আমি বললাম “কবিতার মত সুন্দর, এটা নিশ্চই উপকথা” স্যাম হেসে বলল “কেন আমি বানাতে পারিনা? এতোটাই নিরস ভাবো আমাকে” দুজনেই হেসে উঠলাম। সমু বলল-”তাহলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াল, যে সেই জায়গাটার কালচে মাটির লাভা ফ্লো খুব প্রাচীন নয়”। হ্যাঁ,দাদু বললেন-তবে প্রাচীন বলতে তুমি শতখানেক নাকি হাজারখানেক বোঝাচ্ছ সেটা তো জিওলজিস্ট বলতে পারে।এখানে বেশীরভাগ দ্বীপই অবশ্য ভলক্যানিক, সেটা খুব আশ্চর্যের নয়, কিন্তু স্যামের মতে ঐ নির্দিষ্ট গাছ ছাড়া ওখানে বাকি ভেজিটেশন গজিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কারন নতুন লাভা ফ্লো এর উপর প্রথমে এটি গজিয়ে ওঠে ও অন্যদের সুবিধা করে দেয়, ঠিক যেমন বীর সৈনিক নতুন দেশ জয়ের পর সাধারন মানুষ বসতি গড়ে। এবার আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম স্যাম বড় গর্তগুলোর দিকে খুব সতর্কপায়ে এগোচ্ছে, আমাকে হাত নেড়ে আসতে নিষেধ করল। একটা কাপড়ের লম্বা প্রান্ত আগুন জ্বালিয়ে গর্তে নামিয়ে দিল, প্রায় সাথে সাথে দেখলাম কাপড়টা সে টেনে তুলল, নিভে যাওয়া কালো কার্বন। আমার কাছে এসে বলল- “নীচু জায়গা এভয়েড করবে, এখানে মাটি থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বেরোচ্ছে, মাত্রা এতো বেশী যে মারা পরবে। গাছপালা তাই জন্মায়নি প্রায়””।”” সে রাত্রে সমুদ্রের ধারে আগুন জ্বেলে বসে ডিনার সারলাম, তখনই স্যাম আমাকে দুধ চিনি ছাড়া কফি খাওয়ায়, তার মতে এতে ঘুম গভীর হয় না, প্রথমদিন তো জঘন্য লেগেছিল,পরে কি করে যেন অভ্যেস হয়ে গেল। এই সময় পরদিন অন্যদিকটা দেখার প্ল্যানটাও স্যাম সেরে নিল, কাল বিকেলের মধ্যে আমরা ফিরেও যাব ঠিক হল। রাতে তাঁবুতে শুয়ে খুব ভাল ঘুম হলো না, দিনে যেটা অনুভব করিনি রাত্রে সেই গা ছমছমে ভাবটা স্বস্তি দিচ্ছিল না আমাকে অথবা কফি এফেক্ট। আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল , স্যাম বেশ ঘুমোচ্ছে দেখলাম, আমি তাঁবুর বাইরে এলাম। সমুদ্রের হাওয়ায় একটু এক্সেরসাইজ করছিলাম, হঠাৎ মনে হল পিছন দিকে একটু অন্যরকম কিছু দেখলাম, ঘুরে দেখি দূরে পশ্চিমদিকে একটু উঁচু জায়গায় একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। খুব অবাক হয়ে আমি ভালোভাবে দেখার জন্যে কয়েক পা এগোতেই লোকটা একটা বড় পাথরের আড়ালে সরে গেল। আমি তাড়াতাড়ি স্যামকে জাগিয়ে বললাম ব্যাপারটা। সে বেশ চিন্তিত মুখে বলল যে এরকমটা সে আশঙ্কা করেছিল কেননা এখানকার দ্বীপগুলোর ওপর দখলদারির জন্যে অনেক ঝামেলা চলছে, লোকটা কোনো ইউনিফর্মে ছিল কিনা সে জানতে চাইল। তখন আমি বুঝলাম আসল কথাটাই বলিনি, মানুষটা একজন নেটিভ পলিনেশিয় ছিল। স্যাম বলল- কিভাবে বুঝলে এতো দূর থেকে? আমি বললাম- লোকটা তো এখানকার ট্র্যাডিশ্যানাল পোষাকে ছিল। যেরকম সামোয়াতে ওহিয়ার বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো দেখেছি। বর্ননা শুনে স্যাম তো বেজায় চোটে গেল, ভাবল আমি তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি। বলল- তুমি কি জানো ঐ রকম পোষাক শুধুমাত্র কেউ মারা গেলে পরা হয়, আজকাল কেউ বিশেষ পরেও না, আগে আগে চল ছিল। যেহেতু শুনে এসেছ এটা অশুভ জায়গা তাই মাথায় ওসব ঘুরছে। বকা খেয়ে গুম হয়ে বসে আছি, স্যাম আমাকে স্বাভাবিক করতে বলল-এরকম হতেই পারে, নির্জন জায়গায় মন ও চোখের ভুল খুব সাধারন ব্যাপার। সে ঠিক করল যে জায়গায় লোকটাকে দেখা গেছে সেখানেই যাব আমরা। অল্প ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা রওনা দিলাম , এদিকটায় গাছপালা একটু বেশি, যেখানে লোকটাকে দেখা গিয়েছিল সেখানে একটা বড় পাথর আছে প্রায় গোলাকৃতি, আমরা ওটাকেই টার্গেট করে এগোলাম, না হলে হয়তো জায়গাটা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হতো না। দূরত্ব খুব না হলেও আধঘন্টার বেশি লাগল ঝোপ জঙ্গল পেরিয়ে সেখানে পৌঁছতে, প্রচুর পরিচিত গাছ কলা ও নানা ধরনের কচু, নারকেল তো আছেই, কটা পড়ে থাকা নারকোলের জল ও শাঁস খেলাম পথে। দেবু বলল -“দাদু, সেদেশে নির্বাসন দিলেও কেউ না খেয়ে মরবে না তাহলে।”> -সেকথা ঠিক, আর প্রানীর উপদ্রবও বেশ কম দেখেছিলাম, একরকম বড় আকারের বাদুর পাওয়া যায় যারা দিন রাত সবসময় ওড়ে, তবে রংবেরঙের পাখি প্রচুর। যাহোক সে জায়গায় পৌঁছে পাথরটার চারপাশে কোনো মানুষ কিছুক্ষণ আগে চলাফেরা করেছে এমন কোনো প্রমান দেখা গেল না। স্যাম বলল – কি বলেছিলাম তোমার চোখের ভুল। কিন্তু কথাটা শেষ করতে করতেই সে থমকে গেল, ঝোপঝাড় সরিয়ে কি যেন দেখছে দেখে আমিও সেদিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি পাথরের পিছনের ঢালে একটা বড়সড় গর্ত ঢাকা পরে আছে জঙ্গলে। মনে হচ্ছে পাথরটা ওই গর্তটা ঢাকতেই ব্যবহার হয়েছিল, এখন ওটা একটু সরে এসেছে। স্যামের সঙ্গের ব্যাকপ্যাকে সব প্রয়োজনীয় জিনিসই যাদুটুপির মতো বেরিয়ে আসে, ঝোপজঙ্গল সাফ করার জিনিসও বেরোলো, আর কিছুক্ষণ পরে গর্তটা পরিষ্কার হল। এবার আমি স্যামকে আর না বলে পারলাম না যে এর মধ্যে যাবার প্ল্যান না করাই ভাল, বলা যায় না কোনরকম হিংস্র প্রাণী তো থাকতে পারে। স্যাম বলল- ইঁদুর বাদুর ছাড়া কোনো বড় জন্তু এর মধ্যে যাতায়াত করলে এভাবে গাছ গজাতো না। আমার ওজর আপত্তি টিঁকবে না বুঝে টর্চ জ্বেলে স্যামের পিছু পিছু সুরঙ্গে ঢুকলাম। পরের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করূন
Categories
পাঁচমিশালী গল্প
অভিযান-পর্ব ১
বড়দিনের ছুটি, মিতুল, দেবু, তিতির ও সমু দুপুরবেলা জুটেছে প্রিয় গল্পদাদু বিমল দেব এর বাডিতে । দিদু আবার লাঞ্চের নেমন্তন্ন করেছেন, মানে পেটপুজোটাও অসাধারণ জমবে গল্পের সাথে।সামনে দাদু বলতে হলেও আড়ালে যে গল্পদাদু বলে ডাকে এরা সেটা দাদু ভালই জানেন আর উপভোগও করে থাকেন। অল্পবয়সে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গাতে ঘুরে ঘুরে কাজ করেছেন আর তাতেই তাঁর গল্পের ঝুলি অফুরন্ত হয়ে উঠেছে.।নানা স্বাদের স্ন্যাক আসছে দিদুর হেল্পার সুমিত্রাদির হাতে, সেগুলো খুবই মনকারা বটে কিন্ত উৎসাহের সাথে তারা তাকিয়ে আছে দাদুর মুখের দিকে, নড়েচড়ে গুছিয়ে বসছে সোফায় নতুন গল্পের শুরুর আশায়।
বিশাল কফিমাগে কালো কফিতে চুমুক দিলেন দাদু। তিতির একটু বেশী কথা বলে, বলল- “আচ্ছা দাদু তোমার তো সুগার খাওয়া বন্ধ নয়, এই কালো দুধ চিনি ছাড়া কফিতে তুমি কি স্বাদ পাও বল তো?” দাদু বললেন- বাঃ,ঠিক সময় প্রশ্নটা করেছিস তো, এই অভ্যেস যে ধরিয়েছিল তাকে নিয়ে একটা বড়সড় গল্প হয়ে যায়। সবাই হইহই করে উঠল, তবে আজ সেটাই শোনা যাক।
স্যামের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ফ্লোরিডাতে, আলাপের শুরুটাও বেশ মজার। ফ্লোরিডার পশ্চিমের বীচগুলো গালফ্ অফ মেক্সিকোর দিকে আর পুবেরগুলো আটলান্টিক,আমি গালফ্ এর দিকে সিয়েস্তা নামে একটা ছোট শহরে বছর দুই ছিলাম একটা কাজ নিয়ে, সাদা গুঁড়ো চিনির মতো বালি আর নীল টলটলে জলের আকর্ষণ যে কি জিনিস কথায় বলে বোঝানো কঠিন। প্রতিদিন দিনের শেষে কাজ থেকে ফিরে আমি যেতাম সাঁতার কাটতে, এরকমই একদিন বেশ একটু দেরি হয়েছে কাজ থেকে ফিরতে, তবু নেমে পরলাম জলে, সূর্য তখন ডুবু ডুবু।
সাঁতার কাটতে কাটতে কোনো কারনে অন্যমনস্ক হয়ে পরেছিলাম, হঠাৎ দেখি একটা জেট স্কী প্রায় আমার দিকে ছুটে আসছে, খুব ভয় পেয়ে সরে যাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মনে হল লোকটা হাতের ইশারায় আমাকে বোট এ ঊঠতে বলছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাকে প্রায় ঝুটি ধরে টেনে তুলল বোটে, তারপর প্রচুর বকুনি খেতে হল, আসলে আমি পাড় থেকে আনেকটা দূরে চলে এসেছিলাম আর ঐ দিন সন্ধ্যায় শার্কের ওয়ারনিং ছিল। এভাবেই স্যাম এর সাথে পরিচয় প্রথম আলাপ। খুব লম্বা, শক্তপোক্ত চেহারা, গায়ের রং ও মুখের গড়ন সাদা আমেরিকানদের থেকে অন্যরকম , পরে জানলাম সে আসলে পলিনেশিয়,তার পুরো নাম ছিল, স্যামুয়েল আকাকা, তবে বর্তমানে সে আমেরিকান।পরপর কদিন বীচে দেখা হওয়ায় বন্ধুত্ব হয়ে গেল,একদিন তাকে আমাদের দেশীয় খাবার খাওয়ালাম, তখনি বুঝলাম অনেক দেশের অনেক ডিশ্ তার খাওয়া আছে।
কিন্তু সে কাজ কি করে তা জানতে আমার আরও কিছুদিন সময় লেগেছিল, জিজ্ঞাসা করলে বলত -বেড়িয়ে বেড়াই, সেটাই কাজ। তোরা তো জানিসই আমার কেমন নেশা বেড়ানোর, আমি তখন হাওয়াই যাবার একটা প্ল্যান করছিলাম, তাই ভাবলাম স্যামের থেকেই টিপ্স নেয়া যাক। তখনি জানলাম স্যাম সেই মাসেই হাওয়াই যাচ্ছে। যদিও হাওয়াই থেকে সে যাবে অন্য জায়গায়, আমি তার সাথে যেতে পারি হাওয়াই পর্যন্ত। এইখানে দাদু একটু কফি ব্রেক নিলে মিতুল প্রশ্ন করবার সুযোগ পেল,- দাদু তুমি সময়টা বলনি, মানে কত সালের কথা বলছ সেটা। -ও তাইতো, সেটা ৭০ হবে, ৬৮ থেকে ৭০ দুবছর ছিলাম ফ্লোরিডাতে ,এটা শেষ দিকের ঘটনা। -তাহলে স্যামের সাথে হাওয়াই গেলে।
– তা গেলাম , তবে গল্পটা সেখানে নয়। যাবার ঠিক আগে আগে স্যামের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করল, ডানপায়ে চোট ও মাথায় স্টিচ নিয়ে সে বাড়িতে আটকে পড়ল। আমার মত সেও একা, তাই কদিন তাকে একটু সাহায্য করলাম । যদিও সে এতটাই শক্তপোক্ত যে ওই অবস্থাতেও সে আমার সাহায্যের থোরাই কেয়ার করে, কিন্তু যেটা ঘটল, এর ফলে আমার ওপর তার বেশ একটু বিশ্বাস ও নির্ভরতা জন্মাল । আর সেটাই আমাকে একটা অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ করে দিল। এখানে স্যাম সম্পর্কে দুটো কথা তোদের বলে নিই, সে ছিল অল্প কথার মানুষ, নিজের সম্পর্কে বা কাজের প্ল্যানের সম্পর্কে কোনো কথা আগে থেকে সে আমাকে জানাত না, ফলে আমার মনে হচ্ছিল আমি “ফলো দ্য লিডার” গেম খেলছি। এতে একটা মজা আছে, তখন তখন ভারি বিরক্ত লাগলেও পরে মনে হয়েছিল এই ধোঁয়াশাটা আমার জন্য ভালই ছিল। “আমরা যাব এখানে” বলে স্যাম ম্যাপে একটা দ্বীপ দেখালো, সেটার নাম আমেরিকান সামোয়া, ভূগোলের ভাষায় বলতে গেলে জায়গাটা প্রাকৃতিক ভাবে পলিনেশিয়া,কিন্তু আমেরিকার দখলে, সম্ভবত এখনও নীরক্ষরেখার দক্ষিণে ওটাই আমেরিকার শেষ সীমানা। কাছেই আবার একই নামের আরেকটা স্বাধীন দ্বীপ রয়েছে।।
আমি স্যামের কাছ থেকে ওখানে যাবার প্রস্তাব পেয়ে যখন সত্যিই খুব খুশি তখন স্যাম জানিয়ে দিল জায়গাটা খুব শান্তির নয়, নেটিভ পলিনেশিয়দের সাথে দ্বীপগুলোর দখল নিয়ে ফরাসী, ব্রিটীশ, আমেরিকান সকলে মিলে ঝামেলা চলছে সেখানে। যাই হোক হাওয়াই দ্বীপে দুদিন কাটিয়ে আমরা সামোয়াতে পৌঁছলাম।প্লেন থেকে দেখে মনে হচ্ছিল নীল সমুদ্রের বুকে ফুল ছড়িয়ে দিয়েছে কেউ, অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ সেখানে। দেবু একটু উস্ খুস্ করছিল, দাদু বলল, “কি বলবি বলে ফেল”, সে বলল “বাবার আই ফোনটা এনে ম্যাপটা দেখে নিলে সুবিধা হোত না বুঝতে?” দাদু বুক সেলফের ওপর রাখা পুরোনো গ্লোবটা দেখিয়ে বলল, “ সত্তর সালের গল্প যখন গ্লোবেই কাজ চালিয়ে নে” সবাই মিলে জায়গাগুলোর অবস্থান একটু দেখে নিলে দাদু আবার শুরু করলেন- সামোয়া পৌঁছে স্যাম ছোটছেলের মতো খুশী হয়ে উঠল, বেশ কিছু আত্মীয় বন্ধু আছে তার সেখানে, তাদের সাথে ওদের ভাষায় অনবরত বকে যাচ্ছিল সে, আমি যার বিন্দুবির্সগও বুঝছিলাম না। আমার সাথে অবশ্য ইংলিশেই কথা বলছিল সবাই। ওখানকার বেশিরভাগ মানুষ সমুদ্রে মাছ ধরে, ওখানে টুনা মাছ পাওয়াও যায় প্রচুর, আর সেগুল ক্যানে ভরার কাজ হয় । গোটা আমেরিকার টুনার চাহিদার একটা বড় অংশ মেটায় এই ছোট্ট দ্বীপগুলো। ঐ দ্বীপে একটা বড় বন্দর রয়েছে যার নাম পাগো পাগো, বিশ্বযুদ্ধের সময় যেটা আমেরিকার প্রচুর কাজে লেগেছিল, সেনা ঘাঁটি তখনও বহাল আছে, তাই মূল ভূখন্ড থেকে অত দূরে থাকলেও সামোয়া বেশ আধুনিক জায়গা। আর ভূস্বর্গ খেতাবটা আমাদের কাশ্মীর নিয়ে না নিলে প্রথম ঐ শব্দটাই মনে আসে জায়গাটা দেখে, পশ্চিমের লোকেরা বলেও ট্রপিক্যাল প্যারাডাইস। যেদিন পৌঁছলাম সেদিন ওদের আতিথেয়তার বাড়াবাড়িতে কিছুই কাজ হল না স্যামের, দুপুরে আমি একটু ঘুমিয়ে পরেছিলাম একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল, শুনলাম সামনের বারান্দায় স্যামের সাথে কয়েকজনের কথা কাটাকাটি হচ্ছে, দু একটা ইংলিশ শব্দের মধ্যে ‘ডেথ’ আর ‘প্রহিবিটেড’ কানে এল। ঝামেলা মিটলে ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম কি হয়েছে, স্যাম জানাল এখান থেকে একটু দূরে একটা ছোট দ্বীপ আছে যেটা সে একটু এক্সপ্লোর করে দেখতে চায় কিছু ছবি আর তথ্য তার কাজে লাগতে পারে, তা এখানকার লোকজন তাকে ঐ দ্বীপে যেতে দিতে চাইছে না, ওটা নাকি অশুভ জায়গা, কেউ থাকে না, নামটাও নাকি ‘মালিয়ু’ যার অর্থ ‘মৃত্যু’।
যার বাড়ি উঠেছি সে স্যামের কাজিন, নাম ওহিয়া। সে আমাকে একা পেয়ে বলল ওই দ্বীপে বছর দশ আগে কজন মানুষ গিয়েছিল, তাদের মৃতদেহ নাকি একটা গর্তের মত জায়গায় পাওয়া যায়, কোনরকম আঘাতের চিহ্ন ছিল না যেন ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে কেউ। এই ঘটনার বহু আগে থেকেই অবশ্য ওই দ্বীপ সম্পর্কে নানা কথা চালু ছিল,মাছ ধরা বোট থেকে নানা ভয়ানক দৃশ্যও নাকি অনেকে দেখেছে ঔ দ্বীপে। তবে ওহিয়াদের মত যুবকদের মনে থাকার মত ওটাই শেষ ঘটনা। তার পর থেকে আর কেউ যাতে সেখানে না যায় সেটা দেখা হয়। স্যামকে এবার একটু অন্যরকম প্ল্যান করতে হল, সে প্রথমেই আমাকে বলে নিল আমার এ ব্যাপারে কোনোরকম ভয়ডর থাকলে পিছিয়ে যেতে পারি, সেক্ষেত্রে সে একাই ঐ দ্বীপে যাবে, যেহেতু স্থানীয়দের মধ্যেও কেউ যাবে না। আমি তাকে আশ্বাস দিলাম আমার পিছিয়ে আসার কোনো প্রশ্নই নেই। সে মনে হল বেশ খুশী হয়েছে, তার মুখের রেখার নরনচরন বড্ড কম। স্যাম তার চেনা লোকজনদের জানাল সে আমাকে সামোয়া নিয়ে যাচ্ছে, মানে যেটা শুরুতে তোদের বলেছিলাম স্বাধীন দ্বীপরাষ্ট্র , সেই দেশে বিখ্যাত লেখক রবার্ট লুই স্টিভেনসনের সমাধী আছে, সেটা দেখাতে। দাদুর শ্রোতার দল কলকল করে উঠল “উনি কি ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ এর লেখক ” ? অবশ্যই, তোরা নিশ্চই সবাই পড়েছিস, ছেলেবেলায় ট্রেজার আইল্যান্ড’ পড়েনি এমন লোক মেলা ভার। যাহোক আমার নিজেরই জানা ছিলনা যে তিনি তাঁর জীবনের শেষ চার বছর সামোয়াতে কাটিয়েছিলেন। এই অভিজ্ঞতাও আমার সারা জীবনের মনে রাখার মত যেটা স্যামের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে এক্সট্রা পাওনা ।এই প্রসঙ্গে আমি পরে আসছি এখন গল্পে ফেরা যাক। সবরকম খুঁটিনাটি রসদ বিকেলের মধ্যে জোগাড় করে রাখলাম, বলাই বাহুল্য সবার চোখ এড়িয়ে, ভাড়া করা স্পীডবোটে সেগুলো রেখে আসতে হল। ভোরের দিকে রওনা হলাম, ভাল মানুষের মত মুখ করে মাথা নাড়লাম যখন বাড়ির গিন্নি বললেন ‘খুব ভাল লাগবে তোমার দেখে এসো’। সেদেশে ভোররাত থেকে সবাই উঠে পরে মাছ ধরতে যায়, অতএব ধরা পরার মহা সম্ভাবনা। স্যাম ভাবলেশহীন, তার অভিজ্ঞতার কাছে আমি শিশু, ঠিক ম্যানেজ করল, ধীরে ধীরে আমাদের দ্বীপটা চোখের বাইরে চলে গেল, ঘন ঝোঁপ জঙ্গলে ভর্তি বা ন্যাড়া কোরাল অ্যাটল এর মতো অনেক ছোট বড় দ্বীপ, পেরিয়ে ঘন্টা তিনেকের চেষ্টায় আমরা গন্তব্যে পৌঁছলাম। দ্বীপটা অনেকটা বড়, সমুদ্রের কিনারা বরাবর গাছপালা আছে, বেশ ঘন জঙ্গল তবে বড় গাছ কম। মাঝখানটা ক্রমশ উঁচু হয়ে চূড়োর মতো উঠেছে, খাঁড়া পাথরের শৃঙ্গের মত আর সেখানে সবুজ কমে এসেছে। বীচ বলে কিছু পাওয়া মুশকিল, এই কারনেই ওখানকার সব দ্বীপ বাসযোগ্য হয় না। স্যাম খুঁজে খুঁজে একটু সমতল কিনারা পেল, সেখানে বোট লাগান হল ।
তাঁবু পেতে গুছিয়ে বসতেই যা একটু সময় গেছে, স্যাম বলল “আমরা এখানে বড়জোর দুদিন থাকতে পারব, অনেক রকম বিপদের সম্ভাবনা আছে, তাই এখনি কিছু খেয়ে নিয়ে উঁচু টিলাটার থেকে ঘুরে আসি তাহলে দ্বীপটার একটা আইডিয়া পাওয়া যাবে” , সে হাত তুলে একটা মাঝারি উঁচু চুড়ো দেখাল। ঘন্টা দুয়েক জঙ্গলের মধ্যে উঁচু নীচু ট্রেক করে আমরা টিলার মাথায় পৌঁছলাম। সেখানে দেখি অন্যদিকের ঢাল প্রায় ন্যাড়া ও কালচে মাটির, কিছু লাল ফুলে ভর্তি গুল্ম জাতীয় গাছ রয়েছে,আর ঢাল নিরবিচ্ছিন্ন নয় কিছু ইন্টারেস্টিং গর্তের মত দেখা যাচ্ছে যেন। স্যাম রুকস্যাক খুলে চটপট জিনিস বের করল, তারপর মাটি পাথরের নমুনা সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পরল,। মাটি-পাথর সম্পর্কে আমার জ্ঞান বড্ড কম তাই উৎসাহও কম,আমি সমুদ্রের ভাল ভিউ পেয়ে কিছু ফটো তুলতে লাগলাম। স্যামের কাছে সেসময়ের দামী ক্যামেরা ছিল সে ও ফটো নিল।সে দিনটা এভাবেই কেটে গেল এদিক সেদিক ঘুরতে। আমি অকাজে বেড়াতে এলেও স্যাম যে তার কাজের ব্যাপারে সিরিয়াস সেটা টের পাচ্ছিলাম।লাল ফুলের গাছগুলো হাওয়াই তে প্রচুর দেখেছি, লাল ছাড়াও অন্য রঙের ফুল হয়। নামটা মনে করতে পারলাম না,স্যামকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল “লেহুয়া ওহিয়া”হাওয়াইয়ান নাম, এটা নেটিভ গাছ ওখানের, নানা প্রজাতি ছড়িয়ে আছে সাউথ প্যাসিফিকে”” । -”ওহিয়া মানে তোমার ভাই এর যে নাম?” আমি বললাম। স্যাম মাথা নাড়ল, “ ওহিয়া একজন হ্যান্ডসাম বীর যোদ্ধ্বা ছিল, যে সুন্দরী মেয়েটিকে সে ভালবাসত, তার নাম ছিল লেহুয়া, দুজনে খুব সুখীই ছিল, বাধ সাধল লাভা ও আগুনপাহাড়ের দেবী পেলে, সে সুন্দর ওহিয়াকে খুব ভালবেসে ফেলল, ওহিয়া তাকে ভাল না বাসলে সে ঈর্ষায় বোধবুদ্ধি হারিয়ে তাকে গাছ বানিয়ে দিল। পরে লেহুয়া দেবতাদের কাছে বিচার চাইলে তারা তাকে সেই গাছের ফুল করে দিল। আর এর পর থেকে, ওহিয়া লেহুয়া গাছটি যেন পেলে দেবীকে উপহাস করে তার টাটকা লাভার উপর জন্মে ওঠে, যখন অন্য কোনো গাছ সেখান জন্মাতে পারে না। কেমন গল্পটা?”