ইউসুফ ও জুলেখা

জুলেখা যখন জানতে পারলেন যে, তাঁর সম্বন্ধে অপরাপর মহিলারা অন্যায় আলোচনা আরম্ভ করেছে, তখন তিনি তাদের জব্দ করার জন্য ফন্দী আঁটলেন। তিনি একদিন তাদের নিমন্ত্রণ করলেন এবং ছুরি দিয়ে কেটে খেতে হয় এমন একটি খাবার প্রস্তুত করলেন। সকলে খেতে এলে তাদের প্রত্যেককে এক একটি ছুরি দিলেন। তারা যখন খেতে আরম্ভ করেছে ঠিক সেই সময়ে জুলেখা ইউসুফকে ডাকলেন। ইউসুফকে দেখে মেয়রা এত বিস্মিত ও মুগ্ধ হলো যে তারা খাবার কাটতে গিয়ে নিজেদের আঙ্গুল কেটে ফেললো। তারা বলাবলি করতে লাগলোঃ এত রূপ! এত সুন্দর! এ কি মানুষ না ফেরেশতা।

জুলেখা সেই সময়ে সুযোগ পেয়ে বললেনঃ তোমরা আমাকে দোষী করছিলে – এবার তো তোমরাও দোষী। নিমন্ত্রিত মহিলারা এবাসের সত্য সত্যই লজ্জিত হলো। ইউসুফের প্রতি নারীদের এইরূপ আসক্তির কথা জানতে পেরে সমাজের মাতব্বরেরা শঙ্কিত হলেন। তাঁরা নৈতিক জীবন পবিত্র রাখার জন্য ইউসুফের বিরুদ্ধে বাদশাহের নিকট অভিযোগ করলেন। বাদশাহ উপায়ান্তর না পেয়ে নিরপরাধ ইউসুফের কারাবাসের হুকুম দিলেন। ইউসুফক কয়েদখানায় নেওয়া হলো। তাঁর সঙ্গে আরো দু’টি যুবককে কারাগারে প্রেরণ করা হলো।

একদা রাত্রে সেই যুবক দু’টি স্বপ্ন দেখলো। সেই স্বপ্নের কথা ইউসুফকে জানালো। একজন বললো, সে যেন আঙ্গুর থেকে রস বের করছে। অপর একজন বললো, সে যেন মাথায় বয়ে রুটি নিয়ে যাচ্ছে! কতকগুলি পাখি সেই রুটিগুলো ঠুকরে খাচ্ছে। ইউসুফ খোদাতা’লা কৃপায় প্রগাঢ় তত্ত্বদর্শী হয়েছিলেন। তিনি স্বপ্ন-বৃত্তান্ত শ্রবণ করে বললেনঃ দেখ, তোমাদরে একজন শীঘ্রই মুক্তি পাবে এবং বাদশাহের সঙ্গী নিযুক্ত হয়ে তাঁকে শরবত পান করাবে। অপরজনের ফাঁসী হবে এবং তার মাথা পাখিতে ঠুকরে খাবে।

কয়েকদিনের মধ্যেই ইউসুফের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য সত্যই ফলে গেলো। একজন মুক্তি পেলো অপর জনের ফাঁসী হলো। যে ব্যক্তি মুক্তি পেয়েছিলো সে বাদশাহের অনুচর নিযুক্ত হলো। কিছুদিন পরে বাদশাহ এক স্বপ্ন দেখলেন, সাতটি কৃশকায় গাভী সাতটি বলবতী গাভীকে খেয়ে ফেলছে এবং সাতটি শীর্ণ ধানের শীষ সাতটি সতেজ ধানের শীষকে খেয়ে ফেলছে। বাদশাহ পরদিন দরবারে স্বপ্ন বৃত্তান্ত প্রকাশ করে অনুচরদের কাছে এর অর্থ জানতে চাইলেন। কিন্তু কেউ সদুত্তর দিতে পারলো না।

কারাগারের সেই যুবক সেখানে উপস্থিত ছিলো। ইউসুফের কথা তার মনে পড়ে গেলো তখনই তাঁর কাছে গিয়ে সে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলো। ইউসুফ বললেনঃ প্রথমে সাত বৎসর খুব ভীষণ অজন্মা ও দুর্ভিক্ষ হবে সে সময় তোমরা সেই সঞ্চিত শস্য থেকে খরচ করতে পারবে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে পেয়ে বাদশাহ খুব সন্তুষ্ট এবং ইউসুফকে তাঁর নিকটে আনবার সঙ্কল্প করলেন।

যে সকল মেয়ে অসাবধানতায় নিজেদের আঙ্গুল কেটে ফেলেছিলো, তাদের কাছে অনুসন্ধান করে বাদশাহ জানতে পারলেন ইউসুফ তাদের সংগে কোনো অসদ্ব্যবহার করেননি। তারাই ইউসুফকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলো। জুলেখাও সেখানে ছিলেন। তিনি এ কথার সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য দিলেন। বাদশাহ সব কথ শুনে অনুতপ্ত হলেন এবং ইউসুফকে মুক্তি দিয়ে তাঁকে রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করলেন।

ইউসুফের স্বপ্নের ব্যাখ্যা সত্য সত্যই সফল হলো। প্রথম সাত বৎসর ভাল ফসল হলো এবং পরের সাত বৎসর ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো। মিশরের সঞ্চিত খাদ্যের কথা জানতে পেরে নানা দেশ থেকে লোকজন আসতে লাগলো। ইউসুফের ভ্রাতারাও খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে এলো। তিনি তাদের দেখে চিনতে পারলেন, কিন্তু তারা তাঁকে চিনতে পারলো না।

তিনি ভ্রাতাদের খাদ্য দিয়ে বলে দিলেনঃ আবার যখন আসবে তোমাদের ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে এসো। তাকে না নিয়ে এলে খাদ্য পাবে না। এই বলে অনুচরবর্গের দ্বারা কিছু অর্থ গোপনে খাদ্যের থলির মধ্যে পুরে দিলেন। তারা বাড়ি গিয়ে তাদের পিতাকে মিশরের শাসনকর্তার অনেক গুণের কথা বর্ণনা করলো এবং এবারে ছোট ভাইকে নিয়ে যাবার জন্য বলে দিয়েছেন সে কথাও জানালো।

হযরত ইয়াকুব তাদের পূর্বের কাজ স্মরণ করে কনিষ্ঠ পুত্র বনি ইয়ামিনকে তাদের সঙ্গে দিতে রাজি হলেন না। খাদ্যের বস্তা খোলা হবার পর তার মধ্যে টাকা দেখতে পেয়ে তারা খুবই বিস্মিত হলো। পুনরায় খাদ্যাভাব ঘটলে তারা তাদের পিতাকে গিয়ে শক্ত করে ধরে বললোঃ আব্বা, আপনি ছোট ভাইকে আমাদের সংগে যেতে দিন। খোদার নামে শপথ করে বলছি, আমরা তাকে অক্ষত দেহে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। পিতা তাদের জিদের কাছে পরাজিত হয়ে অগত্যা অনুমতি দিলেন।

বনি-ইয়ামিনকে সংগে নিয়ে তারা গেলো এবং ইউসুফের নির্দেশ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দরজা দিয়ে শহরে প্রবেশ করলো। ইউসুফের কাছে যখন তারা পৌঁছলো তখন ছোট ভাইকে ডেকে নিয়ে তিনি নিজের পরিচয় প্রদান করলেন। অন্যবারের মতন এবারেও তাদের বস্তা বোঝাই করে খাদ্য দেওয়া হলো। ইউসুফের এক চাকর একটি পেয়ালা ইচ্ছা করে ছোট ভাইয়ের বস্তায় লুকিয়ে রেখে দিলো। পরে অভিযোগ উঠলো যে, ছোট ভাই একটি দামি রৌপ্য পেয়ালা চুরি করেছে।

তারা শপথ করে বললোঃ আমরা তো জানিই না কে পেয়ালা চুরি করেছে। এতে তো আমাদের কোন দোষ নেই। কিন্তু ইউসুফ ইচ্ছাকৃতভাবে চুরি করার অভিযুক্ত হিসেবে ছোট ভাইকেই নিয়োগ করলেন। তাঁর ভাইয়েরা হিতাহিত বিবেচনা না করে বললোঃ হে, শাসক! আমাদের কাছে এক পরিবারের দ্বাদশ জন সদস্য ছিলো, তাদের মধ্যে কেবল এক জনই অক্ষম এবং অসহায়।

শাহারবনু’র গল্প-১

স্বার্থপর দৈত্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *