এই সকালে কুয়ালালামপুর শহরটা নরম রোদের আলোয় ডুবে রয়েছে। সেই সঙ্গে মৃদুমন্দ বাতাসও বইছে। রোদ ছড়িয়ে আছে সেগামবুট, দামানসারা, লেইক গার্ডেন্স, তাসিক টিটিওয়াঙ্গসা, আমপাঙ এবং স্টেডিয়াম নেগারার ওপর । মৃদুমন্দ বাতাস বইছে জালান সুলতান সালাহুদ্দিন সড়ক, জালান সুলতান ইসমাইল সড়ক, এবং এর উত্তরে পুত্রা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, দক্ষিণে মারদেকা স্কোয়ার এবং চায়নাটাউন-এর ওপর। সেই রোদ জামালের ঘামে ভেজা শরীরটিও ছুঁয়ে যায় বৈ কি। আজও আঠারো তলার ওপরে চেন লি ওং ভয়ঙ্কর নির্দেশ দিতে পারে। জামাল ঘামস্রোত টের পায়।
পয়তাল্লিশ বছর বয়েসি চিনাটির হলদে মুখটি গোলাকার, তির্যক চোখে শীতল চাউনি; জামালকে দিয়ে বিপদজনক সব কাজ করিয়ে নেয়। লোকটা কি মানসিক ভারসাম্যহীন? জামাল জানে সব চিনেই হয়তো চেন লি ওং এর মতো মানসিক বিকারগ্রস্থ নয়, কেবল চেন লি ওং-ই ওরকম … কুয়ালালামপুর শহরের মারদেকা স্কোয়ার। সেখানেই গড়ে উঠছে বহুতল বানিজ্যিক ভবনটি। মাস ছয়েক ধরে কাজ করছে জামাল। কন্সস্ট্রাকশন সুপারভাইজার চেন লি ওং প্রথম থেকেই ওর ওপর অজানা কারণে খড়গহস্ত। বাংলাদেশি শ্রমিক বলে? মালয়েশিয়ার কন্সস্ট্রাকশন সার্কেলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা গিজগিজ করছে। এদের দাপটে একদিন মালয়েশিয়ায় চিনেরা সংখ্যালঘু হয়ে উঠতে পারে -এ কারণে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চিনেদের এত ভয়? বাংলাদেশিদের প্রকৃত আত্মাকে এইসব চিনেরা কোনওদিনই চিনতে পারবে না। যেমন, জামালের জন্ম পদ্মা নদীর তীরে।
হরিরামপুরের রামকৃষ্ণপুর বলে একটি জায়গায়। বাড়ির সামান্য দক্ষিণে পদ্মার বিরাট প্রবাহ। ছেলেবেলা থেকেই পদ্মার বিশাল বি¯তৃতি নিয়ে বড় হয়েছে ও। প্রথম প্রথম বিস্ময় ছিল, পরে সে বিস্ময় কাটিয়ে নিজেকে আবিস্কারের নেশা। পদ্মায় সাঁতার কাটা, নৌকা বাওয়া …এতে করে ওর বুকে যে দুর্দন্ত সাহসের জন্ম নিয়েছে তা চিনে কন্সস্ট্রাকশন সুপারভাইজার চেন লি ওং এর জানার কথা না। নদীর ধার ঘেঁষেই কাটল জীবনের বাইশ বছর। তারপর জীবিকার সন্ধানে প্রথমে শহর ঢাকা, তারপরে কুয়ালালামপুর শহর। ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে বাবা পৈত্রিক জমাজমি নগদ ২ লাখ ১০ হাজার বিনিময়ে বিক্রি করতে কার্পন্য করেননি-এমনই বিরাট হৃদয় তার। তবে বিদেশে এসে দিশেহারা জামাল। নির্মীয়মান ভবনটির নিচের দিকের একটি কক্ষে জামালের ঘুমাবার স্থান।
খাওয়া-দাওয়া অন্যান্য বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গেই। রান্নাবান্না, গোছলের পানি নিয়ে প্রতিনিয়ত তামিল শ্রমিকদের সঙ্গে যুদ্ধ। এরাও বাংলাদেশিদের ওপর বিরূপ। জামালের কান্না পায় …তাও ভালো; কারণ, ১ হাজার ৪৫৭ জন বাংলাদেশি শ্রমিক এখন মালয়েশিয়ার জেলে দুঃসহ সময় পাড়ি দিচ্ছে … … বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কেফায়েত উল্লাহ বলেন, বিদেশে কোনো শ্রমিক গ্রেপ্তারের খবর পেলেই দূতাবাসের মাধ্যমে তাঁরা খোঁজখবর নেন এবং মুক্ত করার চেষ্টা করেন। মালয়েশিয়ার এই শ্রমিকদের বিষয়টি হাইকমিশন এবং মন্ত্রণালয় গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। তাঁদের কীভাবে দেশে ফেরত আনা যায়, সে ব্যাপারে সরকার সচেষ্ট আছে। তবে অবৈধভাবে যেন কেউ মালয়েশিয়ায় না যান, সে ব্যাপারে তিনি সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান।
কেফায়েত উল্লাহ জানান, আটক শ্রমিকদের মুক্তিসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী এ মাসেই মালয়েশিয়া যাবেন। আশা করা যায়, এরপর ইতিবাচক কিছু হবে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রথম সচিব ও শ্রম কাউন্সেলর মাসুদুল হাসান বলেছেন, কোনো শ্রমিকের গ্রেপ্তারের সংবাদ জানতে পারলেই হাইকমিশন তাঁর ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়। এরপর তাঁরা যে কোম্পানিতে কাজ করতে এসেছিলেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে সরাসরি অভিবাসন কর্তৃপক্ষকেও চিঠি দিয়ে শ্রমিকদের মুক্তির অনুরোধ জানানো হয়। যেসব কারণে গ্রেপ্তার: মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের কারণে অথবা মালয়েশিয়ায় থাকার বৈধ কাগজপত্র না থাকার কারণে এসব বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অনেকে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও পালিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেন। ফলে তাঁরা গ্রেপ্তার হন। মাসুদুল হাসান জানান, মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইন-১৯৫৯-এর ধারা ৬(১) সি/১৫ (১) সি এবং পাসপোর্ট আইন ১৯৬৬-এর ১২ (১) ধারা অনুযায়ী এসব বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইন-১৯৫৯-এর ৬(১) সি ধারায় বলা হয়েছে, বৈধ অনুমতি ছাড়া কেউ মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে পারবে না। আর ১৫ (১) সি-তে বলা হয়েছে, কেউ যিনি দিনের ভিসা বা অনুমতি নিয়ে মালয়েশিয়া আসবেন, সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর থাকতে পারবেন না। পাসপোর্ট আইন ১৯৬৬-এর ১২ (১) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি পাসপোর্ট বা ভিসা জালিয়াতি করেন বা কোনো মিথ্যা তথ্য দেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। হাইকমিশন ও মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসা অনেকেই জানিয়েছেন, অনেকেই সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া আসেন এবং তাঁদের এই ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ছাড়া অনেকেই নির্ধারিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও মালয়েশিয়া থাকেন। ফলে পুলিশ তাঁদের আটক করে। বিভিন্ন শিবিরে বন্দী ৯২৯ জন: মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শিবিরে মোট ৯২৯ জন আটক রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে লেংগিং শিবিরে এক নারীসহ মোট ২৯১ জন বন্দী আছেন। মাসুদুল হাসান জানান, কাউকে গ্রেপ্তারের পরপরই শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারের রায় হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁকে শিবিরে থাকতে হয়। রায় হওয়ার পর তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। আবার সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দেশে ফেরত আসার আগেও তাঁকে কয়েক দিন শিবিরে থাকতে হতে পারে। মালয়েশিয়া থেকে ফিরে আসা ফেরদৌস ও জুয়েল নামের দুই শ্রমিক জানান, শিবিরগুলোতে প্রায়ই বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতন করা হয়। অনেক সময় ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয় না।
বিভিন্ন সময়ে ফেরত আসা আরও অনেক শ্রমিক একই অভিযোগ করেছেন। জেল খাটছেন ৫২৮ জন: মালয়েশিয়ার জেলে সাজা খাটছেন এক নারীসহ ৫২৮ জন। অভিবাসন আইন ভাঙায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে জেলিবু জেলে ৩২ জন সাজা খাটছেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা আইন ১৯৯০-এর অধীনে শাদুল ইসলাম নামের একজন সাজা খাটছেন টেমপাট তাহানান পারলিনডুংগান জেলে। (তথ্যসূত্র: প্রথম আলো। শনিবার, ৭ নভেম্বর ২০০৯) … রান্নাবান্না, গোছলের পানি নিয়ে প্রতিনিয়ত তামিল শ্রমিকদের সঙ্গে যুদ্ধ। এরাও বাংলাদেশিদের ওপর বিরূপ। জামালের কান্না পায় … অন্ধকারে মায়ের প্রসন্ন শ্যামলা মুখখানি ভেসে ওঠে। অন্ধকারে বোন শিউলির মুখ ভেসে ওঠে। অন্ধকারে প্রেমিকা শিরিনের মুখ ভেসে ওঠে। …জামালের বয়েস তখন আঠারো কি উনিশ । সে, আশ্বিনের এক সুন্দর সকালে রামকৃষ্ণপুর ঘাট থেকে বালিকা শিউলি ও কিশোরী শিরিনকে নৌকায় তুলে দক্ষিণে যাত্রা করে।
ওপারে চর বয়রা। আশ্বিনের মনোরম দিনটি ঝলমলে রোদে ভাসছিল। পদ্মা নদীর পানি ঝিকমিক করছিল। আর গাঙের বাতাস ঝাপটা মারছিল ওদের মুখচোখে। স্বাধীনতার আস্বাদ পেয়ে বালিকা শিউলি ও কিশোরী শিরিন-এর মুখ আনন্দে চকচক করছিল। তারা নৌকার গলুয়ের ওপর পাশাপাশি বসে গল্প করছিল। ঘন্টা দেড়েক পরে চর বয়রার ঘাটে নৌকা ভেড়ায় জামাল। তখন আশেপাশে গভীর ছায়া জমেছে। চর বয়রার ঘাটে বন্ধু সুশান্ত দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে আগেই খবর দিয়ে রেখেছিল। সুশান্ত জামালদের দেখে খুশি হয়। চেক লুঙ্গির ওপর হলুদ রঙের শার্ট পরেছে সুশান্ত। ওর কাঁধ অবধি ঢেউ খেলানো বাতাসে ওড়ে। সুশান্ত এখন টেমপাট তাহানান পারলিনডুংগান জেলে। সুশান্তর বাড়ি চর বয়রার কুমার পাড়ায়।
চরের বালিতে পা ডুবিয়ে তারা সেদিকে যেতে থাকে। শিউলির কানে কানে শিরিন কী সব বলে। শিউলি হাসে। আড়চোখে সুশান্তর দিকে তাকায়। শিরিনও হাসে। তবে ও খানিকটা সুন্দরী বলেই গম্ভীর হয়ে থাকে। কোথাও ঢাক বাজছে। এ মাসেই পূজা। সুশান্তদের উঠান ঘেরা ছিমছাম ঘরদোর। এখানে ওখানে মাটির তৈরি হাঁড়িপাতিল ছড়িয়ে। সুশান্তর মা আর বোনেরা নতুন অতিথিদের দেখে ভারি খুশি হয়ে ওঠে। কাঁসার থালায় নাড়– এল, মুড়ি এল, গুড় এল। কাঁসার গেলাসে এল ডাবের পানি। উষ্ণ অভ্যর্থনায় শিউলি ও শিরিন-এর মুখ আনন্দে চকচক করছিল। জামাল লক্ষ করছিল। দুপুরে কি দিয়া ভাত খাবা মায়েরা? সুশান্তর মা মনোরমা মাসী জানতে চাইলেন। মাসীর মিষ্টি কন্ঠস্বরে শিউলি অবাক হয়ে যায়। জামাল মিটমিট করে হাসলেও শিউলি ও শিরিন চুপ করে থাকে। বুঝছি। যাও অখন আমাগো গ্রামখানি ঘুইরা দেইয়া আস। ওর দৌড়ে উঠান পেরিয়ে আসে। সঙ্গে জুটল সুশান্তর বোন বীণা। ফরসা, দীর্ঘাঙ্গি বীণা কিশোরী। ওর হাঁটাচলায় লীলায়িত ছন্দ । জানা গেল বীণা নাচতে জানে।
(শিরিন লক্ষ করছিল জামাল ঘন ঘন বীণার ফরসা সুন্দর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল কি না …) শিরিন বলল. তোমার নাচ দেখুম বীণা। হ, হ, দেখুম। শিউলিও বলে ওঠে। বীণা প্রথমে রাজী হয় না। পরে রাজী হয়। ততক্ষণে ওরা এক মাঠের মতন নির্জন স্থানে চলে এসেছে। আকাশে ও চর বয়রার মাটিতে গাছপালার ওপর গভীর ছায়া পড়েছে। শিউলি খুব রেডিও শোনে। সে অনেক গান জানে। শিউলিই গাইল। ‘পলাশ ডাকা কোকিল ডাকা আমার এদেশ ভাইরে। ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলানো এমন কোথাও নাইরে ।’ বীণা নাচে। ওর নৃত্যরত ভঙিতে সকলেই বিস্মিত হয়ে যায়। চর বয়রার কুমারপাড়ার মেয়ে – এমন করে নাচতে শিখল কি করে। শিউলির কন্ঠস্বরটিও কিন্তু চমৎকার। জামাল অবাক হয়ে যায়।
দুপুরে মনোরমা মাসী চিংড়ি মাছের ভর্তা ও বেলে মাছের তরকারি রেঁধেছিলেন। ওরা আরাম করে খায়। তবে শিরিনের মুখটি গম্ভীর দেখায়। কেননা, এক ফাঁকে বীণা জামালের পাতে এক টুকরো বেলে মাছ তুলে দিয়েছে। বীণাকে শিরিণ ঈর্ষা করতে থাকে। এবং এ নিয়ে পরে জামালের সঙ্গে ঝগড়া করবে বলে ঠিক করল। খেতে খেতে মাসীর রান্নার অকুন্ঠ প্রশংসা করে। মনোরমা মাসীর প্রসন্ন ফরসা মুখটি তে আনন্দের আভা ফোটে। যেন এই প্রশংসার জন্যই অপেক্ষা করেছিলেন। যাওয়ার সময় মনোরমা মাসী বললেন, তুমরা আবার আইস। পূজার সময়- আসুম মাসী। আপনিও রামকৃষ্ণপুর যাইয়েন। যামু।
ঘাটে সুশান্তর কাছে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যার আগেই রামকৃষ্ণপুর ঘাটে নৌকা ভেড়ায় জামাল … ২ জামালকে আজ সুপারভাইজার চেন লি ওং কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছে। মারদেকা স্কোয়ারের একটি নির্মীয়মান বানিজ্যিক ভবনের প্রায় একশ আশি ফুট ওপরে বিপদজনক ভঙ্গিতে ঝুলতে থাকে জামাল। তবে দূরবর্তী এক নদীর পাড়ের ছায়া ও নদীর বাতাস ওকে সাহস যোগায় … সে ছায়ায় কখনও-বা পদ্মাপাড়ের শিরিনের মুখটি ভেসে ওঠে …সুপারভাইজার চেন লি ওং টের পায় না …বিকারগ্রস্থ লোকটার টের পাবার কথাও না …