরা করিতেছে । অথচ সবসুদ্ধ ভারি অদ্ভুত দেখাইতেছে । চারি দিকে এই জীবন্ত নির্জীবতার পরম গম্ভীর রকমসকম দেখিয়া রাজপুত্র আকাশে মুখ তুলিয়া হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিল । এই আন্তরিক কৌতুকের উচ্চ হাস্যধ্বনি তাসরাজ্যের কলরবহীন রাজপথে ভারি বিচিত্র শুনাইল ।
এখানে সকলই এমনি একান্ত যথাযথ , এমনি পরিপাটি , এমনি প্রাচীন , এমনি সুগম্ভীর যে কৌতুক আপনার অকস্মাৎ-উচ্ছ্বসিত , উচ্ছৃঙ্খল শব্দে আপনি চকিত হইয়া, ম্লান হইয়া, নির্বাপিত হইয়া গেল — চারিদিকের লোকপ্রবাহ পূর্বাপেক্ষা দ্বিগুণ স্তব্ধ গম্ভীর অনুভূত হইল । কোটালের পুত্র এবং সদাগরের পুত্র ব্যাকুল হইয়া রাজপুত্রকে কহিল , ভাই সাঙাত , এই নিরানন্দ ভূমিতে আর একদণ্ড নয় । এখানে আর দুই দিন থাকিলে মাঝে মাঝে আপনাকে স্পর্শ করিয়া দেখিতে হইবে জীবিত আছি কি না । রাজপুত্র কহিল , “ না ভাই , আমার কৌতূহল হইতেছে । ইহারা মানুষের মতো দেখিতে – ইহাদের মধ্যে এক-ফোঁটা জীবন্ত পদার্থ আছে কি না একবার নাড়া দিয়া দেখিতে হইবে । ”
গল্পটির দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন