নির্বোধ

ভোর থেকে ধরণীর প্রাণ খোলা বুকে সাজ সাজ ভাব। সূর্য ঊঠেছে সকালের স্নিগ্ধতার সাথে। সমুদ্রের পানি এসে খোলা মাঠের মেঝেকে ধুয়ে দিয়ে গেছে । ঘাস গুলো একে একে বসে গেছে সারি বদ্ধ হয়ে । চারিদিকে স্নিগ্ধ বাতাস জায়গাটাকে সুশীতল করে রাখছে । দিগন্ত এসে বসেছে প্রাঙ্গনের এক পারে । দিগন্ত হলো প্রাঙ্গনের দ্বার । বড় বড় ঘাস বিছানো টিলা এসে বসেছে প্রাঙ্গনের সামনে । অতিথীদের বসবার আসন হবে এই টিলা গুলো । হিমালয় এদের মধ্যমণি হয়ে বসেছে সবার মধ্যখানে। হিমালয় হলো প্রধান অতিথীর বসবার সিংহাসন । সুশীতল মেঘ ঘুরে ফিরে বেরাচ্ছে চারধারে । বায়ু নিরবে বয়ে যাচ্ছে ।হয়তো আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগছে এত কিছুর কারন কি। কারন হলো ধরিত্রিতে ধরিত্রি সম্মেলন । আর ধরিত্রির সাথে সম্পর্কযুক্ত সবি এই সম্মেলনের অতিথী ।

যেমন -পৃথিবীর সব প্রাণি ,পাহাড়,নদী ,সবুজ প্রাণ ,বায়ু ,পানি এমন কি পৃথিবীর চার পাশের গ্রহ নক্ষত্র এর অতিথী । এই সম্মেলনের মধ্যমনি ,সভাপতি হলো মানব। জীব জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণি মানব হলো এই সম্মেলনের পরিচালনাকারি। অতিথী সকল আসতে শুরু করেছে । সিংহরাজ বন প্রধান ,জল প্রধান কুমির, এইরুপ গুরুত্ব পূর্ণ আমন্ত্রীত অতিথী এসে বসেছে টিলা গুলোর উপর । দর্শক শ্রোতা বসেছে খোলা প্রাঙ্গনের মেঝেতে। আজ সবাই হিংসা ক্রোধ ভুলে ,খাবার লোভ ত্যাগ করে বসে গল্প গুজব করছে । পন্ডিত শেয়ালের সামনে তার প্রিয় খাদ্য কাকড়া বসে আছে। জিভে পানি আসছে বটে, তবু কিছু করতে পারছে না।নজরদারি রাখা আছে ।মেঘ -বায়ু ঘুরে ঘুরে নজর রাখছে সব কিছুর উপর। গন্ডার সবার ভিরে আসতে গিয়ে বাঘের গায়ে শিংয়ের গুতো মেরে দেয় ,তবু বাঘ নরম সুরে তাকে বসতে বলে।ইদুর তার সভাব সুলভ দৌড়তে গিয়ে হাতির কানে ঢুকে পরে ,তবু হাতি কিছু বলেনা । প্রাঙ্গনের মাঝখানদিয়ে ফুয়ারার জলের মত ধারা বয়ে যায় । এতে জলের মাছ ,বিভিন্ন প্রাণি এসে বসেছে । তিমি ,ডলফিন মাঝে মাঝে পানির ধারা শূন্যে উড়াচ্ছে । সকলে বসে একে অন্যের সাথে গল্প গুজোব করছে ।

এর মধ্যে বায়ু এসে বলে যায় প্রধান অতিথি কিছু সময়ের মধ্যে এসে উপস্থিত হবে । বায়ুর এক অংশ গেছে মানবকে আনতে । এদিকে প্রধান অতিথির খাবারের জন্য মৌমাছি টাটকা মধু এনেছে , ফল গাছ তাদের টাটকা ফল এনেছে ,এছারা বিভিন্ন প্রাণি বিভিন্ন খাবার এনেছে প্রধান অতিথির জন্য। বাঘ তার চামরা দিয়ে বানানো পোষাক এনেছে মানবকে পরানোর জন্য । ফুলের মুকুট তৈরি করেছে ফুলগাছ । সকলে আগ্রহি মানব কখন আসবে , হঠাৎ মেঘের গর্জন , সাথে তপধ্বনি জয়হোক মানবের জয়হোক ,সবাই আজ তারি গুন গাই । বায়ু তার পিঠে চরিয়ে দ্বার দিয়ে ঢুকে মানবকে বসিয়ে দেয় এভারেস্টের চূড়াতে । একে একে মানবকে পড়ানো হয় পোষাক ,মুকুট,সামনে দেয়া হয় নানা খাবার। মানব চারিপাশ ভালোকরে দেখে নেয় , এরপর হাততুলে সবাইকে অভিনন্দন যানায় । সবকিছু ঠিকঠাক , মানব অনুমতি দেয় অনুষ্ঠান শুরু করতে ।

একে একে আমন্ত্রিত প্রধানেরা ভাষন দেয় ,তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে। এদের কথা থেকে যা বোঝা যায় তা হলো পৃথিবীর তিন পরশক্তি -মাটি ,পানি, বায়ু খুব বেশি বর্বর হয়ে গেছে । ঝড় ,জলচ্ছাস ,বন্যা ,খরা,ভূমিকম্পের মত সমস্যা দিয়ে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে তুলছে। পৃথিবীর প্রাণিদের ক্ষতি করছে , এমনকি মানব জাতিকে-ও কষ্ট দিতে ব্যস্ত হচ্ছে এরা । কথা গুলো শুনে মানব রাগান্নিত হলেন ,বললেন – -এতবড় স্পর্ধ্বা ,আমার স্বজাতির উপর অত্যাচার ,মাটি তোমার কারন কি ? মাটি এসে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে – হে মহামান্য মানব । আমি মাটি ,আমার উপর ভর দিয়ে পৃথিবীর সব কিছু দাঁড়িয়ে। আমি তো এতে বাধা দেয় না । আমিতো সবার সেবার জন্য । কিন্তু বর্তমানে এমন হয়েছে মেঘ বৃষ্টি দেয়না । সূর্যের উত্তপ্ত আলো আমার গায়ে ঢেলে পরে । আমাকে শীতল করে পানি । কিন্তু আমার গায়ে পানি ঠিক মত থাকছে না এখন উত্তপ্ত গরমের অত্যাচারে ।

তাইতো আমি গরমের অত্যাচারে না থাকতে পেরে মাঝে মাঝে রাগে কেপে উঠি ,মাঝে মাঝে আমার ঘৃণার থুথু উপরে ছুরে দেয়।সূর্যকেতো আমি কাছে পাবো না । পরিবেশে গ্রীন হাউজ যেভাবে নষ্ট হচ্ছে , সূর্যের উত্তপ্ত আলো আমাকে এভাবে কষ্ট দিলে কিভাবে আমি শান্ত থাকি বলুন। মানব এবার পানিকে ডাকলেন কাঠগড়ায় । পানি এসে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করে – হে মহামান্য ,মানব। দোষতো আমার নয় । দোষতো মেঘের ও বৃক্ষের । মেঘ ঠিকঠাক আমাকে সমৃদ্ধ কারি কাঁচামাল পানি তা দেয়না । তাছারা বৃক্ষ অক্সিজেন প্রকৃতিতে ঠিকঠাক না দেবার কারনে গ্রীন হাউজ নষ্ট হচ্ছে । এর ফলে সূর্যের যে তাপ আসছে তা আমাকে উত্তপ্ত করে তোলে । তাইতো আমি সূর্যের ও প্রকৃতির ক্ষিপ্ততা থেকে বাঁচতে মাঝে মাঝো লুকিয়ে যায়।

আবার যখন মেঘ বৃষ্টি হয়ে আসে, আমি তাকে ভাসিয়ে দেয় এদিকে ওদিকে । মানব পানির কথা শুনলো , বুঝলো যা বলেছে তাতো ঠিক । মানব এবার বায়ুকে কাঠগড়ায় ডাকলো । বায়ু মানবের পাশে ছিল । আস্তে আস্তে সে কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ালো ।বলতে শুরু করলো- হুজুর দোষতো আমার নয় । দোষতো প্রকৃত বৃক্ষের । বৃক্ষতো আমার শরীরের পর্যাপ্ত অক্সিজেন দেয় না । এদিকে আমি গ্রীন হাউজ ঠীক রাখতে না পেরে সূর্যের তাপে থাকতে পারি না । তাই আমি মাঝে মাঝে এদিকে ওদিকে ছুটো ছুটি করি। এতে পৃথিবীতে বসবাস কারি বিভিন্ন প্রাণের ও প্রকৃতির ক্ষতি হয়ে যায় । সূর্যের এতে কোন দোষ নেই । সেতো তার গায়ের উত্তপ্ততা ঝেরে ফেলতে পারবে না বা নিজে নিজেকে ঢেকে রাখবে না। দোষ প্রকৃত বৃক্ষের ,সে প্রকৃতির গ্রীন হাউজ রক্ষায় ঠিক ভাবে কাজ করছে না । প্রকৃত বৃক্ষের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর তিন পরশক্তির কথা শেষ । এবার মেঘকে ডাকা হলো । মেঘ এসে বলতে শুরু করলো – হে পৃথিবীর প্রাণি প্রধান। দোষতো প্রকৃত বৃক্ষেরি।বৃক্ষ পরিবেশের ভারসম্য রক্ষার উপাদান অক্সিজেন প্রয়োজন মত দিচ্ছে না । অন্যদিকে কার্বন ঠিকভাবে পরিবেশ থেকে নিয়ে নিচ্ছেনা । তাই পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে। আমাকে সমৃদ্ধকারি বাষ্প আমাকে সমৃদ্ধ করতে পারছে না ।

তাই আমি প্রয়োজনমত বৃষ্টি দিতে পারি না ।যতটুকু পারি পানিকে দেবার চেষ্টা করি।দোষতো প্রকৃত বৃক্ষেরি। সবার দোষ গিয়ে পরলো বৃক্ষের উপর। মানব এবার তার সভাব সূলভ হুমকার ছেরে বলে উঠলো – বৃক্ষ ,তাইতো আমার স্বজাতি বৃক্ষকে দেক্ষতে পারে না । তাইতো তারা বৃক্ষদের কেটে দু টুকরো করে। কোথায় সেই অপরাধি বৃক্ষ । দ্রুত কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তোর কারন বল। যথাযথ কারন বলতে না পারলে তোকে তোর শাস্তি মৃত্যু দন্ড পেতে হবে। বৃক্ষ জরাজীর্ন অবস্থায় সবার ভীরে এক কোনে বসে ছিল ।আস্তে আস্তে ভীর ঠেলে কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ালো । মৃদু স্বরে বলতে শুরু করলো – হুজুর সবার দোষতো আমার উপর পরলো ।আমি প্রাণের অস্তিত্ব ,পরিবেশের ভারসম্যের প্রধান উপাদান অক্সিজেন প্রয়োজন মত দিতে পারি না । কথাটা ঠিক। তবে দেখুন আজ আমার যে জরাজীর্ন অবস্থা তাতে আমি আমার নীজ অস্তিত্ব বাঁচাতে হীমশীম খায় । আমি কিভাবে অন্যকে সাহায্য করবো ।আপনার স্বজাতি আমাদের যেভাবে অত্যাচার করে।আমার বংশ যেভাবে ধ্বংশ করে ।

এভাবে আমাদের অস্তিত্ব ধ্বংধশ করতে থাকলে কি করে আমরা প্রকৃতিকে সাহায্য করবো । মানব বৃক্ষের কথা শুনে আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠলো- তোর এত বড় স্পর্ধ্বা ,আমার স্বজাতিকে দোষারোপ করিস। প্রকৃত তুই দোষি । এখনি তোর মৃত্যু দন্ড কার্যকর করা হবে। সঙ্গে সঙ্গে মানব গাছ কাটক পাখি কাঠঠোকরাকে ডাকলো । কাঠঠোকরা ঐ গাছেরি এক ডালে বসে ছিল ।গাছের পাতা ভেদ করে মাথাটা বের করে বললো হুজুর হুকুম করেন। কিন্তু মানব বললো -দাঁড়াও । আমার স্বজাতির একটা রীতি আছে কাউকে মৃত্যুদন্ড দেবার পূর্বে তার শেষ ইচ্ছা জানতে হয় । তো বল বৃক্ষ তোর শেষ ইচ্ছা কি? এদিকে বুদ্ধিহীন পৃথিবীর প্রাণি গুলো শুধু তাকিয়ে দেখে মানবের কর্মকান্ড । তারা জানেনা কি ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটতে যাচ্ছে তাদের ভাগ্যে। বৃক্ষ বললো – হে মহামান্য মানব । আমার শেষ ইচ্ছা নেই । শেষ অনুরোধ আছে ।আর তা হলো আমাকে মারবেন না ।

প্রকৃতিকে , খোদার সৃষ্টি প্রাণকে বাঁচাতে আপনার স্বজাতির অস্বিত্ব রক্ষার জন্য বলছি । আমাকে হত্যা করবেন না । বরং আমাকে আমার অস্তিত্ব রক্ষায় সাহায্য করুন । এর দ্বারা আপনি নিজেকে ও এই পৃথিবীর সবকিছুর ভারসম্য রক্ষায় কাজ করুণ। অন্যথা ,আপনি যে চূড়াতে বসে আমাকে বিচার করছেন । ঠিক ওখান থেকে আমার পদতলে এসে মারা যাবেন। এ কথা শুনে মানব এর মুখ রাগে রক্তিম হয়ে উঠলো । সে বৃক্ষকে হত্যার হুকুম দিয়ে দিলো । কাঠ ঠোকরা সঙ্গে সঙ্গে প্রাণের অস্তিত্বের উৎস গাছ কেটে দু টুকরো করে ফেলে । বায়ু থেকে ,প্রকৃতি থেকে অক্সিজেন হারিয়ে যায় । অক্সিজেন ছারা সবাই ছটফট করতে থাকে । মানব ছটফট করতে করতে পাহাড় চূড়া থেকে নিচে পরে যায় ,ঠিক যেখানে বৃক্ষ মরে পরে ছিল। গাছের ডালে ছোট একটা বীজ ছিল ,তা মাটিতে লুটিয়ে পরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

একটা আষাঢ়ে গল্প-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-১ম অংশ

দূর সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ । সেখানে কেবল তাসের সাহেব , তাসের বিবি , টেক্কা…

একটা আষাঢ়ে গল্প-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-২য় অংশ

এমনি তো কিছুকাল যায় । কিন্তু এই তিনটে বিদেশী যুবক কোনো নিয়মের মধ্যেই ধরা দেয়…

দূরবর্তী এক নদীর উপকথা

এই সকালে কুয়ালালামপুর শহরটা নরম রোদের আলোয় ডুবে রয়েছে। সেই সঙ্গে মৃদুমন্দ বাতাসও বইছে। রোদ…