প্রাচীনকালে একটি গ্রামের শেষ প্রান্তে পর্বত নামে একটি গরীব লোক ছিল। তার বউ আর সে একটি কুঁড়েঘরে থাকত। তার কুঁড়ের পাশে ছিল আর একটি ঘর। একদিন ঐ ঘরে ঢুকল এক বুড়ো। বুড়োর আত্মীয় স্বজন কেউ ছিল না। বুড়ো অসুস্থ ছিল। এসব লক্ষ্য করে তাকে সাহায্য করার ইচ্ছা জগল পর্বতের মনে। কিন্তু ইচ্ছা জাগলেও পর্বতের ক্ষমতা ছিল না। সাহায্য করতে না পারায় পর্বত মনে মনে দুঃখ পেয়েছিল। তার মনের অবস্থা বুঝে তার বলল, “এত মাথামুন্ডু কি ভাবছ? বুড়োটার কপালে কষ্ট পাওয়া আছে তাই পাচ্ছে। কর্মফল বলে একটা জিনিস আছে তো নাকি! যে আজ বাদে কাল মরবে তাকে নিয়ে তোমায় এত ভাবতে হবে না।” বউ যা বলল তার একটি কথাও মিথ্যে নয়। তবু বুড়োর কষ্ট দেখে পর্বতের বড় কষ্ট হয়। বুড়ো সারারাত কাশে।
এক একদিন পর্বত ভাবে বুড়োটার গলা টিপে মেরে ফেললে কেমন হয়। এত কষ্ট পেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল। ভাবে বটে, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। একদিন পর্বত ঘরের বাইরে একটি গাছের নিচে ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দেবে ঠিক করল। গাছের নিচে শুতে না শুতেই একটা বিরাট ছাড়া মূর্তি দেখে ঘাবড়ে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “কে তুমি?” “আমি ভূত।” বলল ঐ মূর্তি। শুনে পর্বতের গোটা শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগল। সে অনেক কষ্টে বলল, “কি চাও তুমি?” “তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। এই পোঁটলাতে টাকা আছে। এই টাকা ঐ বুড়োকে দিযে তাকে নগরে নিয়ে গিয়ে সারাতে হবে।” আমার কথা বুঝতে পেরেছ? ভুত বলল। এমন পরোপকারী ভূত দেখে পর্বতের মন থেকে ভয় মুছে গেল। সে ভূতের সঙ্গে কথা বলল, “ঐ বুড়োর উপর তোমার এত দয়া কেন? কোন জ্যান্ত লোক বুড়োকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসছে না আর তুমি কোন স্বার্থে তাকে টাকা দিচ্ছ?” ভূত বলল, “ ঐ বুড়োটা যে কত বড় ধনী লোক তা তুমি জান না। অবশ্য সে আজকের কথা নয়।
অনেক দিন আগে এই বুড়োটা ধনী ছিল। দানধর্মও করত। আমি তখন এক লক্ষপতির বাড়িতে কাজ করতাম। আমার ঐ বাড়ির মালিক আমাকে দশহাজার টাকা দিয়ে নগর থেকে একটি জিনিস আনতে বলেছিল। আমি যাওয়ার সময় একটি ধর্মশালায় রাত কাটিয়েছিলাম। রাত্রে আমার সমস্ত টাকা চুরি হয়ে যাওয়ার কথা আমার মালিক বিশ্বাস করে নি। বিচার হল। বিচারক আমাকে চোর বলে ঘোষণা করল। আমার ভীষণ দুঃখ হল। আমি সোজা গিয়ে নদীতে ঝাঁপ নিয়ে আত্মহত্যা করতে গেলাম। কিন্তু সে যাত্রায় মরতে পারলাম না। চারজন ধরে আমাকে বাঁচাল। তারপর সবাই আমায় জিজ্ঞেস করতে লাগল আমার আত্মহত্যার কারন। সবাই শুনত আমার দুঃখের কথা। কে কতটা বিশ্বাস করত কে জানে। তবে আমাকে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। আমার থাকার জায়গা নেই, খাবার নেই। এই অবস্থায় একজন যুবক আমাকে ধরে দিয়ে গেল তার বাড়িতে। আমাকে গোপনে দশহাজার টাকা দিল। এত টাকা নিয়ে ধর্মশালায় উঠতে বারণ করল। এত টাকা পেয়ে আমার জীবনের মোড় ঘুড়ে গেল।
তারপর অনেক বছর পরে আমি দশহাজার টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ঐ যুবককে খুঁজছিলাম, পাইনি। অনেক খোঁজ করে জানতে পেরেছি এই বুড়োই সেই যুবক। তুমি যদি এই টাকাটা বুড়োকে দিয়ে দাও তাহলে আমি মুক্তি পেতে পারি।” বলে টাকার থলি পর্বতের হাতে দিয়ে ভূত উধাও হয়ে গেল। টাকাটা নিয়ে পর্বত ঘরে ঢুকল। মনে মনে বলল,“ যা করার কাল সকালে করব। এখন টাকাটা থাক।” এমন সময় দরজায় কে যেন আঘাত করতে লাগল। দরজা খুলে দেখে ভূত। “কি হলো, আবার এলে কেন?” পর্বত ভূতকে জিজ্ঞেস করল। “আবার এলাম মানে। আমি তো এই প্রথম এসেছি। তোমার পাশের বাড়ির বুড়োর কাছে আমি ঋণী। এই নাও ধর। এই টাকার থলিটা বুড়োকে দাও। এই টাকা দিয়ে তার চিকিৎসা করাও।” বলে নতুন ভূতটা টাকার থলি পর্বতের হাতে দিল। পর্বতের মনে কৌতূহল জাগল। সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি বুড়োর কাছে কিভাবে ঋণী হলে?” তার প্রশ্রে জবাবে দ্বিতীয় ভূত বলল, “একবার আমার পাঁচ বছরের মেয়ের ভীষণ অসুখ করেছিল। স্থানীয় বৈদ্যরা দেখে তাকে নগরের চিকিৎসালয়ে নিয়ে যেতে হল। আমি সপরিবারে নগরে গেলাম। চিকিৎসকের মতে ছ’মাস ধরে তার চিকিৎসা চলবে।
পাঁচ-ছ হাজার টাকা খরচ হবে চিকিৎসার জন্য। এত টাকা পাব কোথায়? দুঃখে আমি বসে বসে কাঁদতে লাগলাম। এমন সময় একজন এসে ‘মেয়ের জীবন আগে বাঁচুক’ বলে আমাকে দশহাজার টাকা দিল। মেয়ে বাঁচল। কিন্তু আমি ঐ লোকটার ঋণ শোধ করতে পারিনি। মরেও মুক্তি পাচ্ছিনা। অনেক খোঁজ করে জানতে পেরেছি এই বুড়োই সেই লোক। তুমি দয়া করে এই টাকাটা বুড়োকে দিয়ে দিও। এই ঋণ শোধ করতে পারলেই আমি এই ভূতের জীবন থেকে মুক্তি পাব।” দ্বিতীয় ভূতও টাকার থলি পর্বতকে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। পর্বত বউকে জাগিয়ে বলল, “কি গো, এত টাকা জীবনে কখনো দেখেছ? দেখে নাও কত টাকা।” বউ অত টাকা দেখে প্রথমে অবাক হয়ে গেল। তারপর স্বামীকে বলল, “দেখ বুড়োর যা অবস্থা বেশ বুঝতে পারছি একে আর বাঁচানো যাবে না। তার চেয়ে এই টাকা দিয়ে আমরা আমাদের ছেলেদের মানুষ করতে পারব। “না, তা হয় না, এ টাকা আমি ঐ বুড়োকে দিয়ে দেব।” পর্বত বলল। “দিতে চাও দাও। একটা থলির টাকা দাও। অন্য থলিটা রেখে দাও। পর্বতের বউ বলল।
পর্বত প্রথমে ভাবল কথাটা মন্দ নয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তার মনে হল তা করা তার অন্যায় হবে। সে বউকে বলল, “না, আমি দুটো থলিই বুড়োকে দিতে চাই।” বলে সে পরের দিন ঐ দুটো থলি বুড়োকে দিয়ে দিল। বেতাল এই কাহিনী শুনিয়ে বলল, “রাজা, পর্বত এরকম করল কেন? সে যা করল তা কি বিনা স্বার্থে? না কি ভূতদের টাকা হজম করতে তার ভয় করল? আমার এই প্রশ্নের জবাব যদি না দাও তাহলে তোমার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।” জবাবে রাজা বিক্রমাদিত্য বললেন, “ব্যাপারটা অত জটিল নয়। পরপর দুজন ঋণী থাকার ফলে যে ভূত হয়েছে তা জেনে পর্বতের ঋণী হয়ে ভূত হতে ইচ্ছা করল না। সেই জন্যই ঐ দুজনের টাকা পর্বত নিজের কাজে খরচ করতে ভয় পেল।” রাজা এই কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই বেতাল শবসহ আবার ফিরে গেল সেই গাছে।