Categories রূপকথা

যাদুর কম্বল

অনেক কাল আগে হিমালয়ে আত্মানন্দ নামে একজন সাধু ছিল। বহু লোক অনেক কষ্ট সহ্য করে ঐ বৃদ্ধ সাধুকে দেখতে যেত। ওরা মাঝে মাঝে ঐ সাধুর সাধনায় বিঘ্ন ঘটাত নানা ধরনের প্রশ্ন করে। বারবার সাধনায় বিঘ্ন ঘটায় বিরক্ত হয়ে সাধু একটি কম্বলে মন্ত্রপড়া জল ছিটিয়ে ঐ কম্বলে এমনভাবে নিজেকে মুড়ে রাখতো যে লোকে তাকে দেখতে পেত না। ফলে ঐ কম্বলমোড়া অবস্থায় সাধনা করতে সাধুর সুবিধা হত। একবার ঐ সাধু একটি খরস্রোতা নদী পেরোতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। পড়ার সঙ্গে মঙ্গে সাধু মূর্ছা গেল। কিছুক্ষণ পরে একজন লোভী ব্যবসায়ী ঐ পথের পাশ দিয়ে হাটে যাচ্ছিল। সে ঐ কম্বল দেখতে পেল।

সে ভাবল, “এই কম্বল যতই পুরনো হোক, হাটে যখন যাচ্ছি বিক্রি ঠিক হবেই। না হয় দু পয়সা কম পেলাম।” লোকটি এই কথা ভেবে কম্বল নিয়ে চলে গেল শোভাবতী নগরের হাটে। হাটে একটা বুড়ো ভিখারী ব্যবসাদারের কাছে থেকে কিনে গায়ে দেওয়া সঙ্গে সঙ্গে বুড়োটা অদৃশ্য হয়ে গেল। চোখের সামনে এই ঘটনা যারা দেখল তারা অবাক হল। এই খবর কিছুক্ষণের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ল। ঐ সময় শোভাবতী নগরে চুরিডাকাতি যে বেশি করে হত। শোভাবতীর রাজা চন্ডীদত্ত অনেক চেষ্টা করেও চোরডাকাত ধরতে পারছিল না। এমন সময় ঐ কম্বলের খবর রাজার কানে যেতেই রাজা ঐ ভিখারীকে খোঁজার জন্য লোক পাঠাল। রাজার ধারনা ছিল ঐ কম্বলের সাহায্যে চোর ধরার সুবিধা হবে। রাজা ঐ কম্বল খুঁজছে শুনে ভিখারী ভয় পেয়ে হাতের লাঠিটা ফেলে দিয়ে গা ঢাকা দিয়ে রইল। ভিখারীর ধারণা ছিল রাজা যদি কম্বল নিযে নেয় তাহলে তাকে শীতে কষ্ট পেতে হবে।

দিনের পর দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার ফলে ভিখারী ভিক্ষে পেত না। কিছুদিনের মধ্যেই তার না খেতে পেয়ে মরার অবস্থা হয়েছিল। এইভাবে কিছুদিন চলার পর সে একদিন রাত্রে গভীরভাবে ভাবতে বসল। যে ঠিক করল এভাবে না খেতে পেয়ে মরার চেয়ে রাজার হাতে কম্বলটি দিয়ে দেওয়াই ভাল। পরের দিন কম্বলে গা ঢাকা দিয়ে সে রাজসভায় দিয়ে সোজা রাজার সামনে হাজির হল। “মহারাজ, এই কম্বল আমার কোন কাজে লাগছেনা। এই কম্বলের জন্য আমার আজকে এমন অবস্থা হয়েছে যে আমি ভিক্ষা পাচ্ছি না। ফলে আমার দুমুঠো ভাত জুটছে না। এটা যদি আপনার কাজে লাগে নিন।” বলে সে রাজাকে কম্বলটি দিয়ে দিল। ইতিমধ্যে হিমালয়ের ঐ সাধু খোঁজ করে জানতে পারল যে চন্ডীদত্ত নামে এক রাজার কাছে কম্বলটি আছে। সাধু সোজা ঐ রাজার কাছে এসে ঐ কম্বল চাইল। রাজা ঐ কম্বলের প্রয়োজনের কথা বুঝিয়ে বলে সেটা নিজের কাছেই রাখতে চাইল। শেষে সাধু আত্মানন্দ রাজার কাছেই সেই কম্বলটি রাখতে রাজী হয়ে তার হাতে একটি রক্ষাকবচ বেঁধে দিল। তারপর থেকে রাজা, ঐ কম্বলের সাহায্যে একের পর এক অপরাধীকে ধরে শাস্তি দিতে লাগল।

কিছুদিনের মধ্যেই শোভাবতী নগরের চুরি ডাকাতির উপদ্রপ কমে গেল। লোকে বুঝল রাজা ঐ কম্বলের সাহায্যে চোর ধরছেন। একদিন রাজনর্তকী চঞ্চলার বাড়িতে গেল রাজা। সেদিন বিশেষ মুহূর্তে চঞ্চলা দুদিনের জন্য ঐ কম্বল রাজার কাছে চাইল। রাজা চঞ্চলাকে নিয়ে রাজপ্রসাদ পর্যন্ত কম্বল মুড়ি দিয়ে এসে তাকে কম্বলটি দিয়ে দিল। তারপর চঞ্চলা কম্বল মুড়ি দিয়ে রাজার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। পরমুহূর্তে রাজা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল, কম্বল মুড়ি দেওয়া সত্ত্বেও চঞ্চলাকে দেখা যাচ্ছে। কম্বল মুড়ি দেওয়ার পর কখনও কাউকে দেখতে পাওয়ার কথা নয়। অথচ চঞ্চলাকে দেখতে পাওয়ায় রাজা প্রথমে অবাক হলেন কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলেন , সাধুর রক্ষাকবচের মুণেই হয়ত চঞ্চলাকে দেখা যাচ্ছে। রাজনর্তকী চঞ্চলা একান্তভাবে তারই। তাকে অন্য কারো বাড়ির দিকে যেতে দেখে চন্ডীদত্ত অবাক হল। স্বভাবতই রাজার ইচ্ছা করল চঞ্চলা কোন দিকে যায় তা দেখার।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল চঞ্চলা নিজের বাড়ি না গিয়ে, গেল কোষাগারের অধিকর্তার বাড়িতে। এটা লক্ষ্য করে রাজা ফিরে এসে শুলো কিন্তু তার চোখে ঘুম এল না। কোষাগারের অধিকর্তার নাম ছিল বিক্রম। বিক্রম ছিল রাজার আত্মীয়। আত্মীয় কি তার বিরুদ্ধে কিছু করছে! এই প্রশ্ন তার মনে জাগল। বিক্রম কম্বল মুড়ি দিয়ে হাতে ছোরা নিয়ে রাজার ঘরে ঢুকল। বিক্রমকে ছোরা হাতে ঢুকতে দেখে রাজা বুঝতে পারল যে তাকেই মেরে ফেলার জন্য বিক্রম ঢুকেছে। কোর রাজাই তার বিরুদ্ধে দেশের কোন প্রান্তে কেউ চক্রান্ত করুক তা সহ্য করে না। চন্ডীদত্ত বিক্রমের এই চক্রান্ত সহ্য করেনি। কিছুক্ষণ ভেবে রাজা ঠিক করল বিক্রমকে আক্রমন করে মেরে ফেলবে। ফলে বিক্রম আক্রমন করার আগেই রাজা তাকে আক্রমন করে মেরে ফেলল। তারপর রাজার নির্দেশে রাজনর্তকীকে প্রহরীরা বন্দী করে আনল। জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা গেল যে রাজাকে হত্যা করে দেশের রাজা হওয়ার ইচ্ছা ছিল বিক্রমের। বিক্রম রাজা হলে চঞ্চলা হত রাণী। এই ছিল শর্ত। সেই শর্ত অনুসারে চঞ্চলা রাজার কাছ থেকে ঐ কম্বল এনে দিয়ে বিক্রমকে সাহায্য করেছিল।

সমস্ত চক্রান্ত প্রকাশ হওয়ার পর রাজা চন্ডীদত্ত চঞ্চলাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করল। পরের দিন রাজা হিমালয়ে গিয়ে খুঁজে খুঁজে আত্মানন্দের কাছে গিয়ে বলল, “প্রভু, আপনার কম্বল আপনি নিয়ে নিন।” বলে রাজা ঐ যাদুর কম্বল সাধুকে দিয়ে ফিরে গেল। বেতাল এই কাহিনী শুনিয়ে বলল, “রাজা, এখন আমার মনে কয়েকটা প্রশ্ন জেগেছে। আত্মানন্দ কম্বলের খোঁজ করে, অত কষ্ট করে রাজার কাছে গেল কেন? অত ক্ষমতাবান সাধু ইচ্ছা করলে আর একটা কম্বল তৈরী করে নিতে পারত। নিজের তৈরী করা যাদুর কম্বল আর এক জনের কাছে থাক এটা কি সাধুর ইচ্ছা ছিল না? যে রাজা ঐ কম্বলের সাহায্যে এতরকম সাহায্য পেল, এমনকি নিজের প্রাণ ও বাঁচাতে পারল সেই রাজা কেন কম্বলটি সাধুকে ফেরত দিল? দেশে বিক্রমের বিশ্বাসঘাতক আরও তো বহু থাকতে পারে? আমার এই সব প্রশ্নের জবার জানা সত্ত্বেও যদি না দাও তাহলে তোমার মাথা চৌচির হয়ে যাবে।” বেতালের প্রশ্নের জবাবে রাজা বিক্রামদিত্য বললেন, “যে কোন যাদুর জিনিসের উপকারিতা বা অপকারিতা নির্ভর করছে তার প্রয়োগকর্তার উপর।

কম্বলের ফলে ভিখারীর না খেতে পেয়ে মরার অবস্থা হয়েছিল। এতেই আমরা বুঝতে পারি কম্বলটি তার কোন কাজে লাগেনি। আমার ঐ কম্বল দিয়ে দুষ্টের দমন করতে পেরেছিল রাজা। রাজার কথা শুনে, তার কাছে কম্বল রাখতে সাধু রাজী হয়ে রাজার হাতে রক্ষাকবচ বেঁধে দিয়েছিল। কে কিভাবে ব্যবহার করবে এই বিষয়ে সন্দেহ ছিল বলেই সাধু রাজার কাছে থেকে কম্বল আনতে গিয়েছিল। রাজাও চঞ্চলাকে কম্বল দেওয়ার পর, বিক্রমের ঐ কম্বল ব্যবহারের পর বিশেষবাবে অনুধাবন করল যে কম্বলের ব্যবহার সকলের হাতে একভাবে হবে না। সেই জন্য আত্মানন্দ সাধার কম্বল সাধুর হাতে ফেরত দেওয়া হল।” রাজার এইভাবে মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে বেতাল শব নিয়ে ফিরে গেল সেই গাছে।

আরো পড়তে পারেন...

নরওয়ে দেশের পুরান

আমাদের দেশের পুরাণে যেমন দেবতা আর অসুরের গল্প আছে, পুরাতন নরওয়ে আর সুইডেন দেশের পুরাণেও…

সাতমার পালোয়ান-উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

এক রাজার দেশে এক কুমার ছিল, তার নাম ছিল কানাই। কানাই কিছু একটা গড়িতে গেলেই…

গুপি গাইন ও বাঘা বাইন-উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী-২য় অংশ

এই ব’লে দুজনায় সেই ভিজা কাপড়েই প্রাণ খুলে গান বাজানা শুরু করল। বাঘার ঢোলটি সেদিন…