গ্রামে একটি কাঁচারাস্তা যখন পাকা হয়

কী বলছিস তুই? যা ঘটছে তাই বলছি। আপনি দ্রুত ব্যবস্থা নেন। কুদ্দুইসা এলাকায় গিয়ে লোকজন জড়ো করে গাছপালা সব কেটে সাফ করে দিয়েছে। মা আর ছোট আপাকে যাচ্ছেতাই বলে গালাগাল দিয়েছে, এক নিঃশ্বাসে কথা বলে থামে জহির। ঠিক আছে, কী করা যায় আমি দেখছি, ছোট ভাইকে বলে বড় ভাই রনি। তুই চিন্তা করিস না। চিন্তা করব না তো বসে বসে মজা দেখব? আমি এখনই বাড়ি যাইতেছি, দেখে নেব শালাদের কত বাড় বেড়েছে। জহির, তোর একা বাড়ি যাওয়ার দরকার নাই। কী আর করবে? না হয় খুনই করবে? কিন্তু আর সহ্য করা যায় না, সঙ্গে সঙ্গে সেল কেটে দেয় জহির। হতবাক রনি হাতের মোবাইল সেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই শালার সেলফোন দ্রুত মানুষকে চেঞ্জ করে দিচ্ছে। পৃথিবীর এক প্রান্তের খবর আরেক প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে। ঢাকা থেকে তিনশো কিলোমিটার দূরে, গ্রামের বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনা মাত্র মিনিট পঁচিশেক আগে ঘটেছে, আর এখন ঢাকা থেকেই খবরটা পেয়ে গেল। সুস্থ একটা পরিস্থিতি সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল।
 অফিসের রুমে বসে রনি। ঘামছে। ভয়ানক ভীতু প্রকৃতির মানুষ। কী করবে? কার কাছে যাবে? মনে পড়ছে মা আর ছোট বোনটার কচি মুখ। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর মা পরম মমতায় ছায়া দিয়ে বড় করেছে সব ভাইবোনকে। সবচেয়ে দুঃখ লাগে কুদ্দুসের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ছোটবেলা থেকে যাদের সঙ্গে বেড়ে উঠেছে সেই বন্ধুরা। ওরা টাকার কাছে বিকিয়ে গেছে। টাকা! এখন টাকাই মোক্ষ? টাকায়সব কিছু বিকায়? টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেল সাদেক, রফিক, শফিক। ওরা তিন ভাই। ওই তিনজনেরই সঙ্গে সেই শৈশব থেকে রনি হাসি-তামাশায় আনন্দে খেলাধুলায় বড় হয়েছে। সকাল-বিকেলে যাদের মুখ দেখে, মাকে চাচি ডাকে, সেই মাকে গালিগালাচ করেছে ওরা? তাও নিজেদের কোনো স্বার্থ নয়, আমাদের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরের কুদ্দুসের জন্য?

মাথায় আগুন লাগে। টেবিল ছেড়ে দাঁড়ায়। সেল লাগায় ডিআইজি সালাহউদ্দিনকে। সালাহউদ্দিন অফিস কলিগের আত্মীয়। পুলিশের এত বড় একজন কর্মকর্তা কিন্তু অসম্ভব ভদ্র। কথা বললে মনে হয়, একজন বিদগ্ধ অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলছে। সালাহউদ্দিন গল্প লেখেন। তার বাসায় দু-একবার যাবার সুযোগ হয়েছিল কলিগের সঙ্গে। ফোন নাম্বারও আদান-প্রদান করা হয়েছে। তাকে একবার ফোন দেবে নাকি? ভাবতে ভাবতে ফোন দেয় সালাহউদ্দিনকে। রিং বাজছে। ধরবে কি? ভাবতে ভাবতেই ফোন ধরে সালাহউদ্দিন, কী খবর ভাই? কেমন আছেন? জ্বি ভাই ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন? আছি আরকি। চারদিকে এত ঝামেলা নিয়ে ভালো থাকা যায়? ভালো থাকার চেষ্টা করছি। তো আপনার খবর বলুন।

ভাই, আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। জরুরি? জ্বি, জরুরি। অফিসে চলে আসেন, বিকেলে। ঠিক আছে। আসব। ফোনটা রেখে স্বসিত্ম বোধ করে রনি। অন্তত একজন মানুষের কাছে নিজের কষ্টটা কিছুটা হলেও শেয়ার করা যাবে, যার কাছে ক্ষমতার একটা রশি আছে। কিন্তু সালাহউদ্দিন কতটা গুরুত্ব দেবে আমাকে, ভাবনার মধ্যে আবার ডুবে যায় রনি। আমি তো খুব সামান্য মানুষ। মানুষের কাছে বলা যায়, এমন কোনো প্রসঙ্গও নেই। ছাপোশা মানুষ। অফিসেও যে খুব ভালো আছে, বলা যাবে না।

মাথার মধ্যে আবার অন্য ভাবনা, জহির কি সত্যি সত্যি বাড়ির দিকে রওয়ানা করছে? ও গোয়ার টাইপের মানুষ। লেখাপড়া শেখানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু স্বাধীন মোষ গ্রামের বাড়িতে থাকলে যা হয়, তাই হয়েছে। লেখাপড়া করেনি। সবকিছু যুক্তির বাইরে গিয়ে মহিষের মতো ঠেলার একটা প্রবল প্রবণতা আছে জহিরের। একটা খুনোখুনি হলে, ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না। নিজের ইমিডিয়েট ছোট ভাই—লেখাপড়া শেখেনি, বুদ্ধি বিবেচনায় চলে যাচ্ছে। ফোন দেয় জহিরকে। অনেকক্ষণ বাজার পর ফোন ধরে জহির, হ্যালো! তুই কোথায়? আমি অফিসে। বাড়ি যাবার জন্য ছুটির দরখাস্ত লিখছি।

শোন জহির, বাড়ি তুই একলা কেন যাবি? আমিও যাব তোর সঙ্গে, এক কাজ কর— কী? আমি পরিচিত একজন ডিআইজিকে ফোন দিয়েছিলাম। উনি বিকেলে দেখা করতে বলেছেন, ওনার সঙ্গে দেখা করে ভেবেচিন্তে সিন্ধান্ত নেয়া যাবে। মাথা গরম করিস না। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের নাই টাকা-পয়সা, নাই বড় ক্ষমতাবান আত্মীয়, কে আমাদের সামলাবে? ওনার সঙ্গে কথা বলি, শেষে বাড়ি যাই? ঠিক আছে। মনে হলো জহিরের রাগ একটু কমেছে। সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রশ্ন করে, বাড়িতে মাকে ফোন করেছিলেন?

না, এখনই করছি। করেন। খুব সহজে মাকে ফোন করার জন্য বলল জহির। কিন্তু রনি ভাবছে, মাকে কী বলবে? আর মাই বা কী বলবে? ছোট বোন শিমুলকে কী বলবে? অপমানে নিজের কাছে নিজের মাথা নুয়ে আসে রনির। হায়, এ কোন যাতনায় পড়ল সে? তাহলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে পাশবিকতাই দরকার? পাশবিকতার সাধনা করাই এখন বেঁচে থাকার মন্ত্র? আজ যদি অঢেল টাকার মালিক থাকত, ক্ষমতার রসি আপন হাতেই ওর হাতে জমাট বেঁধে থাকত। রিং বাজছে। মায়ের নাম্বার। যাক, নিজের করতে হলো না, মা-ই করল ফোন। অনেক দ্বিধা আর সংকোচের সঙ্গে ফোন ধরে রনি, হ্যালো! ভাইজান, বাড়ির খবর শুনছেন? ফোনে শিমুল। হ্যাঁ, শুনেছি। কী অবস্থা?

ওই শোনেন, অরা এহনও গালিগালাচ করতেছে। গাছ কয়টা কেটেছে? পশ্চিমের বাগানের উত্তরের দিকের সব কয়ডা গাছ কাঁডাল গাছ, সুপারি গাছ, বিলাতি গাবগাছ— সব কাটছে। আর কইতেছে আপনেরা বাড়ি আইলে রাস্তায় আঁঁটতে দেবে না। তোরা কিছু চিন্তা করসি সা। আমি আর জহির বাড়ি আসতেছি। ওদের সামনে যাওয়ার দরকার নেই। আমি কী বলেছি, বুঝতে পারছিস? হয়। ঝুঝজি। মা কই? পাশে খারাইয়া রইছে। ফোন দিমু মারে? না, এখন দিস না। আমি পরে ফোন দেব। ফোন কেটে দেয় রনি। যাক, তবু একটা যোগাযোগ হলো বাড়ির সঙ্গে। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে অসসিত্ম লাগবে, তাই কথা বলল না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা ঘুণপোকা কুরে কুরে খায় রনি রায়হানকে। এই সস্তা জীবনের দাম কী? আমার মতো এই প্রকারের কোটি কোটি মানুষ আছে বাংলাদেশে, পৃথিবীজুড়ে। খায়দায়, বিয়ে করে, বৌয়ের সঙ্গে সেক্স করে, কুকুরের মতো বাচ্চা জন্ম দেয়, শেষে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে শিয়ালের মতো মরে যায়। ব্যস, জীবন ফুরিয়ে গেল? এই যদি জীবন হয়, তবে কেন জন্ম নিলাম? কেন অসুরের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি না? অফিসে পাঁচটি বছর কেটে যাচ্ছে, চাকরিটা পারমানেন্ট হচ্ছে না। এই চাকরিকে কি চাকরি বলে? যেদিকে তাকাই কেবল শূন্য, শূন্য আর শূন্য। বিপুল শূন্যতার মাঝে বেঁচে থেকে কী লাভ? আজ যদি টাকা থাকত, মাছুয়ার পোলা কুদ্দুসের সঙ্গে একটা বোঝাপাড়ায় আসা যেত। অথবা যদি শৈশব একটা পাশবিক শক্তির আধার হতে পারত, মাছুয়ার পোলা কুদ্দুস কোথায় ভেসে যেত।
লোকের মুখে শুনেছে, কুদ্দুসের বড় শেল্টার এলাকার এমপি। যে লোকটি এমপি হয়েছে সে আবার একটা কলেজের অধ্যাপক ছিল। তার কাছে যাওয়া হয়নি রনির। কেন যাবে? কোনো প্রয়োজন তো ছিল না। বাতাসে শোনা যায়, কুদ্দুসের টাকার কাছে এমপি লোকটা বশ্যতা শিকার করেছে। বলুন তো কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন? সিগারেটে টান দিয়ে জিজ্ঞেস করে সালাহউদ্দিন। সামনে বসে আছে রনি আর জহির। অফিসটা ঢাকা শহরের বুকের ওপর। সালাহউদ্দিনের হালকা-পাতলা গড়ন। মাথায় কালো চুল। ব্যাক ব্রাশ করে আঁচড়ানো। দোহারা গড়নের মানুষটি তাকিয়ে আছে রনির দিকে।

আমরা দুই ভাই। বাড়িতে থাকি না। বাড়িতে থাকে আমার মা আর ছোট বোন। আমাদের বাড়ি থেকে পশ্চিম দিকের একটা ছেলে হঠাৎ প্রচুর টাকার মালিক হয়েছে। উত্তরায় বাড়ি করেছে। গাড়িও কিনেছে— তার সঙ্গে আপনাদের ঝামেলা কী? একটা রাস্তার ঝামেলা। কী বললেন? জিজ্ঞেস করে সালাহউদ্দিন। রাস্তার ঝামেলা? সেইটা আবার কী? গাড়ি কিনেছে ঢাকায়, সমস্যা কেন গ্রামে? জালের সঙ্গে সুতোর যেমন সম্পর্ক, তেমন একটার সঙ্গে একটা জড়িয়ে আছে এই ঝামেলায়, উত্তর দেয় জহির। আপনি একটু শুনলে ঘটনাটা বুঝতে পরবেন। ঠিক আছে, বলুন।

কুদ্দুসের বাড়ি তো আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে। আবার আমাদের বাড়ির পূর্ব দিক দিয়ে গেছে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা। যে রাস্তা পাকা হয়েছে। ঢাকা থেকে সরাসরি গাড়ি চলাচল করে। বুঝতে পারে রনি, ডিআইজি কোনো আগ্রহ পাচ্ছে না। একটা বাড়ির দুই দিকে, পূর্ব-পশ্চিমের সঙ্গে ঢাকায় এক ব্যক্তির গাড়ি কেনার সর্ম্পক কী? তাকায় জাহিরের দিকে, তুই থাম। আমি বলি। জহির ঘাড় কাৎ করে, বলেন। ভাই, কুদ্দুসের বাড়ি যাবার পথ আমাদের বাড়ির একেবারে পেছন থেকে। এখন ও গাড়ি কিনেছে, ওর টাকা আছে, মানুষের কাছে ওর এক ধরনের সম্মান বেড়েছে। কুদ্দুস সেই সম্মানটাকে আরও বাড়াতে চায়, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা দিয়ে সরাসরি ওর বাড়ি গাড়িতে যাবে।

এতক্ষণে ডিআইজি সালাহউদ্দিনের মুখে এক ধরনের কোমলতা দেখা যায়, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ওটা তো কাঁচা রাস্তা। ছিল, এখন পাকা হচ্ছে। তাই বলেন, সোজা হয়ে বসে চেয়ারে ডিআইজি। আপনাদের জায়গা বেেঁধছে ওই রাস্তা পাকা করতে গিয়ে। জি। বেশি না কম জায়গা? বেশি বা কম— সেটা বড় কথা নয়। আমরা বাড়ি থাকি না। বাড়িতে থাকে মা আর বোন। আমরা সামাজিক মানুষ— গ্রামের মধ্যে একটা রাস্তা পাকা হচ্ছে, বিষয়টা আনন্দের। কারণ, পাকা হলে আমরাও সুন্দরভাবে বাড়ি পৌঁছাতে পারব। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে, আমাদের বাড়ির একেবারের সঙ্গের বাড়ির কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোকের সঙ্গে মিলে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা দখল করে রাস্তা বানাচ্ছে, থামে রনি।

আর সেই জায়গায় অনেক গাছ ছিল, বলে জহির। কপাল কুঁচকে যায় সালাহউদ্দিনের, অনেক গাছ? জি, আমি কিছুক্ষণ আগে কথা বলেছি ছোট বোনের সঙ্গে। বোন জানিয়েছে, আম, কাঁঠাল, বিলাতি গাব আর সুপারি গাছ, উত্তর দেয় রনি। কেবল গাছ কেটেই শেষ নয়, আমার মা-বোনকে অকথ্য গালিগালাচ করেছে। হুমকি দিয়েছে, আমরা বাড়ি গেলে আমাদের রাস্তায় বের হতে দেবে না। রাস্তা ওদের বাপের নাকি? ডিআইজির গলায় রাগ। এখন আপনারা কী করতে চান? আমরা বাড়ি যেতে চাই, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় জহির। মা একা আছে।

ঠিক আছে, আপনারা বাড়ি যাবেন, আমি ব্যবস্থা করছি, বলতে বলতে ডিআইজি ফোন তুলে বলেন, আমাকে এখনই পিরোজপুরের এসপিকে ধরিয়ে দাও। রিসিভার রেখে তাকান তিনি, আমি বলে দিচ্ছি এসপিকে। এসপি বলে দেবে থানার ওসিকে। আপনাদের থানার নাম কী? উজানগাঁও, দ্রুত জবাব দেয় জহির। বলতে বলতে ফোন বাজে। রিসিভার কানে নেন সালাহউদ্দিন, পিরোজপুরের এসপি বলছেন? শোনেন, আমার খুব পরিচিত একজন মানুষ, নাম রনি রায়হান। আপনার থানা উজানগাঁওয়ে বাড়ি। ওনারা দুই ভাই থাকে ঢাকায়। এক লোক, যাকে আবার লোকাল এমপি শেল্টার দেয়, তার নাম কুদ্দুস। কুদ্দুস ওনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে রাস্তা পাকা করাচ্ছে। রাস্তা পাকা করাচ্ছে সেটা কোনো সমস্যা না, সমস্যা জোর করে রনিদের অনেকগুলো গাছ কেটে ফেলেছে। মা-বোনকে গালিগালাচ করেছে। আবার রনি রায়হানদের বাড়ি যেতেও হুমকি দিচ্ছে। বলছে, বাড়ি গেলে খবর আছে। আমার এই পরিচতি মানুষ আগামী কাল বাড়ি যাবে, আপনি ওসিকে বলে দেবেন, যাতে কোনো সমস্যা না হয়। প্রয়োজন হলে টহল পুলিশের ব্যবস্থা করবেন।
কী বললেন? বাড়ি যাবার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করবে? ঠিক আছে, আমি বলে দিচ্ছি। ওনারা বাড়ি যেদিনই যাবে, আগে আপনার সঙ্গে পিরোজপুরে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করবে। ওকে। ডিআইজি সালাহউদ্দিন একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে নিজে নাম লিখে রনির হাতে দেন, এসপিকে এটা দেবেন। আর কী হয় মোবাইলে আমাকে জানাবেন। তবে বেশি কিছু করতে পারবে না। এক কাজ করবেন। কী কাজ? এমপির সঙ্গে দেখা করে আলাপ করেন।

ভাইয়া, আপনার প্রস্তাবটা আমি ভেবেছি। তাকে তো আমরাই ভোট দিয়েছি। আমার ধারণা ছিল, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সব এমপি খারাপ না। তার ওপর একটা কলেজে যখন পড়িয়েছেন। কিন্তু মানুষটা তেল আর জল মিলিয়ে খাচ্ছেন একেবারে কুমিরের মতো, বলে রনি। কী রকম? প্রশ্ন করেন ডিআইজি। আমি ধর্মে নই, মানুষে বিশ্বাসী। মানুষ মানুষের জন্য। একটা লোকের টাকা হতেই পারে, টাকা দিয়ে বাড়ি করতে পারে, রাস্তা করতে পারে, সমস্যা নেই। কিন্তু সেই টাকার কারণে যখন নিরীহ সাধারণ মানুষ অকারণে ক্ষতিগ্রসত্ম হয়, তখন খারাপ লাগে। এই কুদ্দুসকে আমার শৈশবে দেখেছি কালো কুচকুচে একটি শরীরের ছোট্ট ছেলে। ওর বাবা আমাদের বাড়ির কাছে নদীতে ছোট্ট একটা নৌকায় মাছ কিনে আনত। সেই মাছ বাজারে বাজারে বিক্রি করে কোনোভাবে দিন চলত। সেই ছেলের টাকার গরমে যখন একজন নির্বাচিত শিক্ষিত এমপি নাচে, তার কাছে যাওয়ার আর রুচি থাকে না।

আপনি ঠিকই বলেছেন রনি, আমরা টাকার কাছে বিকিয়ে গেছি, আপন মনে মন্তব্য করেন সালাহউদ্দিন। রুমে ঢোকে আর্দালি ওবায়েদ, স্যার, বাসায় যাবেন না? সাড়ে পাঁচটা বাজে। হ্যাঁ, যাব। গাড়ি লাগাতে বলো। দাঁড়ায় জহির আর রনি। হাত বাড়ায় রনি, দুপুরে বাড়ি থেকে ফোন আসার পর নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল, ভাই। আপনার ভরসায় মনে বড় স্বস্তি পেলাম। ভালো থাকবেন, চলি। আসুন। রনি আর জহির বের হয়ে আসে বাইরে।
পরের দিন লঞ্চে ওঠে দুই ভাই, রনি আর জহির। সময়টা আশ্বিন মাস। নদী শান্ত। বাসযাত্রা ভালো লাগে না রনির। একটা সিটে গুদামের মালের মতো বসে থাকতে হয়। লঞ্চে অনেক জায়গা। েঁহটে বেড়ানো যায়। ছাদে দাঁড়িয়ে আদিগন্ত্ম নদী, নদীর পার, পারের মানুষ, মানুষের বিচিত্র জীবনযাত্রা দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। জহির চেয়েছিল বাসে যেতে। রনি বলে, নারে, অনেক দিন নদীপথে বাড়ি যাই না। তাছাড়া সময়টাও অনুকূলে। লঞ্চেই যাই। ঠিক আছে, চলেন। জহির ক্যাবিন ভাড়া করেছে। সদরঘাটে এসে রনির মনটা খুব খারাপ হলো। অনেক দিন পর সদরঘাটে এসেছে। এই সদরঘাট দিয়ে আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে ঢাকায় ঢুকেছিল। তখনও সদরঘাটে এত মানুষ ছিল না। সদরঘাটের পানি থেকে নৃশংস দুগন্ধ আসত না। স্বচ্ছ, টলটলে পানি ছিল। এখন গন্ধে নাক রাখা দায়। মনে আছে, কয়েক বছর আগে নৌ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী অনেক ঘটা করে নদীর তলের বর্জ্য অপসারণের কাজ উদ্বোধন করেছিলেন। একটা বিশাল জাহাজের ওপর ক্রেন, ক্রেন নদীর তলদেশে চলে যায়, মুখে করে নিয়ে আসে প্রচুর পলিথিন, বোতল আর ময়লার কাঁড়ি। টিভির পর্দায় দেখানো হলো মন্ত্রীর কাজ। মাইক্রোফোনে মন্ত্রী বলছেন, নদীর তলদেশ থেকে সব ময়লা আর পলিথিন তুলে ফেলা হবে। ফলে বুড়িগঙ্গার পানি দূষণমুক্ত হয়ে আগের মতো পরিষ্কার হবে। মানুষ খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু পরের দিন থেকে সেই ক্রেন আর নদীর তলদেশ থেকে পলিথিন আর বর্জ্য তুলতে আসেনি। কিন্তু এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ বাজেটের টাকার কী হয়েছিল কেউ জানে না। যত দূর মনে পড়ে এই প্রকল্পের বাজেট ছিল প্রায় দুশো কোটি টাকা। কেউ জানে না একেবারে ঠিক নয়, মাননীয় মন্ত্রী, মাননীয় সচিব নিশ্চয়ই জানেন। কিন্তু কে যাবে জিজ্ঞেস করতে? কার ঘাড়ে কয়টা মাথা?

মন খারাপ নিয়ে রনি লঞ্চে ওঠে। কিন্তু কেবিন ভাড়া করেছে দেখে মনটা আবার খারাপ হলো। জহিরকে জিজ্ঞেস করে, তুই কেবিন ভাড়া করেছিস কেন? বাড়ি গেলে আমি তো কেবিনেই যাই। আমার ফুটানি ভালো লাগে না। মেঝেতে ঢালা বিছানায় অনেক মানুষের সঙ্গে মিশে, হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে কিংবা ঘুমিয়ে যেতে পারলে ভালো লাগত। সামনে মুখ নিচু করে তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকে জহির। দেখে মায়া লাগে, জহির ভেবেছিল বড় ভাইয়ের সঙ্গে যাচ্ছে। ভাইকে একুট আরামে এবং মর্য়াদার সঙ্গে নিতে চায়। কাঁধে হাত দেয়, চল, ভেতরে চল। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। সবাই গ্রামে যাওয়ার জন্য উন্মুখ। কেবিনে ঢুকে ব্যাগটা রেখে বাইরে এসে লঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ায় রনি। বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধ কিছুটা হলেও সয়ে এসেছে। সুকানি বার বার হর্ন বাজাচ্ছে। রনি তাকয় মোবাইলের দিকে। সময় বিকেল ছটা। লঞ্চ এখনই ছাড়বে। রনিরা যে লঞ্চে যাচ্ছে সেই লঞ্চের নাম সৈকত। সৈকত লঞ্চ ঘিরে আরও অনেকগুলো লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরই লঞ্চটা ছেড়ে দেয়। রনি ঘুরে ভেতরে ঢোকে লঞ্চের। লোকে টইটম্বুর সৈকত। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে ওঠে রনি। দাঁড়ায় রেলিং ঘেঁষে। আহ, কী অপার্থিব সৌন্দর্য রাশি দুই তীরে! দেখে ফুরায় না, বিকেলের সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। আকাশের গায় লাল লালিমা। দুচোখে দেখার বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকে রনি, দুধারের পানি কেটে কেটে চলতে থাকে সৈকত।
উজানগাঁও থানা। রাত সাড়ে নটা। ওসি খাদেম বসে আছে চেয়ারে। তার সামনে কুদ্দুস বসা ভাঙ্গা ফুটের মতো। খাদেম একের পর এক সিগারেট টানছে। ধোঁয়া উড়ে উড়ে কুদ্দুসের মুখের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ভ্রুক্ষেপ করছে না খাদেম। পুলিশের দীর্ঘদিনের চাকরির অভিজ্ঞতায় জানে, সামনে বসা এইসব লোকেরা দুই দিনের বৈরাগী। ক্ষমতার পালাবদলে এরা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কুদ্দুসের পেছনে দাঁড়িয়ে ঘামছে সাদেক আর রফিক। ওদের মুখ থমথমে। খাদেম সিগারেটে শেষ টান দিয়ে অবশিষ্টাংশ ফেলে তাকায় কুদ্দুসের দিকে, কী বলবেন, বলেন। রাত হয়েছে। বাসায় যেতে হবে। বুঝলেন না মিসেস ওসি বসে আছে। দেরি করে গেলে আমাকে উল্টো প্যাদানি দেবে। খাদেমের কথায় সবাই টুকটুক হাসে। পরিবেশটা গম্ভীর থেকে একটু হালকা হয়। কুদ্দুস তাকায় পেছনে দাঁড়ানো তার বরকন্দজের দিকে। ওদের মুখ আবার ভাবলেশহীন।

কই বলেন, কী বলবেন, তাড়া দেয় খাদেম হোসেন। ওই দুই ভাই তো কাইল দেশে আইতেছে, মিনমিন করে বলে কুদ্দুস। হাসে খাদেম, ওই দুই ভাই কি বিদেশ থেকে আসছে? নাকি সোনালু গ্রামে, মানে আপনাদের গ্রামে জন্মে নাই? মাথা নাড়ায়, হ্যাঁ, জন্মাইছে। তাহলে? ওরা ওদের গ্রামে আসবে। আমার কী করার আছে? এমপি সাব আপনাকে ফোন দেয় নাই?

এমপির কাজ ফোন দেওয়া। দিয়েছে, আমিও তার সঙ্গে কথা বলেছি। এখন আপনি বলেন মি. কুদ্দুস, আপনার জন্য কী করতে পারি? ওদের গ্রেফতার করেন। ওরা কি চোর? কোন কারণে গ্রেফতার করব? আপনি আপনার রাস্তা সোজা করার জন্য রনি আর জহিরের পুকুরের পার দিয়ে রাস্তা পাকা করে নিয়েছেন। পথে বাধল খাল, আপনি একটু অন্যদিক দিয়ে গেলে ওই দুই ভাইয়ের বাগানের গাছগুলো কচুকাটার মতো কাটার দরকার ছিল না। কিন্তু দলের লোকজন নিয়ে গাছগুলো তো কাটলেনই, ওদের নিরীহ নিরাপদ মা আর বোনকে গালিগালাচ করলেন। সব অন্যায় করলেন আপনারা আবার গ্রেফতারও করতে বলবেন, কিভাবে সম্ভব?

কুদ্দুস ভোঁদড়ের স্বভাবে এদিক-ওদিক তাকায়। মনে মনে বলে, লোকটাকে এত টাকা দিলাম, আর এখন কিনা বলে..। এমপি সাহেব তো মাইন্ড করবেন। আমি কি আপনার এমপির চাকরি করি? আইজ আপনের কী অইছে? আপনে তো বড়জোর দেড় বছর। তারপর তো নির্বাচন, বলেন সেই নির্বাচনের পর আপনারা আবার ক্ষমতায় আসবেন? বলেন, আসবেন? জানি সেই কাজ আপনারা করেননি। করছেনও না। ছিলেন তো মাছুয়ার পোলা. শুনছি তো আপনের হিস্টোরি, একবেলা খাইতেন তিনবেলা না খাইয়া কাটাইতেন। হঠাৎ কিছু টাকার মালিক হয়ে মানুষকে আর মানুষ মনে হচ্ছে না? এমপি পর্যন্ত কিনে ফেলছেন। অবশ্য এমপি তো আজকাল কেনাবেচার জিনিসই। কাঁচামাল বাজারে বিক্রি হয় কেজিতে, এরা হয় লাখ টাকায় কিংবা কোটিতে।

কুদ্দুসের মনে হচ্ছে থানার ভেতর থেকে দৌড়ে পালায়। কিন্তু কিভাবে পালাবে? বরং তার পাছা চেয়ারের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। আর ব্যাটা আমার এত খবর জানল কেমনে? আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগাইছে নাকি? শুনছি টাকা-পয়সা হলে পেছনে গোয়েন্দা লাগে। আর সঙ্গের দুইখান দাঁতাল ভোঁদাই দাঁড়িয়েই আছে। আরে তোরা বাইরে যা, তোদের বসরে ওসি সাব সাবান দিয়ে কচলাচ্ছে আর তোরা দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? আমি যাই? দাঁড়ায় কুদ্দুস। যান। বসে বসে আর একটা সিগারেট ধরায় খাদেম হোসেন। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, কুদ্দুস মিয়া, মানুষের পাছায় আঙ্গুল দেয়া বন্ধ করেন। আর শোনেন আসল মোজেজা, আমার একজন বস, ডিআইজি ঢাকা থেকে ফোন দিয়েছে। বলেছে, রনি আর জহির দুই ভাই ভালো মানুষ। আমিও জানি ওরা ভালো মানুষ। আপনাদের সোনালু গ্রামের সবাই এক বাক্যে বলেছে ওরা ভালো। দুই ভাই শিক্ষিত। আপনারা থাকবেন দেড় বছর আর ঢাকায় আমার যে স্যার সে থাকবে আরও দশ বছর। পরে উনি আমাকে প্যাদানি দেবেন, তখন আপনাকে পাওয়া যাবে? আপনি তো তখন ধোঁয়া সাবানের ফেনার মতো উড়ে যাবেন। আর আপনার জনাব এমপি সাহেব? তাকেও পাওয়া যাবে না। আমার ব্যবহার দেখে অবাক হয়েছেন, হওয়ারই কথা। এখন আসুন।
ওরা তিনজনে দ্রুত দরজার দিকে এগোতে থাকে। ওসি খাদেম আবার ডাকে, শুনুন। ওরা তিনজনে ফিরে এসে ওসির সামনে দাঁড়ায়, রনি আর জহিরের গায়ে যদি একটা ফুলের টোকাও পড়ে, আপনাদের কিন্তু খবর আছে। যান এখন। কুদ্দুস আর ওর সঙ্গীরা তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো উজানগাঁও থানা থেকে বের হয়ে রাস্তার ওপর দাঁড়ায়। গোটা ঘটনা এমন উল্টে গেল, ওরা কল্পনাও করেনি। গাড়ির ড্রাইভার থানার পেছনে গাড়ি পার্ক করে ঘুমাচ্ছে। গাঁওগেরামে গাড়ি নিয়ে ঘোরে কুদ্দুস। তাকে মোবাইল করলে মিনিট তিনেকের মধ্যে গাড়ি নিয়ে হাজির ড্রাইভার। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে কুদ্দুস। পেছনের সিটে বসে সাদেক আর রফিক। দুই চাচাতো ভাই। গাড়ি চলতে শুরু করেছে।

বস! সাদেক ভরাট গলায় যখন ডাকে, তখন খুব ভালো লাগে কুদ্দুসের। ঢাকায় তো কেউ এমন ভক্তির সঙ্গে বস ডাকে না। কী? সামনে তাকিয়ে প্রশ্ন করে কুদ্দুস। এত দিন যে আমরা ওসিরে এত মাছ-মাংস খাওয়াইলাম, আপনে টাকা-পয়সা দিলেন, ওনার বৌরে পাকিস্তানি শাড়ি দিলেন, সবই ফাও গেল? ফাও যাইবে ক্যান? আমি সব কচলাইয়া বার করুম না? আমারে তো চেনে নাই! দুই-এক দিনের মইধ্যে ঢাকা যামু। মিনিস্টারের লগে দেহা করমু। তহন ওরে বুঝাইয়া দিমু— হাতে তালি বাজায় সাদেক, বস,আপনে কিন্ত উজানগাঁও থিকা ওসি ব্যাডারে ট্রান্সফার কইরা হিলট্যাকে পাঠাইবেন। তাইলে ব্যাটা বোজবে, আমাগো হাতে কত পাওয়ার।

সবই তো অইলো, কথা বলে রফিক, রনি আর জহিরের কী অইবে? হগো তো কিছু করতে পারমু না। কইলেই অইলো? ফোঁস করে ওঠে সাদেক, ওসি সাব হের কথা কইচে, আমরা আমাগো কাম করুম। রাস্তা না দিলে রাস্তায় হাঁটবে ক্যান? রাস্তায় হাঁটতে দিমু না। ওগো রাস্তায় দেখলে পিটাইয়া ঠ্যাং ভাইঙ্গা হালামু। ওসি সাব কী কইছে, হোনো নাই? ওগো গায়ে ফুলের টোকা পড়লেও খবর আছে, পুলিশের লগে বাড়াবাড়ি করা ঠিক অইবে না। কইলেই অইলো? অগো কিচু না কইলে আমাগো ইজ্জত থাহে? গেরামে মাইনষের কাছে মুখ দেহামু কেমনে? সাদেকের চোখেমুখে ক্রোধ।

তোরে একটা কথা জিগাই রফিক। আমি কতা কইলে তো আবার খারাপ অইয়া যায়। হাচা কইরা ক তো, রনি আর জহিরের দোষটা কী? অত কতায় কাম নাই, মাঝখান থেকে ঢোকে কুদ্দুস। ওরা গ্রামে আসতেছে আসুক। অগো কিছু কওয়ার দরকার নাই। আমি ঢাকা যাইয়া ওসিরে ট্র্রান্সফার করার ব্যবস্থা করি আগে, তারপর দেখা যাইবে। আমিও হেই কতা কই, সমর্থন করে সাদেক। কিন্তু গাড়িতে মন খারাপ করে বসে থাকে রফিক। ঢাকা থেকে আসতেছে রনি আর জহির। ওদের দুই ভাইকে মারপিটের ব্যবস্থা করতে পারলে কুদ্দুসের কাছ থেকে কিছু টাকা খসানো যেত। হাতে একদম টাকা-পযসা নেই। বাড়ি থেকে দুপুরে বের হওয়ার সমায় বৌ বলেছে, ঘরে চাইল-ডাইল নাই। একদম নাই? যা আছে হেতে টাইনা-টুইনা একদিন যাইতে পারে। গাড়ি চলছে সামনে। কিন্তু রফিকের মাথার মধ্যে চলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তা।
দুপুরের হালকা রোদে হাঁটছে রনি আর জহির। রনির হাতে সাইডব্যাগ। জহিরের হাতে বড় বড় দুটি ব্যাগ। মা, শিমুলের জন্য কাপড়, থ্রিপিস, হরলিক্স, আরও অনেক কিছু। বছর খানেক আগেও এই রাস্তাটা কাঁচা ছিল। এখন পাকা হয়েছে। ইটের ওপর পলেস্তারা দেয়া হয়েছে। হাঁটতে ভালো লাগছে। এই রাস্তা দিয়ে কত দিন সোনালু বাজার গেছে রনি। বাড়ির কলা সুপারি কাঁঠাল ডিম বিক্রি করেছে। বিক্রি করে মায়ের দেয়া ফর্দ অনুসারে বাজার করেছে। জিলাপি খেয়েছে। রাস্তার পাশ দিয়ে খাল বয়ে গেছে। কাঁচারাস্তা পাকা হচ্ছে হোক, কিন্তু আমাদের ওপর বিপদ কেন? আমরা কী করেছি? মনে মনে ভাবে আর হাঁটে রনি। আপনি কী চিন্তা করতেছেন? জিজ্ঞেস করে জহির।

আমি? আমি চিন্তা করছি এই পথে কত হেঁটেছি, কত মার্বেল খেলেছি, তখন ছিল কাঁচা রাস্তা, সেই সময়ে কেউ কি ভেবেছে এই অজপাড়াগাঁয়ের রাস্তাও একদিন পাকা হবে? এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলবে? সবই হচ্ছে স্বাধীনতার কারণে। দেশটি স্বাধীন না হলে এত উন্নয়ন, এত আয়োজন কোনো দিন সম্ভব ছিল না। রনির কথায় উষ্মা প্রকাশ করে জহির, স্বাধীনতা ম্বাধীনতা করেন, আমাগো মতো গরিব মানুষের কী লাভ অইছে? লাভ অইছে টাকাঅলাদের। ওগো এক টাকা একশো টাহা অইছে। তোর প্রতিক্রিয়াটা হলো একেবারে ব্যক্তির জায়গা থেকে। কিন্তু এই যে এখন আমরা পাকা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, ভালো লাগছে না? এটাই সামষ্টিক স্বাধীনতার ফসল।

আপনে যে কি না, মাথামু্লু কিছুই বুঝি না। রাস্তা পাকা হওয়ার জন্য আমাদের ওপর দিয়ে যাচ্ছে ঝড়ঝাপটা, খুন হবার জোগাড়, আপনি দেখতেছেন স্বাধীনতার সুফল…রাগে ব্যাগ দুটো নিয়ে সামনে সামনে হাঁটতে থাকে জহির। হাসে রনি, আরে গাধা, এই কাঁচারাস্তা পাকা হওয়া তো কোনো অন্যায় বা অপরাধ নয়, যারা বানিয়েছে বা এই রাস্তার পেছনে আছে সেই মানুষগুলো অপরাধী। আমাদের লড়াই হচ্ছে ওদের বিরুদ্ধে। জহির কোনো কথা বলে না। ঘাড় গুঁজে হাঁটতে থাকে। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা হরমুচের সঙ্গে, আরে বাজান, তোমরা আইচো? আমি তো কই তোমরা আও না ক্যান? তোমার মায়রে আর বুইনেরে যা কইছে সাদেক, রফিক, হ্যাঁ মোহে আনা যায় না। তোমাগো জাগার গাছ কাটতেছে আবার তোমাগো গালিগালাচ করতেছে। এইয়া কি আলুায় সইবে? কি মামলা-টামলা করেছা?

হরমুচকে দেখে দুজন দাঁড়ায়। না চাচা, মামলা করার আগে সব একটু দেখতে হবে না? আগে দেখি, জবাব দেয় রনি। হ হেইটও ঠিক কইচো। এই আইলা? হ চচা। চাচি কেমন আছে? আছে আরকি। বোজো না, গেরামে কোনো কাম আছে? একজন আরেকজনের পিছনে হাপের নাহান লাইগা থাহে, আইচো গেরামে, থাহো দুই দিন। সব দেখবা। চাচা, বাড়িতে আইসেন। আসমুনে বাজান, হন হন করে চলে যায় হরমুজ।

বাড়ির কাছাকাছি আসার পথে দেখা সাদেকের মায়ের সঙ্গে। অনেক বয়স্ক মানুষ। শুকিয়ে আমসি। পরনে আধময়লা একটা শাড়ি। সাদেকের মাকে চাচি ডাকে রনি আর জহির। চোখে একটু কম দেখে। ওদের দেখে রাস্তার পাশে সরে দাঁড়ায় সে। রনি হাসে, এগিয়ে সামনে দাঁড়ায়, চাচি, আমারে চেনেন নাই? আমি রনি। তুমি রনি! খপ করে হাত ধরে, বাজান, পোলারা আমার কতা হোনে না। আমি কত কইছি, রনি আর জহিরের লগে এক লগে বড় অইচো, ওর বাপ বাঁইচা থাহনেরা সাময়ে কত খাইচো, ওরা এতিম, অগো লগে খালি খালি ঝামেলা করিস না। বাবা, ওরা আমার কতা হোনে না। আমি জানি চাচি। আপনে আমাদের বাড়ি আইসেন। এহন যাই।
তোমাগো বাড়ি কেমনে যাই? তোমার মার সামনে যাওয়ার মুখ কি আমার আছে? আমি তোমাগো বাড়ি ঘুইরা যাই, তোমাগো বাড়ির ভেতর হান্দি না। যদি তোমাগো মায়ের সামনে পড়ি, তোমার মায়ে জিগায়, আপনের পোলারা এমন করল ক্যান, কী জবাব দিমু? শোনেন চাচি, সাদের রফিক কী করছে, সেটা ওদের ব্যাপার। কিন্তু আপনি আমাদের চাচি। আপনি আগের মতোই আমাদের বাড়ি আসবেন। চাচির চোখে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি, আসব বাবা, আসব।

চাচির সঙ্গে রনির কথাবার্তা হয়তো শুনে থাকবে, মা আর শিমুল বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে রেখে শিমুল দৌড়ে এসে জহিরের হাত থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে থাকে। আশপাশের বাড়ি থেকেও নারী পুরুষ শিশুরা জমা হয়েছে ওদের ঘিরে। বাড়িতে ঢোকে সবাইকে নিয়ে। শিমুলের ব্যসততা বেড়ে গেছে। ঘরের ভেতর থেকে চেয়ার এনে সবাইকে বসতে দিচ্ছে। তোরা কখন খাইছো? উঠোনে চেয়ারে বসে রনি, রাতে খেয়েছি, মা। শিমুল, ব্যাগের ভেতর থেকে লুঙ্গি আর গামছা দে, গোসল করব। জহির ঘরের ভেতরে ঢুকেছে। জামাকাপড় চেঞ্জ করছে। রনির পাশে দাঁড়ানো সুফিয়ার মা, বংশ সম্পর্কীয় ভাইয়ের বৌ, মুখরা রমণী হিসেবে তার একটা পরিচিতি আছে। গলা বাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ওগো কইলো এইবার শায়েস্তা করতে অইবে তোমার। তোমার আসার ভরসায় আমরা চাইয়া রইচি।

হাসে রনি, দেখা যাক কী করতে পারি। শিমুল লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে আসে, এই নেন। কথা পরে কইবেন, ভাইজান, আগে গোসলটা সাইরা আসেন। জহির কই? হের কতা কইয়েন না। ঘরের ভেতরে হে পান্তা ভাত খাইতেছে। গোসল না করেই খেতে বসল?

শিমুল আর সুফিয়ার মা হাসে। রনি গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে খালপারের দিকে যায়। বাড়িটার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আলতাফরা বড় একটা ঘর তুলেছে পশ্চিমের পোতায়। খালপারের সামান্য উত্তরে ওরা গাছ কেটেছে। ধীরে ধীরে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় রনি। বলশালী আর তরুণ গাছগুলোকে কেটে ফেলে রেখেছে। মনে হচ্ছে গাছগুলো কাঁদছে। এমন করে মানুষ মানুষের গাছ কাটে? না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। রনির বুকটা হুহু করে ওঠে। কোনো ঝগড়া না, টাকা-পয়সা নিয়ে লেনদেন না, তার পরও কেন ওরা এমন করে গাছগুলো কাটল? খালের ওপারের মজিদ ভাই রনিকে দেখে দাঁড়ায়, বাড়ি আইচো ক্যা? কেয়ামত দেকতে আইচো? চাইর দিকে কেয়ামত আইচে। নাইলে এই গাছগুলা মানুষ অইয়া কাটতে পারে? কী করমু ভাই, আমগো গায়ে শক্তি নাই। দূরে খাড়াইয়া দেখছি, ডাকাইতের নাহান গাছগুলা কাটছে। মনে হইছে গাছ কাটতেছে না হেরা, হেরা জোমাত খাইতেছে। মজিদের গলা অনেক বড়। কথা অনেক দূর থেকে শোনা যায়। উঠোনের লোকগুলো আবার জড়ো হয়েছে গাছ কাটার জায়গায়। খালের ওপারের আরও মানুষ এসেছে। রনি বুঝতে পারে, এই মানুষগুলো ওর পক্ষের, অথবা ন্যায়ের পক্ষে। তাকায় সামনে, রাস্তার ওপারে সাদেক, রফিক আর সফিক ওদের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। শুনছে এবং দেখছে মানুষের প্রতিক্রিয়া। মনে মনে ওরা ভয় পেয়েছে, প্রথম ভয় পেয়েছে গত রাতে থানার ওসির কথায়। এখন যুক্ত হয়েছে এলাকার মানুষ।

বিকেলের মধ্যে এলাকার লোকদের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে রনি আর জহির। জহির চটাং চটাং কথা বললেও রনি খুব ধীরেসুস্থে মানুষের মনের পালস বোঝার চেষ্টা করছে। কোনোভাবেই মামলার দিকে যাবে না। নিজের পকেটের পয়সা উকিল-মহুরি পুলিশের পকেটে ফেলবে না। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ মানুষের অভিমত মামলা করার। কেউ কেউ সদ্ভাবেই চাইছে একটা মামলায় জড়িয়ে গ্রামেরই এই উঠতি দুষ্টচক্রের বিনাশ। কিন্ত অনেকে চাইছে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে। গ্রামে একটা মামলা হলে দুই পক্ষের কাছ থেকে চা সিগারেটসহ আরও কিছু সুবিধা আদায় করা যাবে। ঠিক এই সুবািধা লোটার সুযোগটা দিতে চাচ্ছে না রনি। সন্ধ্যার একটু পরে খালের ওপারের ইসমাইল আসে, কেমন আছো ভাই? ভালো, আপনি কেমন আছেন?

ভালো তো থাকতে চাই, কিন্তু কেমনে থাকমু? কেন? কী হয়েছে? আমার কী অইছে তোমারে পরে কমুনে। হুনলাম তুমি নাহি মামলা করবা? আমারেও তোমার লগে নেও। আমি তো মামলা করি নাই জীবনে। মজা পচ্ছে রনি, আপনি কার বিরুদ্ধে মামলা করবেন? আকাশে অর্ধেক চাঁদ। হালকা আলোয় চারপাশটা মোহনীয়। উঠোনের ওপর ঝুঁকে পড়েছে আমগাছের ডালাপালা। আমগাছের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল দুটো নারকেল গাছ। হালকা বাতাসে নারকেল গাছের চিরল চিরল পাতারা দুলছে হালকা বায়ে।

ইসমাইল কানের মুখ আনে, কুদ্দুসের বিরুদ্ধে। সে কি করেছে আপনার? হে কি করেছে? হোনো, নতুন এই রাস্তাটা তোমাগো বাড়ির খাল পর অইয়া গেছে আমাগো বাড়ির পাশ দিয়া। আমাগো জমিজমা কতো কম। আমি তো আমাগো জাগার ওপর দিয়া রাস্তা দিমু না। এলাকার হক্কলরে জিগাইয়া দেখতে পারো, আমি সবাইরে কইচি। শেষে কী করলেন?
শেষে একদিন আমার বাড়ি আইলো কুদ্দুস, হের চেলা তোমাগো সাদেক, রফিক, শফিক মিয়ারা। আমার আত ধইরা কুদ্দুস কইলো, ইসমাইল ভাই, আপনে জানেন আমি কত কষ্ট কইরা, মন্ত্রী মিনিস্টার ধইরা আমাগো এমপির লগে যোগাযোগ কইরা এই রাস্তা পাশ করাইচি। এহন যদি রাস্তা যাইতে না দেন, বিষয়ডা কি ভালো দেখায়? আপনার বাড়ির সামনের রাস্তা পাকা, আপনের ভালো লাগবে না? পোলা-মাইয়া বিয়া দেওয়ার সমায় এই রাস্তা আপনার খুব কাজে লাগবে। কতা কইতে আমারে আরও কইলো, আপনে আর ঝামেলা কইরেন না, আমি আপনেরে দশ হাজার টাকা দিমু। এই নেন নগদ দুই হাজার টাহা। কইয়া আমার হাতে নগদ দুই হাজার টাহা দিলো। আমার টানাটানির হাত। এক লগে দুই হাজার টাহা আতে পাইয়া খুশি অইলাম। রাস্তা অইয়া গেল দুই দিনের মইধ্যে। এহন আমি টাহা চাইলে কয়, কিয়ের টাহা? রনি দেখে গ্রামে একটা কাঁচারাস্তা পাকা করতে গেলে কত সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়, সেটা না জেনেই টাকার গরমে কাজে নেমে পড়েছে সে। ইসমাইলকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে একটা ডাক শুনতে পায়, রনি!

কে? সামনে এসে দাঁড়ায় রফিক, আমি রফিক। কী খবর? হাত ধরে রফিক, আমি জানি তুমি আমার নামে অনেক কিছু হুনচো। বিশ্বাস করো, আমি তোমার বিরুদ্ধে কিছু করি নাই। আসলে আমারে কুদ্দুস কিইন্না হালাইচে। অর জন্য কাম করি, বদনাম অয়। কিন্তু উপায় না পাইয়া কুদ্দুসের পিছে নামি। ওর কাম করি। জানো, আমার ঘরে আইজ রান্দন অয় নাই। আমার ছোট ছোট তিনডা মাইয়া-পোলা, আমি অগো বাপ। পোলা-মাইয়ার না খাওয়া মুহের দিকে চাইতে পারি না। ঠিক আছে, পকেটে পাঁচশো টাকার একটা নোট ছিল। রফিকের হাতে দিয়ে বলে, যাও, চাল কিনে ঘরে যাও। কাল সকালে এসো। টাকাটা পেয়ে প্রায় পায়ের ওপর পড়ে যায় রফিক, আমি তোমার লগে আছি। আমি আর কুদ্দুসের লগে কাম করুম না। আর সকালে আইয়া চাচির পাও ধরমু। পেছনে কখন এসে মা দাঁড়িয়েছে, ওরা জানে না। কেডা? রফিক? তুই কোন মুহে আমার পোলার কাছে আইলি? তোর কি কোনো লাজ-শরম নাই? মায়ের কাছে এগিয়ে যায় রনি, মা, থামুন তো। রফিক, তুমি চলে যাও। রফিক দ্রুত মাথা নিচু করে চলে যায়। মায়ের গলা পেয়ে জহির আর শিমুল আসে। জহিরের প্রশ্ন, কে আইছিলো? কেউ না। মা, খিদে লেগেছে, ভেতরে চলেন। সবাই ভেতরে যায়, কিন্তু রনির করোটির ভেতরে খেলা করে একটি চিত্রকল্প, গ্রামের একটি কাঁচারাস্তা পাকা করতে হলে কত রকমরে ঘটনা বা গল্পের সৃষ্টি হতে পারে! —–মনি হায়দার

অপেক্ষা

মহেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *