সজল ব্যাটা একেবারে মহা হারকিপটে । কখনও ভুলেও ওর কাছ থেকে একটা টাকা খসানো যায় না । এমন নয় যে ওরা গরীব। টাকা পয়সা নেই । টাকা শহরে ও’র বাবার চার-চারটে বাড়ি । এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো নানা রকমের ব্যবসা-বাণিজ্য । ভাইগুলো সব বিদেশে লেখাপড়া করছে । দু’দিক থেকে টাকা পয়সা ওদের বাসায় ঢুকছে কিন্তু বেরুবার পথ পাচ্ছে না । তবুও ব্যাটার এমন কিপটেমি আমাদের আর সহ্য হয় না । দিনের পর দিন আমাদের টাকায় এটা সেটা খেয়ে দেয়ে বেশ আছে । তাই আমরা একদিন ঠিক করলাম যে, ওকে একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো । তাতে যাদি ওর হাড় কিপটেমি ভাবটা দূর হয়।
রতনদের বাড়ী বুড়িগঙ্গা নদীর খুব কাছে । আমাদের স্কুল থেকে ওদের বাসাটা কাছে হওয়ায় স্কুল ছুটির পর কিংবা বন্ধের দিনগুলোতে আমাদের বেশির ভাগ আড্ডাগুলেই রতনদের দোতালার ছাদেই হতো । রতনদের ছাদ থেকে বড়ীগঙ্গা নদীর পুরোটা দেখা যায় । বিকেল বেলা নদীর বুকে ব্যস্ত লঞ্চগুলো দেখতে বেশ লাগে । তাই আড্ডার জন্য এর চেয়ে আর্দশের জায়গা আর হয় না । যে কোন ভাল জিনিষের পাশাপাশি যেমন একটা খারাপ জিনিষ থাকে । ঠিক তেমনি রতনদের ছাদ থেকে বুড়ীগঙ্গার সন্ধ্যাকালীন মনোরম দৃশ্য দেখার পাশাপাশি আরেকটি খারাপ জিনিসও খুব ভাল করে দেখা যায় । সেটি হলো – পোস্তগোলা শ্মশানঘাট ।
এটি মনে হয় ঢাকা শহরের একমাত্র শ্মশানঘাট । তাই মরদেহ পোড়ানোর ধুম লেগেই থাকে । কারো জন্য সেটি শেষ যাত্রা হলেও আমাদের জন্য শ্মশানঘাটটি অতি ভয়ন্কর একটা জায়গা। কেননা এই শ্মশানঘাটটি নিয়ে নানান ভৌতিক ঘটনা প্রচলিত আছে । যেগুলোর বেশির ভাগই খুব ভয়ন্কর । শুনলেই গা শিনশিন করে উঠে । শ্মশানঘাটে নাকি রাতের অন্ধকারে প্রায়ই – তেনাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় । বিশেষ করে অমাবশ্যার রাতে । তখন যদি কেউ তেনাদের সামনে পরে তাহলে আর রক্ষা নাই । নির্ঘাত পরের দিন হয় মৃতদেহ পাওয়া যাবে নয়তো পাগল অবস্হায় পাওয়া । তাই আমরা পারতে খুব একটা ওদিকটা মারাই না । এড়িয়ে চলি ।
রতনদের ছাদ থেকে প্রায়ই দেখা যায় শ্মশানঘাটে কুন্ডুলি পাকিয়ে মরদেহ পোড়ানোর ধোয়া আকাশে উঠে যাচ্ছে । বাতাস আমাদের দিকে বইতে থাকলে চামরা পোড়ার একটু গন্ধও পাওয়া যায় বলে আমার মনে হয় । যদিও গন্ধ পাওয়ার ব্যাপারটা কেউই স্বীকার করে না । তবুও আমার মনে হয়েছে আমি বার দু’য়েক পোড়া চামরার গন্ধ পেয়েছি । একদিন সাহস করে আমরা ক’জন মিলে গিয়েছিলাম শ্মশানঘাটে লাশ পোড়ানো দেখতে। কিন্তু সে দৃর্শ্যটা আমি সহ্য করতে পারিনি ভয় পেয়ে চলে এসেছি । দু-তিন জন লোক বিরাট বিরাট লাঠি দিয়ে নেড়ে চেড়ে মরা পোড়াচ্ছে । দেখলেই গা ঘুলিয়ে উঠে। আমাদের মধ্যে ফিরোজই সব চাইতে সাহসি । ফিরোজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো লাশ পোড়ানো দেখেছে । লাশ পোড়ানো শেষে ছাইগুলো যে একটি ছোট কলসিতে ভরে নদীতে ফেলে দেওয়া হয় ও সেটাও দেখে এসেছে ।
সেই ফিরোজকে একদিন ছাদে দাঁড়িয়ে শ্মশানঘাটটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়তে দেখলাম । আমরা তখন কেরাম খেলছিলাম । আমরা বলতে- আমি , বাপ্পি ,তপন আর সজল । রতন গিয়েছিল নীচে আমাদের জন্য ঠান্ডা পানি আনতে । ফিরোজ একটু দেরি করে আসায় খেলায় অংশ গ্রহন না করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কখনও নদী আবার কখনও শ্মশানঘাটটি দেখছিল । ওকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে দেখে আমি আর বাপ্পি এগিয়ে গিয়ে ওর কাধে হাত রেখে – জিজ্ঞেস করলাম কিরে কি হয়েছে?
– না কিছু না । ফিরোজ মাথা নেড়ে কিছু না বলে আমাদের এড়িয়ে যেতে চাইল ।
– কিছু না বললেই হলো ! আমি স্পস্ঠ তোকে বোয়াল মাছের মতো বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে দেখলাম ।
– বললাম তো কিছু না । এমনি ….
– দেখ মিথ্যা বলবি না । আমরা না তোর বন্ধু । বাপ্পি ফিরোজ এর কাধে হাত রেখে বলল ।
– না, মানে শ্মশানঘটটা দেখে ভাবছিলাম -মানুষ মরে গেলেই তো সব শেষ তাই না ? ফিরোজ আবারও উদাস হয়ে বলল ।
– তা তো ঠিকই মরে গেলেই তো সব শেষ । বলে আমিও ওর সঙ্গে মাথা নাড়ালাম ।
– মরে গেলে সব শেষ হবে কেন ? মরে গেলে তো মানুষ ভূত হয়েওতো টিকে থাকার চেষ্টা করে । তপন এর কথায় আমরা সবাই হেসে উঠলাম ।
– শুন ব্যাটা ভূত বলে আসলে কিছু নাই । সব মনের ভূল । সজন বীরের মতো বলল ।
– তুই জানস না , আমাদের ঠাকুর মারা বলেন – যারা বেঁচে থাকতে অন্যায় জুলুম করে তারা মরে গেলে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায় ।
– তোর দাদি মার কি ভাবে জানলো এ কথা ? তারা কি ভূত প্রেত দেখেছে ? সজল তপনকে একেবারে তুচ্ছ তাচ্ছিল করে প্রশ্ন করল ।
– দেখেছেই তো । তপন আমতা আমতা করে উত্তর দিল ।
– যতোসব বাকোয়াস কথা ।
– বাকোয়াস না , দিদা বলছে দাহের পর তিন চার ঘন্টা পর্যন্ত নাকি তেনাদের আত্মা শ্মাশানঘটে ঘুরে বেড়ায় । তখন নাকি তেনাদের দেখাও যায় ।
– তোর দিদা চাপা মেরেছেরে । পুরো আজেন্টিনা চাপা মেরেছে। বলে সজল হো হো করে হাসতে লাগল ।
– তোর খুব সাহস মনে হচ্ছে যে । ফিরোজ সজলকে উদ্দেশ্য করে বলল ।
– সাহসই তো , তোর মতো নাকি যে, দিনের বেলায় শ্মাশানঘাটে ঘুরে এসে বাহাবা ফলাবো । আমি চাইলে রাতেও শ্মাশানঘাট ঘুরে আসতে পারি ।
– তাই নাকি ! তাহলে প্রমাণ দিয়ে দে ? দেখবো কতো বড় বুকের পাটা । ফিরোজ তেতে উঠে বলল।
– প্রমাণ লাগবে কেন , যা সত্য তাই বললাম ।
– কি ভাবে বুঝবো যে তুই রাতের বেলা শ্মাশানঘাট থেকে ঘুরে আসতে পারবি ? আমি বললাম ।
– আমি ইচ্ছে করলে প্রমাণও দিতে পারি কিন্তু দিমু না । কিন্তু দিমু না , প্রমান দিয়ে আমার লাভ কি । আমি বুঝলাম সজল ধান্ধা খুঁজছে ।
– যদি তুই রাতের বেলা শ্মাশানঘাট থেকে ঘুরে আসতে পারিস তা হলে তুই যা খেতে চাবি তাই তোকে খাওয়াবো । ফিরোজ বলে আমাদের সবার দিকে তাকালো।
– হু যা তাই খাওয়াবো । বলে আমরা সবাই মাথা নাড়লাম ।
– আবে রাখ তোদের খাওয়া দাওয়া । নগদ মাল কতো দিবি তা ক ?
– যা , সবাই মিলে তোকে একশ টাকা দিমু ।
– দিবি তো ? সজল এর চোখ দু’টো চকচক করে উঠতে দেখলাম ।
– অবশ্যই দেবে । তবে আমাদের কথাও তোকে শুনতে হবে । ফিরোজ বলল ।
– কি কথা ?
– তুই শ্মাশানে রাত ১২টা পরে যাবি । বলে ফিরোজ আমাদের দিকে চেয়ে একটু হাসল । আমি মনে মনে ভাবলাম রাত ১২টা কথাশুনে সজল হয়তো পিছিয়ে যাবে । কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ও বলে উঠলো – রাত ১২টা কেন ? মাল পেলে রাত ১টা’র পরে যেতেও রাজি আছি ।
– তাহলে আজ রাতেই যা । ফিরোজ বলল ।
– ওকে নো প্রবলেম । আগে মাল দে । আমি বাকির কাজ করিনা । জানস তো বাকি কাজ ফাঁকি । আমরা আমাদের সবার পকেটে যা ছিল তা মিলমিশ করে একশটাকা জোগার করে সজল এর হাতে তুলে দিলাম । তপন শুধু বলল ও আসতে পারবে না । এতো রাতে নাকি ও কিছুতেই বাসা থেকে বেড় হতে পারবেনা । সবাই মিলে ঠিক করা হলো যে, রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে আমরা যার যার মতো রতন এর বাসার নীচে চলে আসবো । তারপর ১২টা বাজলে সজল চলে যাবে শ্মাশানে আর আমরা শ্মাশানের কাছে কর্টন মেলের গেটে অপেক্ষা করবো ।
দুই
স্কুল বন্ধ থাকলেও এতো রাতে বাসা থেকে বেড় হওয়াটা আমার জন্য খুব একটা সহজ হলো না । শেষমেস ছোট মামাকে সব খুলে বলার পর মামা নিজেই আমাকে নিয়ে বেড় হলেন । রতনদের বাসায় নীচে আসার পর দেখলাম রতন, ফিরোজ, বাপ্পি অপেক্ষা করছে ।
সজল কোথায় জিজ্ঞেস করাতে ফিরোজ বলল – ও শালায় এখনও আসেনি ।
– মনে হয় ভেগেছে । রতন ফিরোজ এর কাধে হাত রেখে বলল।
– টাকা নিয়েছে না, ভেগে যাবে কোথায় ? ডাবোল আদায় করে ছাড়বো । আমাদের সঙ্গে মামদো বাজি চলবে না । ফিরোজ উত্তেজিত হয়ে বলল । আমি হাতঘড়ি দেখলাম রাত পৌনে ১২টা বাজে । একটু যেন শীতও পড়ছে । তবে আকাশ বেশ পরিস্কার । সাদাসাদা মেঘ মাথার উপড় দিয়ে উড়ে চাচ্ছে। আকাশে বিশাল রুপালী একটা চাঁদ । আমি মুগ্ধ হয়ে আকাশ দেখতে লাগলাম । বাপ্পি কোন কিছু না বললেও ঘুনঘুন করে গান গাইছে । ছোট মামাকে দেখলাম একটু দূরে সড়ে গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। আমরা যখন সজল আসবে না ভেবে ফিরে যাবার বলো ঠিক করে ফেলেছিলাম । ঠিক সে সময় সজল আসল । ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় ১২টা বাজে । সজল এসেই আমাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল- চল, যাওয়া যাক । সজলকে দেখে আমার কিছুটা অন্যমনন্স্ক আর কেমন যানি চুপচাপ মনে হলো । আমি ভাবলাম হয়তো সাহস দেখাতে গিয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফান্দে পরে গেছে সেই জন্য মন খারাপ । আমি ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললাম – কিরে সজল ! ভয় লাগছে ? যাওয়া বাদ দিবি?
– না , চল, যাওয়া যাক । সজল বেশ গম্ভীর ভাবে বলল ।
– তোর খারাপ লাগলে, থাক না ।
– আহা : বিরক্ত করিস না, বললাম তো চল ।
– কি হইছে রে ? ফিরোজ আমার পাশে এসে জিজ্ঞেস করল ।
– না , কিছু না । আমি জিজ্ঞেস করছিলাম ওর খারাপ লাগছে কিনা ।
– কিরে সজলা বাদ দিবিনি যাওয়া ? ফিরোজ হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল । ফিরোজ এর বলার মধ্যে কেমন একটা খোঁচার আভাস পেলাম । সজল কিছু না বলে হাঁটতে লাগল ।
হঠাৎই সবাই কেমন যানি চুপচাপ হয়ে গেছি । সবাই নীরবে হাঁটছি । বেশ কিছুক্ষন হাঁটার পরে আমরা কর্টন মেলের পেছনের গেটে এসে দাঁড়ালাম । কর্টন মেলের পেছনটা বেশ নীরব । সামনের দিকের মেইন রাস্তায় দু’চারজন লোকজন থাকলেও এদিকটা একেবারে জনশূন্য ।
আমরা দাঁড়িয়ে পরলেও সজল কিন্তু দাঁড়ালো না । ও সোজা শ্মাশান ঘাট এর দিকে হাঁটতে থাকলো । আমি প্রায় দৈড়ে গিয়ে বললাম – সজল দাঁড়া , ভাল করে ভেবে দেখ যাবি কি না !
– ভাবাভাবির কিছু নাই । তোরা এখানে থাক আমি শ্মাশান ঘাট থেকে ঘুরে আসছি ।
– আমরা বুঝবো কি করে যে, তুই আসলেই শ্মাশান ঘাটের ভেতরে গেছিস । বাপ্পি এসে প্রশ্ন করল ।
– আমি প্রমাণ নিয়ে আসবো ;
– কি প্রমাণ আনবি শুনি ।
– মরা পোড়ানোর লাকড়ী নিয়ে আসলে চলবে ? কথাটা বলে সজল খেক খেক করে হাসতে হাসতে এগিয়ে গেল । এ সজলকে আমার কেমন যানি খুব অপরিচিত মনে হলো । মনে হলো – ওকে যেন আমি ঠিক চিনিনা । এই প্রথম দেখলাম । ওর হাসির শব্দে আমার পুরো শরীর কাটা দিয়ে উঠল । আমি কোন কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলাম । আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সজল এক সময় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল । আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি চাঁদটা ততোক্ষনে মেঘের আড়ালে চলে গেছে । আমার কেন যেন খুব ভয় ভয় করতে লাগল । সবাই কেমন চুপচাপ হয়ে আছি । কারো মুখেই কোন কথা নেই । ছোট বেলা থেকে পড়ে এসেছি – সময় আর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা । কিন্তু এখানে আসার পর দেখলাম সময় কি করে স্লো হয়ে যায় । ঘড়ির কাটা যেন আর চলতেই চাচ্ছে । সময় যেন আটকে আছে মহাকালের আর্বতে।
(পরের খণ্ডে সমাপ্ত)
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।