
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ যে, আমাদের সমাজে নির্বোধ ও জ্ঞানী এই দুই শ্রেণীর লোক বাস করে। নির্বোধ বা বোকা লোকেরা মানুষের উপকার তো করতে পারেই না বরং অনেক সময় ক্ষতি করে ফেলে। তারা নিজেদের জন্যও বোঝাস্বরূপ। তাই ইসলাম ধর্মে জ্ঞানার্জনের ওপর ব্যাপক জোর দেয়া হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। তিনি মানুষকে তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত, ইবাদতের নিয়ম-কানুন, যাকাতের বিধান, ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়, বিবাহ-তালাক, যুদ্ধ-কৌশল, বিচার বিভাগীয় আইন-কানুন, প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক আইন, হালাল-হারাম এবং অঙ্কশাস্ত্র, বিজ্ঞানশাস্ত্র ও চিকিতসাশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দিতেন।
রাসূলেখোদা জ্ঞানার্জনের প্রতি এত আগ্রহী ছিলেন যে, মদীনায় মসজিদে নববীর একাংশ ইবাদতের জন্য নির্ধারিত রেখে, বাকী অংশের কিছুটা প্রশাসনের জন্য রাখেন এবং অন্য অংশকে শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা হিসাবে ব্যবহার করেন। এই ঐতিহাসিক মাদ্রাসাটি ‘সুফ্ফা’ নামে পরিচিত ছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই সুফফাটি দেখাশোনা করতেন এবং সেখানে একজন শিক্ষক নিযুক্ত করেন। এই সুফফাটি ছিল অবৈতনিক এবং সেখানে সর্বপ্রকার লেখাপড়ার ব্যবস্থা ছিল।
বন্ধুরা, ইসলামে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে আজকের আসরে আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এতে শিক্ষার প্রতি রাসূলে-খোদার অনুরাগ সম্পর্কে কিছু ঘটনা শোনাব। আশা করি তোমরা অনেক কিছু জানতে পারবে।
ইংরেজীতে একটি কথা আছে, ‘knowledge is power’ অর্থাৎ ‘জ্ঞানই শক্তি।’ নলেজ বা জ্ঞানের আভিধানিক অর্থ ‘জানা।’ এটি অজ্ঞতা, মূর্খতা ইত্যাদি বিপরীত। জ্ঞান কেবল বই-পুস্তকের মাধ্যমেই অর্জন করা যায় না। আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনযাপন থেকেও আমরা জ্ঞান অর্জন করতে পারি। কোন মানুষ যদি জ্ঞান লাভ না করে অর্থাৎ প্রশিক্ষণ না নিয়ে সিংহ, বাঘ বা অন্য কোন হিংস্র জন্তু শিকার করতে যায়, তবে সে উল্টো হিংস্র পশুর শিকারে পড়বে। কেননা, হিংস্র জন্তু শিকার করা এবং এ থেকে বাচার কোন জ্ঞান তার কাছে নেই।
জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ সাগরের বিশাল তিমি আর ডাঙার বিশাল হাতিকে বশ করেছে। জ্ঞানের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর তাইতো ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, প্রত্যক মুসলমান নর-নারীর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।
পবিত্র কুরআনে নামাজ পড়ার ব্যাপারে ৮২ জায়গায় তাগিদ দেয়া হয়েছে, আর জ্ঞান-চর্চার উপর তাগিদ দেয়া হয়েছে ৯২ জায়গায়। নবী করীম (সা.) এর প্রতি প্রথম যে ওহিটি নাজিল হয়েছে, তা ‘ইকরা’শব্দ দিয়ে শুরু হয়েছে। আর সূরা যুমারের নয় নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, হে নবী! আপনি বলুন, জ্ঞানী ও নির্বোধরা কি কখনো সমান হতে পারে? অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ। তিনি আরো বলেছেলেন, “দোলনা থেকে শুরু করে কবরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মানুষকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।”
হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “জ্ঞানার্জনের জন্য, প্রয়োজন হলে, সুদূর চীন দেশেও যেতে হবে।” আরো বলা হয়েছে, “বিদ্যানের কলমের কালি, শহীদের রক্তের চাইতেও পবিত্র।” নবী করীম (সা.) আরো বলেছেন, “জ্ঞানী ব্যক্তির ঘুম, জাহিলের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।”
বন্ধুরা, জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বক্তব্যের পর এ পর্যায়ে এ সম্পর্কেই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা শোনাব।
“একবার এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে উপস্থিত হয়ে জানতে চাইল, হে আল্লাহর রাসূল! যদি কোনো ব্যক্তির জানাযার একই সময়ে কোনো ইলমী জলসা অর্থাৎ জ্ঞানার্জনের বৈঠক থাকে তাহলে আমি কোনটিতে অংশ নিতে পারি? রাসূলেখোদা বললেন, জানাযায় অংশগ্রহণ ও দাফন-কাফন করার জন্যে অন্য লোক থাকলে তুমি ইলমী জলসায় উপস্থিত হও। নিশ্চয়ই জ্ঞান চর্চার অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া হাজারটা জানাযায় অংশগ্রহণ থেকে, হাজারটা অসুস্থ লোকের খোঁজ নেয়া থেকে, হাজার রাত ইবাদত করা থেকে, হাজার দিন রোযা পালন থেকে, হাজার দেরহাম সদকা দেয়া থেকে, হাজার বার নফল হজ্জ করা থেকে এবং হাজারটা নফল জিহাদে অংশগ্রহণ করা থেকে উত্তম। এরপর রাসূল (সা.) বললেন, “ইলম দ্বারাই আল্লাহর আনুগত্য হয়, ইলমের দ্বারাই আল্লাহর ইবাদত সম্পন্ন হয়। জ্ঞানের মধ্যে দুনিয়া ও আখেরাতের মঙ্গল নিহিত যেমনিভাবে মুর্খতার সাথে দুনিয়া ও পরকালের অনিষ্টতা নিহিত রয়েছে।”
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই শুনে থাকবে যে, মানুষকে জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার জন্য মহান আল্লাহ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে একটি হাদিসের গল্প শোনাব।
একবার রাসূলেখোদা মসজিদে নববীতে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন দু’দল লোক গোল হয়ে বসে কোনো কাজে ব্যস্ত আছে। একদল আল্লাহর যিকির-আযকার ও ইবাদত-বন্দেগী করছে আরেকদল জ্ঞানচর্চার কাজে মশগুল। রাসূলুল্লাহ (সা.) দু’দলকে দেখেই খুশী হলেন এবং তাঁর সাথের লোকদেরকে বললেন, “এ দু’দল লোকই ভালো কাজে ব্যস্ত আছে এবং এরা সবাই উত্তম ও পূণ্যবান। কিন্তু আমাকে পাঠানো হয়েছে লোকজনকে শিক্ষা দিয়ে জ্ঞানী করে গড়ে তোলার জন্য।” এ কথা বলেই তিনি সেই দলের দিকে এগিয়ে গেলেন যারা শিক্ষা দান ও গ্রহণের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনিও তাদের সঙ্গে বসলেন এবং শিক্ষাদানের কাজে লেগে গেলেন।
রাসূলে খোদা (সা.) মুর্খতাকে অপছন্দ করতেন বলেই আজীবন তিনি জ্ঞান বিতরণ করেছেন এবং সবখানে শিক্ষার আলো জ্বালানোর চেষ্টা করেছেন।
বন্ধুরা, তোমরা তো জানো যে, দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ই রমজান শুক্রবার বদরের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এই যুদ্ধে পরাজিত ৭০ জন কাফেরকে বন্দী করে মদীনায় আনা হয়। এই বন্দীদের মুক্তিপণ হিসাবে অর্থ বা অন্য কোন সম্পদ নির্ধারণ করা যেত। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী ঘোষণা দেন যে, বন্দীদের মধ্যে যারা শিক্ষিত, তারা প্রত্যেকে ১০জন করে নিরক্ষরকে শিক্ষা দান করতে পারলে বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাবে।
এভাবে মহানবী (সা.) মুসলমানদের মধ্যে জ্ঞানের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন বলেই পরবর্তীতে মুসলিম শাসকরা বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে শাসন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ জ্ঞান চর্চা ছেড়ে দিয়ে মুর্খতাকে গ্রহণ করে মুসলমানরা কুরআনের নির্দেশ থেকে যেমন দুরে সরে গেছে তেমনি নিজেদের অবস্থানকেও দুর্বল করে ফেলেছে। তাই নিজেদের হারানো গৌরব ফিরে পেতে হলে সবাইকে জ্ঞান চর্চায় এগিয়ে আসতে হবে।