১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। যাচ্ছি না ইচ্ছে করেই, মনে হচ্ছে এই বার না গেলে মার খাব। পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকলাম। ‘একি অবস্থা করেছিস তুই?’ আমি নিজের দিকে তাকালাম। লাল হাফ প্যান্ট আর সবুজ গেঞ্জিতে মাটি মেখে একাকার। পায়ের মাটি তাজা। ঘরের মেছেতে ছোপছোপ দাগ। হাতের মাটি শুকিয়ে খড়খড় করছে। ‘
এই মাত্র পরিষ্কার জামাকাপড় পরে খেলতে গেলি, আর এর মধ্যে এত মাটি কোথা থেকে এল?’ ‘বাগান করছিলাম।’ ‘বাগান করছিলি? এই কি তার নমুনা? বাগান করলে এ রকম হয় কখনো? ঠিকঠিক বল কি করছিলি? মাকে বলা যাবে না ঠিক কি করছিলাম। চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম। ক’দিন আগে পিন্টুদের বাড়ি গিয়ে ছিলাম। ওদের দোতালায় একটা ঘর পুরোপুরি হতে এখন বাকি। তার মেঝেতে বালি ছিল এক ঢিপি। বালিটা বৃষ্টিতে ভিজে গেচ্ছিল।
তার থেকে পিন্টু একটা বালির শহর করেছিল, মিশরের মত। নাম দিয়েছিল মিশর সভ্যতা। আমি ভুল করে পা রেখে দিয়েছিলাম আর ভেঙে যায় কিছুটা। ও তারপরে আর ঐ জায়গাটা ঠিক করে উঠতে পারেনি। আমার ওপরে খুব রেগে গিয়েছিল। কয়েকদিন তো কথাই বলেনি। তখন আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে ওকে আমি মিশর সভ্যতা নতুন করে বানিয়ে দেবো। ‘কিরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? বল কি করেছিলি?’ ‘ আমি মিশর সভ্যতা করার চেষ্টা করছিলাম।’ ‘মিশর সভ্যতা, বাগানে?’ ‘ হ্যাঁ ; পিন্টু করেছিল আগে, ওদের বাড়িতে। আমাকে বলেছিল যে বালি ভিজিয়ে নাকি মিশর সভ্যতার মত শহর করা যায়।’ ‘ তারপর?’ ‘আমাদের বাড়ির বাগানের কোনে যে বালির ঢিপিটা আছে তার ওপর জল ঢেলে ভেজানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ভিজছে না। কোথায় যেন চলে যাচ্ছে সব জল। আঠের বালতি জল ঢালার পর দেখি একটুও ভেজেনি। ভাবছিলাম কি করব। তখন তুমি ডাকলে।” ‘ওফফ, তোকে নিয়ে আর পারি না। বালি কি কখন ওরকম করে ভেজে নাকি? কিন্তু জল, জল কোথা থেকে নিলি? এই রে সর্বনাশ, ড্রামের জল শেষ করেছিস নাকি?’ ‘না, না, কল থেকে বালতি করে নিয়ে গেছি।’ ‘বাঁচালি।
বা, বাহ।’ মা যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ‘দূর বোকা তুইও যেমন, বালি কি ওরকম করে ভেজান যায় নাকি?। যা যা, বাথরুম গিয়ে সব ছেড়ে পরিষ্কার হয়ে করে আয়। অনেক খেলা হয়েছে তোর আজকের মত। এবার পড়তে বোস।’ কি আর করা। হাত মুখ ধুয়ে, পরিষ্কার করে পড়তে বসতে হল। কিন্তু আজ পড়ায় মন বসছে না। পিন্টুর সাথে শিগগিরি এই নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
২’বুঝলি পিন্টু, মিশর সভ্যতা আর হল না।’ ‘হুমম’ ও কিছু বলল না। আমরা দুজন ফুটবল খেলার শেষে মাঠের এক কোনে বসে আছি। খেলার শেষে রোজই থাকি কিছুক্ষন। তবে খেলা যদি জমে যায় বা দু-চারটে গোল হয়, তাহলে অন্যরাও থাকে। আজকে খেলা জমেনি। এমনিতেই ফুটবলটা আমার চেয়ে ও খেলে ভাল। তার ওপর আজকে আমি খেলেছি খুবই বাজে, একটা গোল তো আমার জন্যই খেয়েছি। ও খেলার জন্য চুপ করে রয়েছে না মিশর সভ্যতার জন্য সেটা ঠিক বুঝলাম না। ‘আমি সেদিন বাড়িতে অত চেষ্টা করলাম, হলই না’। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে।” ও আমার দিকে ফিরে বলল, ‘তবে আমরা ইট দিয়ে চেষ্টা করতে পারি’ ‘ইট না হয় কয়েকটা জোগাড় করে নেব।
কিন্তু গাঁথব কি দিয়ে? সিমেন্ট তো আর আমরা পাবনা, আর কেউ দেবেও না। ” ‘হুমম’, এই বলে ও গম্ভীরভাবে ঘাড় নাড়ল। ”তার মানে এই খেলাটা আর তেমন জমবে না। অন্য কিছু ভাবতে হবে।’ ‘আচ্ছা, আমরা আবিষ্কারক হলে কেমন হয়? আমি কয়েকদিন ধরে প্রোফেসর শঙ্কুর গল্পের বই পড়ছি। তাই থেকে এই আইডিয়াটা পেয়েছি, বুঝলি উনি না অনেক কিছু আবিষ্কার করেন, সারা পৃথিবী জোড়া নামডাক-‘ ‘আমি তেমন পড়িনি, তা কি কি আবিষ্কার করেন বল দেখি?’ পিন্টু চিরকালই গল্পের বই পড়ে কম। এ ব্যাপারে ওর মাস্টার হচ্ছি আমি। বেশ উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করলাম। কারন ইতিমধ্যে আমি মনে মনে প্রোফেসর শঙ্কুর বিরাট বড় ভক্ত হয়ে উঠেছি। ‘ও বাবা, সে অনেক কিছু। রোবট তৈরী করেন। অদৃশ্য হওয়ার ওষুধ, বন্দুক পিস্তল, মহাকাশযান কত কি।” ‘বাহ ভাল তো, কিন্তু আমরা কি আবিষ্কার করব?’ ‘করব, কিন্তু তার আগে আমাদের একটা ল্যাবরেটরি গড়ে তুলতে হবে। বড় বড় বিজ্ঞানীরা সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে। আমাদের ও সবকিছু নিজেদেরই জোগাড় করে নিতে হবে।’ ‘ঠিক আছে, কিন্তু কিভাবে শুরু করব ঠিক বুঝতে পারছি না।’ ‘আরে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা আগে একটা লিস্ট করে নেব কি কি লাগবে আর কি কি আমাদের আছে। তারপরে একটা নোটবই করতে হবে, আর সবকিছু লিখে রাখতে হবে। প্রোফেসর শঙ্কুও সব লিখে রাখেন।’ সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। আমরা উঠে পড়লাম। নতুন কোন উদ্যোগ নিলে ফূর্তির আর সীমা থাকে না। আজকেও আমরা বেশ লাফাতে লাফাতেই বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ল্যাবরেটরির ফর্দটা করে নিতে হবে। আর কোথায় ল্যাবরেটরি হবে সেটাও ঠিক করে নিতে হবে।
৩
কয়েকদিন পরে দেখা গেল বেশীরভাগ জিনিসই জোগাড় করা যাচ্ছে না। আমাদের ল্যাবরেটরির ব্যাপারটাকে বড়রা তেমন পাত্তাও দিল না কেউ। নিদেন পক্ষে দাদা-দিদিরাও না। লিস্টের থেকে অনেক কিছুই বাদ গেল। যে আগুন ছাড়া প্রায় কোন কিছুই আবিষ্কার প্রায় অসম্ভব, সেই দেশলাইটাই পাওয়া গেলনা। শেষমেশ লিস্টটা দাঁড়াল এইরকম।(১) আতশ কাঁচ – আছে, এবং দুটো। আমাকে বাবা একটা মেলা থেকে কিনে দিয়েছিল। সবুজ রঙের। আর পিন্টুরটা কালো আর বড়। ওটা বেশ পুরনো। (২) চুম্বক – আছে, কিন্তু এটা আমার কাছে নেই আছে ওর কাছে। ওদের বাড়িতে কিছুদিন আগে একটা পুরনো রেডিও খারাপ হয়ে গেছিল। পিন্টু ওর দাদার কাছ থেকে শুনে স্পীকার ভেঙে চুম্বক জোগাড় করেছে। আমি শুনেছিলাম চুম্বককে ঝুলিয়ে দিলে নাকি উত্তর-দক্ষিন দিকে মুখ করে থাকে। এটা থেকে অবশ্য তেমন বোঝার উপায় নেই। কারন এটা গোল, কোনটা উত্তর, কোনটা দক্ষিন বোঝার উপায় নেই। তবে অসুবিধে নেই। শুনেছি চুম্বক নাকি তৈরী করে নেওয়া যায়।
(৩) কাঁচি – মার একটা পুরনো কাঁচি আমাকে দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাই দিয়ে কাগজ দিব্যি কাটা যাচ্ছে। (৪) ছিপ – এটা জানি না বিজ্ঞানের কোন কাজে লাগবে। তবে পিন্টুদের বাড়ি নাকি কোন কালে একটা খুব ভাল ছিপ ছিল। ও সেই ছিপের হুইল’টা ল্যাবরেটরির জন্য খুলে নিয়ে এসেছে। (৫) নোটবই – এটা বাবা আমাকে দিয়েছে। সব লেখা থাকবে এখানে। আমরা বসেছিলাম আমাদের এক গোপন আস্তানায়। এটা নতুন। আমাদের গোপন ঘাঁটি কিছুদিন পরে পরেই জানাজানি হয়ে যায়। তখন আমরা আবার নতুন ঘাঁটি খুঁজে নিই।
আমাদের আগের জায়গাটা দিব্যি ছিল। কেউ জানতেও পারেনি। কিন্তু সেখানে হঠাৎ এক বোলতার চাক হয়েছে বলে আমরা একটু খোলামেলা জায়গায় এসেছি এবার। আমাদের পাড়ায় একটা বাড়ি তৈরী হচ্ছিল কিন্তু কোন কারনে অর্ধেক হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। ছাদ ঢালাই হয়েছে, মেঝে হয়নি। ইটগুলো দাঁত বার করে বসে আছে। আমি কাগজ কেটে একটু অন্য ধরনের এরোপ্লেন বানান যায় কিনা সেই চেষ্টা করছিলাম। আমি দুরকম জানি। একটা খুব সহজে তৈরী করা যায়, সেটা হচ্ছে জেট। আর অন্যটা একটু শক্ত, তবে ওড়ে বেশ। পিন্টু আতশ কাঁচ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ও নাকি শুনেছে যে ঐ কাঁচ দিয়ে নাকি আগুন ধরান যায়। কি জানি কি করে। মনে হয় সেই চেষ্টাই করছিল। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠল। ‘কি রে কি হল?’ ‘আইডিয়া, মাটি খুড়লে কেমন হয়?’ ‘মাটি? কেন?’ পিন্টু অধৈর্যের মত ছটফট করে বলল, ”ওফফ তুই কিচ্ছু বুঝিস না। মাটি খুঁড়েও তো কত কিছু আবিষ্কার করা যেতে পারে। আগে কত লোক গুপ্তধন পেয়েছে মাটি খুঁড়ে। প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে মাটি খুঁড়েই। পুরনো দিনের কত কিছু। আমরাও তো কিছু একটা পেয়ে যেতে পারি’ যেমন কথা তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে আমরা খালি হাতেই মাটি খুঁড়তে লেগে গেলাম। আমাদের গোপন আস্তানা যে বাড়িতে তার মেঝেতেই। খুঁড়ে চলেছি, জামাকাপড়ের কি অবস্থা সেদিকে হুঁস নেই। কতক্ষন কেটে গেছে খেয়াল নেই এমন সময় আমার হাতে উঠে এল একটা হাড়। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
‘পাওয়া গেছে!!!’ পিন্টুও ছুটে এসে একরকম আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়েই দেখতে শুরু করল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,”হ্যাঁ রে, এখানে তো কেউ আগে কখনো থাকতো না, কিসের হাড় হবে বলে তোর মনে হয়।’ ‘আমার তো মনে হচ্ছে এটা কোন লুপ্ত প্রানীর হাড় হবে। ডাইনোসর হতে পারে। চল ভাল করে খুঁজি। আমার মনে হয় আরো পাওয়া যেতে পারে। তারপরে আমরা ডাক্তারজেঠুকে দেখিয়ে নেব-‘ কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের মধ্যে আর কোন সন্দেহ হইল না এটা কোন ডাইনোসরের হাড়। কারন আরো বেশ কিছু হাড় পাওয়া গেল। আমরা আনন্দে নাচানাচি শুরু করেদিলাম। ঠিক হল আমাদের নামে তার নাম দেওয়া হবে – টুবলুসরাস রেক্স বা পিন্টুসরাস রেক্স। ৪ আমরা আবার মাঠের কোনে বসে আছি। দুজনে দুজনের দিকে পিঠ দিয়ে। কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। ময়লা জামাকাপড়েই ছুটেছিলাম ডাক্তারজেঠুর বাড়ি। জেঠু চা খাচ্ছিলেন। আর আমরা টেবিলের ওপরে সাজিয়ে রেখেছিলাম হাড়্গুলো। আমাদের অনেক পরিশ্রমের ফসল। বুক ঢিপঢিপ করছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বিখ্যাত হয়ে যাব। এমন সময় জেঠু এসে হাড়্গুলো একবার দেখেই আমাদের দিকে গম্ভীরভাবে তাকালেন।
‘এগুলো আমার টেবিলের ওপরে রাখতে কে বলেছে?’ ‘না, মানে কেউ বলেনি,আসলে আমরা একটু আগেই এই ডাইনোসরটাকে আবিষ্কার করেছি। এক জায়গায় মাটি খুঁড়ে পেয়েছি এইসব হাড়।’ আমতা আমরা করে বললাম। ‘ডাইনোসরের হাড় না ঘোড়াড্ডিম। এগুলো কুকুরের হাড়। কোত্থেকে ময়লা ঘেঁটে আমার ডেস্কটা নোংরা করলি। তোদের নিয়ে আর পারি না। যা শিগগির ফেলে দে, আর বাড়ি গিয়ে ডেটল দিয়ে ভাল করে চান করবি। আমার কথা মনে থাকে যেন।’ হাড়্গুলো ফেলেদিয়ে এসে অবধি আমরা এইভাবে বসে আছি। শেষে পিন্টুই মুখ খুলল,”আবিষ্কার করা মনে হয় আমাদের দ্বারা আর হল না’ ‘হুমম-‘ ‘আমি ভাবছিলাম এর চেয়ে বরং গোয়েন্দা হওয়া যাক।’ ‘ঠিক বলেছিস’, আমি হাঁটুর ওপর মাথা রেখে বললাম।