ডিলিউশান

পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলার সময় বাসটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। জানালা দিয়ে পাহাড়, বড় বড় গাছ পেরিয়ে শূন্যতা দেখতে পেলাম আমি। খাড়া ঢালের পাশে এসে বাসটা ব্রেকফেল করেছে। কিছুক্ষণ শূন্যে ভেসে রইল সেটা ঐ অবস্থায়। তারপর প্রচন্ড জোরে গিয়ে আছড়ে পড়ল মাটিতে। পড়েই ঝাঁকি খেয়ে খেয়ে নামতে লাগল নিচে। চারিদিকে প্রচন্ড তান্ডব, চেচামেচি শুরু হয়েছে মানুষের। বাঁচার তীব্র আকুতি নিয়ে মানুষ ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে। আর আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি।

প্রথম ঝাঁকুনিতে বাসের ছাদের সাথে সংঘর্ষে আমার কাঁধটা ভেঙে গেল। গাছের ডাল ভাঙার মতো করে হাড় ভাঙার শব্দ পেলাম। গগন বিরাদী চিৎকার বেরিয়ে এলো আমার গলা দিয়ে। দ্বিতীয় ঝাঁকুনিতে প্রচন্ড জোরে কিছুর সঙ্গে আমার মাথা ঠুকে গেল। রক্ত ছিটকে এসে আমার চোখের পাপড়ি ভিজিয়ে দিল। আমি জ্ঞান হারালাম। কতক্ষণ কেটে গেল, কি হলো জানি না। অনেকক্ষণ পর এক টেকো ভদ্রলোককে আমার উপর ঝুঁকে থাকতে লাগলাম আমি। আমার গলায় বাম হাত রেখে কি যেন পরীক্ষা করছে সে। আরেক হাতে কব্জি চেপে ধরে পালস দেখছে। দেখা শেষ হলে হতাশ হয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল- “বেঁচে নেই।”

আমার বুকটা বোধহয় ধড়াস করে উঠল। কি বলে বেঁচে নেই? আমি বেঁচে নেই? সেটা কি করে হয়? এই তো দেখতে পাচ্ছি সব, শুনতে পাচ্ছি, শরীরে টেকো ভদ্রলোকের হাতের স্পর্শ টের পাচ্ছি, তারপরও বলছে আমি বেঁচে নেই? বেঁচে থাকার সংজ্ঞা কি তাহলে? ভদ্রলোক এবার হাত দিয়ে আমার খোলা চোখ বন্ধ করে দিলেন। আমি চিৎকার করে বলতে চাইলাম, “কি করছেন আপনি? কি করছেন? আমি তো বেঁচে আছি! আমাকে বাঁচতে দিন!!” আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। অব্যক্ত বেদনায় আমি গলা ছেড়ে কাঁদতে চাইলাম। কিন্তু কণ্ঠস্বরও বুঝি প্রতারণা করল, আমি কাঁদতেও ব্যর্থ হলাম। হঠাৎ কেমন সবকিছু বদলে গেল চারপাশে! ধড়ফড় করে উঠে বসে বসলাম নিজের বিছানায়। ঘেমে নেয়ে গেছি পুরোপুরি।

নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, হাত পা ঠিকই আছে। ঘাড় মটকায়নি, এক্সিডেন্টও হয়নি কোন। আমি ঠিক আছি। দুঃস্বপ্ন দেখেছি। আমার পাশে শুয়ে ছিল আমার স্ত্রী, পিয়া। আমার ছটফটানিতে তারও ঘুম ভেঙ্গেছে। সে উঠে বসে আমার হাতে হাত রাখল। মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল- “স্বপ্ন দেখেছ?” আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। মৃত্যু এবং জীবনের মধ্যে কত স্বল্প দূরত্ব আমি সেটা টের পেয়েছি। পিয়া আর কিছু জিজ্ঞেস না করে আমার হাত ধরে আমাকে বাথরুমে নিয়ে গেল। বলল- “একটু হাত মুখ ধুয়ে নাও, স্বপ্নের ঘোর কেটে যাবে।” আমি বেসিনের সামনে দাড়িয়ে জোরে জোরে পানির ছিটা দিতে লাগলাম সারা মুখে।

মনে হচ্ছে আমার নাকে-মুখে এখনো রক্ত লেগে আছে। পিয়া পাশ থেকে বলল- “মাথায় পানি দিয়ে দেব? ভালো লাগবে।” আমার মাথায় পানি দিতে লাগল সে। ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে আমার স্নায়ু শান্ত, সুস্থির হলো কিছুটা। আমি মাথা থেকে দুঃস্বপ্নটা ঝেরে ফেলতে চাইলাম। এই বেঁচে থাকাটাকে অনুভব করতে চাইলাম সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে। ঠিক তখনই আবার সব কেমন যেন ঝাপসা হয়ে গেল। আমার সারা শরীর কেমন যেন অনুভূতিশূন্য, কেমন নিষ্প্রাণ হতে লাগল আস্তে আস্তে। পৃথিবীটাকে ঝাপসা দেখলাম।

পরমুহূর্তেই সেই টেকো ভদ্রলোককে দেখতে পেলাম আবার চোখের সামনে। এক হাতে আমার চোখ বন্ধ করে আরেক হাতে একটা কাপড় দিয়ে আমার মুখমন্ডল ঢেকে দিচ্ছেন তিনি। আমার অস্তিত্ব কেঁপে উঠল ভয়ানক ভাবে, আমি তাহলে সত্যিই মারা গিয়েছি। মৃত্যুর আগে শেষ প্রতিচ্ছবি দেখেছি নিজের জীবনের! এবার আমি আর কষ্ট পেলাম না। আমার অনুভূতিগুলো মনে হচ্ছে একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে। শরীরটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে খুব অন্ধকার, জমাট বাঁধা, অজানা কোন বলয়ে। এভাবেই কি সবাই মারা যায়? চেতনার শেষ বিন্দু পর্যন্ত বেঁচে থাকার প্রচন্ড আকুতি আমার মধ্যে হাহাকার করে গেল।

আরো পড়তে পারেন...

পাখির কাছে শেখা

প্রতিদিন সকালে আমি যখন ঘুম থেকে উঠি দেখি একটা ছোট্ট সুন্দর নীল-হলুদ রঙের নাম না…

নেকড়ে, শেয়াল আর ভেড়ার গল্প (দক্ষিণ আফ্রিকার উপকথা)

এক নেকড়ে একদিন তার শিকার থেকে ফেরার সময় সামনে দেখে এক খামার বাড়ি আর সেখানে…

টিউবলাইট —- ঋতম সেন

বারান্দার সামনে দিয়ে তিনটে সাদা তার চলে গ্যাছে। রাস্তার ওপারের গাছটা ঝাঁকড়া হয়ে ল্যাম্পপোস্টটাকে প্রায়…