
প্রতিদিন একই জায়গায় ভিখিরাটাকে বসে থাকতে দেখেন তানভীর সাহেব। মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হন তিনি। ব্যাটা বসার আর জায়গা পেল না! একেবারে তার ফ্যাটের গেটের ধারে! গেট থেকে বাইরে পা রাখলেই বজ্জাতটা চেঁচাতে শুরু করে দেয়,‘আল্লার ওয়াস্তে দুইডা ট্যাকা দেন সাব…’ যত্তসব! এই ভিখিরী-ফিখিরীদের একদম সহ্য করতে পারেন না তানভীর সাহেব। যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন এদের। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ভিখিরী লোকটাকে ইচ্ছে করলেই তিনি এখান থেকে সরিয়ে দিতে পারেন। অথচ তিনি তা করছেন না। আবার ভিখিরীটাকে দেখলেই তার মেজাজ বিগড়ে যায়। কিন্তু তিনি যে কারণে এসব করছেন না সেটা হচ্ছে- তিনি যখন প্রতিদিন ভোরে জগিং করতে বের হোন তখন তাকে দেখলেই ভিা চাইতে শুরু করে লোকটা।
কিন্তু তিনি এমন ভান করে সামনে দিয়ে চলে যান যেন তাকে দেখেও না দেখার ভানই করছেন! ব্যাপারটা করলে ভীষণ ভাল লাগে তানভীর সাহেবের। তিনি যখন ল্য করেন যে ভিখিরীটা তাকে দেখলেই দু’পয়সা পাওয়ার জন্যে উঠেপড়ে লাগে অথচ তিনি তাকে একদম পাত্তাই দেন না তখন সেটা ভেবে ভীষণ তৃপ্তিবোধ করেন তানভীর সাহেব। অন্যরকম আনন্দবোধ হয় তার। ভিখিরীটাকে জ্বালাতন করে হয়ত এমন আনন্দ পান বলেই লোকটাকে সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ পাচ্ছেন না। তানভীর সাহেব ল্য করেছেন ভিখিরীটার দুটো পা-ই নেই। নষ্ট হয়ে যাওয়া গাড়ির টায়ারের চামড়া কেটে কোমড়ের সঙ্গে বেঁধে মাটিতে চলার বিকল্প হিসেবে চালিয়ে নিচ্ছে যাতায়াতটা। শতচ্ছিন্ন বহু পুরোনো পোশাক দেখলেই মনে হয় কাপড় বলতে গায়ে কিছু নেই। যেন কাঁদামাটি থেকে উঠে আসা কোন কদাকার ভূত! চেহারাটা চেনার জো নেই একদম। ভিখিরীরা সাধারণত এমনই হয় দেখতে। কাঁধে ঝোলানো থাকে ওদের নিজস্ব ঝোলা, যেটাকে বস্তা বলাটাও মন্দ নয়! তবে অন্যান্য ভিখিরীদের মতন থালা না বিছিয়ে ছেঁড়া একটুকরো কাপড় মাটিতে বিছিয়ে রাখে লোকটা। আরেকটা ল্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে ব্যাটা প্রতিদিনই ভোরবেলা এসে গেটের পাশে বসে থাকে, আবার যখন তানভীর সাহেব ফেরেন তখন তার টিকিটিও নজরের বাইরে! সারাটা দিন তো নই! যেন ব্যাটা এ বাড়ির সামনে এসে ভোর বেলাতেই একবার করে বসবে এমন রুটিন বেধে রেখেছে! অবশ্য এতসব নিয়ে তানভীর সাহেবের তেমন একটা মাথাব্যথা নেই। তো, এভাবেই দিন কাটছিলো। একদিন তানভীর সাহেবের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা কয়েকদিনের জন্যে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে চলে গেলেন। পুরো এ্যাপার্টমেন্টে একাই রয়ে গেলেন তানভীর সাহেব। অবশ্য উপরের তলায় তার ভাড়াটিয়ারা থাকে। উনার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা যেদিন গ্রামের বাড়ি চলে যান তার পরেরদিন ভোরে অন্যান্য দিনের মতনই তানভীর সাহেব জগিং করতে বেরুলেন তখন তিনি অবাক হয়ে ল্য করলেন যে ভিখিরীটা উধাও! অবাক হলেও বিস্মিত হলেন না তিনি। ভাবলেন, ব্যাটা হয়ত মাসে একবার বিরতী নোয়ার ধান্দা করছে। তবে কেন জানা নেই, ঔইদিনই পুরোটা সময় তিনি ভিখিরীটাকে মন থেকে মুছতে পারলেন না। সেদিনই সন্ধ্যায়। বসে বসে একমনে টিভি দেখছিলেন তিনি। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দেখলেন ফোরে একটা খাম পড়ে আছে। ঝুকে খামটা তুলে নিলেন তানভরি সাহেব। আশেপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছে না। মনে হয় পিয়ন চিঠিটা রেখেই চলে গেছে। এদিককার চিঠিপত্রগুলো বিলি করতে প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যায় পিয়নের। দরজা লাগিয়ে আবার টিভির ঘরে এসে বসলেন তানভীর সাহেব। খামে ডাক বিভাগের চাপ মারা আছে। তবে কোন জায়গা থেকে এসেছে ঠিক স্পস্ট বোঝা যাচ্ছে না।
চিঠিটা খুলে পড়লেন তিনি। তারপর…না, ঠিক একমুহূর্ত পর! চুপচাপ বসে আছেন তানভীর সাহেব। চিঠিটাতে এমন কিছু লেখা ছিলো যা তাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। এমনভাবে জায়গায় জমে গেছেন তিনি যেন উঠে দাঁড়ালেই সাংঘাতিক কিছূ ঘটে যাবে। এবং… সত্যিই…হলোও কিন্তু তাই! খুব তাড়াতাড়ি! অত্যন্ত দ্রুত! কিছু বুঝে ওঠার আগেই, মুহূর্তেই! একটা বিস্ফোরণ, তারপর… সবকিছু শেষ!! ২. তানভীর সাহেবের দেখা প্রতিদিনের সেই ভিখিরীটা হঠাৎ উদয় হলো। তবে আগের জায়গায় নয়, রাস্তার ওপাশে- কিছুটা দূরে। লোকটার চোখজোড়া চক্চক্ করছে। তানভীর সাহেবের পুরো দালানটা কিছুণ আগে বোমায় বিস্ফোরিত হয়ে ধ্বসে পড়েছে। এখনও চারদিকে আগুনের শিখা উঁকিঝুঁকি মারছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে যাওয়ায় চারদিকটা এখন অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মাঝে ধ্বসে পড়া পুরো বিল্ডিঙের ধূলো আর আগুনের উজ্জ্বল কুন্ডলী পাকানো শিখা চারদিকটায় হৈচৈ-এর সৃষ্ঠি করেছে। প্রচুর লোকজন বেড়িয়ে এসেছে রাস্তায়। পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স- এ সমস্ত কিছুর কান ফাটানো শব্দে গোটা পরিবেশটা উত্তপ্ত। লোকজন বলাবলি করছে, ফ্যাটে নাকি ভাগ্যক্রমে কেউই ছিলো না। আর তানভীর সাহেবও অলৌকিকভাবে এ বোমা বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে গেছেন, তবে তিনি ভয়াবহ রকম আহত। এ ঘটনায় চারদিকে ভীষণ হৈচৈ। সাংবাদিকরাও জুটে গেছে এতণে। কিন্তু দূরের ঔই পাহীন কুৎসিত ভিখিরীটার কোনদিকে যেন আগ্রহ নেই। লোকটা শুধু চলে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সটার দিকে নিঃস্পলক তাকিয়ে তাকলো। অ্যাম্বুলেন্সটায় করে তানভীর সাহেবকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভিখিরীটার দৃষ্ঠি থেকে যেন ঝরে পড়ছে একরাশ ক্রোধ…!! ৩. এ ঘটনার প্রায় একমাস পর। তানভীর সাহেব তার গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছেন শহর ছেড়ে।
সস্ত্রীক। বোমা বিস্ফোরণে তার দুটো পাই পঙ্গু গেছে। সারা শরীরে জ্বলসে যাওয়া তামাটে চিহ্ন। এই তানভীর সাহেবের সাথে একমাস আগের তানভীর সাহেবে কোন মিলই নেই। কুৎসিত, কদাকার! নিজের এই বেহাল দশা দেখে তার মনে হলো সেই ভিখিরীটার কথা। আজ আর তাদের দুজনের মাঝে তেমন কোন ফারাক নেই। গতকাল একটা খাম তিনি আবারও পেয়েছেন। তবে এখন আর তাকে আগের মতন আতঙ্কিত দেখাচ্ছে না। তিনি খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাম থেকে চিঠিটা বের করে পড়লেন: ‘এ যাত্রা তুমি বেঁচে গেলে বাবা! আমাকে জন্ম দিয়েও পিতৃ পরিচয় থেকে বঞ্ছিত করেছো তুমি। শুধু তাই নয়, প্রচন্ড ঘৃনা ভরে আমাকে তুমি সরিয়ে দিয়েছো তার দুনিয়া থেকে। আজ আমিও তোমাকে এ পৃথিবীর আলো থেকে বঞ্ছিত করে এই জগত সংসার থেকে সরিয়ে দেব। অপোয় থেকো…’ তানভীর সাহেব নির্বিকার। তিনি দূরের ঔই মেঠো পথের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবলেন, অপোর শেষ হবে কবে…? —সংগৃহীত