
চারিদিকে ভীষণ অভাব! কোথাও শান্তি নেই। নেই এতটুকু প্রশান্তির বাতাস। তাদের ঘরে ক্ষুধার আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলে অষ্টপ্রহর। কাজ নেই। অর্থও নেই। প্রয়োজনীয় খাদ্য নেই। রোগে-শোকে ওষুধপত্র নেই! কী নিদারুণ কষ্ট! কষ্ট আর কষ্ট! এইভাবে কি জীবন চলে? সংসার চলে! কী করা যায়! এইভাবে আর কতদিন? কতদিন আর এইভাবে বেঁচে থাকা যায়? সংসারের পুরুষরা দিশাহারা। স্ত্রীরা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। পাড়ায় পাড়ায় এমনি হাহাকার! এমনি দুর্দশা! সবাই চিন্তায় মগ্ন। একটা উপায় তো বের করা দরকার। কী সেই উপায়? পাড়ার মহিলারা অনেক ভেবে বের করলো একটা পথ। তারা সিদ্ধান্ত নিলো চলো আমরা বেরিয়ে পড়ি পাড়া ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, গোত্র ছেড়ে অন্য দিকে। খাবারের তালাশে। বিশ্বাস তাদের অটুট। স্বপ্নটাও ভোরের শিশির ভেজা ঘাসের মতো। তাদের বিশ্বাস আমরা নিশ্চয়ই পারবো। কেন পারবো না? আমরা তো মা! আমাদের কোলে ছোট ছোট বাচ্চা আছে। তারা চুক চুক করে বুকের দুধ খায়। আমরা খেতে না পাই, কিন্তু বাচ্চাদের খাবার ঠিকই আমাদের বুকে দিয়ে দিয়েছেন প্রভু। আল্লাহর এ এক আশ্চর্য কুদরত এবং রহমত! আমরা নিশ্চয়ই অন্য কোনো গোত্রে গিয়ে এমন কিছু পাবো যাদেরকে দুধ পান করালে আমরা কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারবো। আর তাতে আমাদের অভাবও ঘুচে যাবে। তা ঠিক, তা ঠিক। সবাই একমত হয়ে যায়। তবে আর দেরি কেন? না, দেরি নয়। চলো দ্রুত বেরিয়ে পড়ি ভাগ্যের অন্বেষণে। তারা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। তাদের গোত্রের নাম বনু সাদ। এই দলের মধ্যে ছিলেন একজন সৌভাগ্যবতী মা তার নাম হালিমা। হালিমাও অন্য মহিলাদের সাথে বেরিয়ে পড়লেন। তার সাথে আছে স্বামী, একটি দুগ্ধপোষ্য ছোট্ট শিশুপুত্র এবং একটি জীর্ণ-শীর্ণ বয়স্ক উট। যে এক ফোঁটা দুধও দিতে পারতো না। তাদের উদ্দেশ্য কোথায় পাওয়া যায় দুধ-শিশু! যাদেরকে দুধ খাওয়ানোর বিনিময়ে অর্থ পাওয়া যায়! হালিমা তার পরিবারসহ একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। তিনি আর সইতে পারছিলেন না অভাবের কষ্টে। সংসারের এতগুলো পেট অভুক্ত থাকলে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলে কোন্ মা-ই আর স্থির থাকতে পারেন! হালিমাও পারেন না। তিনি ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তার দু’চোখ দিয়ে কষ্টের ঝর্ণা বয়। সেই ঝর্ণা এক সময় নদী হয়। সাগর হয়। তারপর সেখানে ওঠে বিশাল ঢেউ। সে কেবল কষ্টের ঢেউ! হালিমাসহ বনু সাদ গোত্রের মহিলারা দুধ-শিশুর খোঁজ করছেন। হালিমার কোলের শিশুটি ক্ষুধার যন্ত্রণায় কেবলই কাঁদছে। শিশুপুত্রের কান্নায় তা বুকের আগুন জ্বলে ওঠে দ্বিগুণ। ঐ সময় তাকে খাওয়ানোর এতটুকু দুধও তার বুকে ছিল না। উটের পালানেও না। তিনি দিশেহারা হয়ে একটি গাধার পিঠে উঠে বসলেন। সাথে কাফেলার অন্যরাও। ছুটতে থাকলেন সামনের দিকে। কোথায় পাওয়া যায় দুধ-শিশু! পথটা ছিল দীর্ঘ এবং দুর্গম। সবাই ক্লান্ত। ক্ষুধায় জর্জরিত। ঘামে ভিজে একাকার। বহুকষ্ট করে তারা মক্কায় পৌঁছুলেন। মক্কায় অনেক দুধশিশু পাওয়া যায়। আশা ও স্বপ্নে তাদের চোখ দু’টো দিঘির ঢেউয়ের মতো টল টল করে উঠলো। তারা খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলেন কুরাইশ গোত্রে। খোঁজ পান এই গোত্রে আবু তালিবের ঘরে একটি শিশুপুত্র আছে! তাদেরকে দেখে আবু তালিবও দারুণ খুশি। তাদের একে একে সবাইকে অনুরোধ করলেন তিনি তাদের শিশু পুত্রটিকে দুধ খাওয়ানোর ভার নেবার জন্য। দলের অন্যরা দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ শিশুটির পিতা নেই! পিতৃহীন শিশুর দুধ খাওয়ানোর ভার নিতে তারা রাজি হলো না। কিন্তু একজন, মাত্র একজন মা এগিয়ে গেলেন সামনে। তিনি দারুণ আনন্দে চাঁদের চেয়েও সুন্দর সেই পিতৃহীন শিশুটিকে কোলে তুলে বুকে জাপটে ধরলেন। অন্য মহিলারা তার আগেই দুধশিশু পেয়ে গেছে। বাকি ছিলেন শুধু একজন। মা হালিমা। তিনি তার স্বামীকে বললেন, সবাইতো দুধ-শিশু পেয়ে গেছে। আমিই কেবল পাইনি। এই কাফেলার সাথে আমি শূন্য হাতে ফিরে যেতে পারবো না। আমি এই এতিম শিশুটির ভার নেবো। তার দায়-দায়িত্ব আমিই বহন করবো। অর্থ-কড়ি যাই পাই না কেন! স্বামী বললেন, সত্যিই। আমারও খুব ভালো লাগছে শিশুটিকে। তুমি তাকে নিতে পারো। আল্লাহপাক হয়তো তাঁর মাধ্যমেই আমাদের জন্য অফুরন্ত কল্যাণ রেখেছেন! এতিম শিশুটিকে নিয়ে মা হালিমা রওনা দিলেন নিজেদের কাফেলার দিকে। গভীর রাত। একটু আগেও কোলের শিশুটিকে খাওয়াতে পারেননি একটু দুধ। ক্ষুধায় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে বাছা। অন্য পাশে আছেন সদ্য আনা চাঁদের চেয়েও সুন্দর শিশুটি। হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন তার বুকে দুধের ভার। তিনি তখনই নিজের ও সদ্য আনা শিশুটিকে দুধ খাওয়াতে শুরু করলেন। তারা দু’জনই পেট ভরে দুধ খেয়ে পরম তৃপ্তির সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে। আবার কী আশ্চর্য! হালিমার স্বামী দেখলেন যে উটের পালান ছিল একেবারে মরুভূমির শুষ্ক, সেই পালানই এখন দুধে টইটম্বুর! তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়। হৃদয় চিরে বেরিয়ে এলো আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার অঝোর বৃষ্টিধারা। তাঁরা দু’জনই সেই রাতে উটের দুধ খেলেন পেট ভরে। তখনও উটের পালান দুধে ভরপুর। সকালে হালিমার স্বামী আনন্দচিত্তে বললেন, দেখেছো হালিমা! আল্লাহর কী রহমত! বলেছিলাম না এই শিশুই আমাদের জন্য বয়ে আনবে আল্লাহর পক্ষ থেকে অশেষ কল্যাণ! বাস্তবেও দেখলে তো! জেনে রাখো, তুমি এক মহা কল্যাণময় শিশু এনেছো। হালিমা খুশি হয়ে বললেন, আমারও কিন্তু তাই মনে হয়। কাফেলা চলেছে এবার আপন গোত্রের দিকে। যে গোত্রে অভাবের কোনো শেষ ছিলো না। বৃষ্টি নেই। ফসল নেই। ঘাস লতা-পাতা নেই। ছিল শুধু খরা আর খরা। উট, ভেড়া, গাধাসহ পশুগুলোও খাবার না পেয়ে শুকিয়ে গেছে! তাদের শরীরে গোশতো নেই। পালানে দুই নেই। কী করুণ অবস্থা! ঘরে ফিরে আসার পর মা হালিমা দেখলেন এক আশ্চর্য পরিবর্তন। এখন তাদের ছাগল-ভেড়াগুলো সকালে বেরিয়ে যায় আর সন্ধ্যায় ফেরে পালান ভর্তি দুধসহ। সেই দুধ দুইয়ে তারা খান। বাড়ির পশুগুলোর স্বাস্থ্যও হয়ে উঠেছে নাদুস-নুদুস। এখন সেখানে বৃষ্টি হয়। আর তাতে ঘাস তরুলতা তরতাজা হয়ে ওঠে। মা হালিমার ঘরটি ভরে গেল আল্লাহর অশেষ নিয়ামতে। এইভাবেই কেটে গেল দু’টি বছর। এখন হালিমার শিশুটি যেমন স্বাস্থ্যবান, ঠিক তেমনি তার পালিত অপর সেই মহা সৌভাগ্যবান শিশুটিও। মা হালিমা সাহস করে যে এতিম শিশুকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন- তিনি আর কেউ নন জগৎসেরা মহামানব, জোছনাপ্লাবিত পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও সুন্দর নবী মুহাম্মদ (সা)। তাঁকে বুকে তুলে নিয়েই তো বদলে গেল মা হালিমার পরিবারের অবস্থা! কী সৌভাগ্যের পরশমণি নবী মুহাম্মদ (সা)! মা হালিমা সত্যিই সৌভাগ্যবতী এক দুধ-মা। শিশুপুত্র মুহাম্মদকে (সা) আদরে, সোহাগে বুকে তুলে নেবার কারণে যার পূর্বের সেই জীর্ণ ঘরে অঝোর ধারায় ঝরছিল আল্লাহর অফুরন্ত রহমত, নিয়ামত এবং বরকতের ঝরনাধারা। জীর্ণ ঘরে জোছনার হাসি! সে তো কেবল সৌভাগ্যেরই বৃষ্টি! আর তাঁকে যিনি সাহস করে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন, দুধ খাইয়ে বড় করেছিলেন তাঁর তুলনা এবং মর্যাদা! সে তো পরিমাপযোগ্য নয়। তার তো কোনো তুলনাই হয় না। রাসূল মুহাম্মদ (সা) যে পরশে জগৎ হাসে। —কায়েস মাহমুদ